আচরণবাদের উদ্ভব বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার প্রচেষ্টার ভিত্তিতে বিভিন্ন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অন্যতম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রচলন খুব বেশী দিন ঘটেনি। প্রকৃত বিচারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়ালডো (Dwight Waldo) মন্তব্য করেছেন: By almost any measure, the most important aspect of post-World War II Political Science has been the rise of ‘Behaviouralism.” মূলত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উদ্যোগই এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আচরণবাদের জন্মভূমি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা হয়। তবে জাপান, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশেও তত্ত্বটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর্থার বেন্টলী ও গ্রাহাম ওয়ালাস ১৯০৮ সালে আচরণবাদী আলোচনার সূত্রপাত করেন। তবে বিংশ শতাব্দীর বিশ ও তিরিশের দশকে লাসওয়েল, গনসেল, মেরিয়াম (Charles Merriam ) প্রমুখ ব্যক্তিদের হাতে মতবাদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মতবাদটির অন্যান্য প্রবক্তাদের মধ্যে কার্কপ্যাট্রিক (E. M. Kirkpa-trick), ডাল (R. A. Dahl), ডেভিড ইস্টন প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নাম উল্লেখযোগ্য।

শিকাগো স্কুল: আচরণবাদের আলোচনার ক্ষেত্রে অনেকে শিকাগো স্কুলের অবদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিয়ামের নেতৃত্বে একটি পাঠচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পাঠচক্রের উদ্যোগ-আয়োজন ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় আচরণবাদী আলোচনার একটি পীঠস্থানে পরিণত হয়। এই পাঠচক্রের সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অ্যালমণ্ড (Gabrial Almond), ট্রুমান (David Truman), ভি. ও. কী. (V.O. Key), সাইমন (Herbert Simon) প্রমুখ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও শিকাগো স্কুলের আচরণবাদী চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হন। এ প্রসঙ্গে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাটলিনের আলোচনা উল্লেখযোগ্য। আচরণবাদী চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটে বিংশ শতকের প্রথম দশকে। কিন্তু আচরণবাদী গবেষণার মূলকেন্দ্র হিসাবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি লাভ করে তিনের দশক থেকেই।

সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ: আচরণবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে ‘সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ (The Social Science Research Council)-এর ভূমিকাও উল্লেখ করা দরকার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে এই পরিষদ গঠিত হয়। ডাল-এর মতানুসারে আচরণবাদের প্রসারের ক্ষেত্রে এ পরিষদের সক্রিয় অবদান অস্বীকার করা যায় না। এই পরিষদ রাজনীতিক আচরণ আলোচনার ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। বলা হয় যে বিভিন্ন ভূমিকায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের রাজনীতিক আচরণ ও সম্পর্কসমূহ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচনা করা আবশ্যক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্যায়: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আচরণবাদী আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের বিকাশে এই চিন্তাধারা সাফল্য অর্জন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের আচরণবাদ পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই সময় এই অনুধাবন পদ্ধতি এক জটিল প্রযুক্তিবিদ্যার রূপ ধারণ করে। এই সময় এক্ষেত্রে যে সমস্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাঁরা হলেন হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল, রবার্ট ডাল, ডেভিড ইস্টন, ডেভিড আপটার, অ্যালমণ্ড, সিডনি ভার্বা প্রমুখ।

আচরণবাদী চিন্তাধারা কালক্রমে ইউরোপ ও এশিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে। ঊনিশ শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে এই ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ এই সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র স্বীকৃতি লাভ করে। ডেভিড ইস্টন তাঁর The Political System গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “By the 1970’s positive theory has craved a firm niche for itself in Political Science.”