ষোড়শ শতক মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সুবর্ণযুগ—এ যুগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বৈষ্ণব কবিতা। সপ্তদশ শতকে তার অনুবৃত্তি এবং অষ্টাদশ শতকে তার বিকৃতি লক্ষ্য করা যায়। অষ্টাদশ শতকে বাংলার সমাজ দেহে যে সার্বিক অবক্ষয় লক্ষিত হয়েছিল, তার মধ্যে একটি মাত্র উজ্জ্বল আলোকরেখা দেখা গিয়েছিল সাধক কবি রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীতে সম্ভবত বৈষ্ণব কাব্যের আদর্শে রচিত হয়েছিল রামপ্রসাদের সঙ্গীত, বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে আমরা এগুলিকে বলি ‘শাক্ত পদাবলী’।

ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বৈষ্ণব সাধনার অন্তরঙ্গ সুর ও বিগলিত ভাবাবেশ মাধুর্য শাক্তকাব্যেও সংক্রামিত হইল— দেবীর স্তবস্তুতির মধ্যে ভক্তের আত্মসমর্পণ ও একান্ত নির্ভয়ের ভাবটি বৈষ্ণব কবিতার প্রভাবের ফলস্বরূপ ফুটিয়া উঠিল।”

বৈষ্ণব কবিতার সঙ্গে শাক্ত কবিতার একটি আপাত-সাদৃশ্য দৃষ্টিগোচর হ’লেও রসের বিচারে যে, এতদুভয়ের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য বর্তমান রয়েছে–এ বিষয়টি একটু সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। গৌড়ীর বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে মোট পাঁচটি মূল রসের কথা বলা হয়েছে— শান্ত, দাস্য, সথ্য, বাৎসলা ও মধুরস’।

বৈষ্ণব পদাবলীতে ‘শাস্ত’ ও ‘দাস্য’ রসের পদ প্রায় নেই বললেই চলে। ‘সখ্য’ রসের অল্প কিছু পদ পাওয়া যায় গোষ্ঠলীলা’ আদি পর্যায়ে। চৈতন্যোত্তর কবিগণ চৈতন্যদেবের বাল্যলীলা স্মরণে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার কিছু পদ রচনা করেন, যার মধ্যে বাৎসল্য রসের পরিচয় সুস্পষ্ট। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে ‘মধুর’ তথা ‘‘শৃঙ্গার’ বা ‘উজ্জ্বল’ রসকেই শ্রেষ্ঠ স্থান প্রদান করা হয়েছে। প্রায় সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যই মধুররসাশ্রিত এর আধার ‘রাধা-কৃষ্ণের প্রেম’। বৈষ্ণব পদের এই মাধুর্যরস এবং শাক্তপদের মাধুর্যরস নামতঃ এক হলেও আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। শাক্তপদের দুটি প্রধান ধারা—একটিতে আছে উমাসঙ্গীত—এটি কন্যাসাধনার দৃষ্টাত্ত, এর রস বাৎসলা— ‘বাল্যলীলা, পর্যায়ে এই রসই প্রধান। অপর ধারায় আছে শ্যামা সঙ্গীত-এটি মাতৃসাধনার দৃষ্টান্ত— এর রস ‘ঐশ্বর্য’ এবং ‘প্রতি বাৎসলা’—’ভক্তের আকৃতি এবং জগজ্জননীর রূপ’ প্রভৃতি পর্যায়ে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অতএব শাক্ত পদাবলীতে প্রকৃতপক্ষে দুটি রসই প্রধান— -‘ঐশ্বর্য’ এবং ‘বাৎসল্য ও প্রতিবাৎসল্য’ তথা ঐশ্বর্য-বাতিরিক্ত রসই একযোগে ‘মাধুর্য’ রসরূপে শাক্তপদে পরিচিত, কারণ এতে বাঙালীর গার্হস্থ্য জীবনের মা ও মেয়ের একান্ত মধুর সম্পর্কের চিত্রই তাতে অঙ্কিত হয়েছে।

শাক্ত পদাবলীর প্রথম স্রষ্টা সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। শাক্ত পদাবলীর দুটি ধারারই প্রবর্তক ছিলেন তিনি; আগমনী-বিজয়ার পদে তিনিই জগজ্জননীকে কন্যারূপে নিয়ে আসেন পারিবারিক বন্ধন-সীমায়, আবার বিভিন্ন সাধনসঙ্গীতে সবৈশ্বময়ী শক্তিভূতা সনাতনী তথা আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতিকে তিনি জগদীশ্বরী রূপেই স্তুতি করেছেন। পরবর্তী কবিরা সকলেই মোটামুটি এই ধারারই অনুসরণ করবার ফলে সাধারণভাবে একটি ধারণা গড়ে ওঠে যে ‘আগমনী-বিজয়া’র গান তথা উমাসঙ্গীতগুলি যেমন বাৎসল্য তথা মাধুর্য রসের আকর, ভক্তের আকৃতি আদি শ্যামাসঙ্গীতে তেমনি দেবীর ঐশ্বর্যের চিত্রই অঙ্কন করা হয়েছে। কথাটির মধ্যে কিছুটা সত্যতা থাকলেও সেই সত্য নিরঙ্কুশ নয়। কারণ আগমনী-বিজয়ার গানে যেমন মাধুর্যরস সত্ত্বেও উমাকে পিতা এবং মাতা হিমালয় মেনকাও কখন কখন জগজ্জননী ঈশ্বরী রূপে গ্রহণ করেছেন, ‘ভক্তের আকৃতিতেও তেমনি কোনো কোনো ভক্ত সর্বেশ্বরী দেবীকে একেবারেই মায়ের আসনে বসিয়ে তার সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ফলত শাক্ত পদাবলীতে মাধুর্য ও ঐশ্বর্যরসের পার্বতী পরমেশ্বর রূপ নিত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। মূল ‘চণ্ডী’তেও দেবীর মধ্যে বিপরীতরূপের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়

‘চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা

ত্বমেব দেবী বরদে ভূবনত্রয়েহপি।’

বস্তুত দেবীর মধ্যে কঠোরতা ও কোমলতার, ঐশ্বর্যের ও মাধুর্যের অনুপম মিশ্রণ দেখা যায়। অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “লৌকিক ভাবের সুর পঞ্চমে ধ্বনিত হইলেও শাক্তপদাবলীতে দেবতার দেবসত্তা অম্লান। শাক্তপদাবলী কেবল লীলা প্রধান নয়, তত্ত্বপ্রধান ইহা লীলা ও তত্ত্বের অদ্বৈত সন্ধি। যিনি ব্রহ্মময়ী হইয়াও প্রপঞ্চ জগতের প্রতিটি বস্তুতে অনুস্যুত, যাঁহার আনন্দলীলায় বিশ্ব আনন্দময় ও সৌন্দর্যধনা, সেই আদিশক্তি গৃহের জননী ও দুহিতা হইলেও তিনিই যে পরমাশক্তি, একথা শক্তিসাধক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হন নাই। মাধুর্খ বিহ্বল হইয়া সাধক কোনো স্থলেই জগজ্জননীর ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করেন নাই।”

আগমনী-বিজয়ার পদে দেবী সর্বদাই উমা বা গৌরী—– হিমালয় মেনকার বড় আদরের কন্যা, পাগল ভোলা শিবের গৃহিণী, কার্তিক-গণেশের মা। এখানে সর্বত্র তার শুধুই লীলা, কখনও মাতৃস্তন্যপানে উদ্‌গ্রীব, কখনও চাদ ধরবার জন্য বায়না, কখনও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে অভিমানিনীর মতো গাল ফোলানো, আবার পিতাকে দেখেই প্রণাম করতে ছোটেন, অথচ তাকে দেখেও পিতার উক্তি—উমা তো সামান্য মেয়ে নয়।

‘আগমনী-বিজয়া’ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি কমলাকান্ত। তার অধিকাংশ পদেই দেবীর মানবমূর্তিই আমরা দেখতে পাই প্রায় সর্বত্রই তিনি গিরিরাজ মেনকার আদরের দুলালী। অথচ তার মধ্যে কমলাকান্ত এমন পদও রচনা করেছেন, সেখানে গিরিরাজও কন্যা উমাকে সাক্ষাৎ ঈশ্বরীরূপে দেখতে পেয়েছেন।

‘গিরিরাণী, এই নাও তোমার উমাকে।

কত না মিনতি করি, তুষিয়ে ত্রিশূলধারী,

প্রাণ-উমা আনিলাম নিজ পুরে। 

দেখো মনে রেখো ভয়, সামান্যা তনয়া নয়, 

যাঁরে সেবে বিধি বিষ্ণু হারে।

ও রাঙ্গা চরণ দুটি হৃদে রাখেন ধুর্জটি,

তিলার্ধ বিচ্ছেদ নাহি করে।।’

‘আগমনী’ পর্যায়ের অধিকাংশ গানে মাধুর্যরসের ধারা বয়ে গেলেও এখানে কিন্তু বিধি বিষ্ণু-শিবস্তুতা দেবীর ঈশ্বরীমূর্তিতেই তার ঐশ্বর্য বিকাশ করেছেন। বিজয়া পর্যায়ের কাঙ্গাল ফকিরচাদ রচিত একটি পদে মেনকা একদিন যেমন উমাকে বিদায় দিতে গিয়ে অতিশয় কাতর হয়ে পড়েছেন কন্যার বিরহ আশঙ্কায়, তেমনি ঐ পদেই আবার কন্যা উমাকে চৈতন্যরূপিণী ব্রহ্মময়ী’ বলে উল্লেখ করেছেন

‘মা গো, রজনী প্রভাত হয়েছে।

ও মা, ডাকিছে বিহঙ্গ, পবন তরঙ্গ

গন্ধভরে মন্দ মন্দ যে বহিছে।।

ভানু যত তনু প্রকাশ করিছে,

বিদায় দিতে তোমায় বিজয়া বলেছে;

দেই কেমন, ভেবে সেই ভাব মনে, সদা আঁখি ঝুরে,

আমার হাদয় ফাটিছে।। 

চৈতন্যরূপিণী তুমি ব্রহ্মময়ী,

তুমি নাই যথায় এমন স্থান আর কৈ? 

তোমায় দিলে বিদায়, সকলই যে যায়,

(মাগো) তোমার অবলম্বন করি’ এই জগৎ রয়েছে।’

কমলাকাস্তের আর একটি পদের কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে। গিরিরাজ গমন করিল হরপুরে। সেখানে গিয়ে হিমালয় প্রথমেই জামাতা শিবের সঙ্গে দেখা না কাঁৱে ‘গমন করিল গিরি শয়ন-মন্দিরে। পিতাকে দেখেই ছুটে এলেন কন্যা উমা, যিনি জগজ্জননীরূপে শিবের গৃহিণী। তারপর

‘জগজাননী তায় প্রণাম করিতে চায়,

নিষেধ করয়ে গিরি ধরি দুই করে।’

উমা নিজের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও যে মূলত স্বয়ং আদ্যাশক্তি পরনা প্রকৃতি, পিতা হিমালয় কিন্তু এই ধারণাটি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন নি বলেই কন্যার প্রণাম গ্রহণ করতে পারেন নি। ঐশ্বর্যরস আর মাধুর্যরস এখানে একাকার হয়ে গেছে।

‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ে সাধক কবি রামপ্রসাদের বহু পদেই দেবী একদিকে সবৈশ্বর্যময়ী আবার অন্যদিকে জননীরূপা। একই সঙ্গে ঐশ্বর্যরস এবং মাধুর্যরসের সমন্বয় ঘটেছে এমনি একটি পদ—

‘বল মা আমি দাঁড়াই কোথা।

আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা!

মার সোহাগে বাপের আদর, এ দৃষ্টান্ত যথা তথা 

যে বাপ বিমাতাকে শিরে ধরে,

এমন বাপের ভরসা বৃথা।।’

যে কালে আমাদের দেশে কুলীনের ঘরে বহু বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল, এই পদে সেই ঘরের ছেলের দুরবস্থার কথাই যেন কবি স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছেন। একেবারে ঘরের কথা—মাধুর্যরসেই পরিপূর্ণ। এই পদেরই শেষে আছে—

‘প্ৰসাদ বলে এই কথা, বেদাগমে আছে গাঁথা

শু-মা যে-জন তোমার নাম করে 

তার কপালে ঝুলি-কাথা।।’

—এখানে দেবী আর মানবী মাতা নন, তিনি পরমেশ্বরী রূপ ধারণ করেছেন।

শাক্তপদে ঐশ্বর্য ও মাধুর্যের যুগপৎ অবস্থান বিষয়ে সুধি সমালোচক ত্রিপুরা-শঙ্কর সেনশাস্ত্রী বলেন— “শাক্ত সাধকগণ শুধু জগন্মাতার মাধুর্যলীলারই বর্ণনা করেন নাই, তাহার ঐশ্বর্যেরও বর্ণনা করিয়াদেন। “আগমনী’ ও ‘বিজয়া’র গানে জগদম্বার লীলা মাধুর্য বর্ণিত হইলেও তাহার ঐশ্বর্যভাব একেবারে অনুপস্থিত নয়, আবার দশমহাবিদ্যার রূপবর্ণনায় তাঁহার ঐশ্বর্যভাব প্রাধান্য লাভ করিলেও তাহার মাধুর্য ঘন দিব্যমূর্তির কথাও পুরাণকার বিস্তৃত হন নাই। মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীর অপূর্ব কবিত্বপূর্ণ স্তবসমূহে যুগপৎ দেবীর ভীম ও কাস্ত রূপ বর্ণিত হইয়াছে। শাক্ত সাধকদের দিব্যদৃষ্টিতে জগন্মাতার ঐশ্বর্য ও মাধুর্য সমান মর্যাদা লাভ করিয়াছে।”