রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত মতবাদগুলির মধ্যে আদর্শবাদ বা ভাববাদ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। এই মতবাদে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। এই মতবাদে রাষ্ট্রের চরম উৎকর্ষ ও অবাধ ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের আদর্শ ও আইনের প্রতি সকলের চরম ও দ্বিধাহীন আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সকল আদর্শবাদী রাষ্ট্র-দার্শনিক অভিন্ন অভিমত পোষণ করেন তা নয়। নাগরিকদের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা প্রশ্নাতীত কিনা এ প্রসঙ্গে ভাববাদী দার্শনিকদের মধ্যে অল্পবিস্তর মতপার্থক্য বর্তমান।

আদর্শবাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল ন্যায় ও নীতিবোধের এক চরম অভিব্যক্তি বা মূর্ত প্রকাশ। অভ্রান্ত যুক্তির প্রতীক হল এই রাষ্ট্র। বলা হয় যে ব্যক্তির স্বাধীনতা ভোগ এবং ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব একমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত পরিবেশের মধ্যে। সুতরাং ন্যায় ও নীতিবোধ এবং যুক্তি ও স্বাধীনতার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা আবশ্যক। এই আনুগত্যের অর্থ ন্যায়-নীতি ও যুক্তির প্রতি আনুগত্য এবং স্বাধীনতার স্বার্থে আনুগত্য।

প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও রুশো মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:

প্লেটো তাঁর ‘গণরাজ্য’ (Republic) গ্রন্থে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বাঙ্গসুন্দর আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন। অ্যারিস্টটল এক পরিপূর্ণ সুন্দর জীবনের প্রতীক হিসাবে রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। তাঁদের মতানুসারে মানুষ প্রকৃতিগতভাবে রাষ্ট্রনৈতিক জীব। তাই একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই ব্যক্তি তার জীবনকে সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে পারে। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের কাছে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থ ছিল অভিন্ন। তাই ব্যক্তির আনুগত্যের বিষয়টি তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়নি। ফরাসী দার্শনিক রুশো রাষ্ট্রকে সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের আলোকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের জনমণ্ডলীর সমষ্টিগত ইচ্ছার (General will) মধ্যেই এই সামগ্রিক কল্যাণের সন্ধান পাওয়া যায়। সামগ্রিক সামাজিক কল্যাণের প্রতীক হল এই সমষ্টিগত ইচ্ছা। এই সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছা (Real will) বর্তমান। সুতরাং সমষ্টিগত ইচ্ছার বিরোধিতা মানে ব্যক্তির নিজের প্রকৃত ইচ্ছার বিরোধিতা। এই সমষ্টিগত ইচ্ছাই হল চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। এবং আইন হল এই সমষ্টিগত ইচ্ছারই অভিব্যক্তি। সুতরাং আইনেরও বিরোধিতা করা যায় না।

হেগেল মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:

আদর্শবাদী জার্মান দার্শনিক হেগেল চরম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য হল চরম। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণের অধিকারকে তিনি অস্বীকার করেছেন। হেগেলের মতানুসারে রাষ্ট্র হল একটি সচেতন নৈতিক আদর্শ সম্পূর্ণ ব্যক্তি। এর আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্র একটি অতিমানবীয় সংগঠন। এই সংগঠন সর্বশক্তিমান ও অভ্রান্ত। এর স্থান সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের এই সর্বময় কর্তৃত্বকে দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করে নেওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। রাষ্ট্রই হল ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা ও যাবতীয় ভালোর উৎস। সুতরাং কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই, রাষ্ট্রের নির্দেশ পালনের দ্বারা এবং রাষ্ট্রের ইচ্ছার অনুবর্তী হয়ে ব্যক্তি তাঁর সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। হেগেলের যুক্তি হল ব্যক্তি তার প্রকৃত ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হয়ে স্বাধীনতা উপলব্ধি করতে পারে। রাষ্ট্রই হল প্রকৃত ইচ্ছার পরিপূর্ণ প্রকাশ। রাষ্ট্রের মধ্যেই প্রকৃত ইচ্ছা বিধৃত থাকে। সুতরাং একমাত্র রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে ব্যক্তি তার প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। হেগেল রাষ্ট্রে দেবত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে ‘রাষ্ট্র হল পৃথিবীতে ঈশ্বরের পদক্ষেপ’। রাষ্ট্রের আদেশই হল আইন। এই আইন হল সার্বজনীন চেতনার অভিব্যক্তি এবং যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই আইন অমান্য করার অধিকার নাগরিকদের থাকতে পারে না।

গ্রীণ মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:

ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক গ্রীণও ভাববাদী দার্শনিক হিসাবে পরিচিত। তিনিও নাগরিকদের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উপর ভাববাদী জার্মান দার্শনিক কান্ট-হেগেলের প্রভাব পড়েছে এবং সমকালীন ব্রিটিশ উদারপন্থী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাধারার প্রভাবও পড়েছে। গ্রীণের মতানুসারে ব্যক্তির অধিকারের উৎস রাষ্ট্র। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণ করে। মানুষের সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবনের পথে যে সমস্ত বাধা-বিপত্তি আসে রাষ্ট্র তা অপসারণ করে। যথাযথ সামাজিক আচার-আচরণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। এইভাবে রাষ্ট্র ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করে। তা ছাড়া রাষ্ট্র সমাজের নৈতিক সচেতনতা এবং ব্যক্তির নৈতিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। এই সমস্ত কারণের জন্য রাষ্ট্রের আদেশ-নির্দেশের প্রতি আনুগত্য থাকা দরকার। এবং এই কারণের জন্য মানুষ আইন মেনে চলে স্বাভাবিকভাবে। রাষ্ট্রের উপরিউক্ত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে বিরুদ্ধাচরণের অধিকার অস্বীকৃত।

আদর্শবাদ বা ভাববাদের বিরুদ্ধাচরণের অধিকার:

তবে গ্রীণের অভিমত অনুসারে নাগরিকদের আনুগত্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রের এই দাবি নিঃশর্ত বা চরম নয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণের ব্যাপারে নাগরিকদের অধিকারকে গ্রীণ একেবারে অস্বীকার করেন নি। গ্রীণের মতে রাষ্ট্র ভুল বা অন্যায় করলে রাষ্ট্রের মঙ্গলের স্বার্থেই ব্যক্তির কর্তব্য হল রাষ্ট্রকে বাধা দেওয়া। রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী বা নাগরিক স্বার্থের বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে বিরোধিতা করার অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্র যদি কোন অন্যায় আইন প্রণয়ন করে এবং সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের কোন সুযোগ যদি নাগরিকদের সামনে না থাকে, সেক্ষেত্রে, বিরোধিতা করাকে গ্রীন কর্তব্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তবে জনস্বার্থের বৃহত্তর সংরক্ষণই হবে বিরুদ্ধাচরণের উদ্দেশ্য।

ব্রাডলে মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:

ইংরেজ আদর্শবাদী দার্শনিক ব্রাডলে রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র ব্যতিরেকে ব্যক্তির পরিপূর্ণ অস্তিত্ব অসম্ভব। ব্যক্তির জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি সম্ভব হয় এবং পরিপূর্ণতা আসে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বিরোধিতার হতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রই তার আইনের মাধ্যমে ব্যক্তিকে এক মঙ্গলময় জীবনের সন্ধান দেয়।

বোসাংকেত মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:

এ প্রসঙ্গে আর একজন ইংরেজ আদর্শবাদী দার্শনিকের নাম উল্লেখযোগ্য। ইনি হলেন বোসাংকেত। বোসাংকেত সমাজের সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতীক হিসাবে রাষ্ট্রকে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে সমাজের এই সমষ্টিগত ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং সর্বসাধারণের স্বার্থের অভিব্যক্তি হল এই সমষ্টিগত ইচ্ছা। সুতরাং রাষ্ট্র মানুষের আনুগত্য দাবি করতে পারে। তা ছাড়া বোসাংকেত রাষ্ট্রকে স্বাধীনতার অভিব্যক্তি হিসাবেও অভিহিত করেছেন। অতএব এদিক থেকেও ব্যক্তির আনুগত্যের উপর রাষ্ট্রের চরম দাবি অনস্বীকার্য। বোসাংকেত রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা স্বীকার করেও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উপর নির্দিষ্ট সীমারেখা টেনেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বাধাগুলি দূর করা।

আদর্শবাদ বা ভাববাদের সমালোচনা:

রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত ভাববাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিভিন্ন বিরূপ সমালোচনা করা হয়।

(১) আদর্শবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা আলোচনার ক্ষেত্রে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরোপুরি পরিহার করে কেবল ভাব ও কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। বাস্তব উপাদানকে অস্বীকার করে ভাববাদ রাষ্ট্রকে বাস্তবতাবর্জিত আদর্শের দৃষ্টিতে দেখেছে। তাই মতবাদটি অবাস্তব ও অধিবিদ্যামূলক।

(২) ভাববাদে রাষ্ট্রের উপর চরম উৎকর্ষ আরোপ করা হয়েছে। রাষ্ট্রকে অবাধ ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। এই কারণে এই মতবাদ ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের বিরোধী। জোড বলেছেন: “The absolute theory of the State is in fact inimical to individual freedom. “হবহাউস (Hobhouse) -ও যথার্থই বলেছেন যে, আদর্শবাদে যাকে প্রকৃত স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তা স্বাধীনতার অস্বীকার মাত্র। ভাববাদে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের হাতেই ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়েছে।

(৩) ভাববাদে রাষ্ট্রকে অভ্রান্ত এবং এই কারণে অপ্রতিরোধ্য বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন রকম বিরোধিতার অধিকারকে স্বীকার করা হয়নি। তার ফলে রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত হয়েছে।

(৪) আদর্শবাদ ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা ও অপ্রকৃত ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে আইন ও স্বাধীনতাকে অভিন্ন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। এও ঠিক নয়। আইন ও স্বাধীনতা কখনই অভিন্ন নয়।

(৫) জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের ধারণা থেকে পরবর্তী কালে নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি হয়েছে।

আদর্শবাদ বা ভাববাদের মূল্যায়ন:

উপরিউক্ত বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ভাববাদের তাত্ত্বিক তাৎপর্যকে অস্বীকার করা যায় না।

  • (১) রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তাকে কোনক্রমে অগ্রাহ্য করা যায় না। 

  • (২) আবার রাষ্ট্রই হল ব্যক্তির সকল অধিকারের স্রষ্টা ও রক্ষক। এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। ব্যক্তির স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় প্রাধান্যের প্রয়োজনীয়তা আছে। 

  • (৩) সর্বোপরি রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে নাগরিকদের আনুগত্য দাবি করতে পারে— ইংরেজ আদর্শবাদী দার্শনিক গ্রীণের এই বক্তব্য অভ্রান্ত।