আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সর্বোত্তম অভিব্যক্তি ঘটেছে আচরণবাদের মাধ্যমে। মার্কিন মুলুকের একদল বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আচরণবাদী বিশ্লেষণ ধারার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা সামাজিক ও রাজনীতিক জীব হিসাবে মানুষের প্রকৃত আচরণ সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী। আরনল্ড ব্রেখট তাঁর Political Theory গ্রন্থে বলেছেন যে, আচরণবাদ হল রাজনীতিক জীবন সম্পর্কে এক অভিজ্ঞতাবাদী ও স্থায়ী (enduring) তত্ত্ব গঠনের প্রচেষ্টা। ডেভিড ট্রুম্যান এর মতানুসারে আচরণবাদের উদ্দেশ্যও হল রাজনীতিক প্রক্রিয়ার বিজ্ঞান গঠন করা। টুম্যান-এর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক আচরণ বলতে দেশ শাসনের পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কার্যকলাপ ও মিথষ্ক্রিয়াকে (Interactions) বোঝায়। ট্রুম্যান তার Implications of Political Behaviour Research শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন: “The term political behaviour comprehends those actions and interactions of men and groups which are involved in the process of governing.” তাঁর আরও অভিমত হল যে ব্যক্তির পর্যবেক্ষিত ও পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে আচরণবাদ সরকারী কাজকর্মকে ব্যাখ্যা করে। তিনি রাজনীতিক আচরণবাদের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন: (১) সুসংবদ্ধ গবেষণার উপর গুরুত্ব আরোপ এবং (২) অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির উপর বিশেষ দৃষ্টি। ওয়ালডু (Dwight Waldo)-র মতানুসারে আচরণবাদী আন্দোলন হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার এক নতুন ও সক্রিয় উদ্যোগ।

ডেভিড ইস্টন তাঁর The Political System গ্রন্থে আচরণবাদকে “An intellectual tendency and a coacademic movement” হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ইস্টনের মতানুসারে আচরণবাদ হল একটি বৌদ্ধিক প্রবণতা এবং নির্দিষ্ট বিদ্যাবিষয়ক আন্দোলন। তাঁর আরও অভিমত হল যে আচরণবাদী গবেষণায় ব্যক্তিকে রাজনীতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে টেনে আনা হয়েছে। ইস্টনের মতে সাম্প্রতিককালে আচরণবাদ বহুলাংশে মনোবিদ্যা আশ্রয়ী হয়ে পড়েছে। গিল্ড ও পামারের মতানুসারে ‘যে-কোন ঘটনার সুশৃঙ্খল, অভিজ্ঞতাবাদী ও কার্য-কারণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা হল আচরণবাদ’ (“a systematic empirical, causal explanation of certain phenomena”)।

রবার্ট ডাল-এর মতানুসারে আচরণবাদ ব্যক্তির পর্যবেক্ষিত ও পর্যবেক্ষণশীল (observed and observable) আচার-আচরণের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে এবং আধুনিক মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও অর্থবিদ্যার সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতালব্ধ অংশকে আরও বিজ্ঞানসম্মত করে গড়ে তুলতে চায়। তাঁর মতানুসারে ঐতিহাসিক বিচারে আচরণবাদ হল একটি প্রতিবাদী আন্দোলন। তিনি বলেছেন: “Historically speaking, the behavioural approach was a protest movement within political science.” আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঐতিহ্যগত, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, বর্ণনামূলক এবং সাবেকী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিরোধী।

কার্কপ্যাট্রিক (E. M. Kirkpatrick) তাঁর The Impact of Behavioural Approach on Traditional Political Science শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “Between World War II and the mid-fifties; the term ‘political behaviour’ represents both an approach and a challange, an orientation and a reform movement, a type of research and a rallying cry, a ‘hurrah’ term and a ‘boo’ term. Debate about behavioural techniques and methods was often accompanied by vituperation; discussions were more often aimed at vanquishing adversaries that at clarifying issues.”

প্রকৃত প্রস্তাবে বহু দৃষ্টিভঙ্গির এক সমষ্টিবদ্ধ রূপ হল আচরণবাদ। বিশেষ কোন একটি দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এই আচরণবাদী চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়নি। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা পূর্ব পরিকল্পিত অনুমানের উপর ভিত্তিশীল, মূল্যবোধযুক্ত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যালোচনার পুরোপুরি বিরোধী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যালোচনার পরিবর্তে মানুষের রাজনীতিক আচরণ, আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানের সহযোগিতা, সংখ্যায়ন, ভৌত বিজ্ঞানসমূহের অভিজ্ঞতা প্রভৃতির উপর জোর দেওয়া হয়।

রাজনীতিক আচরণ: প্রসঙ্গত রাজনীতিক আচরণের অর্থ ব্যাখ্যা করা দরকার। মানুষের রাজনীতিক কাজকর্ম বা আচরণকে রাজনীতিক আচরণ বলা হয়। এই আচরণ অবশ্যই রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বা রাজনীতিক অর্থবহ হবে। ইউলাউ (Heinz Eulau) তাঁর Behavioural Persuasion in Politics গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া (interactions) ও আদান-প্রদান ঘটে। তার ফলে এক ধরনের সম্মিলিত বা যৌথ আচরণের সৃষ্টি হয়। এই আচরণ রাজনীতিক কাজকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও তা রাজনীতিক আচরণ হিসাবে বিবেচিত হয় না। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অভিজ্ঞতা ও সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে রাজনীতিক আচরণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন।

আচরণবাদের মুখ্য লক্ষ্য: আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ মনে করেন যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ভৌতবিজ্ঞানের কলাকৌশলের ভিত্তিতে বিজ্ঞানসম্মত নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করাই এই মতবাদের মুখ্য লক্ষ্য। এই তত্ত্বের উদ্দেশ্য হল অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব (emperical theory) ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানের পারস্পরিক বিশ্বাসের দ্বারা রাজনীতিক কাঠামো বিচার-বিশ্লেষণ করা। আচরণবাদীদের অন্যতম উদ্দেশ্য হল অভিজ্ঞতাবাদী ধ্যান-ধারণা ও তত্ত্ব গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করা। ইস্টনের মতানুসারে রাজনীতিক আচরণের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের সত্যতা যাচাই করে নেওয়া দরকার।

ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণের উপর গুরুত্ব: আচরণবাদে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণের পর্যালোচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই মতবাদ অনুসারে ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণকে অন্য সকল বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণ তার ব্যক্তিত্ব, সমাজ ও সামাজিক সংগঠনের প্রকাশ মাত্র। তাই যে কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তির আচরণ প্রকাশিত হয় তারই প্রেক্ষাপটে আচরণের প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিচার করা হয়। ব্যক্তির আচরণ পরিবেশ নিরপেক্ষ হতে পারে না। মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের কোন আচরণই তার সামগ্রিক থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। এই কারণে ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণের উপর সমাজ-সংস্কৃতি ও সম্ভাব্য অন্যান্য প্রভাবের আলোচনা আবশ্যক। তাই ব্যক্তির রাজনীতিক আচার আচরণের সঠিক বিচার-বিশ্লেষণের জন্য অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা দরকার।

তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা: এই মতবাদে তত্ত্ব ও গবেষণার পরস্পরের উপর নির্ভরশীল তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। তত্ত্ব ও গবেষণার মধ্যে দৃঢ় সংহতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে পরিমাপ ও সংখ্যায়নের প্রয়োজনের কথা বলা হয়। রাজনীতিক আচরণের সমস্যাদি বিশ্লেষণের স্বার্থে একটি সংক্ষিপ্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত গবেষণা পদ্ধতি গড়ে তোলাই হল এই মতবাদের লক্ষ্য।

মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা: ‘কেন এবং কি করে রাজনীতিক ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়’ আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কেবল তাই পর্যালোচনা করেন। এই সমস্ত ঘটনার ঔচিত্য-অনৌচিত্য আচরণবাদী আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়। ইস্টনের মতানুসারে আচরণবাদী বিশ্লেষণ পূর্বধারণা-সম্ভূত মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ হওয়া দরকার। আচরণবাদে রাজনীতিক আলোচনা থেকে মূল্যবোধের ধারণাকে বাদ দেওয়া হয়। আচরণবাদী আলোচনা হল মূল্যবোধহীন আলোচনা। এই আলোচনায় ব্যক্তিগত রাজনীতিক মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়। কোন নৈতিক প্রশ্নকে আচরণবাদী আলোচনায় স্থান দেওয়া হয় না। কারণ বৈজ্ঞানিক আলোচনার অন্যতম শর্ত হল মূল্যবোধ-নিরপেক্ষতা।

আচরণবাদী পদ্ধতি: আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতিতে এক প্রযুক্তিবিদ্যাগত বিপ্লব আনয়নের চেষ্টা করেছেন। তাঁরা ভৌতবিজ্ঞানের মত আলোচনা ও বিশ্লেষণ কাঠামো গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ভৌত বিজ্ঞানের কলা-কৌশলের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁরা নিয়মানুবর্তিতা, সত্যতা নির্ধারণ, সংখ্যায়ন, ধারণার সুসংহতকরণ, সংহতিসাধন, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের পন্থা প্রভৃতির উপর জোর দিয়েছেন। তা ছাড়া তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নমুনা সমীক্ষা, সাক্ষাৎকার, মতামতজ্ঞাপক ভোট গ্রহণ, গাণিতিক পদ্ধতির প্রয়োগ, গণক যন্ত্রের ব্যবহার প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পরীক্ষা ও সত্যতা প্রমাণ সম্ভব এমন অনুমান, প্রয়োগযোগ্য সংজ্ঞা, বৈধতা বিচারের মাপকাঠি প্রভৃতি বিজ্ঞানসম্মত পন্থা-পদ্ধতি আচরণবাদে গ্রহণ করা হয়।

গ্রাহাম ওয়ালাস: ওয়ালাস তাঁর Human Nature in Politics গ্রন্থে একটি নির্দিষ্ট রাজনীতিক পরিস্থিতিতে মানুষের প্রকৃত আচরণ পর্যালোচনার কথা বলেছেন। ওয়ালাস মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতির সাহায্যে রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। তাঁর মতে মানুষের জটিল রাজনীতিক আচরণ বিচার-বিশ্লেষণের জন্য তথ্য ও প্রমাণ জোগাড় করা দরকার। অর্থাৎ পরিসংখ্যানের গুরুত্ব এখানে যথেষ্ট। তাঁর মতে মানুষের রাজনীতিক আচরণ সব সময় যুক্তি বা ব্যক্তিগত স্বার্থের অনুগামী হয় না। আবার বিশেষ কোন রাজনীতিক পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ কি হওয়া উচিত বা হতে পারে সে বিষয়ে অনুশীলন ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।

আর্থার বেণ্টলী: আর্থার বেণ্টলী তাঁর The Process of Government গ্রন্থে রাজনীতিক আচরণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তথ্য ও পরিসংখ্যানের উপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রায়োগিক ও বাস্তববাদিতার পথে এগিয়েছেন। তিনি রাজনীতিক পদ্ধতিতে জনমত, দল, নির্বাচন ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সমাজতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তি অপেক্ষা বিভিন্ন সংঘ বা গোষ্ঠীর কার্যাবলীর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন: “When groups are adequately stated, everything is stated.” বেণ্টলী সাবেকী দার্শনিক, বর্ণনামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন।

আচরণবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে মেরিয়াম (Charles E. Merrium) এর New Aspects of Politics, 1925; ক্যাটলিন (Catlin)-এর The Science and Method in Politics, 1927; লাসওয়েল (H. D. Lasswell)-এর Psycho-pathology and Politics, 1930 প্রভৃতি গ্রন্থের অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেরিয়াম তথ্য সংগ্রহ, সংখ্যায়ন প্রভৃতির উপর জোর দেন। মেরিয়ামের উদ্যোগেই পরবর্তীকালে আচরণবাদ দৃঢ়ভিত্তিক হয়।