আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারার উদ্ভব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। তার ফলে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব ঘটে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আচরণবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিপূর্ণতা লাভ করে। আবার বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকে দেখা গেল যে পুনরায় পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। এই অবস্থায় আচরণবাদী আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আচরণবাদের পীঠস্থান হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সমাজেই ক্রমবর্ধমান রাজনীতিক ও সামাজিক সংকটের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় আচরণবাদের বিশ্লেষণগত কার্যকারিতা ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়। তখন আচরণবাদের মোহ ভাঙ্গতে শুরু করে। ঐতিহ্যবাদীরা আগাগোড়াই আচরণবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন আর এক শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই আচরণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত করলেন। বস্তুত যে-কোন তত্ত্ব বা মতবাদের জন্ম হয় এক ধরনের অসন্তোষ থেকে। আচরণবাদ এবং আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারাকে ডেভিড ইস্টন ‘আচরণবাদোত্তর বিপ্লব’ (Post Behavioural Revolution) বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই নতুন চিন্তাধারাকে ‘বিপ্লব’ বলার পক্ষপাতী নন।

ইস্টন: আচরণবাদোত্তর আন্দোলনের উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করা। ডেভিড ইস্টন একে ‘ভবিষ্যৎ-ভিত্তিক’ (future-oriented) এক বিপ্লব হিসাবে অভিহিত করেছেন। ইস্টন আচরণবাদোত্তর আন্দোলনকে আচরণবাদ-বিরোধী প্রতিক্রিয়া হিসাবে মেনে নিতে রাজী নন। তাঁর মতানুসারে আচরণবাদোত্তর বিপ্লব সংস্কার-বিরোধী কোন উদ্যোগ নয়, এ হল এক সংস্কারমূলক আন্দোলন। ইস্টন তাঁর The Political System শীর্ষক গ্রন্থে আচরণবাদোত্তর আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন: “a genuine revolution, not a reaction, a becoming, not a preservation, a reform, not a counter reformation.” তবে ইস্টন নিজেই আবার বলেছেন: “…behaviouralism once denoted intense dissatisfaction with the traditional research, post-behaviouralism is itself a sign of mounting discontent with the behavioural revolution.”

মূল বক্তব্য: সামাজিক দিক থেকে প্রাসঙ্গিক, অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার উপর আচরণবাদোত্তর আন্দোলনে জোর দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই নতুন বিশ্লেষণ ধারায় মূল্যবোধ ও তথ্য, আদর্শমূলক ও অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারার প্রবক্তাদের মতানুসারে আচরণবাদীরা ভৌত বিজ্ঞান থেকে নেওয়া গবেষণা পদ্ধতির সাহায্যে পর্যন্ত গবেষণা পরিচালনা করেছেন। এতদ্‌সত্ত্বেও সেই সমস্ত গবেষণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি যথার্থ বিজ্ঞান শাস্ত্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়নি। আচরণবাদীরা আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারাকে আচরণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে মানতে চান না। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে আচরণবাদোত্তর আন্দোলনের ব্যাপারে ডেভিড ইস্টনের আলোচনায় আচরণবাদ বিরোধী বহু বক্তব্য বর্তমান। আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল্যায়নকে রাজনীতি ও মূল্যবোধ নিরপেক্ষ করার পক্ষপাতী। কিন্তু আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারায় তা স্বীকার করা হয় না। এই বিশ্লেষণে মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই চিন্তাধারায় সত্যতার মানবিক মূল্যবোধকে সংরক্ষণের কথা বলা হয়। তা ছাড়া জ্ঞানকে সামাজিক স্বার্থে প্রয়োগ করার কথা বলা হয়। আবার আচরণবাদীরা বিষয়বস্তুর বদলে গবেষণার কলা-কৌশলের উপর বেশি জোর দেন। কিন্তু আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারায় বিশ্লেষণের কলা-কৌশলের থেকে মৌলিক বিষয়বস্তুর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আরও বলা হয় সামাজিক সমস্যার সমাধানের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণা সম্পর্কযুক্ত অর্থবহ হবে। সামাজিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণের এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মানুষের প্রয়োজনের অনুপন্থী করার কথা বলা হয়। ইস্টনের বক্তব্য অনুসারে আচরণবাদোত্তর আন্দোলনের সঙ্গে বিশেষ কোন রাজনীতিক মতবাদের যোগ নেই। এই চিন্তাধারার সঙ্গে বামপন্থী ও রক্ষণশীল নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর চিন্তাবিদদের সংযোগ ছিল। বস্তুত আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারা হল একটি বৌদ্ধিক প্রবণতা (Intellectual tendency)।