আখ্যান বা কাহিনি কাব্যের অন্যতম অন্তর্গত বিষয় হল ব্যালাড। তাছাড়াও আখ্যানধর্মী কাহিনির মধ্যে সর্বাধিক বেশি গুরুত্ব ও বৈচিত্র্য মহাকাব্যের। কিন্তু মহাকাব্য ব্যতীত আখ্যান কাব্যের অন্যান্য প্রকরণগুলি হল—মঙ্গল কাব্য, জীবনী কাব্য, রূপক কাব্য, নীতি কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা ইত্যাদি। এখন আমরা মঙ্গলকাব্য বিষয়ে আলোচনা করতে পারি।
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল স্থান অধিকার করে আছে মঙ্গল কাব্য, লোকজীবন ও ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তি থেকেই উৎপত্তি মঙ্গল কাব্যের, বিভিন্ন দেব-দেবীর যেমন মনসা, চণ্ডী, ও ধর্ম, শিব ইত্যাদিকে স্তুতি ও মাহাত্ম্যকীর্তন ছিল এইসব আখ্যানের বিষয়। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে মৌলিক আখ্যান কাব্য বলতে একমাত্র এই মঙ্গল কাব্যকেই বুঝি, কারণ অন্যান্য আখ্যান কাব্যের অধিকাংশই ছিল অনূদিত। রামায়ণ, মহাভারত কিংবা ভাগবতের অনুবাদ সম্পর্কে একথা প্রযোজ্য।
এখন মঙ্গল কাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলির দিকে চোখ বোলানোর আগে একবার দেখে নেওয়া যাক শ্ৰী আশুতোষ ভট্টাচার্য মঙ্গল কাব্যের সংজ্ঞা দিতে দিয়ে ঠিক কি বলেছেন— “আনুমানিক খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দী হইতে আরম্ভ করিয়া অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভরতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গসাহিত্যে যে বিশেষ এক ধর্ম বিষয়ক আখ্যানকাব্য প্রচলন ছিল, তাহাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্যে নামে পরিচিত।”
আখ্যান কাব্যের বৈশিষ্ট্যাগুলি হল নিম্নরূপ—
(১) মঙ্গল কাব্যের সাধারণত দুটি খণ্ড বর্তমান। দেবখণ্ড ও নরখণ্ড। দেবখণ্ডে দেব দেবীদের কথা থাকে ও নরখণ্ডে থাকে সেই শাপভ্রষ্ট দেবদেবীর কথা যাগ মর্ত্যে অবস্থান করেছেন। তবে দৃশ্যত মঙ্গলকাব্যে চারটি খণ্ড, ‘বন্দনা খণ্ড’, এই খণ্ডে দেবদেবীর বন্দনা বা প্রশস্তি গান গাওয়া হয়। ‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ খণ্ডে কাব্যরচনার মূলে যে দেব বা দেবীর আদেশ থাকে তার বর্ণনা দেন কবি। এখানে কবি তাঁর আত্মপরিচয়ও দান করেন। দেব খণ্ডে সেই অভিশাপের কথা বর্ণিত হয়, যার জন্যই দেব বা দেবীকে মর্ত্যে জন্ম নিতে হয় মর্তে থাকে তাদের মানবরূপে লীলার বর্ণনা।
(২) গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে কবির তৎকালীন সমষ্টি অবজ্ঞ সমাজ পরিবেশ, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবেশের সুস্পষ্ট চিত্র মেলে, যার সাহিত্য মূল্য অসীম।
(৩) মঙ্গল কাব্যে কতকগুলি বিষয়ে উল্লিখিত থাকেই যেমন বারমাস্যা, নারীগণের পতিনিন্দা, রান্না ও খাওয়ার বিপুল বর্ণনা, চৌতিশা স্তব ইত্যাদি।
(৪) দেব দেবীদের মাহাত্ম্য জ্ঞাপক কাব্য হলেও মঙ্গল কাব্যে মানব মানবীর চরিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে এবং সেই চরিত্রগুলির বহু বৈচিত্র্যও ফুটে উঠেছে, মঙ্গল কাব্যে যেমন চাঁদ সদাগরের মতো দৃপ্ত, সৎ চরিত্রের পরিচয় পাই তেমনি ভাঁড়ু দত্ত বা মুরারীশীলের মতো শঠ, খল চরিত্রও অত্যন্ত সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
Leave a comment