আদি-মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ে ‘রাজপুত’ নামক নতুন জাতির উত্থান। রাজপুতদের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মত প্রচলিত আছে। গুপ্ত পরবর্তী যুগে ভারতে বসবাসকারী বিদেশিদের মধ্য থেকে রাজপুতদের উৎপত্তি বলে যেমন মনে করা হয় ; তেমনি কেউ কেউ এদের আর্যবংশসম্ভূত যোদ্ধা জাতি বলেই সিদ্ধান্তে এসেছেন। আবার ভারতের নিম্নবর্ণভুক্ত কোনো কোনো জাতি সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজপুত এবং ক্ষত্রিয় বর্ণভুক্ত হয়েছে বলেও অনেকের ধারণা। আধুনিক ইতিহাসচর্চায় ভারতের পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজপুতদের উৎপত্তি ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়।

রোমিলা থাপার লিখেছেন, “এরা (রাজপুত) যে কোথা থেকে এসেছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সম্ভবত এরা বিদেশি। এমন ধারণার কারণ হল, ব্রাহ্মণরা বিশেষ প্রচেষ্টা করে এদের রাজবংশসভূত বলে আখ্যা দিয়েছে এবং তাদের ক্ষত্রিয় বর্ণভুক্ত করেছে। ব্রাহ্মণরা রাজপুতদের আদি পূর্বপুরুষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাদের একেবারে সূর্যবংশ বা চন্দ্রবংশসদ্ভূত বলে বর্ণনা করেছে। অর্থাৎ পৌরাণিক ঐতিহ্যের ধারা অনুসারে কোনো রাজবংশকে যতখানি মর্যাদাসম্পন্ন করা যায়, রাজপুতদের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা সেই চেষ্টাই করেছে।”১ কোনো কোনো পণ্ডিত এই প্রসঙ্গে ‘চাঁদ রইসা’গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। এতে বলা হয়েছে যে, আবু পর্বতে এক পবিত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ড থেকে এক পৌরাণিক মানুষের সৃষ্টি হয়। সেই মানবের বংশধর হল রাজপুতদের চারটি গোষ্ঠী, যেমন— (১) প্রতিহার বা পরিহার। গুর্জর-প্রতিহারদের সাথে সম্পর্ক থাকলেও এরা অভিন্ন নয়। (২) চাহমান বা চৌহান, (৩) চৌলুক্য। দাক্ষিণাত্যের চালুক্য এবং এরা স্বতন্ত্র। এরা শোলাংকি নামেও অভিহিত হয় এবং (৪) পরমার বা পাওয়ার। এই কারণে এই চারটি বংশ ‘অগ্নিকুল’ নামে খ্যাত। এই কিংবদন্তীর মাধ্যমে বিদেশি হুন জাতির সাথে রাজপুতদের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “অগ্নিকুলোদ্ভব’ এক বিশেষণ মাত্র। এর তাৎপর্য হল যে, সম্ভবত অগ্নিশুদ্ধি দ্বারা বর্ণবহির্ভূত বিদেশিকে উচ্চবর্ণের হিন্দু পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছিল। রাজপুতানা বা রাজস্থান ও দক্ষিণ পাঞ্জাবের হন, শক প্রভৃতি বিদেশি এইভাবে হিন্দু সমাজে প্রবেশের অধিকার লাভ করে।” রোমিলা থাপার-এর মতে, বিদেশি হন এবং তাদের ভারতে অনুপ্রবেশকালে আরও ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির যেসব লোক ভারতে এসেছিল এবং পরে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করেছিল, রাজপুতরা তাদেরই বংশধর। গুপ্ত রাজাদের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, হুনদের আক্রমণের সময় রাজস্থানে ছোটো ছোটো গণরাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। উদারতন্ত্রী গণরাজ্যগুলিতে বর্ণব্যবস্থার কঠোরতা ছিল না। ঐতিহ্য নিয়ে এরা মাথা ঘামাত না। ফলে হুন আক্রমণকারীরা খুব সহজে এইসব অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে মিশে যেতে পারে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সাঙ্গীকরণের কাজকে সহজ করেছিল।

বি. এন. এস. যাদব-এর মতে, বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ এবং উপজাতীয়দের মধ্য থেকেই বিভিন্ন রাজপুত গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরীর অনুমান যে, রাজপুতদের বহু কথিত ছত্রিশটি গোষ্ঠীর মূল শিকড় ছিল ভারতবর্ষেই। যদিও হুন বা গুর্জরদের মতো বহিরাগত উপজাতিগুলি রাজপুতদের মর্যাদা দাবি করে। ‘বৃহৎধর্মপুরাণ’গ্রন্থে রাজপুতদের একটি ‘মিশ্র’ জাতি বলা হয়েছে। ‘শূদ্র কমলাকর’গ্রন্থের লেখক রাজপুতদের ‘উগ্র’ অর্থাৎ ক্ষত্রিয় পুরুষ ও শূদ্রানারীর সন্তানরূপে গণ্য করেছেন। অধ্যাপক যাদব মন্তব্য করেছেন যে, এই সকল কিংবদন্তী আদি-মধ্যযুগে ক্ষত্রিয় শাসক ও অভিজাত শ্রেণির মধ্যে তথাকথিত নিম্নস্তরের উপাদানের উপস্থিতির সম্ভাবনা ইঙ্গিত দেয়। অবশ্য রাজপুতরা এবং বিশেষ করে ‘অগ্নিকুল’ ভুক্ত চারটি বংশে নিজেদের সোচ্চারে ক্ষত্রিয় বলে গর্ববোধ করত।

রাজপুতরা আদি ভারতীয় বর্ণব্যবস্থার অংশ ক্ষত্রিয় বর্ণভুক্ত, নাকি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা ক্ষত্রিয়ত্ব অর্জন করেছে, এই বিতর্কে দশম-একাদশ শতকের কিছু বিবরণ ও লিপি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। আরবদেশীয় পর্যটক ইব্‌ন খুরদাদ্বাহ (মৃত্যু ৯১২ খ্রিঃ) লক্ষ্য করেছিলেন যে, ভারতের ক্ষত্রিয় সম্প্রদায় দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল—(১) সারকুফ্রীয় বা সৎক্ষত্রিয় এবং (২) কতরীয় বা ক্ষত্রিয়। দশম শতকের একটি লেখতে দেখা যায় যে, পাঞ্জাবের ভাতিণ্ডা অঞ্চলের জনৈক রাজা নিজেকে ‘সুক্ষত্রিয়ান্বয়-বিভূষণ’ নামে উল্লেখ করেছেন। একাদশ শতকের প্রখ্যাত লিপিকার ক্ষেমেন্দ্র এবং দ্বাদশ শতকে উমাপতি ধর ‘সুক্ষত্রিয়’শব্দটি নানাক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। বৎসরাজ লিখিত ‘কিরাতার্জুনীয়’ গ্রন্থে (দ্বাদশ শতক) ‘সৎক্ষত্রিয়’ শব্দটি পাওয়া যায়। সি.ভি. বৈদ্য (C. V. Vaidya) মনে করেন যে, শাসকগোষ্ঠী ‘সুক্ষত্রিয়’ নামে পরিচিত হত এবং সাধারণ কৃষিজীবীর একাংশ ‘ক্ষত্রিয়’নামে অভিহিত হত। কিন্তু ঐতিহাসিক যাদব (B. N. S. Yadav) মনে করেন, এই নামকরণের আরও গভীর মাত্রা আছে। ‘পৃথ্বীরাজ বিজয়’ গ্রন্থে কিছু মানুষকে ‘বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয়’ বলা হয়েছে। আবার এ কথাও স্বীকার করা হয়েছে যে, অনেকেই গায়ের জোরে ক্ষত্রিয়ত্ব অর্জন করেছে। ‘দ্বয়াশ্রয়’ গ্রন্থে বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় (যুদ্ধক্ষত্র) ও সাধারণ ক্ষত্রিয়দের পৃথক অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছে। ‘বর্ণরত্নাকর’ গ্রন্থে রাজপুত গোষ্ঠীগুলির দুটি পৃথক তালিকা দেওয়া হয়েছে। একটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছে ছত্রিশটি কুলীন গোষ্ঠীর নাম। অন্যটিতে অন্যান্য অসংখ্য গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ আছে।

জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চায় ‘রাজপুতদের ভারতীয় উৎসের তত্ত্ব প্রচার করা হয়। ইতিহাসমূলক সাহিত্যসমূহে রাজপুতদের সাহসিকতা, সততা ও সামরিক দক্ষতার নানা কাহিনি প্রচার করে তাদের জাতীয় বীরের পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অধ্যাপক বৈদ্য (CV. Vaidya) এই প্রসঙ্গে প্রায় চরমপন্থী মতবাদে বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন যে, আদি-মধ্যযুগে রাজপুতরা ঐতিহ্যগত পরম্পরা রক্ষা করার জন্য যে সাহসিকতা ও ত্যাগ প্রদর্শন করেছে, তা একমাত্র বৈদিক আর্যদের কাছ থেকেই আশা করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন : “The Rajputs who now came to the front and who by their heroism diffuse such glory on the period of Medieval Indian history cannot but have been the descendents of vedic Aryans. None by vedic Aryans could have fought so valiantly in defence of ancestral faith। অনুরূপ বক্তব্যের আর একটি দিক্ হল যে, “রাজপুতরা ক্ষত্রিয়দের মতোই দেশ, জাতি ও সংস্কৃতির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাজনীতির শীর্ষে উঠে আসতে সক্ষম হয়।”

অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় Origin of the Rajputs’ শীর্ষক প্রবন্ধে রাজপুতদের উত্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, আদি-মধ্যযুগে সামাজিক উত্তরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর সামাজিক মর্যাদাময় ‘ক্ষত্রিয়’ অভিধা অর্জনের প্রয়াস থেকে ‘রাজপুত’ শব্দটির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাই রাজপুতদের উৎপত্তি ঘটনাটিকে কোনো একটি গোষ্ঠীর বংশানুক্রমিক ধারাকে প্রকাশ করার উদ্যোগ রূপে না-দেখে বিভিন্ন উপজাতিভুক্ত গোষ্ঠী কর্তৃক সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদাবৃদ্ধির প্রয়াস হিসেবে দেখা উচিত। তিনি বলেছেন যে, ‘রাজপুত’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘রাজপুত্র’ হলেও প্রকৃতপক্ষে ‘রাজপুত’ বলতে ‘রাজপুতানা’ অর্থাৎ বর্তমান রাজস্থানের বিশেষ বিশেষ অভিজাত যোদ্ধাশ্রেণিকে বোঝায়। সাধারণভাবে রাজপুত ও অ-রাজপুতদের মধ্যে পৃথকীকরণের কাজ বেশ জটিল। বিভিন্ন লিপি ও সাহিত্যে ‘রাজপুত’ শব্দের ব্যবহার সত্ত্বেও একথা সত্য। ‘কুমারপাল চরিত’, ‘বর্ণরত্নাকর’, এমনকি ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থেও রাজপুতদের ছত্রিশটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। এই তালিকার নামগুলির অভিন্নতা নেই। ড. চট্টোপাধ্যায়ের মতে, সমকালীন সংগ্রাহকরাও এদের অপরিবর্তনীয়তা অস্বীকার করেছেন। এই দিক থেকে আদি-মধ্যযুগ ও মধ্যযুগে ‘রাজপুতরা’ ছিল মিশ্রজাতি। দ্বাদশ শতকের রচনা অপরাজিত প্রচ্ছা (Aparajita prachha)-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী এই রাজপুতদের অনেকেই ছিল ভূম্যধিকারী ও ছোটো ছোটো আঞ্চলিক সর্দার। রাজপুত্রদের ক্ষমতায় উত্তরণের সূচনাপর্বে রাজপুতদের গোষ্ঠীগঠনের শর্তাবলী তৈরি করা হয়। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দিক থেকে অগ্রণী গোষ্ঠীগুলির নামোল্লেখ সমকালীন লিপি বা সাহিত্যে বার বার পাওয়া যায়। যেমন—চাহমান (বা চৌহান), প্রতিহার ইত্যাদি।

আদি-মধ্যযুগের প্রত্নতত্ত্ব ও সাহিত্য উপাদানগুলির সাক্ষ্য থেকে ঐতিহাসিক অনুমান যে, দুটি বিশেষ প্রবণতা থেকে রাজপুতদের উদ্ভব ও বিকাশের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা যায়। একটি প্রবণতা হল রাজপুতনার বিভিন্ন অঞ্চলে যোদ্ধা গোষ্ঠীগুলির নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। সমকালীন কোনো কোনো লিপির সাক্ষ্যে কৃষি-এলাকার সম্প্রসারণ থেকেই এই বসতিবিস্তারের সমর্থন পাওয়া যায়। অধ্যাপক কে. সি জৈন তাঁর ‘Ancient cities and Towns of Rajasthan (Delhi, 1972) শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে রাজস্থানের নানা অঞ্চলে নতুন বসতিবিস্তারের তথ্য প্রমাণ তুলে ধরেছেন। চাহমান বা চৌহানরা ছিল রাজপুতদের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী। আদি মধ্যযুগের পক্ষে চাহমানদের অধিকৃত ভূখণ্ডকে ‘সপাদ লক্ষ্য’ বা তাদের পদতল দ্বারা চিহ্নিত অঞ্চল বলে অভিহিত করা হয়েছে। স্কন্দ পুরাণ’গ্রন্থে রাজপুতদের রাজ্য ও অধিকৃত জনপদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। নানান অঞ্চলে প্রাপ্ত একটি লিপিতে নাডোল-চাহমান বংশের পক্ষে দাবি করা হয়েছে যে, তাঁদের রাজ্য ‘সপ্তশত’ নামে পরিচিত ছিল এবং জনৈক চাহমান নৃপতি সীমান্তবর্তী সর্দারদের হত্যা করে তাদের ভূখণ্ডগুলিকে চাহমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং চাহমান রাজ্য ‘সপ্তসাহস্রিকা’ নামে পরিচিত হয়। এই সংখ্যাবাচক অভিধা এবং অভিধার পরিবর্তন রাজপুত রাজ্যের ক্ষমতা ও মর্যাদাবৃদ্ধির সংকেত দেয়। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের মত, এই সকল প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য সপ্তম শতকে কৃষি অর্থনীতির বিকাশের সাথে রাজপুতদের উত্থানের সম্পর্ক নির্দেশ করে। কিস্কিন্ধার গুহিলাদের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য সেচব্যবস্থা সমন্বিত কৃষি উৎপাদনের যে প্রমাণ দেয়, তার সমর্থন পাওয়া যায় মান্দোর-এর প্রতিহারদের লেখতে। ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে লিখিত কাকুকা’র ঘটিয়ালা লেখতে তাঁকে এই বলে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে যে, তিনি অগম্য ভাটানানকা অঞ্চল দখল করে সেই অঞ্চলকে কৃষি সমৃদ্ধ করে তোলেন। বলা হয়েছে, “Kakkuka made the land fragrant with the leaves of blue lotuses and pleasant with groves of mango and madhuka trees, and coverd it with leaves of excellent sugarcane.”I ৮৬১ খ্রিস্টাব্দের অপর একটি দলিলে ‘অভীর’ উপজাতি-অধ্যুষিত একটি দুর্গম অঞ্চলে রাজপুত-সংস্কৃতি বিস্তারের দাবি করা হয়েছে। আদি-মধ্যযুগের লেখগুলিতে রাজ্যজয়ের পাশাপাশি অধিকৃত সভ্য ও সংস্কৃতিবান মানুষ বিবর্জিত অঞ্চলগুলিতে ব্রাহ্মণ, সৈনিক ও মহাজনদের পুনর্বাসনের কৃতিত্ব কাক্কুকাকে দেওয়া হয়েছে। সমকালীন লেখতে ‘হট্ট’, ‘মহাজন’ ইত্যাদি শব্দ থেকে উক্ত অঞ্চলসমূহে পণ্য ক্রয়বিক্রয় ব্যবস্থার প্রচলনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পশ্চিম ও মধ্য ভারতের কিছু লিপিতে শাসকশ্রেণি কর্তৃক শবর, ভিল, পুলিন্দ প্রভৃতি স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়কে দমনের কাহিনি জানা যায়।

আদি-মধ্যকালীন লিপিসমূহ থেকে রাজপুত জাতির উদ্ভবের অন্তত দুটি বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়। প্রথমত, বেশ কিছু অঞ্চলে তথাকথিত রাজপুত শক্তির উত্থান ও প্রসার ঘটেছিল স্থানীয় উপজাতি বসতিগুলি দখলের মাধ্যমে। গুহিল ও চাহমান বংশের ক্ষেত্রে এই চিত্রটি পরিষ্কার। গুহিলদের (বা (গুহিলট) কৃতিত্ব-বিষয়ক অসংখ্য চারণগীতিতে ভিল উপজাতি সর্দারদের সরিয়ে দক্ষিণ রাজস্থানে গুহিল রাজ্য প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে। জেমস্ টড্-এর ‘Annals and Antiquities of Rajasthan গ্রন্থ এবং একলিঙ্গজী মন্দিরের গাত্রে খোদিত লিপি থেকে গুহিলদের সাথে ভিল উপজাতির সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। চাহমানদের লিপি থেকে জানা যায় যে, তারা অহিচ্ছত্রপুর থেকে ‘শাকন্তরী’ বা জঙ্গলদেশে কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করেছিল। ‘জঙ্গল দেশে’ রাজপুতদের সম্প্রসারণকে একটি অজ্ঞাত অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারের ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। উত্তর-পূর্ব মাড়োয়াড়ে চাহমানদের নাদোল গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা ঘটান শ্রীলক্ষ্মণ। ‘পুরাতন প্রবন্ধসংগ্রহ’ শীর্ষক গ্রন্থে লক্ষ্মণকে একজন দুঃসাহসিক সামরিক অভিযানকারী এবং গডোয়ার অঞ্চলে মেদ উপজাতিদের পরাস্ত করে চাহমান রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে। ‘পল্লিভল চাঁদ’শীর্ষক লোকগাথাতেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এই লোকগাথার বিষয়বস্তু হল রাঠোর শিহা কর্তৃক ‘মেদ্’ ও ‘মিন’ প্রভৃতি উপজাতীয়দের বশীভূত করার কাহিনি। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতে, উপজাতীয় অঞ্চলে রাজপুত রাজনীতির প্রতিষ্ঠাকে রাজস্থানের উপজাতীয় অর্থনীতি থেকে আধুনিক ও উন্নত, সীমিত অর্থে, অর্থনীতিতে রূপান্তরের ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র বসতি বিস্তার (colonization) প্রক্রিয়া দ্বারা রাজপুতদের উদ্ভব হয়েছিল, এমন ধারণা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক গতিশীলতার (Social mobility) বিশেষ ভূমিকা ছিল। সপ্তম শতকে দেশের সর্বত্র সামাজিক নিম্নস্তরের মানুষের উচ্চতর ‘ক্ষত্রিয়’ স্তরে উন্নীত হওয়ার যে প্রবণতা সক্রিয় ছিল, রাজস্থানও তা থেকে মুক্ত ছিল না। রাজপুতদের ছত্রিশটি গোষ্ঠীর মধ্যে ‘মেদ’ ও ‘হুন’দের নাম পাওয়া যায়। অধ্যাপক যাদব (B. N. Jadav) দেখিয়েছেন যে, নিম্নশ্রেণিভুক্ত ‘মেদ’ উপজাতি ও বহিরাগত ‘হুনদের রাজপুত শ্রেণির অন্তর্ভুক্তি সামাজিক ক্রমোচ্চস্তরে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার, রোমিলা থাপার প্রমুখ দেখিয়েছেন যে, আদি-মধ্যযুগে বিভিন্ন জাতি ও উপজাতি কাল্পনিক বংশতালিকা তৈরি করে ‘ক্ষত্রিয়’ মর্যাদা অর্জনের চেষ্টা করত। গুর্জর প্রতিহারদের উত্থানের সেই একই প্রবণতা সক্রিয় ছিল। পশুপালক গুর্জরদের সাথে প্রতিহারদের সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রয়াস কেউ কেউ করেছেন। এঁদের মতে, ‘গুর্জর-প্রতিহার’ শব্দগুচ্ছের গুর্জর বলতে হুনদের বংশধর এবং গুজরাটে বসবাসকারী ‘গুর্জর’দের বোঝানো হয়নি। তবে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন যে, পশুপালক গুর্জর বংশের উত্তরাধিকারী হল রাজপুত প্রতিহার বংশ। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, সপ্তম শতকে পশ্চিম ভারতে একাধিক গুর্জর শাসকগোষ্ঠীর অস্তিত্ব, আলোয়ার অঞ্চলে প্রতিহারদের ‘বাড়গুর্জর’ নামে পরিচিতি কিংবা ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থে গুর্জরদের উট বিক্রেতা হিসেবে উল্লেখ প্রমাণ করে যে, গুর্জর-প্রতিহার অভিন্ন এবং পশুপালক গুর্জর থেকেই প্রতিহারদের আবির্ভাব। মেবারের গুহিলট বংশের প্রতিষ্ঠাতা বাপ্পা’র উপাধি ছিল ‘রাওল’ বা রাজকুল। অর্থাৎ কোনো রাজবংশের সামন্ত হিসেবেই মেবারের গুহিল রাজবংশ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। অনুরূপভাবে গুজরাট ও রাজস্থানের চাহমান বা চৌহানরা ছিল গুর্জর-প্রতিহারদের সামন্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চাহমান বংশতালিকার দ্বিতীয় নামের সাথে ‘সামস্ত’ উপাধিযুক্ত, কিন্তু তৃতীয় নামের সাথে ‘নৃপ’ বা ‘নরদেব’ শব্দটি যুক্ত। ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দের ‘বিজহলি’ লিপিতে এই প্রভেদ দেখা যায়। ‘সামন্ত’ পদ থেকে স্বাধীন শাসক হিসেবে এই রূপান্তর ঘটে সামরিক শক্তিবৃদ্ধির মাধ্যমে।

রাজপুতদের আবির্ভাবের একটি অর্থনৈতিক স্তরের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। এই ব্যবস্থায় দেখা যায় যে, প্রতিহার ও চাহমানদের মতো বৃহদাকার গোষ্ঠী এবং অন্যান্য ছোটো ছোটো রাজপুত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এক বিশেষ ধরনের জমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হল শুধুমাত্র নিজ গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন প্রভু কর্তৃক ভূমিবণ্টনের বাধ্যবাধকতা পালন করা এবং এর লক্ষ্য ছিল নিজ নিজ গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও পরিধি বিস্তার করা। চাহমানদের বংশ-কর্তৃত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা খুবই সক্রিয় ছিল। তুলনামূলকভাবে বৃহত্তর প্রতিহার রাজ্যের মধ্যে ভূস্বামী হিসেবে অ-প্রতিহার বা অ-রাজপুতদের অস্তিত্ব ছিল। তবে আলোয়ারের গুর্জর-প্রতিহার মন্থন-এর ‘রাজোরগড়’ লিপিতে ‘বংশপোতকভোগ’ শব্দের উল্লেখ থেকে স্ববংশীয়দের মধ্যে ভূমিবণ্টন প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। চাহমানদের ‘হর্য’ লেখতে (৯৭৩ খ্রিঃ) এই ধরনের ভূমিবণ্টনের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে সিংহরাজ, তাঁর দুই ভ্রাতা ও দুই পুত্রের ‘স্বভোগ’ বা ব্যক্তিগত জমির বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এখানে গুহিলবংশীয় জনৈক ব্যক্তির জমিও জনৈক উচ্চ কর্মচারীর ‘ভোগ’-এর উল্লেখ আছে। তবে জমি হস্তান্তরের প্রশ্নে চাহমানবংশীয় ও বংশবহির্ভূত ব্যক্তির অধিকারগত প্রভেদ ছিল।

ভূমিবণ্টন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত আর একটি বিষয় হল গ্রামের সমষ্টি বা একক নির্ধারণ। রাজপুতদের ভূমিব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল ছয়টি গ্রামের সমষ্টি নিয়ে একটি একক গঠন। বৃহত্তর এককগুলি গঠিত হত ৬-এর গুণিতকে যেমন—বারো, আঠারো, চব্বিশ, ত্রিশ ইত্যাদি। এই এককগুলি মণ্ডল, ভুক্তি, বিষয় ইত্যাদি প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তথাপি সমকালীন লিপির বক্তব্য থেকে অনুমিত হয় যে, এই ধরনের এককগুলি স্থানীয় কর্তৃত্বের ভিত্তি হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ছয়-এর গুণিতকে সৃষ্ট চুরাশিটি গ্রামের এক একটি প্রশাসনিক এককের নেতা ‘চৌরাশিয়া’ অভিধায় পরিচিত হতেন। নবম শতকে গুর্জর-প্রতিহার বংশীয় রাজপুত গোষ্ঠীর অধীনে এমন বৃহত্তর এককের প্রাথমিক উল্লেখ দেখা যায়। ক্রমে শাসকশ্রেণির গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ জোরালো করার জন্য এই ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়। চতুর্দশ শতকে ‘চৌরাশিয়া’ পদের শাসকদের ‘বিশালদেবরসো’গ্রন্থে ‘অতি পরিচিত শাসক গোষ্ঠী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ব্যবস্থার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “…the rudiments of the ‘caurasia’ arrangement and its connection with distribution of land can be traced to the early phases of the crystallization of Rajput polity.”

শাসনতান্ত্রিক একক হিসেবে ভূমি বন্দোবস্ত দেবার সঙ্গে সঙ্গে শাসকশ্রেণি উক্ত অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে দুর্গ প্রাকার নির্মাণ করেন। অধ্যাপক জৈন দেখিয়েছেন যে, আদি-মধ্যযুগে রাজপুতদের উত্থানের সাথে দুর্গাদি নির্মাণ দ্বারা ক্ষমতা সংহত করার প্রবণতা একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল, কারণ প্রাচীন রাজস্থানে দুর্গের অস্তিত্ব ছিল না। গুর্জর প্রতিহারদের গোপগিরি লেখতে আদি মধ্যযুগে একটি দুর্গের সামরিক ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক গুরুত্ব সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। আদি-মধ্যযুগে রাজস্থানের নানা অঞ্চলে রাজপুত শক্তির প্রতীক হিসেবে নির্মিত দুর্গগুলির অন্যতম হল কাম্যকিয়কোট্ট (ভরতপুর), রাজ্যপুরা (রজোর), মন্দভ্যপুর দুর্গ (মান্দোর), চিত্রকূট মহাদুর্গ (চিতোর), কোষবর্ধনদুর্গ (কোটা), শুভরণগিরি দুর্গ (জালোর), শ্রীমালিয়াকোট্ট (ভিনমল) ইত্যাদি। শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত্তি এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভূস্বামীদের ওপর নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার ছিল এই সকল দুর্গ।

ভূমিভিত্তিক অভিজাত শাসকশ্রেণি হিসেবে রাজপুতদের উদ্ভবের ফলেই তাদের মধ্যে বিভিন্ন স্তর ও মর্যাদার উৎপত্তি হয়। অপরাজিতা প্রচ্ছা গ্রন্থে দেখানো হয়েছে যে, ক্ষত্রিয় রাজপুতশ্রেণি এক জটিল স্তরবিভাজনের মধ্যে আবদ্ধ ছিল।

এই স্তরবিন্যাসের সর্বোচ্চ ছিলেন সমগ্র রাজ্যের অধীশ্বর মহারাজধিরাজ। নীচের দিকে ছিলেন পঞ্চাশ, কুড়ি, তিন, দুই বা একটি গ্রামের অধিকারীরা। চতুরাংশিকরা ছিলেন ক্ষুদ্র ভূস্বামী এবং তাদের নীচে ছিলেন রাজপুত বা গ্রাম-প্রধানরা। তবে এই সারণি পুঁথিগত। বাস্তবে এই সকল ক্ষত্রিয় ভূস্বামীর সবাই ছিলেন রাজপুত। এই পিরামিডসদৃশ কাঠামোর মধ্যে প্রভু-সামন্ত (Lord-Vassal) সম্বন্ধ লক্ষণীয়। চক্রবর্তী মহারাজাধিরাজ ছিলেন সর্বোচ্চে এবং সর্ব নিম্নে ছিলেন ‘রাউট’ বা রাজপুত। এই তালিকায় ‘ঠাকুরদের নামোল্লেখ নেই। তবে তারাও ক্ষত্রিয়-রাজপুত গ্রাম-প্রধান রূপে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছিল। অধ্যাপক যাদবের মতে, রাজপুতরা ছিল স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় জাতি। চান্দ্রবংশ বা অগ্নিকুল উৎপত্তির দাবির মধ্যে একটা ‘বিশুদ্ধতার গৌরব’ (Purifactory character) প্রকাশ পেত। একইভাবে সমরকুশল গোষ্ঠী হিসেবে রাজপুতদের মধ্যে একটা ‘গোষ্ঠী উন্নাসিকতা’ (high sense of clan, superiority) ছিল। তাই নিজের পরিমণ্ডলের মধ্যে অন্য কোনো সামাজিক উপাদানের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে রাজপুতরা ছিল খুবই সাবধানী। এই কারণে কনৌজের পরাক্রান্ত গাহড়বাল বা বাংলার শক্তিশালী সেন বংশ কখনও শুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা পায়নি।

উৎপত্তির সূচনাপর্বে অগ্নিকুলভুক্ত চারটি রাজপুত গোষ্ঠী প্রতিহার, চাহমান বা চৌহান, শোলাংকি বা চৌলুক্য এবং পরমার বা পাওয়ার ছিল বেশি উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কারণে আদি মধ্যযুগের লিপি ও সাহিত্যে এই চারটি বংশের উল্লেখ বেশি পাওয়া যায়। প্রাক্তন প্রতিহার রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর এই রাজপুত গোষ্ঠীগুলি নতুন রাজপুত রাজ্য গড়ে তোলে। দক্ষিণ রাজস্থানে রাজত্ব শুরু করে রাজপুত-প্রতিহার গোষ্ঠী। আদি প্রতিহারদের সামন্ত ছিল চাহমান বা চৌহানরা। আরবদের আক্রমণকালে মুসলমান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চৌহানরা কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। পরে এরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘মহারাজাধিরাজ’ইত্যাদি উপাধি নিয়ে দিল্লির দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব রাজস্থানে রাজত্ব গড়ে তোলে। শোলাংকিদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় কাথিয়াবাড় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। তাদের শাখাপ্রশাখা প্রসারিত হয় চেদি, পাটন ও ব্রোচ অঞ্চলে। পাওয়ার বা পরমাররা প্রথমে ছিল রাষ্ট্রকূটদের সামন্ত প্রধান। দশম শতকের শেষদিকে এরা বিদ্রোহী হয় এবং ইন্দোরকে কেন্দ্র করে রাজ্য গড়ে তোলে। অন্যান্য বহু রাজপুতগোষ্ঠী, যারা নিজেদের চন্দ্র বা সূর্য বংশোদ্ভূত বলে দাবি করত, তারা পশ্চিম ভারত ও উত্তর ভারতের নানা অংশে রাজ্যস্থাপন করে। দশম শতকে খাজুরাহ অঞ্চলে চন্দেল্লরা বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। চাহমান রাজ্যের উত্তর-পূর্ব দিকে রাজ্য স্থাপন করে তোমর গোষ্ঠী। আদিতে এরাও ছিল প্রতিহারদের সামন্তরাজা। দিল্লির সন্নিকটে হরিয়ানা অঞ্চলে এরা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘তোমর’ গোষ্ঠীর উদ্যোগে ‘ধিল্লিক’ বা ‘দিল্লি’ শহর প্রতিষ্ঠা করে। দ্বাদশ শতকে তোমর রাজ্য চৌহান গোষ্ঠীর দখলিভুক্ত হয়। চৌহান রাজ্যের দক্ষিণদিকে মেবারের সেহলট বা গুহিল গোষ্ঠী রাজ্য স্থাপন করে। আরব আক্রমণের প্রতিরোধে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আরব আক্রমণ কালে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকুটরা সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে তাদের সামন্ত রাজারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এইভাবে প্রতিহারদের সামস্ত কলচুরিরা জব্বলপুরের কাছে ত্রিপুরীতে রাজ্য গড়ে তোলে।

আদি-মধ্যযুগে প্রধান রাজপুত গোষ্ঠীগুলির ভাঙনের ফলে এবং অন্যান্য কারণে একাধিক উপগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। ‘প্রবন্ধ চিন্তামণি’গ্রন্থে পরমার গোষ্ঠীর শত রাজপুত্রের কথা বলা হয়েছে। মাউন্ট আবুর আকলেশ্বর লিপিতে (১২৮৫ খ্রিঃ) গুহিল গোষ্ঠীর অসংখ্য শাখা ও উপশাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির ক্ষেত্রেও এই ধরনের উপগোষ্ঠী সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল ধরে নেওয়া যায়। চাহমানদের উপগোষ্ঠী হিসেবে ‘দেওদা’, ‘মোহিল’, ‘সোনি’ (বা শোনিগরা); পরমারদের ‘ডোডা’ গোষ্ঠী; ওহিলদের ‘পিপাদিয়া’, ‘মঙ্গল্য’ গোষ্ঠী; রাঠোরদের ‘দাধিকা’ গোষ্ঠী ইত্যাদির উল্লেখ সমকালীন লেখতে পাওয়া যায়। আন্তঃগোষ্ঠী বিবাহ সম্পর্কের কিছু সমকালীন বিবরণ থেকেও উপগোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়া যায়। নতুন নতুন এলাকায় মুখ্য রাজপুত গোষ্ঠীগুলির সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র উপযোগী গঠনের তত্ত্ব সম্পর্কে ড. ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় সংশয় প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে, ড. চট্টোপাধ্যায় উপগোষ্ঠী উদ্ভবের প্রধান উপাদান হিসেবে ‘স্থানিক বৈশিষ্ট্য’ (Localism ) – এর উল্লেখ করেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজপুতকরণ ছিল সামাজিক সচলতার প্রক্রিয়ার একটি ফল এবং এই প্রক্রিয়াতেই ‘মেদ’ বা ‘হুন’দের রাজপুত গোষ্ঠীভুক্তি সম্ভব হয়। এই প্রেক্ষাপটে রাজপুতদের উপগোষ্ঠী সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিভিন্ন মূল গোষ্ঠীর সদস্যদের স্থানীয় বৈশিষ্ট্য আত্মীকরণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হয়। রাজপুত উপগোষ্ঠী সৃষ্টির এইরূপ স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পিপাদিয়া গুহিল বা শোনিগরা চাহমানদের ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয়। ‘পিপ্পলপাদ’ ও ‘সুবর্ণগিরি’ নামক অঞ্চল দুটির ভিত্তিতে উপগোষ্ঠীগুলি ‘পিপাদিয়া’ ও সোনিগরা’ নামে পরিচিত হয়। এ ছাড়া আন্তঃগোষ্ঠী বিবাহসম্পর্ক উপগোষ্ঠীর প্রসারে সহায়তা করে।

আদি-মধ্যযুগে রাজপুতদের উদ্ভব এবং পরবর্তী চারশো/পাঁচশো বছরে তাদের বিস্তার অর্থাৎ সপ্তম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের অন্তর্বর্তীকালে রাজপুত গোষ্ঠীর প্রাথমিক আবির্ভাব ও পরবর্তীকালে তাদের অসংখ্য উপগোষ্ঠীর সৃষ্টিতে দুটি প্রধান উপাদান হিসেবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্ণভিত্তিক সমাজে ক্ষত্রিয়তার সাথে নিজেদের সম্পর্কিত করার প্রয়াস এবং সম্প্রসারণ কর্মসূচির ফলে স্থানিকবাদের প্রভাবে উপগোষ্ঠীর সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।