প্রশ্নঃ আত্মার অমরত্ব বলতে কী বােঝ?

অথবা, আত্মার অমরত্ব কী?

ভূমিকাঃ আত্মার অমরত্ব বিষয়ক সমস্যাটি দর্শনের একটি প্রাচীন ও জটিল সমস্যা। ধর্মের বেলায় অমরত্বে বিশ্বাস স্থাপন অপরিহার্য। নীতিবিদ্যায়ও আত্মার অমরত্বেবিশ্বাস স্থাপন অপরিহার্য। আমরা জানি মরণের পর যখন ইহলােকের অবসান হয়, তখন প্রয়াত ব্যক্তির সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটে । আবার অনেকের মতে, আত্মা লোকান্তরিত হয়ে পরলােকের অধিবাসী হয়। সুতরাং আত্মাকে নিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠেছে। নিম্নে আত্মার অমরত্ম সম্পর্কে বিভিন্ন যুক্তি আলােচনা করা হলাে-

আত্মা কিঃ সাধারণত আত্মা বলতে আমরা এমন একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্যকে বুঝি যা দেহকে ধারণ করে আছে। কিন্তু অনেকে আত্মাকে সতত পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বলে স্বীকার করেছেন। আবার অনেকে বলেন, আত্মা একটা অতীন্দ্রিয় ও সক্রিয় সত্তা, যার কাজ হচ্ছে বিভিন্ন সংবেদনের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা

আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে ধারণাঃ আত্মার অমরতা বলতে সাধারণত বুঝায়-আত্মা কোন অবস্থাতেই ধ্বংসশীল নয়, বরং চিরস্থায়ী। অর্থাৎ জীবদেহের ধ্বংস বা বিনাশ হয়ে গেলেও আত্মার বিনাশ হয় না। জড়বাদী দার্শনিকগণ মনে করেন, মৃত্যুতে যেমন দেহ ধ্বংস হয়, তেমনি আত্মাও ধ্বংস হয়। কিন্তু অনেক দার্শনিক দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তাদের মতে, আত্মা অজর ও অমর। দেহের ধ্বংস আছে, কিন্তু আত্মার কোন ধ্বংস নেই।

আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন যুক্তি/মতবাদঃ পাশ্চাত্য দর্শনে অমরত্বের প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় সক্রেটিসের দর্শনে। তিনি যে আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তা তার অন্তিম ভক্তি থেকেই অনুমেয়। আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, মুত্যুতে কেবল দেহই বিনাশ হয়, আত্মা নয়। প্লেটোর দর্শনের এক বড় অংশ আত্মার ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আত্মার অমরত্ম সম্পর্কে প্রধান তিনটি যুক্তি পাওয়া যায়। যথা-(ক) তত্ত্ববিষয়ক যুক্তি (খ) নৈতিক যুক্তি এবং (গ) ধর্মীয় যুক্তি। নিম্নে আত্মার অমরত্বের সপক্ষে এসব যুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-

আত্মার অমরত্বের সপক্ষে তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিঃ পাশ্চাত্য দর্শনে সক্রেটিসই প্রথম আত্মার অমরত্বের বিষয়ে তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির অবতারণা করেন। তিনি বলেন, মৃত্যুর পর দেহ ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু আত্মা ধ্বংস হয় না। এদিক থেকে বলা যায় যে, সক্রেটিস আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতেন। তবে আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে সক্রেটিস সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। প্লেটো সক্রেটিসের আত্মার অমরত্ব সম্পর্কীয় সুস্পষ্ট ধারণাকে দূরীভূত করে দার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করান।

প্লেটোর যুক্তিঃ তার মতে, এপােলজি নামক গ্রন্থে সক্রেটিসের পরকালের ধারণা ও আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে বুঝা যায় যে, সক্রেটিসের মতে, এগুলাে সম্পর্কে একমাত্র পরমসত্তাই সবকিছু জানেন। আমরা কিছু জানি না। প্লেটো তার গুরু সক্রেটিসের অজ্ঞেয়তাবাদকে গ্রহণ না করে আত্মার প্রকৃতি সম্পর্কে অনুসন্ধান কাজ চালানাের পর বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আত্মা হল অমর। যেহেতু আত্মা অবিমিশ্র মৌলিক সত্তা ও জীবনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নীতি। তিনি তার মতবাদকে আরও জোরালাে করার জন্য যেসব যুক্তি প্রদর্শন করেন সেগুলাে হলাে- বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা, আত্মার বা প্রদত্ত গুণ আত্মার অধিষ্ঠান ভাব বা ধারণায় বা জগতে। আত্মা যেহেতু দেহাতিরিক্ত এক আধ্যাত্মিক সত্তা সেহেতু আত্মা অবিনশ্বর, শাশ্বত ও অমর।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে যেসব যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলাে কোনটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। তবুও সেগুলাের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। মূলত আত্মার অমরত্বের বিষয়টি উপলব্ধি ও বিশ্বাসের। অতএব আত্মার অমরতায় বিশ্বাস করাটাই যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত।