আগমনী বিজয়ার বিভিন্ন চরিত্র
শাক্ত পদাবলীর দুটি ধারা—একটিতে আছে ‘উমাসঙ্গীত’— ‘আগমনী বিজয়া’র প্রতিফলন ঘটেছে, অপরটিতে আছে ‘শ্যামাসঙ্গীত’— ভক্তের আকৃতি এবং জগজ্জননীর রূপ সম্বলিত পদগুলিতে এর পরিচয় বিধৃত। শ্যামাসঙ্গীতে আছে শুধু উপাস্যা এবং উপাসক এতে বিভিন্ন তত্ত্বের বিশ্লেষণ রয়েছে এ থেকে কোনো কাহিনী কিংবা চরিত্রের পরিচয় পাওয় যায় না। কিন্তু উমাসঙ্গীতে অর্থাৎ আগমনী-বিজয়া গানে বিবিধ পদের মাধ্যমে যেমন একটি কাহিনী গড়ে তোলা যায়, তেমনি এতে পাওয়া যায় কয়েকটি সুবলয়িত চরিত্র। উমাসঙ্গীতের বিভিন্ন পদের বিশ্লেষণে উক্তিটির যাথার্থ্য প্রমাণ করে।
উমাসঙ্গীতে বাঙালী ঘরোয়া জীবনের একটি কাহিনী রয়েছে। বিবাহের পর কন্যাকে পতিগৃহে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কালে কালে তারও সস্তান-সন্ততি হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘকালের মধ্যেও তার পিতৃগৃহে আসা হয়ে ওঠেনি। এদিকে কন্যাস্নেহাতুরা জননী প্রতিবেশির মুখে জামাতার সংসার-বিরাগী মনোভাবের কথা শুনে শঙ্কিত হন। তারপর যখন স্বপ্নে কন্যার দেখা পান, তখন আর কিছুতেই স্থির থাকতে পারেন না। তিনি স্বামীকে অনুরোধ করেন, তিনি জামাতা গৃহে গিয়ে যেন কন্যাকে একবার নিয়ে আসেন। পত্নীর পৌনঃপুনিক অনুরোধে স্বামী হিমালয় অবশেষে জামাতা গৃহে গমন করেন। সেখানে প্রথমেই তিনি কন্যার সঙ্গে দেখা করে তার মায়ের হৃদয়-বেদনার কথা প্রকাশ করেন। কন্যা তখন তার স্বামীর নিকট মাতৃ-দর্শনের নিমিত্ত আপন হৃহৃদয়-ব্যাকুলতার কথা জ্ঞাপন করলে তার স্বামী তাকে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি দিলে কন্যা তার পিতার সঙ্গে চলে আসে। এখানে ত্রিরাত্রি অবস্থানের পর চতুর্থ দিন প্রভাতেই জামাতা এসে কন্যাকে স্বগৃহে নিয়ে যায়। কন্যার পিতৃগৃহে আগমন, তার স্বল্পকালীন অবস্থান এবং প্রত্যাগমনকে অবলম্বন ক’রে মাতৃ-হৃদয়ের বিচিত্র ভাবানুভূতি স্বতঃ-উৎসারিত হয়ে যেভাবে প্রকাশিত হয়, বিভিন্ন শাক্ত কবি তাকেই রূপায়িত করে তুলেছেন আগমনী-বিজয়ার গানগুলির মধ্য দিয়ে বাঙালী গৃহজীবনের এই কাহিনীটিকেই আমাদের জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা’র মাধ্যমে রূপদান করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অস্তর্বেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেইজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ বাঙালির গৃহের এই চিরস্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপুজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান।” বাঙালী গৃহের এই কন্যাই জগন্মাতা দুর্গা,— তাঁর আগমনে সপ্তমী-অষ্টমী নবমী এই দিবসত্রয় পিতৃগৃহে অবস্থান এবং বিজয়া দশমীতে বিসর্জনকে নিয়েই এই কাহিনী গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন কবি বিচ্ছিন্নভাবে কতকগুলি পদ রচনা করলেও এগুলির সাহায্যে পূর্বোক্ত কাহিনীটি গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এই অনুসঙ্গে এক মহাজনের উক্তি উদ্ধারযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “মাটির কন্যার আগমনী গান এই তা সেদিন বাজিল। মেঘের নন্দী-ভৃঙ্গী শিঙ্গা বাজাইতে বাজাইতে গৌরী শারদাকে এই কিছুদিন হইল ধরা-জননীর কোলে রাখিয়া গিয়াছে। কিন্তু বিজয়ার গান বাজিতে আর দেরি নাই শ্মশানবাসী পাগলটা এল বলিয়া; তাকে তো ফিরাইয়া দিবার জো নাই; হাসির চন্দ্রকলা তার ললাটে লাগিয়া আছে, কিন্তু তার জটায় জটায় কান্নার মন্দাকিনী।”
দুটি পরিবারের চারটি চরিত্র নিয়ে আগমনী-বিজয়ার কাহিনীটি গড়ে উঠেছে। একটি পরিবারে আছেন গিরিরাজ হিমালয় ও তৎপত্নী মেনকা, অপর পরিবারে তাদের প্রাণতুল্য কন্যা পার্বতী উমা এবং জামাতা দেবাদিদেব শঙ্কর।
(ক) মেনকা: বাৎসল্য-রসাশ্রিত আগমনী-বিজয়ার পদগুলিতে প্রধানত মাতৃহহৃদয়ের বেদনাই প্রতিফলিত হয়েছে বলে সমগ্র কাহিনীটিতে বাঙালী জননীর প্রতিরূপ মেনকার ভূমিকাই প্রাধান্য লাভ করেছে। বস্তুত এগুলিকে ‘উমাসঙ্গীত’ নামে অভিহিত করা হয় এই কারণে যে সমগ্র কাহিনীটি উমাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে, উমা এখানে অনেকটা নিষ্ক্রিয় শক্তি—প্রধান সক্রিয় শক্তি মেনকা লীলা পর্বের প্রথমেই আছে ‘বাল্যলীলা’- মেনকার ভূমিকাও এখান থেকেই শুরু। উমার আধুটেপনায় ব্যতিব্যস্ত মেনকা গিরিরাজকে লক্ষ্য করে বলেন—
‘গিরিবর, আর পারি না হে প্রবোধ দিতে উমারে।
উমা কেঁদে করে অভিমান নাহি করে স্তন পান
নাহি খায় ক্ষীর ননী সরে।’
উমার আদর আবদারে ব্যতিব্যস্ত হলেও মেনকার এই অভিযোগের মধ্যে মাতৃহহৃদয়ের অকৃত্রিম বাৎসলাই কাব্যকলাবর্জিত সহজ সরল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য এই বৈষ্ণব কবিতার ‘বালালীলা’র পদগুলিতেও অনুরূপ বাৎসল্য রসের প্রকাশ ঘটেছে। তবে কৃষ্ণলীলায় যেমন কচিৎ ঐশ্বর্যরস তথা অলৌকিকত্বের দেখা পাওয়া উমা-লীলায় কিন্তু তা’ একেবারেই অনুপস্থিত। এই বাৎসল্যরসে যেন মাটির গন্ধ মাখা।
কৈলাসপতি শঙ্করের সঙ্গে কন্যা উমার বিয়ে হলেও মায়ের মনে শঙ্কা কখনও দূরীভূত হয়নি। একে ত উমাকে নিয়ে দেখা দুঃস্বপ্ন তার দিবসের চিত্তাকেও অধিকার করে বসে—
‘আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে।
গিরিরাজ অচেতন কত না ঘুমাও হে।।
এই এখনি শিয়রে ছিল গৌরী আমার কোথায় গেল
হে, আধ আধ মা বলিয়ে বিধুবদনে।।’
এর ওপর আবার নারদ এসে জামাতা শঙ্কর সম্বন্ধে অনেক দুশ্চিন্তার কথা বলে গেছেন—
‘শুনেছি নারদের ঠাঁই গায়ে মাখে চিতা ছাই
ভূষণ ভীষণ তার গলে ফণীহার।’
সর্বোপরি রয়েছে প্রতিবেশিদের গঞ্জনা :
“কি করে প্রাণ ধরে ঘরে আছ গো রাণী…
ভূপতি পাষাণ কায়া, দেহেতে নাই দয়া মায়া
তুমি তার বলে কি জায়া হলে পাষাণী।”
এরপর আর মেনকা ধৈর্য ধারণ করতে পারেন না তিনি গিরিরাজকে তাগিদ দিতে থাকেন- তিনি যেন অবিলম্বে কৈলাসে গিয়ে কন্যা উমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন—
‘যাবে যাবে বল গিরিরাজ গৌরীরে আনিতে।
ব্যাকুল হৈয়াছে প্ৰাণ উমারে দেখিতে হে।।
গৌরী দিয়ে দিগম্বরে আনন্দে রয়েছে ঘরে
কি আছে তব অস্তরে না পারি বুঝিতে।’
এই পদের মধ্য দিয়ে শুধু যে মাতৃহাদয়ের ব্যাকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে তা’ নয়, কন্যা বিষয়ে স্বামীর নিরাসক্তিও তাঁর ক্ষোভের কারণ ঘটিয়েছে। কন্যার দর্শনাকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুলা জননী কিন্তু সামাজিকতাবোধ সম্বন্ধেও সচেতন কন্যার মনস্তত্ত্বও তার অজ্ঞাত নয়, তাই জামাতাকেও সঙ্গে নিয়ে আসবার কথা স্বামীকে স্মরণ করিয়ে দেন—
‘গিরিরাজ হে জামায়ে এনো মেয়ের সঙ্গে।
মেয়ের যেরূপ মন মায়ে বোঝে যেমন,
পুরুষ পাষাণ তুমি বোঝ না তেমন।।’
মেনকার তাড়নায় গিরিরাজ উমাকে আনতে গেলেন। কিন্তু মেনকার আর তর সয় না তিনি ঘর বার হ’চ্ছেন- উমা তো এসে পৌঁছলো না। তাই তিনি বলেন—
‘গিরি গৌরী আমার এলো কৈ?’
অবশেষে প্রতীক্ষার সমাপ্তি হ’লো, প্রতিবেশি মেনকাকে জানালো—
‘গা তোল, গা তোল, বাঁধ মা কুম্ভল
ঐ এলো পাষাণী তোর ঈশানী।
লয়ে যুগল শিশু কোলে মা কৈ মা কৈ বলে
ডাকছে মা তোর শশধর বদনী।।’
কন্যার আগমন বার্তা পেয়ে তার দর্শনাকাঙ্ক্ষায় উতলাহয়ে উঠেন জননী মেনকা। তিনি পাগল পারা হয়ে ছুটে যান তাকে এগিয়ে নিতে—
‘অমনি উঠিয়ে পুলকিত হৈয়ে ধাইল যেন পাগলিনী।
চলিতে চঞ্চল, খসিল কুন্তল, অঞ্চল লোটায়ে ধরণী।।’
গিরিরাজ কন্যা উমাকে এনে মেনকার কোলে সমর্পণ করলেন—
‘গিরিরাণী, এই নাও তোমার উমারে
ধর ধর হরের জীবনধর।’
নিজের চোখের জল মুছে, মেয়ের মুখখানি মুছিয়ে দিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে মেনকা—
‘তখন গৌরী কোলে করি গিরি-নারী
প্রেমানন্দে তনু ভেসে যায়।’
মেনকার কোলে উমা, আর উমার কোলে পুত্র গণেশ-কার দিকে তাকালেন রাণী—
‘রাণী মনে ভাবেন—উমারে দেখি কি কুমারে দেখি
কোন রূপে সঁপিয়ে রাখি নয়নযুগলে।’
মেয়েকে কোলে নিয়েও মায়ের মনে স্বস্তি নেই, পতিগৃহে তার দিনগুলি যেমন কেটেছে, এ নিয়ে তার মনে ভয় রয়েছে কারণ,—
‘শুনি লোকমুখে শিব বিহীন-বৈভব
ফণী সব নাকি ভূষণ তার।’
শুধু তাই নয়, ঘরে নাকি তার সতীনও রয়েছে, তাই উমার কাছে জানতে চান—
‘কও দেখি উমা, কেমন ছিলে মা
ভিখারি হরের ঘরে?’
স্বামী-গরবিনী কি আর দুঃখের পাঁচালী গাইবার জন্য এতদিন পর পিতৃগৃহে এলেন? তাই তিনি তৃপ্ত হহৃদয়ে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন—
‘কে বলে দরিদ্র হর, রতনে রচিত ঘর
জিনি কত সুধাকর শত দিনমণি।…
শুনেছ সতীনের ভয়, সে সকল কিছু নয়
তোমার অধিক ভালবাসে সুরধনী।’
দেখতে দেখতে দুটি দিন– সপ্তমী অষ্টমী কেটে গেল, এলো দুরস্ত নবমী। রাত্রি প্রভাত হলেই তো ডম্বরুধ্বনি ক’রে জামাতা শঙ্কর এসে দ্বারে হানা দেবেন। মেনকার মনে হয় ঐ দ্বারে বাজে ডম্বুর হর বুঝি নিতে এল।’ তাই কখনো তিনি ভাবেন—
‘কালকে ভোলা এলে বলবো –
উমা আমার নাইকো ঘরে।’
কখনো বা মেনকার কাতর প্রার্থনা হৃদয় বিদারী আর্তস্বরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে –
‘ওরে নবমী নিশি না হইও রে অবসান।।
শুনেছি দারুণ তুমি না রাখ সতের মান।।’
কিন্তু প্রকৃতির বিধান লঙ্ঘিত হবার নয়—
‘কি হলো নবমী নিশি হৈল অবসান গো।।
বিসাল ডঙ্গুর ঘন ঘন বাজে শুনে ধ্বনি বিদরে প্রাণ গো।।’
তবু শেষ চেষ্টা জননীর আকুলকণ্ঠে ভিনি আবেদন জানান জয়ার কাছে—
‘জাগায়ো না হর-জায়ায় জয়া তোমায় বিনয় করি।
যাবে বলে সারানিশি কাদিয়া পোহাল গৌরী।’
দশমী প্রভাতে কালান্তক যমের মতই জননীর স্নেহাঞ্চল থেকে তার হৃদয়ের ধনকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে—
‘বিছায়ে বাঘের ছাল দ্বারে বসে মহাকাল,
বেরোও গণেশ মাতা ডাকে বার বার।।’
জননীর অস্তর বেদনা অস্তরকে শতধাবিভক্ত করতে পারে, কিন্তু বাইরের জগৎকে তো আর অভিভূত করতে পারে না। তাই যখন সত্যি সত্যি ঊমা যাত্রার জন্যে তৈরি হচ্ছেন, তখন জননীর শেষ আকৃতি—
‘ফিরে চাও গো উমা তোমার বিধুমুখ হেরি;
অভাগিনী মায়েরে বধিয়ে কোথা যাও গো’
এরপর উমা যখন চলেই যাচ্ছেন তখন সমস্ত লাজ-লজ্জা মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে মা মেনকা যেন ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে গিরিরাজকে লক্ষ্য ক’রে চীৎকার করে ওঠেন—
‘গিরি যায় হে লয়ে হর প্রাণকন্যা গিরিজায়,
ধর গঙ্গাধর পায়।’
‘আগমনী-বিজয়া’ গানে মেনকা চরিত্রের যে অপূর্ব রূপায়ণ ঘটেছে, তাকে ভাবঘন ভাষায় অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী এইভাবে বিশ্লেষণ করেছেন – “জননী মেনকার অপার বাৎসল্যে মৃত্যুঞ্জয় প্রেমের মহিমা বিঘোষিত হইয়াছে।… বালিকা কন্যাকে পতিগৃহে পাঠাইয়া জননীর যে দুশ্চিন্তা, তাহাকে কাছে পাইবার জন্য যে দুর্বার আগ্রহ কাছে পাইয়া মিলনের যে আনন্দ তন্ময়তা আবার বিদায় গিতে গিয়া যে মর্মস্পর্শী অশ্রুকাতরতা, তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে ও সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বর্ণনায় শাক্ত পদাবলীর লীলা অংশ করুণ-মধুর।” বস্তুত বাঙালী-গৃহের যে কোনো জননীর মতোই অবুঝ উমা জননী মেনকার মন, তাঁর আচরণেও সর্বদা বাঙালী-জননীর প্রতিরূপ প্রকাশিত। ফলে মেনকাকে একজন সাধারণ বাঙালী জননী বলে অভিহিত করলেও কোন অত্যুক্তি করা হয় না। বলতে দ্বিধা নেই, কৃষ্ণলীলার মা যশোদার চেয়েও মা মেনকার এই চিত্র বাঙালীর নিকট অনেক বেশি আপনার বলে মনে হয়।
(খ) উমা: শাক্ত পদাবলীর ‘আগমনী-বিজয়া’ অংশে দ্বিতীয় প্রধান উল্লেখযোগ্য চরিত্র ‘উমা’। উমাসঙ্গীতের প্রতি পদের বিষয় অবশ্যই উমা, এমন কোনো পদ নেই যাতে উমার প্রসঙ্গ নেই, কিন্তু সৎসত্ত্বেও উমা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় বলেই উমা চরিত্রটি প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে পারেনি।
মেনকার পৌনঃপুনিক অনুরোধে গিরিরাজ কৈলাসে গিয়ে প্রথমেই দেখা করলেন কন্যা উমার সঙ্গে—এখানেই আমরা প্রথম উমা চরিত্রের সম্মুখীন হই।
গিরিরাজ প্রবেশে কৈলাসপুরী, না ভেটিয়ে ত্রিপুরারি গমন করিল গিরি শয়নমন্দিরে’— অকস্মাৎ পিতার দর্শন লাভ ক’রে জগজ্জননী উমা সামাজিক সংস্কার বশে তাঁকে প্রণাম করতে গেলে ‘নিষেধ করয়ে গিরি ধরি দুটি করে। কবির অতিসচেতনতা এখানে গৌরী জগজ্জননী রূপে আভাসিত, কন্যারূপটি চাপা পড়ে গেল।
এবার গৌরী গেলেন পতি শঙ্কর সান্নিধ্যে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি চেয়ে বল্লেন—
‘দিন যত হয় গত,
মা আমার কাদিছে তত
আসব পুনঃ শীঘ্রগতি।’
গৌরীর অনুপস্থিতিতে সাংসারিক বিপর্যয় ঘটতে পারে আশঙ্কায় তিনি অতি শীঘ্র প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। তাঁর পিতৃগৃহে যাবার কারণ স্বরূপ শুধু মায়ের কান্নাই নয়, তিনি নিজেও যে স্বপ্নে মাকে দেখে মাতৃদর্শনের জন্য আকুল হয়ে উঠেছেন, সে কথাটি বলতে ভোলেন না। উমা শিবের সহানুভূতিলাভের উদ্দেশ্যে নিজের আকুলতার ওপরই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করবার জন্য এক স্বপ্ন-কাহিনীর অবতারণা করেন—
‘কত না দেখেছি স্বপনে যোগনিদ্রা ঘোরে।
বিশেষে জননী আসি, আমার শিয়রে বসি
“মা দুর্গা” বলে ডাকে সঘনে।’
জনক-জননীর জন্য যে সন্তানের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেতে চায়, একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যে তো তা বুঝতে পারে না। তাই উমা বলেন—
‘এ জ্বালা কি জানে অন্যে, আমি মার এক কন্যে
গিয়ে তিন দিন জন্যে, রব পিত্রালয়ে।’
গৌরীর কথা শুনে, মহাদেব চিন্তিত হয়েছেন, মাটিতে আঁকিজুকি কাটছেন—এটি গৌরীর দৃষ্টি এড়ায় নি। তাই তিনি পতি শঙ্করকে জিজ্ঞেস করেন—
‘কি ভাবিছ মনে মনে, ক্ষিতি নখ লেখনে
হয় নয় প্রকাশ বদনে….
নাথ, পুর মন-আশ না করহ উপহাস, বিদায় করহ হর
সরল বচনে।।’
অতঃপর শঙ্করের অনুমতি নিয়ে পিতার সঙ্গে উমা এলেন পিতৃগৃহে। ‘আমার উমা এলো’ বলে রাণী এলোকেশে ধায়” তারপর তাকে সানন্দে ঘরে তুলে এনে—
‘বসিলেন মা হেমবরণী হেরম্বে লয়ে কোলে।
হেরি গণেশ জননী-রাপ রাণী ভাসেন নয়ন জলে।’
জননী মেনকা কন্যা উমাকে বুকে তুলে নিলেন। এই প্রসঙ্গে আর একবারের কথা মেনকার মনে এলো। সেবার তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার শিব তো আছেন ভাল?’
‘উমা’ বলে—’আছেন ভাল’–চোখে দেয় অঞ্চল, বলে—’চোৰে কি হল? আমার চোখে কি হল?’—–স্বামী সঙ্গে আসেন নি তার বিরহ কন্যাকে শোকাকুল ক’রে তোলায় যে তার চোখে জল এসে গেছে, কিন্তু অন্য কথায় উমা তা লুকাতে চাইছে উমার এ ছলনাটুকু মায়ের দৃষ্টি এড়ায় নি, কিংবা তাঁর বুঝতেও অসুবিধে হয়নি।
গৌরীর এই ছলনার আরও একটি দৃষ্টান্ত মেনকার মনে আসে। তিনি বলেন যে আর একবার গৌরীর কোলে থেকে কার্তিক হঠাৎ গিরিরাজ হিমালয়কে দেখে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেছিল—
‘মা, ওমা, ওকে দাঁড়ায়ে?’
উমা বলে—“তোমার দাদা ঐ, বাবা, আমার বাবা ঐ।”
তখন ‘বাপ-সোহাগে’ কার্তিক মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে—’মা, আমার বাবা কই?’ গৌরী তখন উত্তর করেছিলেন— ‘কেন এলেন না, তোমার দিদি জানে।’ অর্থাৎ জামাতাকে আনা হয়নি এই অভিযোগটি গৌরী কৌশলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
একবার উমা নিজে থেকেই পিতৃগৃহে এসেছিলেন। খবর পেয়ে মেনকা এগিয়ে যেতেই অভিমানিনী উমার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল—
‘কই মেয়ে বলে আনতে গিয়েছিলে?
তোমার পাষাণ প্রাণ, আমার পিতাও পাষাণ
জেনে, এলাম আপনা হতে।’
মা যেমন কন্যাস্নেহাতুরা, কন্যা উমাও যে তেমনি মাতৃস্নেহ কাঙালিনী উমার এই অভিমানিনী রূপ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যা হোক্ পূর্ব কাহিনী স্মরণে ঘটনাপরম্পরা থেকে মা মেনকা এবার আগেই সতর্ক হ’য়ে উমার কুশলাদি জানতে চান।
‘ও মা, কেমন ক’রে পরের
ছিলি উমা, বল মা তাই।’
উত্তরে এবারও উমার কণ্ঠে অভিমানের সুর বেজে ওঠে :
তুমি তো মা ছিলে ভুলে,
আমি পাগল নিয়ে সারা হই।…
দিতে হয় মা মুখে তুলে
নয়তো খেতে যায় গো ভুলে,
খেপার দশা ভাবতে গেলে আমাতে আর আমি নই।’
পাগলা ভোলা সম্বন্ধে মেনকা নানা কথা অপরের মুখে আগেও শুনেছেন। তদুপরি জামাতা শিবের দারিদ্র্য, ঊমার সতীন-জ্বালা প্রভৃতি সংবাদও তার কানে পৌঁছেছে। বুদ্ধিমতী উমা এ সমস্ত প্রসঙ্গ উঠবার আগেই তাই তার উত্তরে জানিয়ে দেয় যে সে স্বামীগৃহে পরম আনন্দেই রয়েছে—
‘কে বলে দরিদ্র হর, রতনে খচিত ঘর মা,
জিনি কত সুধাকর শত দিনমণি।
বিবাহ-অবধি আর কে দেখেছে অন্ধকার,
কে জানে কখন দিবা কখন রজনী।।’
আর সতীনের ভয়? তারও কোন কারণ নেই—
‘শুনেছ সতীনের ভয়, সে সকল কিছু নয় মা
তোমার অধিক ভালবাসে সুরধুনী।
মোরে শিব হাদে রাখে জটাতে লুকায়ে দেখে
কার কে এমন আছে সুখের সতিনী।’
বুদ্ধিমতী উমা মাতৃহহৃদয়-বেদনা স্বীয় অস্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন বলেই কথার ছলে নিজের আনন্দময় জীবনের চিত্র তার চোখের সামনে তুলে ধরেন। এরপর বিজয়া-পর্বে আর উমার কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই, সবটাই মা মেনকার বিলাপ। শুধু একটি ক্ষেত্রে মায়ের উক্তিতে উমার আসন্ন বিচ্ছেদ-কাতরতার কিছুটা পরিচয় পাওয়া গেছে। বিজয়া দশমীর প্রভাতেই উমা আবার পতিগৃহে চলে যাবেন বলে সারা নবমী নিশি কেঁদে কাটিয়েছেন, ঘুমাতে পারেন নি, তাই মেনকার উক্তি—
‘জাগায়ো না হরজায়ায় জয়া তোমায় বিনয় করি।
যাবে বলে সারা নিশি কাঁদিয়া পোহাল গৌরী।।
নিশি জেগে কাতর হয়ে আছেন উমা ঘুমাইয়ে।
বিষাদেও বিধু বদন মলিন হয়েছে, মরি।।’
এই উমা জগজ্জননী হলেও শাক্ত পদকর্তারা তাকে একেবারে বাঙালী ঘরের কন্যারূপেই উপস্থাপিত করেছেন। এখানে কোথাও তার ঐশ্বর্যরূপের প্রকাশ নেই, সর্বত্রই মাধুর্যের বিস্তার।
ক্বচিৎ দু’একজন ভক্ত কবি ভক্তের আতিশয্যে এই বাল্যলীলাতেও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে এসেছেন। আমাদের পাঠ্য পদগুলির মধ্যে অজ্ঞাত কবির ৭২ নং পদটিতে (গা তোল, গা তোল গিরি) এবং নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় রচিত ৭৭ নং পদে (‘গা তোল, গা তোল উমা) কিঞ্চিৎ ঐশ্বর্যরসের প্রকাশ ঘটেছে। শেষোক্ত পদে আছে—
‘ব্রহ্মা আদি দেবগণ করিতেছেন আগমন
পুঁজিতে ও শ্রীচরণ, করে জবা-বিগ্বদল।’
(গ) গিরিরাজ ও শঙ্কর: শাক্ত পদাবলীতে গিরিরাজ প্রায়শ উপস্থিত মহাদেব শঙ্করেরও একটি বিরাট ভূমিকা আছে, কিন্তু প্রায় সর্বত্রই তারা উভয়েই নিষ্ক্রিয় শক্তি। অধিকাংশ পদই মেনকার উক্তিরূপে রচিত হয়েছে, এ সব ক্ষেত্রে সর্বত্র উদ্দিষ্ট গিরিরাজ। কিন্তু মেনকার উক্তিতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। শুধু তার কৈলাসে গমন এবং সেখানে গৌরীর সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যেই তাঁর কিছু সক্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়।
মহাদেবও প্রায় সর্বত্র নিষ্ক্রিয়, শুধু একবার তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে, যখন তিনি গৌরীকে। পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি দিচ্ছেন। আর সর্বশেষ একবার, যখন তিনি গৌরীকে আনতে হিমালয় গৃহে গণেশ জননীকে আহ্বান জানাচ্ছেন। এর মধ্যে থেকে এঁদের কারোর চরিত্রই বিশেষভাবে ফুটে উঠবার অবসর পায়নি —একজন নির্বিশেষ পিতা, অপরজন নির্বিশেষে স্বামীরূপেই বর্তমান রয়েছেন।
Leave a comment