প্রশ্নঃ আচরণবাদ কী? আচরণবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ কী কী? বর্ণনা কর।

অথবা, আচরণবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ রাজনীতি বিশ্লেষণের অগ্রগতির ইতিহাসে কতিপয় মতবাদ ও পর্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আচরণবাদ এগুলাের মধ্যে অন্যতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে আচরণবাদের জন্মভূমি। এই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানের আচরণবাদ মাতৃস্নেহে লালিত-পালিত হয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে আচরণবাদের প্রবেশের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নতুন দৃষ্টিকোণের পথ প্রশস্ত করে সমাজবিজ্ঞান এবং ভৌত বিজ্ঞানের সহায়তায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যান-ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

আচরণবাদের সংজ্ঞাঃ আচরণবাদ হলাে মানুষের আচরণকে পর্যালােচনার মাধ্যমে রাজনীতিকে যথাযথ ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। আরাে সহজভাবে বলা যায়, পরীক্ষালব্ধ ও প্রয়ােগযােগ্য তত্ত্ব উদ্ভাবন, রীতিসিদ্ধ বিশ্লেষণ ও তাদের সত্যাসত্য যাচাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রমের সুসমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুসন্ধানকেই আচরণবাদ বলে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক বিভিন্নভাবে আচরণবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তা নিম্নে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-

ডেভিড ট্রম্যান (David Truman)-এর মতে, আচরণবাদ বলতে অনুমান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি, সাক্ষ্য-প্রমাণের সুশৃঙ্খল বিন্যাস, অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির ওপর সবিশেষ গুরুত্বারােপ ও সংখ্যায়নকে বুঝায়।

আর্নল্ড ব্রেখট (Arnold Brecht)-এর মতে, রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে একটি অভিজ্ঞতাবাদী ও স্থায়ী তত্ত্ব গড়ে তােলার প্রয়াসই হলাে আচরণবাদ। ‘An empirical and enduring theory about political life is behaviouralism.’

গিন্ড ও পামার (Guild & Palmar)-এর মতে, যেকোনাে ঘটনার সুসংবদ্ধ, অভিজ্ঞতাবাদী ও কার্যকারণগত ব্যাখ্যাই হলাে আচরণবাদ। ‘A systematic, empirical, casual explanation of certain phenomena is behaviouralism.’

অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরীক্ষালব্ধ ও প্রয়ােগযােগ্য তত্ত্ব উদ্ভাবন, রীতিসিদ্ধ বিশ্লেষণ ও তাদের সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্যাটার্নের সুসমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পন্থাই হচ্ছে আচরণবাদ।

রাবর্ট ডাল (Robert Dahl) বলেন, আচরণবাদ রাজনীতি অধ্যয়নে মনােবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃ তত্ত্ব এবং অর্থনীতির মতবাদ পদ্ধতি আবিষ্কার ও ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত এক প্রকার আন্দোলন।

উল্লিখিত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্যক্তির ধারণা, কার্যকলাপ, জ্ঞান সংক্রান্ত অনুভূতি ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত বিচার-বিবেচনার ফসল যা তার ইচ্ছা-আকাক্ষা ও সংকল্প প্রকাশ পায়, তাই হচ্ছে আচরণবাদ।

আচরণবাদের বৈশিষ্ট্যঃ রবার্ট ডাল আচরণবাদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা- (ক) আচরণবাদ একটি সামাজিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি (খ) রাজনীতি বিশ্লেষণে প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে বরং পর্যবেক্ষণযােগ্য আচরণের ওপর জোর দেয়া। ডেভিড ইস্টন তার বিখ্যাত গ্রন্থ A Framework for Political Analysis এ আচরণবাদের আটটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। বৈশিষ্ট্যগুলাে হলাে-

(১) একরূপতাঃ বিভিন্ন অবস্থা ও পরিবেশভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মানুষের কার্যকলাপ ও আচরণে একরূপতা রয়েছে। এরূপ একরূপতার ভিত্তিতে মানব আচরণ সম্পর্কে সাধারণ নিয়ম ও তত্ত্ব গঠন করা যায়। যেগুলাে রাজনীতির বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।

(২) যাচাইকরণঃ রাজনৈতিক আচরণের একরূপতা সম্পর্কে সাধারণ সূত্রগুলাে পরীক্ষাযােগ্য হবে এবং সংশ্লিষ্ট আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে সে সূত্রের সত্যতা যাচাই করা সম্ভবপর হবে। তাই বলা যায়, যাচাইকরণ আচরণবাদের একটি অপরিহার্য বাহন।

(৩) কৌশলঃ আচরণবাদ মূলত তথ্যনির্ভর পদ্ধতি। পর্যাপ্ত ও নির্ভরযােগ্য তথ্য সংগ্রহ এবং এগুলাের বিশ্লেষণের জন্য আচরণবাদীরা বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রয়ােগ করেন। সুতরাং কৌশল আচরণবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

(৪) সংখ্যায়নঃ আচরণবাদীরা রাজনৈতিক বিষয়াদির গুণগত পরিমাপের পরিবর্তে সংখ্যাগত পরিমাপ এবং বর্ণনামূলক ব্যাখ্যার পরিবর্তে সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করবেন। এ জন্য সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ও অংকশাস্ত্রের প্রয়ােগ লক্ষ্য করা যায়।

(৫) মূল্যবােধঃ মূল্যবােধ আচরণবাদের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নীতিভিত্তিক মূল্যায়ন ও পরীক্ষালব্ধ ব্যাখ্যাকে বিশ্লেষণের জন্য স্বতন্ত্র রাখতে হবে। সুতরাং মূল্যবােধ এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

(৬) সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনাঃ গবেষণার ক্ষেত্র সুশৃঙ্খল ও প্রণালীবদ্ধ। গবেষণা ও তত্ত্ব সুসমন্বিত ও সুশৃঙ্খল জ্ঞানমণ্ডলের দুটি অংশ। যে গবেষণা তত্ত্বভিত্তিক নয় তা অসম্পূর্ণ আর যে তত্ত্ব গবেষণা দ্বারা সমর্থিত নয় তা অহেতুক।

(৭) খাঁটি বিজ্ঞানঃ আচরণবাদীদের পদ্ধতি খাটি বিজ্ঞানভিত্তিক হিসেবেও পরিচিত। কারণ এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়ােগ ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদানকেই প্রাধান্য দেয়া হয় এবং বাস্তব অবস্থায় এগুলাের প্রয়ােগযােগ্যতার ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না।

(৮) বহু বিষয়কঃ আচরণবাদ বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে এক সেতুবন্ধ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। বিভিন্ন বিজ্ঞানে উদ্ভুত প্রণালী, পদ্ধতি এবং ধারণাসমূহকে একসূত্রে গেঁথে দিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানের মধ্যে স্বর্ণসূত্র রচনা করতে চায়।

(৯) মানবাচরণের যথার্থ বিশ্লেষণঃ আচরণবাদে একটি অন্যতম প্রদান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবাচরণের ন্যায়নিষ্ঠ বিশ্লেষণ। কারণ ব্যক্তি ও গােষ্ঠী হচ্ছে আচরণের ভিত্তি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এগুলাের আলােচনা ও বিশ্লেষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ডেভিড ইস্টনের আলােচনা হতে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আচরণবাদ ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর আচরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালােচনা করতে চায়। তার মতে, রাজনৈতিক আচরণ ব্যক্তি আচরণের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত।