কোন একটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গল্প বা উপন্যাস গড়ে উঠলেই তাকে রিজিওন্যাল বা আঞ্চলিক সাহিত্যের আখ্যা দেওয়া যায় না। উপন্যাসিকের আগ্রহ প্রধানত মানুষ ও মানুষের জীবন। আর এই মানুষকে ঔপন্যাসিক দেশ কালের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেন। তাই কথাসাহিত্যে আঞ্চলিকতার উপাদান থাকে বেশি। আঞ্চলিক উপন্যাসের জন্ম তখনই হয় যখন কোন বিশেষ অঞ্চলের পটভূমিতে সেখানকার মানুষের জীবন চিত্রিত হয় বা একটা বিশেষ অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি সেখানকার মানুষের চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে এই বিশেষ অঞ্চলই গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চল সেখানে আর পাঁচটা প্রভাবের মতো সকলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আসে না, আলাদা করে নিজের কথাই বলে। একটা স্থানের জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতির স্বাতন্ত্র্যতার শক্তি এমনই কাহিনী, পাত্র-পাত্রী, উপন্যাসের পরিণাম, সমস্ত কিছুই তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আব্রাহাম এই শ্রেণীর উপন্যাসের পরিচয় দিতে গিয়ে এর স্বরূপ উদঘাটন করেছেন-
“The regional novel emphasizes the setting, speech and customs of a particular locality, not merely as local colour, but as important condition’s affecting the temperament of characters and their way of thinking, feeling and acting.” অর্থৎ কোন বিশেষ অঞ্চলের যা বৈশিষ্ট্য তা যদি চরিত্রগুলি আত্মসাৎ করে এবং তারাই যদি উপন্যাসে বিচরণ করে অঞ্চলটির প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে অঞ্চলটিই বিশেষভাবে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে অবশ্য আরো একটু সতর্ক হয় যে, শুধুমাত্র নিখুঁত অঞ্চল বর্ণনাই সব নয়, দেখতে হবে অঞ্চলের পটে বিধৃত জীবন কাহিনী আঞ্চলিক সত্তার প্রতীক হয়েও চিরন্তন মানবিকতার স্পর্শে দীপ্ত হয়ে উঠেছে কিনা। অঞ্চল শুধুমাত্র উপন্যাসের পটভূমি না থেকে উপন্যাসে এমন একটা বিশেষ মাত্রা জুড়ে দেবে, যার ফলে গোটা উপন্যাসের রসটাই আলাদা হয়ে পড়বে, সে রস আঞ্চলিকতার রস। অর্থাৎ আঞ্চলিক উপন্যাসের কতগুলি শর্ত তৈরী করা যেতে পারে এইভাবে—
-
আঞ্চলিক উপন্যাসে সমাজের খন্ডরূপের আশ্রয় নেওয়া হবে।
-
বিশেষ অঞ্চলের সামগ্রিক ভূ-প্রকৃতির বর্ণনা থাকবে।
-
আঞ্চলিক প্রকৃতির স্বাতন্ত্র্যতা চরিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হবে।
-
বিশেষ আঞ্চলিক সামাজিক প্রথা সংস্কার, ক্রিয়াকর্মের পরিচয় থাকবে।
-
অঞ্চল শুধু পটভূমি নয়, সজীব সত্তার মতো উপন্যাসকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে।
-
আঞ্চলিক পটে বিধৃত জীবনকাহিনী চিরন্তন মানবিকতার স্পর্শে দীপ্ত হয়ে উঠবে।
-
এছাড়াও, আঞ্চলিক উপন্যাসে ব্যক্তি অপেক্ষা গোটা জীবনের প্রাধান্য দেখানো হবে, প্রকৃতি হবে প্রায় নিয়তির মতো।
-
আঞ্চলিক ভাষাকে যথাসম্ভব অনুকরণের চেষ্টা করা হবে।
আঞ্চলিক উপন্যাস স্বীকৃতি পেয়েছে মূলত টমাস হার্ডির ‘ওয়েসেক্স নভেল্সে’ প্রকাশিত হওয়ার পর। বাংলা সাহিত্য আঞ্চলিক উপন্যাসের পথিকৃৎ মনে করা হয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ নানা দিক থেকে আঞ্চলিকতার লক্ষণযুক্ত। স্পষ্টতঃই একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় করে লেখা এই উপন্যাস। সেই অঞ্চল এবং সেখানকার মানুষের পরিচয় দিয়েই উপন্যাসের সূচনা—
“কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁধটা তার নাম হাঁসুলী বাঁক অর্থাৎ যে বাঁধটায় অত্যন্ত অল্পপরিসরের মধ্যে নদী মোড় ফেরে। সেখানে নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলী গয়নার মতো।……কুমার সদ্গোপ এবং গন্ধ বণিকের বাস, এছাড়া নাপিতকুলও আছে একবার এবং তন্তুবায় দু-ঘর।”
বাঁশবাদী গ্রামের কাহার সম্প্রদায়, বাবুদের পালকি টানাই যাদের জাত ব্যবসা, তাদের জীবনকথাই এখানে প্রধান। উপন্যাসের মুখ্য উদ্দেশ্য এই কাহার দলগোষ্ঠীর জীবনাচরণ, তাদের অন্ধবিশ্বাস ফিউডাল জীবনযাত্রায় আস্থা, ইত্যাদিকে ফুটিয়ে তোলা। তবে সেই একই সঙ্গে এসেছে যুদ্ধের অভিঘাত এবং আর্থিক বিপর্যয়। বাঁচার তাগিদে করালীর চন্দনপুরের রেলকারখানায় চাকরী নেওয়ার সঙ্গে ফিউডাল সংস্কৃতির ধারক বনোয়ারীর দ্বন্দ্ব উপন্যাসকে দ্বান্দ্বিকতায় ভরিয়ে দিয়েছে। করালীর হাতে কাঁচা টাকা এসেছে, সে তাই কাহারদের শিকড় ধরে টান দেয়। করালী একের পর এক হাঁসুলী বাঁকের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে। বড়তলার কর্তাবাবাকে মেরে এনেছে। দীর্ঘদিন দরে চলেছে দেবতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, আর তাকে উৎখাতের সংগ্রাম। এই বিশেষ অঞ্চলের লোকগাথা শোনানোর জন্য দুটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ঔপন্যাসিক পাগলাবাবা এবং উভয়লিঙ্গ মানুষ নসুবালা। নসুবালা গেয়েছে—
“বেলতলার বাবাঠাকুর কাহার কুলের পিতা,
বাঁশতলাতে থাকতো বাহন অজগরো চিতা।
পরাণ ভ্রমরে সে থাকতো আগুলি,
(ও হায়) তারে দাহন করে মারল করালী।”
পাগলাবাবা শেষ গান ধরে—
“জল ফেলিতে নাই, চোখে জল ফেলিতে নাই।
বিধাতা বুড়োর খেলা দেখে যারে ভাই।”
ঔপন্যাসিক ঐ বিশেষ অঞ্চলকে যে একটি প্রধান চরিত্র করে তুলেছেন, তা বোঝা যায় লেখকের বর্ণনা দেখে। তার বর্ণনায় অঞ্চল এবং অঞ্চলের বাসিন্দারা এক হয়ে গেছে।
“নদীর ভাবনা এখানে চার মাসের। আষাঢ় থেকে আশ্বিন। আষাঢ় থেকেই মা-মরা ছোট মেয়ের বয়স বেড়ে ওঠে। যৌবনে ভরে যায় তার শরীর। তার পর হঠাৎ একদিন সে হয়ে ওঠে ডাকিনী। কাহারদের এক একটা ঝিউড়িয় মেয়ে হঠাৎ যেমন এক-একদিন বাপ-মা ভাই ভাজের সঙ্গে ঝগড়া করে, পাড়াপড়শীকে শাপ-শাপান্তর করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে গাঁয়ের পথে। …..তেমনিভাবেই সেদিন এভরা নদী অকস্মাৎ ওঠে ভেসে।”
প্রত্যেকটি চরিত্রই হাঁসুলী বাঁকের লোকসংস্কৃতি, লোকবিশ্বাসে পুষ্ট। একমাত্র করালীচরণ তার অঞ্চল থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন ধরনের জীবন যাপন করেছে। দেব দ্বিজে ভক্তি নেই তার, ধর্মে মতি নেই। অবশ্য তার অন্যান্য আচরণের ধরন কাহারদের মতোই। এবং শেষ পর্যন্ত করালীচরণ নিজেকে শিকড় উচ্ছেদ করতে পারেনি। সে যে হাঁসুলী বাঁকেরই একজন, কাহারপাড়ারই মানুষ—সেকথা বোঝা যায় তার প্রত্যাবর্তন দেখে। ঝড়ে তার ভিটে উড়ে গেছে। করালী এর মায়া ত্যাগ করে অন্যত্র থাকতে পারতো, তাই ছিল তার কাছে প্রত্যাশিত। কিন্তু উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে—“হাঁসুলী বাঁকে করালী ফিরেছে, সবল হাতে গাঁইতি চালাচ্ছে, বালি কাটছে, বালি কাটছে আর মাটি খুঁড়ছে।”
এ উপন্যাস আসলে সেই মাটিরই উপন্যাস, যে মাটিতে হাঁসুলী বাঁকের প্রত্যেকটা চরিত্রের শিকড় গ্রথিত রয়েছে। আঞ্চলিক অনুষ্ঠান, উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষা উপন্যাসটিকে আরো সজীব করে তোলে। “বোঝালাম, সব বোঝলাম। কিন্তু অন্যায় হয়েছে। নিশ্চয় অন্যায় হয়েছে। ওগো মানুষটা যদি মরে যেতো। মুখ একে বাক্য আর ঠাই একে মার পিত্তিপুরষে বলে যেয়েছেনেই কথা।” সুতরাং হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’কে আঞ্চলিক উপন্যাস বলতে কোন দ্বিধাই নেই।
Leave a comment