প্রথম নরসিংহবর্মন (৬৩০-৬৬৮ খ্রিঃ):
মহেন্দ্রবর্মনের মৃত্যুর পর পল্লববংশের সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মন (৬৩০-৬৮ খ্রিঃ)। তাঁর নেতৃত্বে পল্লবরাজ্য গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করেছিল। এজন্য তাঁকে পল্লববংশের ‘শ্রেষ্ঠ রাজা’ বলা হয়। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চালুক্যদের পরাজিত করে তিনি বংশের মানমর্যাদা ও শক্তিবৃদ্ধি করেছিলেন।
ড. মহালিঙ্গম্ মনে করেন যে, নরসিংহবর্মন তাঁর রাজত্বের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। ৬৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইহোল লিপিতে এই পরাজয়ের বিবরণ আছে। সমকালীন পল্লব লেখগুলিতে এই প্রসঙ্গে কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। সম্ভবত পরাজয়ের গ্লানি তাঁরা লিপিবদ্ধ করতে চাননি। এই অভিযানে জয়লাভ করে দ্বিতীয় পুলকেশী পল্লবদের অধীনতা থেকে চোলদের মুক্ত করেন এবং সম্ভবত পল্লবদের অধীনস্থ সামন্ত তেলেগু-চোড় রাজ্যও পল্লবদের অধিকারমুক্ত হয়েছিল। এই সময়ে উত্তর দাক্ষিণাত্যে পূর্ব চালুক্যরাজ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নরসিংহবর্মন এই সুযোগে পূর্ব চালুক্যরাজ্য আক্রমণ করলে দ্বিতীয় পুলকেশী পুনরায় তাঁকে বাধা দেন। কিন্তু এবারে নরসিংহবর্মন দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে প্রকৃত বীরত্বের পরিচয় দেন। চালুক্যরাজ চোলদের সাথে মিত্রতা করে তুঙ্গভদ্রা অতিক্রম করে পল্লবরাজ্য আক্রমণ করেন। কিন্তু নরসিংহবর্মন মণিমঙ্গলমের যুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশীকে পরাজিত করে পিছু হঠতে বাধ্য করেন। তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে নরসিংহ তুঙ্গভদ্রা অতিক্রম করে পারিয়ালের যুদ্ধে চালুক্যরাজকে পুনরায় পরাজিত করেন এবং বাতাপি দখল করেন (৬৪২ খ্রিঃ)। নগরটি তিনি অগ্নিদগ্ধ করেন এবং নিজের বিজয়স্তম্ভ প্রোথিত করেন। তার উপাধি হয় ‘বাতাপিকোণ্ড’। সম্ভবত এই যুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশী নিহত হয়েছিলেন, কারণ এর পর তাঁর নাম আর শোনা যায়নি। বাতাপি কতদিন পল্লবদের অধিকারে ছিল, তা সঠিক জানা যায় না। তবে দ্বিতীয় পুলকেশীর আকস্মিক মৃত্যু এবং বিদেশী শক্তির রাজধানী দখলের ঘটনা চালুক্যদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল। এই সুযোগে একাধিক চালুক্য-সামন্ত বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। অবশ্য নরসিংহবর্মনের রাজত্বের শেষদিকে প্রথম বিক্রমাদিত্যের নেতৃত্বে চালুক্যশক্তির পুনরুত্থান ঘটেছিল। এই সময়ে নেলোর, কুরনুল প্রভৃতি অঞ্চল পুনরায় পল্লবদের অধিকার থেকে চালুক্যদের অধিকারে এসেছিল।
প্রথম নরসিংহবর্মনের আর একটি সামরিক কৃতিত্ব হল সিংহলে সফল অভিযান। ‘মহাবংশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, সিংহলের যুবরাজ মানবর্মার সাহায্যে নরসিংহ সিংহলে দুটি নৌ-অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। প্রথম অভিযান প্রেরিত হয়েছিল ৬৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় অভিযানে (৬৬৮ খ্রিঃ) তিনি সফল হন এবং সিংহলের অনুগত মানবর্মাকে বসিয়ে সেখানে নিজ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন।
কেবল বিজেতা নয়, শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও প্রথম নরসিংহবর্মনের খ্যাতি ছিল। মহাবলীপুরমে তিনি কয়েকটি রথ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তখন মহাবলীপুরম্ ছিল দক্ষিণ-ভারতের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর। তাঁর রাজত্বকালে হিউয়েন-সাঙ কাঞ্চী এসেছিলেন (৬৪০ খ্রিঃ)। ছয় মাইল পরিধির এই শহরে তিনি বহু বৌদ্ধমঠ ও জৈন মন্দির লক্ষ্য করেছিলেন। এইসব মঠে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু বসবাস করতেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অবক্ষয়ের কালেও দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল। সংস্কৃত শিক্ষার পীঠস্থান হিসেবে কাঞ্চী খ্যাতিলাভ করেছিল। এগুলি তাঁর সাহিত্যানুরাগ ও ধর্মীয় উদারতার পরিচায়ক।
পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় মহেন্দ্রবর্মন অত্যন্ত স্বল্পকাল (৬৬৮-৭০ খ্রিঃ) রাজত্ব করেন। এরপর রাজা হন প্রথম পরমেশ্বরবর্মন। ‘‘চালুক্য লেখ’ থেকে জানা যায়, চালুক্যরাজ প্রথম বিক্রমাদিত্য পল্লবরাজ্য আক্রমণ করেন। তিনি কাঞ্চীপুরমের কাছাকাছি উপস্থিত হলে পরমেশ্বর পলায়ন করতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধে সম্ভবত গঙ্গগণ চালুক্যদের সহায়তা করেছিল। তাই পরমেশ্বর, বিক্রমাদিত্য নিজরাজ্যে ফিরে যাবার পর, রাজধানীতে ফিরে এসে গঙ্গদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অবশ্য গঙ্গদের বিরুদ্ধে তিনি তেমন কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। তবে এতে হতাশ না হয়ে তিনি চালুক্যদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন ও পেরুবলনাল্লুরের যুদ্ধে বিক্রমাদিত্যকে পরাজিত করেন। কৈলাসনাথ মন্দির লেখ থেকে জানা যায় যে, তিনি নতুন চালুক্য রাজধানী রণরসিক ধ্বংস করেন। চালুক্য ছাড়াও পাণ্ড্যদের বিরুদ্ধেও পরমেশ্বর যুদ্ধে লিপ্ত হন। পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় নরসিংহবর্মন রাজসিংহের (৬৯৫-৭২২ খ্রিঃ) রাজ্যকাল মোটামুটি শান্তিতে অতিবাহিত হয়েছিল বলেই মনে হয়। চৈনিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি চীনে দ্রুত পাঠান। তিনি ছিলেন শৈব। তাঁর আমলেই কৈলাসনাথের মন্দির, মহাবলীপুরমের মন্দির ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় নরসিংহবর্মনের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মন। তাঁর রাজত্বের শেষদিকে চালুক্যগণ পল্লবরাজ্য আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে গঙ্গরাজ চালুক্যদের সাহায্য করেন, ফলে পরমেশ্বর গঙ্গরাজ্যে অভিযান করেন। সম্ভবত গঙ্গদের সঙ্গে যুদ্ধেই তিনি নিহত হন। এই অবস্থায় পল্লবদের অপর শাখার নন্দীবর্মন (দ্বিতীয়) সিংহাসনে বসেন। তিনি দীর্ঘ ৬৫ বছর (৭৩০-৭৯৫ খ্রিঃ) রাজত্ব করেছিলেন। তবে তাঁর রাজ্যকাল শাস্তিতে অতিবাহিত হয়নি। প্রথমেই সিংহাসনের অপর দাবিদার চিত্রমায়ার পক্ষ নিয়ে পাণ্ড্যরাজ পল্লবরাজ্য আক্রমণ করেন। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যও কাঞ্চী আক্রমণ করেন ও চিত্রমায়াকে পল্লব সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। নন্দীবর্মন রাষ্ট্রকুটরাজ দস্তিদুর্গের কাছে অশ্রয় নেন। পরিশেষে দস্তিদুর্গের সহায়তায় তিনি সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। এরপর চালুক্য যুবরাজ কীর্তিবর্মন পুনরায় পল্লব রাজ্য আক্রমণ করেন ও নন্দীবর্মনকে পরাজিত করেন। তবে এরপর চালুক্যগণ কিছুটা দুর্বল হয়ে গেলে দীর্ঘস্থায়ী পল্লব-চালুক্য দ্বন্দ্বের তীব্রতাও ক্রমশই কমে আসে। নন্দীবর্মন পাণ্ড্য, চের ও গঙ্গদের পরাস্ত করেছিলেন বলে জানা যায়। নন্দীবর্মনের পর থেকে পল্লবশক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন অপরাজিতবর্মন। চোলবংশীয় আদিত্য চোল তাঁকে পরাজিত করে পল্লবরাজ্য দখল করলে পল্লবশাসনের সমাপ্তি ঘটে (৮৯১ খ্রিঃ)।
Leave a comment