সূচনা: সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযান এক স্মরণীয় ঘটনা। তিনি চেয়েছিলেন তার আজাদ হিন্দ সেনারা পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে দিল্লির লালকেল্লা অধিকার করবে।

[1] যুদ্ধ পরিকল্পনা: সুভাষচন্দ্র বসু ও জাপানি সেনাধ্যক্ষ কাওয়াবের মধ্যে এক যুদ্ধ পরিকল্পনা রচিত হয়। এই পরিকল্পনায় ঠিক হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর সুভাষ ব্রিগেড ও ৩১ নং জাপানি বাহিনী মিলিতভাবে আরাকান ফ্রন্টে অভিযান করবে এবং ইম্ফলের দিকে এগিয়ে যাবে। সামরিক অভিযানের সুবিধার্থে ভারতের নিকটবর্তী রেঙ্গুনে প্রধান সামরিক দপ্তর গড়ে তােলা হয়।

[2] অভিযানের সূচনা: আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিভিন্ন ব্রিগেডের মধ্যে সুভাষ ব্রিগেডের প্রথম দলটি তাইপুং থেকে যাত্রা শুরু করে (১৯৪৩ খ্রি., ৯ নভেম্বর)। আজাদ হিন্দ ফৌজের দুটি ডিভিশনের ২০ হাজার সেনার মধ্যে প্রথম ডিভিশনটি পরিচালনা করেন মেজর জেনারেল জামান কিয়ানি। দ্বিতীয় ডিভিশনটির পরিচালনা করেন কর্নেল শাহনওয়াজ।

[3] রেঙ্গুনে পদার্পণ: জাপানি নেতাদের সহযােগিতা, নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত আজাদ হিন্দ সেনারা ১৯৪৪-এর জানুয়ারিতে রেঙ্গুনে এসে উপস্থিত হয়। রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ সেনারা ২৪ টি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে অভিযান শুরু করে।

[4] ভারত সীমান্তে অভিযান: রেঙ্গুন থেকে পায়ে হেঁটে আজাদ হিন্দ সেনারা ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলে। সেসময় দৈনিক ৮০ পাউন্ড ওজনের জিনিসপত্র কাঁধে নিয়ে গড়ে ২৫ মাইল করে হেঁটে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলাই ছিল দৈনন্দিন কাজ। জাপানি সেনারা যে পথ ৫দিনে অতিক্রম করত, তাড়াতাড়ি সীমান্তে পৌঁছােনাের আগ্রহে আজাদ হিন্দ সেনারা সেপথ দুদিনে অতিক্রম করে।

[5] সীমান্তে প্রবেশ: কক্সবাজার থেকে ৫০ মাইল দূরে মৌডকে ব্রিটিশ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় আজাদ হিন্দ বাহিনী। অতর্কিত এই আক্রমণে ব্রিটিশ সেনারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়, সেগুলি দখল করে নেয় আজাদ হিন্দ সেনারা।

[6] মৈরাং-এ জাতীয় পতাকা উত্তোলন: একে একে কোহিমা দুর্গ ও ডিমাপুর-কোহিমা রােডের একটি ক্যান্টনমেন্ট দখল করে আজাদ হিন্দ সেনারা (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল)। মণিপুরের অন্তর্গত কোহিমা শহরটিও তারা দখল করে নেয়। মণিপুরের মৈরাং-এ জাতীয় পতাকা তােলা হয় (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল)। শুরু হয় মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল দখলের লড়াই।

[7] আত্মসমর্পণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কোণঠাসা পরিস্থিতি এবং প্রত্যাবর্তনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে খাদ্য ও অস্ত্রের জোগান বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে তীব্র বর্ষা নেমে যাওয়ায় এবং ন্যূনতম প্রয়ােজনীয় খাদ্য ও যুদ্ধ সরঞ্জামের অভাবে আজাদ হিন্দ সেনারা বাধ্য হয় পিছু হটতে। ইম্ফল বা মণিপুর সীমান্তে ব্রিটিশ সেনাপতি স্লিম ও স্কুনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনারা এগিয়ে আসে। ব্রিটিশের ভারী ট্যাংক, কামান এবং বিমান বাহিনীর আক্রমণে আজাদ হিন্দ সেনাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। অবশেষে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট) আজাদ হিন্দ সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সহকর্মীদের পরামর্শে নেতাজি আত্মসমর্পন থেকে বিরত থাকেন।

[8] নেতাজির অন্তর্ধান: আজাদ হিন্দ সেনাদের আত্মসমর্পণের ফলে নেতাজির দিল্লি দখল অধরা থেকে যায়। কিন্তু তিনি ভেঙে না পড়ে, দু-চোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বার্মা (এখনকার মায়ানমার) থেকে সায়গন-এ পৌঁছােন। কথিত আছে, যে এরপর ফরমােজার কাছে তাই-হােকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। যদিও ভারতবাসী এ কথা আজও বিশ্বাস করে না। সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সেনাদের অবদানকে স্বীকার করে যে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে, তাতে ঐক্য (ইত্তেফাক), বিশ্বাস (ইন্মাদ) ও আত্মাৎসর্গ (কুরবানি) শব্দগুলি উল্লিখিত আছে। শব্দগুলি আজও আজাদ হিন্দ যােদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

উপসংহার: আজাদ হিন্দ সেনারা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছােতে পারেনি বটে, কিন্তু তাদের ভারত অভিযানের সামগ্রিক প্রচেষ্টা মূল্যহীন নয়। ভারতের পরাধীনতা মােচনের লক্ষ্যে আজাদ হিন্দ সেনাদের ভারত অভিযান সমকাল ও পরবর্তীকালের প্রজন্মকেও গভীর দেশাত্মবােধে উদ্বুদ্ধ করে।