উত্তর ভারতের যে সকল অংশে রাজপুতরা কর্তৃত্ব স্থাপন করে তা সাধারণভাবে ‘রাজস্থান’ (বা রাজপুত্রদের বাসস্থান) নামে পরিচিত হয়। এখানে অনেকগুলি প্রায় স্বাধীন বা স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাজ্য হল যোধপুর, (মরু) জয়শলমির (মদ্), বিকানির (জঙ্গলদেশ), আজমির (অজয়মেরু), উদয়পুর (মেবার) ইত্যাদি। দীর্ঘকাল সংঘাত ও ভাঙনের মধ্য দিয়ে এই রাজ্যগুলির সৃষ্টি হয়। এই রাজপুত-অধ্যুষিত অঞ্চলের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও পূর্বদিকে ছিল সুলতানি সাম্রাজ্য, দক্ষিণ-পশ্চিমে মালব রাজ্য, পশ্চিমে ছিল উচ্, দিপালপুর ও মুলতান এবং দক্ষিণ দিকে ছিল গুজরাট রাজ্যের সীমানা। জেম্স ট-এর মতে, মোটামুটিভাবে প্রায় তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল ব্যাপী রাজপুতদের কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত ছিল। ভৌগোলিক আকৃতির দিক থেকে রাজস্থান ছিল একটি সমবাহু অসম কোণবিশিষ্ট চতুর্ভুজের মতো। এর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যও বিচিত্র। উত্তর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রসারিত আরাবল্লী পর্বতমালা, যার পশ্চিমে আছে বিশ্বখ্যাত মরু অঞ্চল। উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে যথাক্রমে কৃষিযোগ্য সমতলভূমি এবং সমৃদ্ধ মালভূমি অঞ্চল। এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য রাজস্থানের প্রাকৃতিক সীমানা ও সে অঞ্চলের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ধারাকে প্রভাবিত করেছে। পার্বত্য অঞ্চল রাজস্থানকে দিয়েছে বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রকৃতিদত্ত নিরাপত্তা। মরুভূমি অঞ্চলও বিদেশি আক্রমণকারীদের হাত থেকে লুকিয়ে থাকার নিরাপদ স্থান হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন গ্রিকদের মতোই রাজস্থানের এই ভৌগোলিক অবস্থান, মরুভূমির ও পাহাড়ের রুক্ষতা, রাজপুতদের চরিত্রে অদম্য প্রত্যয়, দুঃসাহস এবং অসীম ধৈর্য্যের সন্নিবেশ ঘটিয়ে তাদের প্রায় অপ্রতিরোধ্য একটি জাতিতে পরিণত করেছে। তাই সপ্তম-অষ্টম শতকে আরব আক্রমণের সময় থেকে ষোড়শ শতকে মোগল আক্রমণ পর্যন্ত সময়কালে রাজস্থান বার বার বহিরাক্রমণ দ্বারা অস্থির হলেও কেউই রাজপুত যোদ্ধাদের চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করতে বা এই অঞ্চলের ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। রাজস্থানের সাংস্কৃতিক জীবনের ওপরেও এই প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের ইতিবাচক প্রভাব ছিল বলে ড. জি. এন. শর্মা মনে করেন। তিনি লিখেছেন, “The abundance of luxuriant vegetation, the peaceful atmosphere of the fertile valleys and productive land of the plateau have also contributed to the cultural development of Rajasthan. “I
চতুর্দশ শতকের শেষদিকে দিল্লি-সুলতানির দুর্বলতার সুযোগে বহু আঞ্চলিক শাসক (মাকৃতি) কার্যত স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা শুরু করেন। এই সুযোগে রাজস্থানের রাজপুত গোষ্ঠীগুলিও নিজ নিজ এলাকায় শক্তি সংহত করে স্বাধীন রাজত্ব কায়েম করে। রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তারের দিক থেকে অগ্রণী রাজপুত গোষ্ঠীগুলির অন্যতম ছিল গুহিলট বা গুহিল চৌহান, রাঠোর, কাচোয়া, হাড়া ইত্যাদি। দিল্লির সুলতান, মালব ও গুজরাটের শক্তিশালী রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে এই রাজপুত রাজ্যগুলি সামরিক সাফল্য অর্জন করলেও, এরা সম্মিলিতভাবে গোটা রাজস্থানের ওপর কোনো বৃহৎ রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা কল্পনাও করত না।
মেবার :
আদি-মধ্যযুগে রাজস্থানের অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য ছিল মেবার। সম্ভবত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে পার্শ্ববর্তী গুজরাট থেকে রাজপুতদের গুহিলট শাখা রাজস্থানে প্রবেশ করে এবং দক্ষিণ পশ্চিম রাজস্থানের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে। দীর্ঘ আট শতক ব্যাপী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পরিচালনা এবং তুর্কি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে মেবার ভারত-ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী হয়ে আছে। মেবারে গুহিলট্ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সূচনা করেন বাপ্পা রাওয়াল। উদয়পুরের চৌদ্দ মাইল উত্তরে নাগ্দা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তিনি শক্তি সঞ্চয় করেন এবং চিতোর দুর্গ দখল করে মেবারের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। আরব সেনাপতি জুনাইদ এর আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি দক্ষতা দেখান। তাঁর উত্তরসূরি দ্বিতীয় খুম্মন (৮১২-৩৬ খ্রিঃ) বাবার মতোই দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন। গুজরাটের শাসকের সাথে যৌথভাবে তিনি নবম শতকে আরব আক্রমণকারীদের সুলতান ও সিন্ধু থেকে বিতাড়িত করেন। পরবর্তী চার দশকে গুহিলটদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বার বার সংকটের মুখে পড়ে। চৌহান, পারমার, চালুক্য প্রভৃতি রাজবংশের আক্রমণের ফলে মেবারের বহু অঞ্চল গুহিলটদের হস্তচ্যুত হয়। তথাপি গুহিলটরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে নিজেদের শক্তি সংহত করার কাজ চালিয়ে যান। দ্বাদশ শতকের শেষদিকে মহম্মদ ঘুরির হাতে তরাইনের যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের উপর্যুপরি পরাজয় এবং গুজরাট ও মালব রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংকটের সুযোগে জৈত্র সিং (১২১৩-৬১ খ্রিঃ) পুনরায় শক্তি সংহত করেন এবং রাজস্থানে তুর্কিদের অগ্রগতি প্রতিহত করেন। কিন্তু ইলতুৎমিস নাগদা দখল করে নেন। অতঃপর চিতোরকে কেন্দ্র করে গুহিলটদের রাজনৈতিক কার্যাবলী পরিচালিত হয়।
আলাউদ্দিন খলজি ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে চিতোর আক্রমণ করেন। আমির খসরুর মতে, তাঁর প্রথম দুটি অভিযান ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত রানা রতন সিংহ আত্মসমর্পণ করলে চিতোরের শাসনভার আলাউদ্দিনের পুত্র খিজির খাঁ’র হাতে ন্যস্ত করা হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আলাউদ্দিন রাজপুতদের হাতে মেবার ফিরিয়ে দেন। সুলতানের অন্যতম কর্মচারী তথা রানা রতন সিংহের ভাগিনেয় রানা মালদেবকে মেবারের শাসক নিযুক্ত করেন। মালদেবের মৃত্যুর পর মেবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হয়। রাজপুত চারণগীতি অনুসারে মালদেবের পুত্র জৈসা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে দিল্লি-সুলতানের সাহায্য প্রার্থী হন। মহম্মদ-বিন্-তুঘলক মেবারে একটি অভিযানও পাঠান। কিন্তু হামিরদেব তা প্রতিহত করেন। রানা হামির (১৩২৬-৬৪ খ্রিঃ) তাঁর দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের জন্য ভারত-ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি মেবারের সীমানা বৃদ্ধি করেন এবং মাড়োয়ার, অম্বর, গোয়ালিয়র, রাইসিন, চান্দেরি ও কাল্পীর শাসকরা রানা হামিরের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হন। ‘কম্প্রিহেনশিভ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’র মতে, “He (Hammir) left a name which is still honoured for gallantry and valour of a very high order.” মৃত রানা হামির মৃত্যুকালে তাঁর পুত্র ক্ষেত্র সিংহের জন্য একটি প্রসারিত ও শক্তিশালী রাজ্য রেখে যান। আজমির, জাহাজপুর, মণ্ডলপুর প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে তিনিও সামরিক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। হাডাদের ক্ষমতাচ্যুত করে তিনি হাড়াবতীকেও মেবারের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন।
মেবারের পরবর্তী শাসক লখা’র (১৩৮২-১৪২১ খ্রিঃ) রাজত্বকালে চিতোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা এগিয়েছিল। মাড়োয়ার রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চল দখল করে এবং সীমান্তের উপজাতীয় সর্দারদের পরাজিত করে তিনি সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেন। তিনি মের ও ভিল সর্দারদের ধ্বংস করেন এবং নগরচলের সংঘল রাজপুতদের ধ্বংস করে বাদনোর দখল করেন। তুর্কিদের বিরুদ্ধেও তিনি লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর আমলে জাওয়ার অঞ্চলে রূপা ও সীসার খনি আবিষ্কৃত হলে মেবারের আর্থিক ভিত্তি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সম্পদ ব্যবহার করে তিনি তুর্কি আক্রমণকালে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মন্দির ও প্রাসাদগুলি পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার করেন এবং কৃষির উন্নতির জন্য বৃহৎ জলাশয় খনন করেন এবং বাঁধ দেন। উদয়পুরের বিখ্যাত ‘পিচ্চোলা হ্রদ তাঁর আমলেই নির্মিত হয়েছিল। সেকালের বিখ্যাত সংস্কৃত সাহিত্যের কবি ঝোটিঙ্গা ভট্ট ও ধনেশ্বর ভট্ট লখা’র রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। মেবারের পরবর্তী শাসক ছিলেন মোকাল (১৪২১-৩৩ খ্রিঃ)। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন। তবে পিতার ইচ্ছানুসারে মোকালের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা চণ্ড নাবালক রানার পরিচালক নিযুক্ত হন। চণ্ড স্বেচ্ছায় সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করার পুরস্কার হিসেবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বের পাশাপাশি সমস্ত রাজকীয় দলিলে তাঁর ব্যক্তিগত প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করার অধিকার পান। চণ্ড অত্যন্ত দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সাথে রাজকার্য পরিচালনা শুরু করেন। কিন্তু নাবালক রানার মাতা তথা চণ্ডর বিমাতা রানী হংসবাঈ চণ্ডর প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং নানাভাবে তাঁর কর্তৃত্বকে আঘাত করতে থাকেন। বলা বাহুল্য, সৎ ও নির্লোভী চণ্ড বিমাতাকে প্রত্যাঘাত না-করে মাণ্ডুতে চলে যান। অতঃপর রাজমাতার ইচ্ছানুসারে তাঁর ভ্রাতা রণমল মাড়োয়ার থেকে এসে মেবারের রানার পক্ষে শাসন পরিচালনা শুরু করেন। তিনি মাড়োয়ার থেকে নিজ গোষ্ঠীর (রাঠোর) রাজপুতদের এনে মেবারের অধিকাংশ উচ্চপদে নিয়োগ করেন। এইভাবে মেবার কার্যত রাঠোরদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ইতিমধ্যে মোকাল সামরিক শক্তি সংগঠিত করে একের পর এক রাজ্য জয় করতে থাকেন। তিনি ১৪২৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ফিরোজ খানকে পরাজিত করেন। সম্ভর, জালোর তাঁর দখলে আসে। গুজরাটের শাসক আহমদ শাহকে পরাজিত করে এবং হাড়া গোষ্ঠীর মর্যাদার প্রতীক জাহাজপুর দুর্গ দখল করে তিনি মেবারের সামরিক দক্ষতা জাহির করেন।
সামরিক কৃতিত্বের পাশাপাশি মোকালের রাজত্বকালে মেবার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও গৌরব অর্জন করে। রাজপুত শিল্পশৈলীর অন্যতম নিদর্শন চিতোরের ‘সমিধেশ্বর মন্দির তিনি সংস্কার করেন। বিখ্যাত ‘একলিঙ্গ’ মন্দিরের চতুঃস্পার্শে তিনি একটি সুউচ্চ প্রাচীর নির্মাণ করেন। সমকালীন লেখ থেকে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমর্থক মাকাল অনেকগুলি শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত মন্দির নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন। ‘পাপমোচন তীর্থে’ তিনি একটি জলাশয় নির্মাণ করেন। মেবারের প্রখ্যাত ভাস্কর মনা, ফন্না ও বিশাল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। কবিরাজ বাণীবিলাস (জোগেশ্বর), ভট্টবিষ্ণু প্রমুখ পণ্ডিত তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেন। তাঁর শেষ জীবন সুখকর হয়নি। রাঠোর সর্দারদের ক্ষমতার লোভ ও দ্বন্দ্ব তাঁকে ভীষণভাবে বিব্রত করে। শেষ পর্যন্ত ক্ষেত্র সিংহের পুত্রদ্বয় চাচা ও মেরা ‘এক ষড়যন্ত্র দ্বারা মোকালকে হত্যা করেন।
মোকালের মৃত্যুর পর মেবারের সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র কুম্ভ (১৪৩৩-৬৮ খ্রিঃ)। তাঁর রাজত্বের সূচনাপর্বে মেবারের রাঠোর ও গুহিলদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কিছু অস্থিরতা সৃষ্টি করে। রানা কুত্ত প্রথমেই তাঁর পিতার হত্যাকারীদের বন্দি ও হত্যা করেন। কিন্তু এই যুদ্ধকালে রাঠোর সর্দার রণমলের কিছু সিদ্ধান্ত গুহিলট্ নেতাদের ক্ষুব্ধ করে। চণ্ডর ভ্রাতা রাঘদেব মেবারের অভিজাতদের সাথে রাঠোরদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রণমল এক ষড়যন্ত্র দ্বারা রাঘদেবকে হত্যা করেন। এই ঘটনা মেবারের অভিজাতদের শঙ্কিত করে এবং তারা চণ্ডকে স্বরাজ্যে এনে রাঠোরদের আধিপত্য ধ্বংস করার আহ্বান জানান। চণ্ড তাদের আহ্বানে সাড়া দেন এবং মেবারে এসে আর এক ষড়যন্ত্র দ্বারা রণমলকে হত্যা করে মেবারের রাজনীতিতে রাঠোরদের কর্তৃত্ব ধ্বংস করেন।
রানা কুম্ভের নেতৃত্বে শিশোদিয়া রাজপুত বংশের সামরিক কর্তৃত্ব গৌরবের শীর্ষদেশ স্পর্শ করে। চিতোর, কুম্ভলগড়, রণপুর প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত সমকালীন লেখ এবং ‘একলিঙ্গ মাহাত্ম্য’ নামক সাহিত্য থেকে রানা কুম্ভের সামরিক সাফল্যের বিবরণ জানা যায়। তিনি দক্ষতার সাথে শত্রু রাজ্যগুলিকে পরাজিত করে ওই সকল অঞ্চলের শাসকদের আনুগত্য অর্জন করেন। হাড়াবতী (কোটা), মালপুরা, অমরাদত্রি (অম্বর), গিরিপুর, সরঙ্গপুর, বৃন্দাবতী (বুন্দী) প্রভৃতি অঞ্চলের পরাজিত শাসকবৃন্দ মেবারের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে নিজ নিজ রাজ্যের শাসনভার ফিরে পান। সম্ভর, মান্দোর, নাগাউর, রণথস্তোর, শিরোহী, আবু, মণ্ডলগড়, আজমির, প্রভৃতি স্থান দখল করে তিনি মেবারের রাজ্যভুক্ত করে নেন। স্বাধীনচেতা রাজ্য জাহাজপুর, জাত্তর, বন্দোর প্রভৃতির বিরুদ্ধে সফল সামরিক আক্রমণ দ্বারা এদের বশ্যতা আদায় করেন। এই সকল সফল অভিযানের সূত্রে রানা কুম্ভ বিপুল সম্পদেরও অধিকারী হন।
রানা কুম্ভের সামরিক সাফল্য এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের ফলে মালব ও গুজরাটের সাথে মেবারের সংঘাত অনিবার্য হয়। হরৌতি, মান্দাসোর প্রভৃতি সীমান্তবর্তী অঞ্চল মেবার দখল করে নিলে মালবের সুলতান ক্ষুব্ধ হন এবং মেবারের অগ্রগতি রোধ করার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে মেবারের কিছু বিক্ষুব্ধ সর্দারকে এবং বিশেষভাবে মাকালের হত্যাকারী পনওয়ারকে আশ্রয় দেবার কারণে রানা কুত্তও মালবের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। যাই হোক্, মাকালের হত্যাকারীকে প্রত্যর্পণের দাবি সুলতান মামুদ খলজি প্রত্যাখ্যান করলে মেবার ও মালব যুদ্ধে নামে (১৪৩৭ খ্রিঃ)। সরঙ্গপুরের যুদ্ধে রানা কুম্ভ মালবের সুলতানকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। রাজস্থানের চারণগীতি এবং রণপুর ও কুম্ভলগড়ের লেখমালা থেকে জানা যায় যে, রানা সরঙ্গপুরকে ভস্মীভূত করেন এবং অসংখ্য যুদ্ধবন্দীসহ সুলতান মামুদ খলজিকে বন্দি করে চিতোরে নিয়ে যান। অবশ্য কিছুদিন পরে রানা মামুদকে কারামুক্ত করে স্বরাজ্য ফিরিয়ে দেন। কেউ কেউ মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত অদূরদর্শিতার নামান্তর। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই সুলতান মামুদ শক্তি সঞ্চয় করে মেবারকে বিব্রত করতে শুরু করেন। অবশ্য একাংশের মতে, মালবের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব নয় বলেই রানা এই কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাই হোক, পাঁচ বছর শক্তি সঞ্চয়ের পর মামুদ খলজি কুম্ভলগড় আক্রমণ করেন। কিন্তু রাজপুতদের প্রবল প্রতিরোধের ফলে পিছু হটে আসতে বাধ্য হন এবং বনমাতার মন্দির ধ্বংস করেন ও বিগ্রহগুলি ভস্মীভূত করেন। চিতোরের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যর্থ অভিযানের পর মালবের সুলতান সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি দখল করার চেষ্টা চালান।
মালবের মতোই রানা কুম্ভর প্রবল শত্রু ছিলেন সীমান্তবর্তী গুজরাটের সুলতান কুতুবউদ্দিন। কুতুবউদ্দিন শিরোহীর দেওরা প্রধানের সাথে মিলিতভাবে মেবার দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর মালব ও গুজরাটের শাসকদ্বয় সম্মিলিতভাবে মেবারের সীমান্ত অঞ্চলগুলি দখল করার জন্য অভিযান চালান। কিন্তু রানা কুত্তর সাহসিকতা ও রাজপুত যোদ্ধাদের বীরত্বের কাছে সুলতানি বাহিনী বার বার পরাজিত হয়।
কেবল সুযোদ্ধা নয়, উচ্চ সংস্কৃতিমনস্কতার জন্যও রানা কুম্ভর নাম ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে (“…….Kumbha, who left behind him a name which is honoured in history and is remembered to this day as one of the greatest rulers of Hindu India”Comprehensive Hist of India, Voll-V.P. 794) সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ইত্যাদি মননশীলতার নানা বিষয়ে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। তিনি গীতগোবিন্দর টীকা ‘রসিক প্রিয়া’ এবং ‘একলিঙ্গ মাহাত্ম্য’ গ্রন্থের শেষাংশ রচনা করেন। সম্ভবত তিনি চারটি নাটকও রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত, প্রাকৃত, কানাড়া, মারাঠি ইত্যাদি ভাষার ওপর তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। তিনি নিজে ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ এবং সঙ্গীতশাস্ত্রের ওপর তাঁর গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল। ‘সঙ্গীত রাজা’, ‘সঙ্গীত মীমাংসা’, ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ ইত্যাদি সঙ্গীত বিষয়ে একাধিক গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। স্থাপত্যশিল্পের প্রতিও তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাঁর উদ্যোগে একাধিক প্রাসাদ, মঠ, বিহার ও বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। চিতোরের ‘কীর্তিস্তম্ভ’ রানা কুত্তর স্থাপত্যরুচির এক অনবদ্য নিদর্শন। তাঁর উদ্যোগে শৃঙ্গারচোরী, ‘চতুর্মুখবিহার’, ‘কুম্ভশায়ম’ ইত্যাদি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। তাঁর আমলে নির্মিত একাধিক বৃহদাকার দুর্গ সেকালের বৃহৎ স্থাপত্যকর্মে শিল্পীদের দক্ষতা প্রমাণ করে। কুম্ভলগড়, অচলগড়, ভৈরত প্রভৃতি দুর্গ তাঁর আমলেই নির্মিত হয়। তাঁর রাজত্বে প্রধান স্থপতি ছিলেন মন্দন। এ ছাড়া জৈতা, পুঞ্জা, দীপ প্রমুখ শিল্পী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের এমনই পরিহাস যে, দেশপ্রেমিক, বীর যোদ্ধা, সংস্কৃতিমান রানা কুম্ভের জীবনাবসান ঘটেছিল তাঁরই পুত্র উদা’র হাতে।
উদা ছিলেন স্বৈরাচারী এবং জঙ্গি আবেগ ও উচ্চাশার অধিকারী। তাই তাঁর শাসনকাল (১৪৬৮ ‘৭৩ খ্রিঃ) ছিল সীমিত এবং সমস্যা জর্জরিত। মহান কুম্ভকে হত্যা করার জন্য কোনো অভিজাতর সমর্থন তিনি পাননি। অভিজাতরা মেবারের সিংহাসন দখল করার জন্য তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রায়মলকে আহ্বান জানান। রায়মল ১৪৭৩ থেকে ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মেবারের শাসন পরিচালনা করেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল চূড়ান্ত অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় জর্জরিত। উদা নিজ পিতাকে হত্যা করে লোভ ও অকৃতজ্ঞতার যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, রাইমলের আমলে তাই বিষফলে পরিপূর্ণ হয়। মেবার রাজপুরুষদের ষড়যন্ত্র ও সংঘর্ষের এক অন্ধকার রাজ্যে পরিণত হয়। রাইমলের চার পুত্র পৃথ্বীরাজ, জয়মল, জয়সিংহ ও সঙ্গ প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ক্ষমতাদখলের জন্য লালায়িত। এঁদের গৃহযুদ্ধ কয়েক বছর মেবারের রাজনীতিকে অস্থিরতার আবর্তে নিক্ষেপ করে। শেষ পর্যন্ত ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে সংগ্রাম সিংহ সিংহাসনে বসলে মেবারের পূর্ব গৌরব ফিরে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সংগ্রাম সিংহ’র জনপ্রিয় নাম ছিল সঙ্গ। তাঁর সিংহাসনারোহণকালে মেবার নানা সমস্যায় বিব্রত ছিল। গৃহযুদ্ধের ফলে আর্থিক ও সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। মালব, গুজরাট ও দিল্লির সুলতানেরা মেবারকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। রানা সঙ্গ দক্ষতার সাথে এই সংকটের মোকাবিলা করেন। তিনি ছিলেন “একজন বিশিষ্ট যোদ্ধা, দক্ষ সেনাপতি, উৎসাহী সংগঠক এবং হিসেবি রাজনীতিবিদ’ (“a distinguished warrior, an able general, an indesatigable organiser and a calculating politician.”)।
মেবারের অন্যতম শত্রু মালবের অভ্যন্তরীণ সংকট রানা সঙ্গের কাজ কিছুটা সহজ করে দেয়। মালবের সুলতান তাঁর অন্যতম আঞ্চলিক শাসক রাজপুত নেতা মেদিনীরাই-এর ক্ষমতাবৃদ্ধিতে কিছুটা ঈর্ষান্বিত ছিলেন। সুলতান ও মুসলিম অভিজাতরা রাজপুতদের ক্ষমতাহীন করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এই উদ্দেশ্যে সুলতান মামুদ খলজি গুজরাটের সুলতান দ্বিতীয় মুজফ্ফর শাহের সাহায্যপ্রার্থী হন। অন্যদিকে মেদিনীরাই রানা সঙ্গের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে গগরৌনের যুদ্ধে মামুদ খলজি পরাজিত ও বন্দি হয়ে চিতোরে আনীত হন। দূরদর্শী রানা সঙ্গ সুলতানকে কিছু রাজ্যের বিনিময়ে মুক্তি দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের বাতাবরণ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। রানা সঙ্গের উত্থান দিল্লির লোদী সুলতানকেও চিন্তিত করেছিল। তাই মালবের সাথে মেবারের সংঘর্ষে তিনি মেবারের বিরুদ্ধাচরণ করেন। অবশ্য রানা সঙ্গ দক্ষতার সাথে সেই সংকটের মোকাবিলা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর একটি পা বাদ যায়। তথাপি তিনি মেবারের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত মোগল নেতা বাবরের মুখোমুখি হলে তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়। বাবর উপলব্ধি করেছিলেন যে, উত্তর ভারতে মোগলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান বাধা মেবারের রানা সঙ্গ। তাই তিনি রানাকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগ নেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ‘খানুয়ার যুদ্ধে’ রানা সঙ্গ পরাজিত ও আহত হয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। তাঁর মৃত্যুর পরেও অন্তত কয়েক দশক কাল মেবার রাজস্থানের গৌরব ধরে রাখতে সচেষ্ট ছিল।
মাড়োয়ার :
রাজপুতদের আর একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী ছিল রাঠোর। মাড়োয়ারকে কেন্দ্র করে রাঠোরদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। মাড়োয়ার রাঠোরদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সূচনা করেন সেটরামের পুত্র সিহ। সম্ভবত সেটরাম ভাগ্যান্বেষণে পলি অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। বাণিজ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পলি অঞ্চলকে মীর ও মীনা উপজাতিদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে সিহ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি দখল করে রাঠোরদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে সিহর মৃত্যুর পর রাঠোরদের নেতা হন তাঁর পুত্র আস্থান। তিনিও পিতার মতো সাহসী ও উদ্যমী ছিলেন। গুহিলটদের পরাজিত করে তিনি দক্ষিণ-পশ্চিমে খেদ পর্যন্ত রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন। ভিলদের হাত থেকে ইদর জয় করেন। তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে তিনি নিহত হন (১২৯১ খ্রিঃ)। আস্থানের মৃত্যুর পর রাঠোরদের কালানুক্রম কিছুটা অস্পষ্ট। তবে তাঁর উত্তরাধিকাররা যে রাজ্যসীমা বৃদ্ধির কাজে সদা তৎপর ছিলেন, তা বোঝা যায়। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে মাড়োয়ার রাজ্যের সম্প্রসারিত রাজ্যসীমা তা প্রমাণ করে। আস্থানের জ্যৈষ্ঠ পুত্র রাওধুহ প্রায় দেড়শো গ্রাম জয় করেছিলেন। ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে পরিহারদের সাথে এক সংঘর্ষে তিনি প্রাণ হারান। কিন্তু তাঁর পুত্র রাও রায়পাল পরিহারদের পরাস্ত করে মান্দোর দখল করেন এবং কিছুকাল নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। পারমারদের পরাজিত করে তিনি মল্লানি অঞ্চল জয় করেন। ভাট্টি রাজপুতদের পরাস্ত করে তিনি জয়শলমীরের দিকেও রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেন। তাঁর উত্তরাধিকারী রাওকর্নপল ভাট্টি ও তুর্কিদের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারান। পরবর্তী শাসক ভীম ভাট্টিদের পরাজিত করে কাক নদীর তীর পর্যন্ত মাড়োয়ারের রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেন।
ভীমের ভাই রাওজানালসি সামরিক দক্ষতা দ্বারা রাঠোরদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করেন। তিনি যোধা রাজপুত, মুলতানের মুসলিম শাসক এবং ভিনমলের শোলাঙ্কিদের পরাজিত করেন। তবে ভাট্টি ও তুর্কিদের যৌথ আক্রমণে আনুমানিক ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হন। তাঁর পুত্ররাও তুর্কিদের হাতে নিহত হন। জালানসির জনৈক পৌত্র মল্লিনাথ মুসলমানদের অধিকার থেকে মাহেভা দখল করতে সক্ষম হন এবং ‘রাওয়াল’ উপাধি নেন।
মান্দোরে রাও চণ্ডর নেতৃত্বে (১৩৮৪-‘১৪২৪ খ্রিঃ) রাঠোরদের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর রাজধানী মান্দোরের ওপর গুজরাটের শাসক জাফর খানের আক্রমণ তিনি দক্ষতার সাথে প্রতিহত করেন (১৩৯৬ খ্রিঃ)। দিল্লি-সুলতানির দুর্বলতার সুযোগে খাটু, দিওয়ান, সম্ভোর, নবগৌর ও আজমির তিনি দখল করে নেন। চৌহান রাজপুতদের হাত থেকে নাদোলও তাঁর দখলে আসে। তুর্কিদের বিরুদ্ধে নিজ ভাই জয়সিংহের সাহায্য না পাওয়ায় চণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই ১৪১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি জয়সিংহের রাজ্যাংশ ফালোদি দখল করে নেন। কিন্তু তাঁর দ্রুত ক্ষমতা বৃদ্ধি স্বজাতীয় ও অন্যান্য শাসকদের ঈর্ষান্বিত করে। ফলে রাজপুত ভাট্টি, সাংখালা গোষ্ঠী এবং মুলতানের মুসলিম গভর্নর মিলিতভাবে নাগৌর আক্রমণ করেন এবং বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা তাঁকে হত্যা করে (১৪২৩ খ্রিঃ)। নিজামীর মতে, চণ্ডর নেতৃত্বে মাড়োয়ার রাজ্য মর্যাদাকর স্থানে উন্নীত হয়েছিল।
চণ্ডর জ্যেষ্ঠপুত্র রাও রণমল মেবারে চলে গেলে রাও কানা ও রাও সট্রা মাড়োয়ার শাসন করেন। এঁদের স্বল্প শাসনকালে মাড়োয়ার রাজ্য তার অর্জিত গৌরব কোনোক্রমে টিকিয়ে রাখে। রাও রণমল মেবারে চক্রান্তকারীদের হাতে নিহত হলে তাঁর পুত্র যোধা চিতোর ছেড়ে মাড়োয়ারে ফিরে আসেন। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে মান্দোর দখল করে তিনি মাড়োয়ারের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করেন। মেরতা, ফালোদি, পোান, ভদ্রযান, সোজাত, শিবা, সিওয়ানসহ গোদওয়াদ ও নাগউর-এর বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে তিনি মাড়োয়ার রাজ্যের সংহতি দৃঢ় করেন। প্রতিবেশী উপজাতি শাসকদের ধ্বংস করে উত্তরদিকে হিসার পর্যন্ত এলাকা তিনি দখল করে নেন। বিভিন্ন অঞ্চলে নিজপুত্রদের শাসক নিযুক্ত করে তিনি হাত শক্ত করেন। তাঁর জনৈক পুত্র বিকা জঙ্গলদেশে গিয়ে স্বতন্ত্র বিকানীর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতা সুদৃঢ় করার জন্য যোধা ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে যোধপুর দুর্গ ও শহর প্রতিষ্ঠা করেন। যোধার নেতৃত্বে মাড়োয়ারের রাজনৈতিক মর্যাদা প্রতিপত্তি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, মেবারের রানা কুম্ভ, তাঁর পুত্র উদা প্রমুখ যোধার সাথে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর দীর্ঘ চার দশকের ব্যস্ততম রাজনৈতিক জীবন শেষ হয় ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে। অতঃপর রাও শতল (১৪৮৯-‘৯২ খ্রিঃ) রাও সুজা (১৪৯২-১৫১৫ খ্রিঃ), রাও গঙ্গা (১৫১৫-৩২ খ্রিঃ) প্রমুখ মাড়োয়ার শাসন করেন।
আগেই বলা হয়েছে যে যোধার পঞ্চমপুত্র বিকা জঙ্গলদেশ দখল করে বিকানীর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি দক্ষিণদিকে সিরসা, লানু, ভানার ভাতিন্দা, সিংহানা, নোহার, পুগাল প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে পাঞ্জাব-সীমানা পর্যন্ত রাজ্য সম্প্রসারিত করেন। পরবর্তী শাসক বিকার জ্যেষ্ঠপুত্র রাও নারা সিংহাসন আরোহণের কয়েক মাসের মধ্যে মারা গেলে, সিংহাসনে বসেন নারার ভাই রাও লুনাকর্ণ (১৫০৫-‘২৬ খ্রিঃ)। তিনি জয়শলমির দুর্গ আক্রমণ করে প্রচুর অর্থসম্পদ লুঠ করেন। কাঁঠালিয়া, দিওয়ান্, ভগভ, নরহদ্, সিংঘানা প্রভৃতি এলাকা তিনি দখল করেন। শিল্পসাহিত্যের অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল।
চৌহান বংশ :
সাহসিকতা ও সাম্রাজ্যের বিশালতার বিচারে রাজপুতদের চৌহান গোষ্ঠীর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চৌহানদের অনেকগুলি গোষ্ঠী উত্তর ভারতের পশ্চিমের সমভূমি অঞ্চলে একাধিক রাজ্য স্থাপন করেছিল। যেমন—সত্তর, রণথম্ভোর, ভৃগুচ্ছ, নাদোল, জালোর প্রভৃতি। এদের মধ্যে সম্ভরের চৌহানদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বেশি। প্রতিহারদের উপসামন্ত হিসেবে এই গোষ্ঠীর উত্থান শুরু হয়। দশম শতকে চৌহান নেতা দ্বিতীয় বিগ্রহরাজ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। একাদশ শতকের শেষদিকে রাজস্থানের কেন্দ্রস্থল আজমিরে চৌহানদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে। ১১৬৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পূর্ব পাঞ্জাব, রেওয়ারী ও উত্তর-পূর্ব রাজস্থান চৌহানদের দখলে চলে আসে। কার্যত তাদের রাজ্যসীমা হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এই কারণে চৌহানরা কার্যত উত্তর পশ্চিম ভারতের দ্বাররক্ষীতে পরিণত হয় এবং পাঞ্জাবের গজনি রাজ্য ও অবশিষ্ট রাজস্থানের মধ্যে একটি প্রাচীর হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে।
চৌহান বংশের গৌরবরশ্মি উজ্জ্বলতর হয় তৃতীয় পৃথ্বীরাজের আমলে (১১৮০-৯২ খ্রিঃ)। ভাঙনদের পরাজিত করে তিনি রেওয়ার তহশিল, ডিওয়ানী ও আলওয়ারের একাংশ দখল করেন। কনৌজরাজ জয়চন্দ্র ও পৃথ্বীরাজের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়েছিল। কিংবদন্তী অনুসারে কনৌজের রাজকন্যা সংযুক্তাকে বিবাহ করার কারণে পৃথ্বীরাজের প্রতি জয়চন্দ্র ক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। রাজপুতদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে মহম্মদ ঘুরি ভারত সীমান্তে প্রবেশ করলে রাজপুত রাজারা প্রথমে তা প্রতিহত করেন (১১৭৮ খ্রিঃ)। কিন্তু এই যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তাবশত নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। বস্তুত, তাঁর এই সংকীর্ণ ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা ও চৌহানদের গৌরবের পক্ষেই চরম ক্ষতিকর ছিল। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে’ (১১৯১ খ্রিঃ) পৃথ্বীরাজ কোনোক্রমে বিজয়ী হলেও পরের বছরেই দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরির কাছে পরাজিত ও বন্দি হন। আজমির ও দিল্লি থেকে চৌহান রাজত্বের অবসান সামগ্রিকভাবে রাজপুত জাতির মর্যাদা ও প্রতিপত্তির ওপর আঘাত হানে এবং উত্তর ভারতের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত রাজপুত সাম্রাজ্যবাদের পতন সূচিত করে।
আজমির হস্তগত হওয়ার পর পৃথ্বীরাজের পুত্র গোবিন্দরাজ রাজস্থানের রণথম্ভোরে এসে চৌহান শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। গোবিন্দরাজের মৃত্যুর পর চৌহানরা আবার দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁর পুত্র বল্হন্ কিছুকাল সুলতান ইলতুৎমিসের অধীনে সামন্ত হিসেবে রাজ্যশাসন করে। তাঁর মৃত্যুর পর আবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চৌহানদের দুর্বল করে তোলে এবং এই সুযোগ নেন ইলতুৎমিস। সুলতানের এক সেনাপতি বল্হনের ভাই প্রহ্লাদের পুত্র বাগভট্টকে পরাজিত করে রণথম্ভোর দুর্গ দখল করে নেন। অবশ্য কিছুকালের মধ্যেই বাগভট্টের উত্তরাধিকারী জৈত্র সিংহ রণথম্ভোর পুনরুদ্ধার করে চৌহানদের পূর্ব গৌরব কিছুটা পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তুর্কিদের পুনঃপুন আক্রমণে বিব্রত হয়ে তিনি নিজপুত্র হামিরদেব (হাম্বিরদেব)-কে সিংহাসনে বসিয়ে (১২৮৩ খ্রিঃ) বনবাসে চলে যান। ১২৮৩ থেকে ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময় তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন। একজন উদ্যমী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে তিনি ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। একের পর এক সফল সামরিক অভিযান চালিয়ে তিনি নিজ রাজ্যকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। প্রথমেই তিনি সরসাপুরের রাজা অর্জুনকে হারিয়ে তাঁর বশ্যতা আদায় করেন। বীর-এর রাজা ভোজ, মেবারের রানা এবং আবু পর্বতের প্রধানকে পরাস্ত করে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। মালব ও মেবারের একাধিক শাসক ও সামন্ত তাঁর বশ্যতা মেনে তাঁকে নিয়মিত উপঢৌকন দিতে রাজি হন। হামিরদেবের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে সুলতান জালালউদ্দিন খলজি তাঁর রাজ্য আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সেই অভিযান শেষ পর্যন্ত তিনি বাতিল করে দেন। এই ঘটনা হামিরদেবের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। আলাউদ্দিন খলজির আমলে কিন্তু বিদ্রোহী নব-মুসলমান (পরাজিত মোঙ্গলদের অনেকেই দিল্লি-সুলতানের বশ্যতা মেনে ‘নব-মুসলমান’ নামে দিল্লিতে ছিলেন) হামিরদেবের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সুলতানি বাহিনী রণথস্তোর আক্রমণ করে। রানা হামির ও তাঁর অনুগামীরা প্রাণপণে প্রতিরোধ চালিয়ে যান। দীর্ঘ অবরোধের পর সুলতান আলাউদ্দিন ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোর দখল করতে সক্ষম হন। রানা হামিরদেব ও তাঁর অনুগামীদের প্রায় সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। রাজপুত রমণীরা তাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য অনেকেই জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে (জৌহর ব্রত) প্রাণ বিসর্জন দেন। হামিরদেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রণথভোরের চৌহানবংশের গৌরবরশ্মিও অস্তমিত হয়। রাজস্থানের ইতিহাসে কেবল একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে নয়; ধর্মসহিষ্ণুতার কারণেও হামিরদেবের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে।
চৌহানদের ‘দেওরা’ গোষ্ঠীর নেতা থুম্বা ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে পারমারদের কাছ থেকে আবু ও চন্দ্রাবতী পর্বত দখল করে স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে থুম্বা মারা যান। তাঁর পরবর্তী পাঁচজন শাসকের রাজত্ব সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। এই পর্বে অচলেশ্বর মন্দিরের নবরূপায়ণ করা হয়। এঁরা কখনো চন্দ্রাবতী আবার কখনো আবু পর্বতের চার মাইল উত্তরে অচলগড়ে রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব চালনা করেন। এই গোষ্ঠীর জনৈক বংশধর শিবভান শিরওয়ানা পাহাড়ের চূড়ায় শিবপুরীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন (১৪০৫ খ্রিঃ)। তাঁর পুত্র শাহশমল ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে সিরোহীতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এর ফলে গুজরাটের শাসক আহমেদ শাহ’র আক্রমণ থেকে রাজপুতরা নিরাপদ দূরত্বে সরে আসতে সক্ষম হন।
শাহশমল সাম্রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী ছিলেন। শোলাঙ্কিদের রাজ্যের একাংশ দখল করে তিনি চৌহানদের রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন। মেবারের রানা কুম্ভ তখন স্থানীয় বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে শাহশমল মেবারের সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটান। কিন্তু রানা কুম্ভ তাঁর সেনাপতিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে আবু পাহাড়, বসন্তগড় ও ভুলা দখল করে এবং সিরোহী রাজ্যের পূর্বপ্রান্তে মেবারের আধিপত্য সম্প্রসারিত করেন (১৪৩৭ খ্রিঃ)। এই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পরবর্তীকালে অচলগড় দুর্গ, কুত্তস্বামী মন্দির এবং একটি বৃহৎ জলাশয় ও প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তবে শাহশমলের পুত্র ও উত্তরাধিকারী লখার হাতে রানা কুম্ভের পুত্র উদা আবু পুনঃহস্তান্তর করেন। লখা ছিলেন ‘প্রজাদরদী ও জ্ঞানদীপ্ত শাসক’ (‘a benerolent and enlightened ruler’)। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সময় যে সকল মানুষ রাজ্য ছেড়ে গিয়েছিলেন, তিনি তাদের ফিরে আসার আহ্বান জানান। সৃষ্টির কাজেও তিনি দক্ষতা দেখান। তিনি ‘কালিকামাতা’র মন্দির ও ‘লাখেলাও’ সরোবর নির্মাণ করে কৃতিত্ব দেখান। লখার পুত্র ও পরবর্তী শাসক জয়মল ছিলেন উচ্চাভিলাষী। দিল্লির সুলতান বহলুল লোদীকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে তিনি ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে মেবারের রানা রায়মলের সাথে হাত মেলান। জালোরের শাসক মজিদ খানকে বন্দি করে তিনি কৃতিত্ব দেখান। পরে প্রচুর অর্থের মুক্তিপণের বিনিময়ে মজিদ খানকে ছেড়ে দেন।
ক্রমে পারিবারিক বিবাদ সিরোহীতে সংকট ঘনীভূত করে। জগমলের ভাই হামির রাজ্যের কিছুটা দখল করে স্বাধীন শাসন কায়েম করতে চাইলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে হামির পরাজিত ও নিহত হন। কিন্তু রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকে। এই সময় দিল্লি থেকে আমেদাবাদের দিকে যাওয়ার সময় সিরোহীর কাছে বহু উন্নতমানের অশ্ব লুণ্ঠিত হয়ে যায়। অশ্বগুলি সম্ভবত গুজরাটের শাসক মামুদ শাহ বেগরহার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হচ্ছিল। এখন সুলতান মামুদ শাহ সমস্ত অশ্ব ফিরিয়ে দেবার দাবি করেন, অন্যথায় শিরোহী আক্রমণের হুমকি দেন। রানা জগমল চাপের মুখে পড়ে সকল অশ্ব ফেরত দেবার বন্দোবস্ত করেন। এতে শিরোহীর রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।
১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে জগমলের পুত্র প্রথম আখেরাজ শিরোহীর সিংহাসনে বসেন। যুদ্ধে তাঁর ক্ষিপ্রতার জন্য রাজস্থানের চারণ কবিরা তাঁকে ‘উড়ানা আখেরাজ’ (‘the flying Akheraj’) নামে সম্বোধিত করে বহু লোকগীতি রচনা করেন। তিনি উত্তর-পশ্চিম মুখে অভিযান চালিয়ে যোধপুরের লোহিয়ানাতে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। রানা সঙ্গের সহযোগীরূপে আখেরাজ বাবরের বিরুদ্ধে খানুয়ার যুদ্ধেও অংশ নেন। ‘মহারাজশ্রী’ উপাধি গ্রহণ তাঁর সামরিক কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর শিরোহীর চৌহানদের গুরুত্ব দ্রুত কমতে থাকে।
হাড়াবতী :
বুন্দী ও কোটা জনপদ দুটি সমন্বিত করে হাড়াবতী রাজ্য গড়ে উঠেছিল। চৌহান বংশের হাডাগোষ্ঠীর নেতা দেব সিংহ উসারা উপজাতিদের পরাস্ত করে বুন্দীতে হাডাবতী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন (১২৪১ খ্রিঃ)। তিনি গজমল, মনোহর দাস, জসকরণ ও অন্যান্যদের পরাজিত করে খতপুর, পাটন ও কারওয়ার দখল করেন। গোন্দ উপজাতিকে পরাজিত করে জেনোলি দখল করে ছিলেন বলে মনে করা হয়। ‘লাখেরীর যুদ্ধে’ তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। শক্তির উপাসক হিসেবে তিনি ‘গঙ্গেশ্বরীর মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দে পুত্র সমর সিংহকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি অবসর জীবনযাপন করেন।
সমর সিংহও সুযোদ্ধা ও সংগঠক ছিলেন। তিনি ভিল উপজাতির কোটিয়া গোষ্ঠীকে পরাজিত করে তাদের মুল ঘাঁটি আকালগড় ও মুকন্দরা ধ্বংস করে দেন। পরে এই দুই স্থানে হাডাবতী রাজ্যের সামরিক দুর্গ গড়ে তোলা হয়। এই যুদ্ধে সমর সিংহের পুত্র জৈত্র সিংহ মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাই সমর সিংহ ১২৭৪ খ্রিস্টাব্দে জৈত্ৰ সিংহকে এই অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন। জৈত্র সিংহ গোদ্, পনওয়ার ও মেদ্ গোষ্ঠীর রাজপুতদের পরাজিত করে কৈথুন, শিশোয়ালী, বরোদ, রেইলান, রামগড় প্রভৃতি স্থান নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। ফলে বুন্দী ও কোটাজেলার বিস্তীর্ণ অংশে হাড়াবতী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে তুর্কিদের আক্রমণের বিরুদ্ধে (১২৫২-৫৩ খ্রিঃ) সমর সিংহ বুদী ও রণথস্তোরের স্বাধীনতা রক্ষা করেন। তবে আলাউদ্দিন খলজির আক্রমণকালে বম্বাভাড়া দুর্গে প্রতিরোধকালে তিনি বীরের মৃত্যুবরণ করেন। সমর সিংহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন নপুজী। তিনিও শোলাঙ্কিদের পরাজিত করে পলাইথা ও টোডা দখল করেন। শোলাঙ্কিদের সাথে যুদ্ধে জৈত্র সিংহ মারা গেলে উত্তরে টোডা ও দক্ষিণে পাটন পর্যন্ত নিজ শাসন সম্প্রসারিত করেন। সম্ভবত আলাউদ্দিনের সাথে এক যুদ্ধকালে তিনি নিহত হন (১৩০৪-১৩০৫ খ্রিঃ)। তাঁর মৃত্যুর পর হাড়াবতী রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
রাজপুত সংস্কৃতি :
ভারতীয় বৈদেশিক জাতি, আদিম উপজাতি এবং ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে মিলন ও মিশ্রণের ফলে রাজপুত জাতির উদ্ভব হওয়ায় তাদের সমাজ সংগঠন ও সংস্কৃতির ওপর ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যগুলির প্রভাব ছিল সর্বাধিক। কোনো কোনো শাখার মধ্যে বৈদেশিক উপাদান বেশি ছিল, আবার অন্য শাখার ক্ষেত্রে কোথাও কৌম (উপজাতি) উপাদান কোথাও বা ভারতীয় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় উপাদানের অধিক প্রকাশ দেখা যায়।
রাজপুত সমাজের ভিত্তি ছিল গোষ্ঠী। প্রতিটি গোষ্ঠী বাস্তব বা কাল্পনিক একজন ধর্মীয় বা ঐতিহাসিক পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই রাজপুতদের গোষ্ঠীচেতনা ছিল প্রায় সার্বিক। গোষ্ঠীগুলি এক একটি বিশেষ এলাকায় নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করত। গোষ্ঠীনেতা ছিলেন শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে। কর্মসূত্রে অন্য গোষ্ঠীর লোক ওই অঞ্চলে অবস্থান করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ওই বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্যরাই। রাজপুতদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি। তবে ভূমির অধিকার ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিকতার প্রভাব ছিল স্পষ্ট। ঐতিহাসিক টড (Tod) তাঁর ‘Annals and Antiquities of Rajasthan’ গ্রন্থে রাজস্থানে মধ্যযুগীয় ইউরোপের অনুরূপ সমস্ত প্রথা বিরাজমান ছিল বলে মন্তব্য করেছেন। তবে মধ্যযুগের সূচনাপর্বে রাজস্থানের ভূমিব্যবস্থা ও ভূমিসম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয় মডেলের ছিল না। মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল জমির মালিক ছিলেন রাজা এবং তিনি অনুগত ব্যক্তিদের মধ্যে নির্দিষ্ট সেরা ও আনুগত্যের বিনিময়ে ভূমিবণ্টন করতেন। কিন্তু রাজস্থানের ব্যবস্থা ছিল স্বতন্ত্র। রাজপুত জাতির বিকাশের পূর্বে জমির মালিকানা ছিল গোষ্ঠীর (clan) হাতে। রাজা গোষ্ঠীর প্রধান হলেও, এককভাবে জমির ওপর তাঁর অধিকার স্বীকৃত ছিল না। ভূমিস্বত্ব ভোগ করত যৌথভাবে সমগ্র গোষ্ঠী। যেমন—মেবারে জমির স্বত্ব ছিল গুহিলট গোষ্ঠীর, মাড়োয়ারে ভূমিস্বত্ব ছিল রাঠোর গোষ্ঠীর ইত্যাদি। রাজা ও গোষ্ঠীর প্রধানরা নিজ নিজ বংশগত অধিকারে ভূমিস্বত্ব লাভ করতেন। ভূমিস্বত্ব লাভের ক্ষেত্রে রাজার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো ভূমিকা ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে গোষ্ঠীর পরিবর্তে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ক্রমশ স্বীকৃতি পায়। শাসকশ্রেণি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ বা মন্দির কর্তৃপক্ষকে নিষ্কর ভূমিদান শুরু করেন। আবার শাসনকার্যে সহায়তা ও সামরিক সাহায্যদানের শর্তে ব্যক্তির মধ্যে ভূমিবণ্টন করতে থাকেন। এইভাবে ‘সামস্ত’ বা মধ্যস্বত্ব- ভোগী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। প্রধান সামন্তরা তাঁর অধীনস্থ জমি উপসামন্তদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। উপসামন্তরা আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে তাঁর জমি ভাগ করে দিতেন রাজপুত যোদ্ধাদের মধ্যে। জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে অবশ্যই গোষ্ঠীভুক্ত লোকেদের প্রাধান্য দেওয়া হত। জেমস টড্ দেখিয়েছেন যে, মেবারের ভূস্বামীদের দুটি অংশ ছিল ‘গ্রাস্য ঠাকুর’ (Lord) এবং ‘ভূঁইয়া’ (Bhoomia)। প্রথমোক্তরা রাজার কাছে থেকে ভূমিদান গ্রহণ করেন এবং বিনিময়ে ঘরে-বাইরে তাঁকে সেবা দেন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই অধিকার নবীকরণ করতে হত। অন্যদিকে ভূঁইয়া শ্রেণি ধারাবাহিকভাবে জমির স্বত্ব ভোগ করতেন। এঁরা আঞ্চলিক স্তরে সরকারকে সেবা দিতে দায়বদ্ধ থাকতেন।
সাধারণভাবে রাজস্থানে কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা দেশের অবশিষ্ট অংশের তুলনায় ভালো ছিল না। ভূমি, পরিবার ও আত্মমর্যাদার প্রতি সচেতন রাজপুত্র জাতিও সাধারণ কৃষকের প্রতি ছিল দয়ামায়াহীন। প্রধান সামন্ত হতেন মূলত প্রধান শাসক বা গোষ্ঠীপ্রধানের নিকট আত্মীয়রা। রাজপুত আদর্শ অনুসারে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে রাজা সাধারণভাবে কোনো সামন্তকে বন্দোবস্ত দেওয়া জমি পুনর্গ্রহণ করতেন না। কিন্তু কৃষকদের ক্ষেত্রে এই নীতি বা আদর্শবাদ মান্য হত না। সামন্তদের অধীন কৃষকদের কোনোরূপ অধিকার বা স্বাধীনতা স্বীকৃত ছিল না। ভূস্বামী নিজের ইচ্ছামতো কৃষকদের ভূমি বন্দোবস্ত দিতেন এবং উৎখাতও করতে পারতেন। কৃষকের কাছে কর আরোপ এবং তা আদায়ের কাজেও সামন্তপ্রভুর ইচ্ছা-অনিচ্ছা চূড়ান্ত ছিল। ফলে মধ্যযুগের ইউরোপে জমির সাথে কৃষকের অচ্ছেদ্য বন্ধন বিষয়টিকে বাদ দিলে মধ্যযুগের রাজপুতানায় কৃষকদের অবস্থা ‘সার্ফ’ বা ভূমিদাসদের সমতুল্যই ছিল।
রাজপুত সমাজব্যবস্থায় জাতিভেদ ও বর্ণাশ্রম প্রথা যথেষ্ট জনপ্রিয় ও কার্যকরী ছিল। চারটি প্রধান বর্ণ ছাড়াও কিছু উপবর্ণের সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের কর্তৃত্ব ও মর্যাদা ছিল অন্যান্যদের তুলনায় বেশি। বর্ণব্যবস্থার তৃতীয় স্থানভুক্ত বৈশ্যরা প্রথমদিকে কৃষিকার্যে লিপ্ত ছিলেন। পরে এঁরা কৃষিকার্য ছেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকে জীবিকা রূপে গ্রহণ করেন। রাজপুত সমাজে নারী বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। পর্দাপ্রথার প্রচলন ছিল। তবে পরিবারের সদস্যদের কাছে নারীর মর্যাদা স্বীকৃত ছিল। শিক্ষালাভ করে নারী তার সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারতেন। জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার সীমিত অর্থে স্বীকৃতি ছিল। আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অতি-সচেতনতা ছিল রাজপুত রমণীর বৈশিষ্ট্য। সম্ভ্রম রক্ষার জন্য তাঁরা সানন্দে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে (জৌহর ব্রত) প্রাণ বিসর্জন দিতে পারতেন। অস্ত্রচালানো, শিকারযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রায় নারীর অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
Leave a comment