সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’ গল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র মুখার্জি, এ-গল্পের সব চরিত্রই অল্প বিস্তর শ্রেণি প্রতিনিধিত্ব করেছে। মুখার্জি চরিত্রটিও তার ব্যতিক্রম নয়, ফসিল গল্পে মুখার্জির পরিচয় দিয়ে গল্পকার লিখেছেন— “অঞ্জনগড়ের এই উদ্বিগ্ন অদৃষ্টের সন্ধিক্ষণে দরবারের ল-এজেন্ট পদে নিযুক্ত হয়ে এল একজন ইংরেজি আইননবিশ উপদেষ্টা। আমাদের মুখার্জিই এল এজেন্ট হয়ে। মুখার্জির চওড়া বুক—যেমন পোলো ম্যাচে তেমনি স্টেটের কাজে অচিরে মহারাজের বড়ো সহায় হয়ে দাঁড়ালো। ক্রমে মুখার্জি হয়ে গেল ডি-ফ্যাক্টো সচিবোত্তম, আর সচিবোত্তম রইলেন শুধু সই করতে।”
গল্পকারের বর্ণনা থেকে জানা গেল—(ক) অঞ্জনগড়ের দুদিনে মুখার্জি ল-এজেন্টের দায়িত্ব পায়। (খ) মুখার্জি মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি। লেখক ‘আমাদের মুখার্জি কথাটি ব্যবহার করে তার মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রতিনিধিকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। (গ) মুখার্জি কর্মক্ষেত্রে একেবারে শুরু থেকেই কর্তব্য, নিষ্ঠা ও শ্রমের মাধ্যমে খুব দ্রুত প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে এবং মহারাজের বড়ো সহায় হয়ে উঠেছে। ফলত সে-ই হয়ে উঠেছে ডি-ফ্যাক্টো সচিবোত্তম।
মুখার্জি আদর্শবাদী যুবক। তার এই আদর্শবাদ তার শিক্ষা ও মধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। মুখার্জি কেবল আদর্শবাদীই নয় সুশিক্ষার কারণে সে সচেতন, শান্তবুদ্ধি, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট স্বপ্নপ্রবণ। লেখকের ভাষায়—“ছেলেবেলায় ইতিহাস-পড়া ডিমোক্রেসীর স্বপ্নটা আজো তার চিন্তার পাকে পাকে জড়িয়ে আছে। বয়সে অপ্রবীণ হলেও সে অত্যন্ত শান্তবুদ্ধি। সে বিশ্বাস করে,—যে সৎসাহসী সে কখনো পরাজিত হয় না, যে কল্যাণকৃৎ তার কখনো দুর্গতি হতে পারে না।”
কাজে নিযুক্ত হয়েই মুখার্জি, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে স্টেটের উন্নতিতে আত্মনিয়োগ করেছে। আদর্শবাদী মধ্যবিত্ত যুবক হিসেবে দেশের নিপীড়িত জনসাধারণের সঙ্গে মুখার্জি আত্মিক টান অনুভব করে। আদর্শবাদী মধ্যবিত্ত মুখার্জি নিপড়িত মানুষগুলির কথা না ভেবে পারে না। মহারাজা তথা সামন্ততন্ত্রের পুষ্টি সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সে প্রজাদের মঙ্গলকেও উপযুক্ত গুরুত্ব দেন। তারই নির্দেশে প্রজাতের ওপর অন্যায় উৎপীড়ন অর্থাৎ ‘লাঠিবাজি’ বন্ধ হয়। দপ্তরে দপ্তরে হিসাব পরীক্ষা শুরু হয়, স্টেটের জরিপ হয়, সেন্সাস নেওয়া হয়। মূলত নিজের কর্মকুলতার জন্যই মুখার্জি সবার নজর কাড়ে। ‘অঞ্জনগনের আবালবৃদ্ধ চিনে ফেলল তাদের এজেন্ট সাহেবকে, একদিকে যেমন কট্টর অন্যদিকে তেমনি ইমারদ।”
মুখার্জির কর্মদক্ষতার ওপর ভিত্তি করেই অঞ্জনগড়ের শ্রী ফিরেছে। তার দূরদৃষ্টির জন্যই অঞ্জনগড়ের অন্তর্ভৌম সম্পদ অভ্র আর অ্যাসবেস্টসের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। কলকাতার মার্চেন্টদের এনে জমি দিয়ে সে রাজকোষের আয় বাড়িয়েছে। রাজবাড়ির লুপ্তশ্রী ফিরিয়েছে। তারপর ডুব দিয়েছে অন্যতর এক স্বপ্নে। যথার্থ আদর্শবাদী যুবকের মতো মুখার্জি জনকল্যাণে ব্রতী হবার আন্তরিক তাগিদ অনুব করেছে। প্রজাদের দারিদ্র্য দূর করতে সে ‘ইরিগেশন স্কীম’ তৈরি করেছে। স্বপ্ন দেখেছে—“প্রত্যেক কুর্মি প্রজাকে মাথাপিছু এক বিঘা জমি দিতে হবে। বিনা সেলামিতে, আর পাঁচ বছরের মতো বিনা খাজনায় আউশ আর আমন; তাছাড়া একটা রবি বছরে এই তিন কিস্তি ফসল তুলতেই হবে…”। আদর্শবাদী শিক্ষিত সচেতন সর্বোপরি কল্যাণকৃৎ মুখার্জির স্বপ্ন জনস্বার্থে ব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে। মঙ্গল ও সুন্দরের সমন্বয়ে মুখার্জি চেয়েছে রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। একটা ব্যাংক, ট্যানারি, কাগজের মিল সর্বোপরি একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে মুখার্জি প্রমাণ করতে চেয়েছে ‘রাজ্যশাসন লাঠিবাজি নয়; এও একটা আর্ট।”
মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি মুখার্জি আদর্শবাদী, স্বপ্ন বিলাসী বাস্তবের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ক্ষীণ। সুতরাং বাস্তবের সঙ্গে তার মানসিকতার সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই সংঘাতের সূচনা স্কুল তৈরিকে কেন্দ্র করে। মহারাজকে স্কুল তৈরির প্রস্তাব দেওয়ামাত্র মহারাজের প্রস্তাব নাকচ করার মধ্যে মুখার্জির স্বপ্ন দেখা জগতে প্রথম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে।
‘ফসিল’ গল্পের পরবর্তী পর্যায়ে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মুখার্জি উভয়পক্ষে সুষ্ঠু মীমাংসার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয়েছে। প্রজাদের বিদ্রোহ দমন করতে সে দুলাল মাহাতোর কাছে গেছে কিন্তু তার সব প্রয়াস বিফলে গেছে। তার এই ব্যর্থজনিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। পোলো খেলার মাঠে—“সমস্তটা সময় পুরো গ্যালাপ ক্ষ্যাপা ঝড়ের মতো খেলে যায়। ডাইনে বাঁয়ে বেপরোয়া আন্ডার-নেক হিট চালায়। কড়কড় করে এক একটা ম্যালেট ভেঙে উড়ে যায় ফালি হয়ে। মুখের ফেনা আর গায়ের ঘামের স্রোতে ভিজে ঢোল হয়ে যায়, কালো ওয়েলারের পায়ের ফ্ল্যানেল। তবু স্কোরের নেশায় পাগল হয়ে মুখার্জি চার্জ করে…”।
অবশেষে একই দিনে ঘটে যাওয়া দুটি অঘটন মহারাজ ও মাইনিং সিন্ডিকেট উভয়ের মাথায় বিপর্যয়ের কালো মেঘ ঘনিয়ে তোলে। ১৪নং পীটের খনি ধসে অে শ্রমিক চাপা পড়ে আর মহারাজের ফৌজদারের গুলিতে ঘোড়ানিমের জঙ্গলে লকড়ি কাটতে গিয়ে মারা যায় বেশ কয়েকজন কুর্মী প্রজা। মুখার্জির ডাক পড়ে মহারাজের কাছে। মুখার্জি এসে বুদ্ধি জোগায়। দুলাল মাহাতোকে আটক করতে বলে। পোলো লনে মুখার্জির ‘রাফ খেলার’ মধ্যে যে মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের সূচনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল তারই বহিঃপ্রকাশ এবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুলাল মহাতোই একমাত্র ব্যক্তি যে সিন্ডিকেট ও মহারাজ এই উভয় নরঘাতকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারতো। কিন্তু সেই মানুষটিকে আটক করার পরামর্শ দিয়ে মুখার্জি আদর্শবাদের টুটি টিপে ধরে। দুলালকে ধরার পরামর্শ দিয়ে মুখার্জি অসুস্থতা অনুভব করে কারণ যে মানুষটি তাকে ‘এজেন্ট বাব’ বলে সম্বোধন করেছিল তাকে আটক করতে বলে মুখার্জি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
আসলে মুখার্জি অর্থনৈতিক কারণে মহারাজের পক্ষ নিতে বাধ্য হয়েছে। মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তরাধিকার তাকে আদর্শবাদী করে গড়ে তুললেও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তার আদর্শবাদ বিবর্তিত হয়েছে। আদর্শবাদ ও বাস্তবতার সংঘাতে অপমৃত্যু ঘটেছে আদর্শবাদের। জন্ম নিয়েছে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষকামী এক বুদ্ধিজীবী সচিবের। “মুখার্জি চরিত্র দোলাচলচিত্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছে বলা যেতে পারে। শোষিত শ্রেণির মঙ্গল আকাঙ্ক্ষায় যে শ্রেণির মানুষরা সাধারণভাবে চিহ্নিত হলেও আকস্মাৎ প্রয়োজনের সময় নিজস্ব নিমক খাওয়ার দায় রাখতে অথবা শোষক শ্রেণির আভিজাত্য বা সামান্য অশ্রুজলের দাম রাখতে আবেগপ্রবণ হয়ে কখনো হয়তো নিজের অজান্তেই তারা শোষক শ্রেণির পক্ষাবলম্বন করে বসে। মার্কসীয় দৃষ্টিতে পাতিবুর্জোয়া শ্রেণির যে চরিত্রলক্ষণ—সেই লক্ষণের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতি রেখেই মুখার্জি চরিত্র অঙ্কিত।”
Leave a comment