“হঠাৎ রেখাকে অপরিচিতা মনে হল”- উৎস নির্দেশ করো। কার এবং কেন রেখাকে অপরিচিতা মনে হয়েছিল?

আলোচ্য অংশটি দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ নামক গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে।

রেজিস্ট্রী বিয়ের একবছর পর, বিবাহবার্ষিকীর দিন বিকেল বেলা কাঞ্চন আর রেখা যখন মিলিত হয়েছিল, তখন রেখার মাথার চুল ভেঙে আলোটা তার চিবুক আর গলার পাশে একটা হালকা ছায়া সৃষ্টি করেছিল। তাতে রেখাকে বেশ স্বপ্নময়, অস্পষ্ট স্মৃতির মতো দেখাচ্ছিল। আলোছায়ার এই মায়ালোকের রেখাকে কাঞ্চনের অপরিচিতা বলে মনে হয়েছিল। বস্তুত, রেজিস্ট্রী বিয়ের পরেও কাঞ্চন রেখা উভয়ে উভয়কে যে চিনতে পারেনি—এ তারই অভিব্যক্তি। একবছর সংক্ষিপ্ত পরিমিত সময়ে, ছোট ঠাসা জায়গায় দুজনে বারেবারে মিলিত হয়েছে তারা, কিন্তু কখনই বাস্তবের কাঠিন্যের ওপর হৃদয়াবেগের কোমল স্পর্শ ছায়া ফেলতে পারেনি। তাদের জীবন তাই বুদ্ধিকেন্দ্রিক। রূপের অতীত রূপ কখনই ধরা পড়েনি তাদের চোখে। তাই আলোছায়ার রহস্যলোকে রেখাকে কাঞ্চনের অপরিচিতা বলে মনে হয়েছিল।

“রেখাকে হঠাৎ বিধবার মতো শূন্য, করুণ মনে হল”-উৎস নির্দেশ করো। কার এবং কেন এইরূপ মনে হয়েছিল?

আলোচ্য অংশটি দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ নামক গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। 

লুকিয়ে রেজিস্ট্রীবিয়ে করার দিন, বন্ধুদের অনুরোধে কাঞ্চন, রেখার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল। রেখার মুখ সিঁদুরের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সে মুখ দেখে কাঞ্চন পুলকিত হয়েছিল। বেশ বড় বউ লাগছিল রেখাকে। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছিল তারা। নতুন আনন্দ বুকে নিয়ে গঙ্গার ধারে নির্জনে বসার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিল কাঞ্চন। সম্মতি ছিল রেখারও। কিন্তু বন্ধুরা চলে যাবার পরই রেখা যখন রুমাল ঘষে ঘষে তার কপাল থেকে সিঁদুর মুছে ফেলেছিল, তখনই কাল্গুনের হঠাৎই রেখাকে বিধবার মতো শূন্য মনে হয়েছিল।

বস্তুত এই সিঁদুর পরানো আর মোছার মধ্যে যে কৃত্রিমতা বা আবেগ শূন্যতা ক্রিয়াশীল তার কারণেই নবোঢ়া রেখাকে শূন্য মনে হয়েছিল কাঞ্চনের।

“আচ্ছা, সেই পাগলটা এবার কোথায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করবে?”—প্রশ্নটি কার? কোন পাগলের কথা এখানে বলা হয়েছে? ‘পাগল’ বলে এখানে কাকে চিহ্নিত করা হয়েছে?

আলোচ্য উক্তিটি ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ গল্পের নায়িকা রেখার।

রেখা-কাঞ্চন বিবাহবার্ষিকীর দিন বৈকালিক ভ্রমণের বেরিয়ে দেখেছিল সেনেট হল ভেঙে গেছে। কাল্গুনের ভাষায় ‘নাইনটিন্থ সেঞ্চুরীর কবর’—সেটাও ভেঙে গেল। তখন রেখা জিজ্ঞাসা করেছিল পাগলটা কোথায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করবে? 

বস্তুত সেনেট হলে অনেক বিষয়ে অনেক বক্তা বক্তৃতা করেছিলেন। সকলেই চেয়েছিলেন যুগযন্ত্রণা থেকে জনতাকে মুক্তি দিতে। কাঞ্চন-রেখার কাছে এই জটিলতার যুগে, যেখানে অস্থিরতা, অবিশ্বাস, রুঢ় কার্কশ্য ঢেকে ফেলেছে হৃদয়াবেগের সমস্ত পথ; প্রেম যেখানে অপেক্ষমান ইউ. জি. সি-র টাকার জন্যে—সেখানে বক্তৃতা করে জনতাদের সমাজ পরিবর্তনের আশ্বাসবাণী যারা শোনায় তারা পাগল ছাড়া আর কিছুই নয়। পাগলের মতো বক্তৃতা করে আশ্বাসের ফানুস ফুলিয়ে বাড়ি ফিরে তারাও কাঞ্চন রেখার মতোই জীবনযন্ত্রণা ভোগ করে। বক্তা বুদ্ধিজীবীদের তাই রেখা এক কথায় পাগল বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে।

“নিজের কাছে মহৎ থাকার তাড়নায় পরস্পর ছদ্মবেশ পরেছি”—উক্তিটি কার? উক্তিটির তাৎপর্য কী?

আলোচ্য উক্তিটি ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ গল্পের নায়ক কাঞ্চনের। 

একবছর আগে কাঞ্চন রেখাকে রেজিস্ট্রী বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ের পর কাঞ্চনের আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকার জন্যে রেখাকে সে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে নি। কিন্তু প্রায় দিনই তারা একটু সময় হাতে নিয়ে মিলিত হত। হাঁটা পথে চলতে চলতে দুচার কথা বলে যে যার বাড়ি ফিরে যেত। এই এক বছরের মধ্যে কেউ কারো ইচ্ছে অনিচ্ছে জানতে পারে নি। শরীর চিনতে পারে নি। ঘোড়ার গাড়ির মধ্যে বসে রেখা একবছর পর দেখতে পায় কাঞ্চনের গলায় একটা তিল আছে। উভয়ে বিবাহিত স্বামী স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নির্জন কক্ষে আড়ষ্ঠ হয়ে বসে থাকে। এমন কি কাঞ্চন রেখার মালাটাও জড়িতে দিতে পারে না। এই ভদ্রবেশী আড়ষ্ঠতা কেবল উভয়ের কাছে উভয়ে সৎচরিত্র বা মহৎ থাকবার জন্যে। তাদের বিবাহিত জীবনে এ আচরণ অনর্থক ও ভ্রান্ত—এ কথা বোঝার পরও উভয়ের প্রতি উভয়ের বিশ্বাস জিইয়ে রেখেছে তারা। এই অবস্থাকে বিদ্রূপ করতে গিয়ে কাঞ্চন ওই স্বগত মন্তব্য করেছিল।

“আমাদের বিয়ে একটা কৌতুক”—উক্তিটি কার? এই উক্তির কারণ কী?

আলোচ্য উক্তিটি ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ গল্পের নায়ক কাঞ্চনের। 

কলেজের শিক্ষক কাঞ্চন গোপনে রেজিস্ট্রী বিয়ে করেছিল রেখাকে। বিয়ের দিন শপথ বাক্য উভয়ে উচ্চারণ করেছিল নিষ্ঠা সহকারে। তারপর রেখার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল কাঞ্চন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে রেখা রুমাল দিয়ে সেই সিঁদুর মুছেও ফেলেছিল। তারপর একবছর পেরিয়ে গেলেও কাঞ্চন রেখাকে তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে নি। এমনকি উভয়ের আকাঙ্ক্ষা উভয়ের কাছে গোপন রেখে একে অন্যের কাছে মহৎ সাজার চেষ্টা করেছে। কেউ কারো ইচ্ছা অনিচ্ছা চাহিদা এমনকি শরীরকে পর্যন্ত জানতে পারেনি, জানার চেষ্টাও করে নি–বিগত এক বছরে। বিবাহিত জীবনের এই অবস্থাকে বিদ্রুপ করার জন্যে কাঞ্চন তাদের বিয়েটাকে ‘কৌতুক’ বলে উল্লেখ করেছে। কারণ বিবাহিত জীবনের স্বাভাবিকতা তাদের জীবনে ছিল না। বরঞ্জ অতি সন্তর্পণে সম্পর্কটাকে জিইয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেছে দুজনেই।

“স্ফূর্তি করবেন, হোটেল ভাড়াভি দিবেন না”—উক্তিটি কার? এই উক্তির কারণ কি?

আলোচ্য উক্তিটি ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ গল্পের গাড়োয়ানের।

রেজিস্ট্রী বিয়ের বিবাহবার্ষিকীর দিন কাঞ্চন আর রেখা একটা ঘোড়াগাড়িতে চড়ে খিদিরপুরের দিকে যাচ্ছিল। কাঞ্চন আর রেখা বিবাহিত বৈধ স্বামী স্ত্রী হলেও দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিকতা তাদের মধ্যে ছিল না। কারণ তাদের বিয়েটা হয়েছিল গোপনে এবং বিয়ের একবছর পরেও বাড়ির লোকের কাছে সে গোপনতা অব্যাহত ছিল। ফলত উভয়েই উভয়ের আকাঙ্ক্ষা উভয়ের কাছে গোপন করে মহৎ হবার ছদ্মবেশ ধারণ করে চলত। ঘোড়াগাড়িতে ওঠার আগে রেখা একটি ফুলের মালা কিনেছিল। ইচ্ছা ছিল কাঞ্চন নিজে হাতে মালাটি ওর খোঁপায় জড়িয়ে দিক। কিন্তু ঘোড়াগাড়ির বন্ধ কোচবাক্সে এই দম্পতি পৃথিবী-বিচ্ছিন্ন-নির্জনতার মধ্যেও দুই প্রান্তের গদীতে দুজনে বসেছিল। অবশেষে খিদিরপুরে পৌঁছে যখন গাড়ি থামাল, তখন মরিয়া হয়ে রেখা তাড়াতাড়ি মালাটা খোঁপায় জড়িয়ে দেবার জন্যে কাঞ্চনকে বলেছিল। কাঞ্চন যখন রেখার খোঁপায় মালা পরাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় গাড়োয়ান একবার পর্দা তুলেই পর্দা ফেলে দিয়েছিল। তারপর কাঞ্চন নির্দ্ধারিত ভাড়া দিতে চাইলে গাড়োয়ান দ্বিগুণ ভাড়া চেয়ে বসল। ক্রুদ্ধ কাঞ্চন অত ভাড়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে গাড়োয়ান ওই মন্তব্য করেছিল।