প্রশ্নঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে ওসমান চরিত্রের প্যাটার্নের মধ্যে মধ্যবিত্ত মানসের যে সকল বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস ঘটেছে তা উপস্থাপন কর।
অথবা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাস অবলম্বনে ওসমান চরিত্র চিত্ৰণ কর।
অথবা, “মধ্যবিত্তের ব্যক্তিসর্বস্ব, আত্মপ্রেম ও আত্মনিগ্রহপরায়ণ চেতনা প্রবল গণআন্দোলনের টানে কীভাবে চিলেকোঠার বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে, ওসমান গনি চরিত্রটি তার দৃষ্টান্ত।”- এ সম্পর্কে তুমি তােমার মতামত দাও।
উত্তরঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। তিনি মাত্র দু’টি উপন্যাস ও কয়েকটি গল্পগ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬) লেখকের খুব অসাধারণ একটি উপন্যাস। তার এই সার্থক উপন্যাস সৃষ্টির পিছনে সবচেয়ে বড়াে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তার চরিত্র চিত্রণের অসাধারণ দক্ষতা। তিনি তার নিপুণ হাতে চরিত্রগুলাে সৃষ্টি করে ব্যতিক্রমী শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছেন। ওসমান, আনােয়ার, আলাউদ্দিন, হাড্ডি খিজির, আলিবক্স, জালাল মাস্টার, রানু, রঞ্জু, মকবুল হােসেন প্রভৃতি সবগুলাে চরিত্রই প্রায় নিপুণভাবে সেই সময়ের মানসকে ধারণ করে আছে।
ওসমান চরিত্রটিকে এ উপন্যাসের প্রতীকী ও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওসমান ও তার পরিপার্শ্ব এবং পরিচিতের সীমার মধ্যেই উপন্যাসের মূল ভাষ্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। ফলে ওসমানের প্রতি লেখকের মনােযােগ ছিল সবচেয়ে বেশি। এ উপন্যাসে চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমান। বাবা ইব্রাহিম শেখ ইন্ডিয়ায় থাকে। ওসমান বাস করে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়। রহমতউল্লাহ মহাজন বা বাড়িওলার চিলেকোঠায় থাকে- সে গােসল ও প্রস্রাব করে ছাদে, পায়খানা সারে অফিসে, সিনেমা হলে বা মসজিদে। ইপিআইডিতে কাজ করে। ওসমানের ডাকনাম রঞ্জু। ওসমানের বাবা ইন্ডিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। সে চলে গেলেও ওসমান রয়ে যায়। ওসমান প্রথমে তার বাপের এক মামাতাে ভাইয়ের। বাসায় অর্থাৎ তার এক চাচার বাসায় থেকে ভর্তি হয় আর্মানিটোলা স্কুলে। চাচাতাে ভাইবােনদের পড়াতাে, কিন্তু তার চাচি তার সাথে দুর্ব্যবহার করত, তাই সে বাসা নেয় চিলেকোঠার উপর। ওসমান ছেলেবেলায় খুব সেন্টিমেন্টাল ছিল। কী কথায় তার রাগ হতাে, কোনাে কথায় সে অপমানবােধে টং হতাে- তা তার জানা ছিল না।
সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে ওসমানও মধ্যবিত্তের সন্তান। তার মনােজগৎ মধ্যবিত্ত সুলভ মানসিকতায় পূর্ণ। লেখক এই উপন্যাসে যে আন্দোলনের কথা বলেছেন, সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনােয়ার আর আলতাফ। আছে রিকশা শ্রমিক বস্তি বাসিন্দা খিজির। গল্পের ফোকাস কখনাে ছিল হাড্ডি খিজিরের উপর, কখনাে বা আনােয়ারের উপর। তবে পুরাে গল্পে অস্তিত্ব ছিল ওসমানের। ঢাকার এক ঘিঞ্জি গলির মধ্যে ওসমানের বাস। তার বন্ধু আলতাফ, আনােয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে কিন্তু ওসমান কোনাে কিছুতেই নেই। সে যেন চিলেকোঠাতে বন্দি। লেখক ওসমান চরিত্রটিকে রহস্যময় করে তৈরি করেছেন। ওসমান যে বাসায় ভাড়া থাকে সেটা আবার আইয়ুবপ্রেমী মহাজন রহমতউল্লাহর। স্বৈরাচারীদের গুলিতে নিহত হয় তারই বাড়ির অন্য ভাড়াটে মকবুল সাহেবের ছেলে তালেব। তালেবের লাশ দেখানাের জন্য রাস্তার সমস্ত মানুষকে সে ডাকতে চায়- মূলত তার সব ভাবনা মনে মনে- স্বপ্ন- কল্পনা ও ভাবনার পুষ্টিতে তার বেঁচে থাকা। সে নীরব বিদ্রোহী-চিন্তার ফ্রেমে তার আন্দোলন সংগ্রাম। তালেবকে যারা হত্যা করেছে, দাফনের দায়িত্ব তাদেরই- এ কথা সে মনে মনে বলে। স্ট্রাইকের দিনও সে অফিসে যায়। আবার আগুন- প্রতিবাদ ইপিআরের জোয়ানদের দেখে তার লাথি মারতে ইচ্ছে হয়- কিন্তু মারে না। ওসমানের সবকিছু গুলিয়ে যায়। সে আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী বাম রাজনীতিক আনােয়ারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে বন্ধু আনােয়ারকে প্রতিদিন একবার ফোন দেয়। কিন্তু জরুরি সময় সে আনােয়ারের নম্বর মনে করতে পারে না। সে কথা বলবে সেক্রেটারিয়েটে অথচ ফোন করে বসল বাড়িতে। পাকবাহিনীর সামনে বাঙালি খালি হাতে মিছিল করলে ওসমানের বুক গর্বে ভরে ওঠে, সেও স্লোগানে সামিল হয়। শ্লোগানের পাল্টা জবাব দেয়।
ওসমান খুব লাজুক- মকবুল সাহেবের মেয়ে তার কাছে অঙ্ক করতে যায়, রানুর নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম সে দেখে- অনেক কথা তার বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। রানু সামনে এলে সব কথা তার বন্ধ হয়ে যায়। সে চাবি রেখেছে। রঞ্জুদের (রানুদের) বাসায়, তার আসতে রাত হয়েছে- রঞ্জুরা ঘুমিয়েছে কি না তাই সে তাদেরকে না ডেকে রাতে একা একা ঘরের বাইরে বসে থাকে। খিজির রঞ্জুকে ডাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলে ওসমান তাকে নিষেধ করে। রানুর সামনে গেলে তার বুক দুরু দুরু করে। মকবুল সাহেবের কথার জবাবে ওসমানের মুখ খােলে- সে বলে- “কথা বললেই টিয়ার গ্যাস, গুলি- মানুষের ন্যূনতম অধিকার থাকবে না? সরকার বাড়াবাড়ি করলে মানুষ কী করবে? তারা কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে?”
ওসমান রােমান্টিক। আসাদুজ্জামানের শােকসভায় ইপিআরের লাটিচার্জে মিছিলের সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সারাদিন শেষে সে ডেরায় ফিরলে- রানু বলেছিল- এতক্ষণে আসলেন- রানুর এ কথাটাই তার কানে বেজেছে সারাক্ষণ। রানুর ভালােবাসায় সে উন্মত্ত অধীর, কিন্তু রানুকে কখনাে মুখফুটে বলতে পারেনি।
ওসমানের এসিডিটির দোষ আছে, তাই সে মাঝে মাঝে নােভালজিন খায়। চারপাশের সবকিছু দেখে তার ঘনঘন মাথা ধরে। সে কিছুই বলতে পারে না বলে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়। স্বাধীনতার কথায় তার তপ্ত করােটিতে শীতল হাওয়া খেলে। শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি বলে ওসমানের সবকিছু তেতাে মনে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলে ওসমানের চেয়ে খুশি কেউ হবে না। মিছিলে গুলি হলে- লাশ দেখলে বা লাশের কথা শুনলে ওসমানের চিনচিন করে পেটব্যথা শুরু হয়। সে দেখতে পায় মৃতদেহগুলােকে ট্রাকে তুলছে। ওসমানের জ্বালানাে আগুনে আইয়ুব খানের ছবি পােড়ানাে হয়েছে। এটাই তার গৌরব, এটাই তার অহংকার।
ওসমান রাগ করতে জানে না, মাথানিচু করে হাসে। সামনের কিছুই সে দেখতে পায় না। এমন চললে শেষে কি না সে গাড়ির তলে পড়ে। মূলত ওসমান যখন দেখে যে- রাস্তায় এক বৃদ্ধকে আর্মি লাথি মারছে, ওসমানের তখন ইচ্ছে হয় লাফ দিয়ে আর্মির ঘাড়ে পড়ে। রঞ্জুকে যখন এ কথা বলে তখন রঞ্জু ভয় পায়। রঞ্জু ভয় পেলে ওসমান তাকে ঠাস করে এক চড় মারে। ওসমান খিজিরকে বলে যে- সে কি ঐ মিলিটারির কান দুটো ছিড়ে আনতে পারেনি।
ওসমান পাকবাহিনীর সবকিছু দেখে তার মধ্যে দ্রোহের জন্ম নেয় কিন্তু সে স্বভাবে চাপা বলে কথা কম বলে এবং তার দ্রোহগুলাে আগুন হয়ে ভেতরে নিজেকে পােড়ায়, অপ্রকাশের ভারে তার আচরণে অসংগতি ধরা পড়ে। সারা শহরে আগুন, আগুনকে কদমবুসি করতে নদী এগিয়ে যায়। বুড়িগঙ্গার ঢেউ লেগে আগুন তাে আরাে লকলক করে বাড়ে।
ওসমান কোনাে আন্দোলনে তেমন নেই কিন্তু সে দিন-রাত্রি স্বাধীনতা আর মুক্তি নিয়ে ভাবে। আন্দোলনে লাখ লাখ বের হওয়া মানুষ দেখলে সে যেন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ওসমান ভাবতে থাকে…বাংলা বাজার, তাঁতি বাজারের মানুষ লুপ্ত-খালের হিম হৃৎপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তাে ইব্রাহীম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি পরা সেপাইরা। শায়েস্তা খার টাকায় আট মণ চালের আমলে না খেয়ে মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাহ, কেউ চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মুঘলের হাতে মার খাওয়া, কোম্পানির বেনেদের হাতে মার খাওয়া-সব মানুষ না এলে মিছিল কি এত বড় শােষণ থেকে মুক্তির সুরাহা দিয়েছে লেখক ওসমানের চিন্তার মাধ্যমে তা দেখিয়েছেন। আরােপ করা সামরিক শাসনের নির্যাতনে বন্ধুরা যখন বিহ্বল, ওসমানের ডানায় তখন লাগে প্রবল বেগ। সহনামী কিশােরকে সে চুম্বনে রক্তাক্ত করে বিকৃত যৌনতার বশে নয়, আত্মপ্রেমে পরাজিত হয়ে। ওসমান একজন। সে এক নার্সিসাস। কিন্তু এখানে তার শেষ নয়। নিজের খাঁচা থেকে বেরুবার জন্য তার ডানা ঝাপটানাে পরিণত হয় প্রচণ্ড ক্রোধে। রকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য সে প্রাণান্ত উদ্যোগ নেয়। এ কি তার আত্মপ্রেম বিসর্জনের প্রস্তুতি? পরিচিত সবাই ওসমানকে চিহ্নিত করে বদ্ধ পাগল হিসেবে। অনুরাগী বন্ধুরা তাকে বন্দি করে রাখে নিজের ঘরে। এখন এই বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে ওসমানকে উদ্ধার করতে পারে কে। এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন? ভােটের রাইট প্রার্থী আলতাফ? রাজনৈতিক বিশ্লেষক বামপন্থি আনােয়ার? এরা কেউ নয়। চিলেকোঠার দুর্গ থেকে ওসমানকে বেরিয়ে পড়তে প্ররােচনা দেই হাড্ডি খিজির যে নিজের বাপের নাম জানে না, যে বড় হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়, যার মা বৌ দুজনেই মহাজনের ভােগ্য এবং গণঅভ্যুত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফু চাপা রাস্তায় যে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয় মিলিটারির হাতে। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে সক্রিয় সাড়া দিয়ে ওসমান ঘরের তালা ভাঙে। সবার অগােচরেও সে বেরিয়ে আসে রাস্তায়, কারফুর দাফট অগ্রাহ্য করে। তার সামনে এখন অজস্র পথ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ যে দিকেই পা বাড়ায় সেদিকেই পূর্ব বাংলা। একসময় শিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয় ওসমান। স্বাধীনতার নেশাই হয়তাে তাকে পাগল করে ফেলে।
ওসমানের অবস্থা আরাে খারাপ হয়। তাকে প্রায়ই দেখা যায় ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কখনাে বা স্টেডিয়ামের বারান্দায় চিৎকার করে দৌড়ায়। নােংরা কাপড়, কথাবার্তার ব্যালেন্স নেই। আনােয়ারের খোঁজ নেয় বেশি বেশি। ওষুধের সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ ওকে সঙ্গ দিতে হবে।
উনসত্তরের সংগ্রাম ও মিছিলে তরঙ্গিত রাজনৈতিক শহর ঢাকা। মধ্যবিত্তের ব্যক্তিসর্বস্ব, আত্মপ্রেম ও আত্মনিগ্রহপরায়ণ চেতনা প্রবল গণআন্দোলনের টানে কীভাবে চিলেকোঠার বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে, ওসমানগনি তার দৃষ্টান্ত। উলিত, আত্মমুগ্ধ, বিবরবাসী মধ্যবিত্তের প্রতিভূ ওসমান। কেরানি ওসমান পুরাতন ঢাকার এক চিলেকোঠার ভাড়াটে বাসিন্দা। সে উন্মূলিত-অস্তিত্ব, তার পরিবারের অন্য সবাই ভারতের অধিবাসী। ওসমানের মধ্যে যে আত্মমুগ্ধতা ও স্মৃতিক্লিষ্টতার বিন্যাস ঘটেছে তা সামন্ত জীবনের টানে নয়- বিচূর্ণ, ভগ্ন বর্তমানের অসংগতিজাত। গণঅভ্যুত্থানের প্রথম পর্যায়ে অনেকটা নির্লিপ্ত দর্শকের মতাে ওসমানের গতিবিধি। সে রাজনীতি-সচেতন অথচ আত্মমগ্ন তার মানস গড়নের মধ্যেই এক ধরনের অক্রিয়তা বিদ্যমান। কিন্তু সংগ্রামে-মিছিলে-রক্তপাতে শিহরিত ঢাকার বহির্জীবন তাকে আকর্ষণ করে। রাজনীতি তার কাছে হয়তাে-বা বুদ্ধিবিলাস, কিন্তু এই অস্ফুট চেতনাবীজ থেকেই জন্ম নেয় সমষ্টিলগ্ন সংগ্রামী জীবনাকাঙ্ক্ষাঃ
“একটি ঘটনার প্রত্যাশায় ওসমান খাবার কথা ভুলে তাড়াতাড়ি হাঁটে। কিন্তু ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে না পৌছাতে জানাজা শেষ হলাে। গত কয়েকদিনে সারা পাকিস্তান জুড়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহিদদের জানাজা। লম্বা কাতারগুলাে ভেঙে যাচ্ছে, এদিক ওদিক লােকজনের ছােটো ছােটো জটলা। ছাত্রদের পরবর্তী কর্মসূচি জানবার জন্য। ওসমান একবার এ-জটলা একবার ও-জটলার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু মাইকের পোঁ পোঁ ধ্বনি ছাড়া কিছুই বুঝা যায় না। মাইকের এই ভোঁতা সংগীত ছাপিয়ে ওঠে স্লোগান, ‘শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’; ‘পুলিশী জুলুম পুলিশী জুলুম’; ‘বন্ধ করাে, বন্ধ করাে।’ গেটে দাঁড়ানােচালম্বা সাদা ও ধূসর ঘােড়াদের পা কাপে। দিকে দিকে আগুন জ্বালাে, ‘আগুন জ্বালাে আগুন জ্বালাে’ ওসমানের বুক দারুণভাবে ওঠানামা করে। স্লোগানগুলাে একটি একটানা আওয়াজে মিলিত হয়ে তার করােটির দেওয়াল দৃপ্ত করে তােলেঃ শুওরের বাচ্চা আইয়ুব খান মােনেম খানের চাকর বাকরের দল, দ্যাখ! ভালাে করে দেখে নে। তােদের সামনে খালি হাতে বুক সর্বস্ব করে তােদের বাপ আইয়ুব খানকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছে এরা! ভরা গলায় ওসমান স্লোগানের জবাব দেয়, ‘মুক্তি চাই মুক্তি চাই!”
এই উদ্ধতি থেকে ওসমানের আত্মস্বরূপের প্রকৃত পরিচয় অনুধাবন সম্ভব। তবুও সমষ্টি থেকে দূরবর্তী ওসমানের জন সংঘচেতনার উদ্দীপক হিসেবে অসংগঠিত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামী খিজিরের প্রয়ােজন হয়। খিজিরের অভিজ্ঞতা এবং আতদান ওসমানের ব্যক্তিভূগােলের সীমাকে ঊনসত্তরের সংগ্রামী জনসমুদ্রে প্রসারিত করে দেয়। তার চেতনাগত বিস্তার অতিক্রম করে যায় বর্তমান সময়বৃত্তঃ
“ওসমান ফের ছাদে যায়। শওকতের পাশে দাঁড়িয়ে রেলিঙে ভর দিয়ে দেখল মাত্র ৭ জন লােকের সঙ্গে স্লোগান দিতে দিতে নামল খিজির আলি, ‘সান্ধ্য আইন সান্ধ্য আইন’; ‘মানি না মানি না’; ‘আগুন জ্বালাে আগুন জ্বালাে’-‘দিকে দিকে আগুন আলাে’, ‘জেলের তালা ভাঙব’ ‘শেখ মুজিবকে আনব’। কয়েক মিনিটের ভেতর নানা দিক থেকে এই সব স্লোগানের প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে। মহল্লার গলি উপগলি শাখাগলি থেকে আরাে সব লােক এসে ছুটছে খিজিরের সঙ্গে। এতাে লােক কোথেকে আসে? পাড়ায় কি এত মানুষ আছে? হ্যাঁ, এবার ওসমান ঠিক ধরতে পেরেছে। মহল্লার জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে যােগ দিচ্ছে ১০০ বছর আগে সায়েবদের হাতে নিহত, সায়েবদের পােষা কুকুর নবাবদের হাতে নিহত মিরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, লক্ষ্ণেী-এর মানুষ, ঘােড়াঘাটের মানুষ, লালবাগের মানুষ। গা একটু ছম ছম করলেও ওসমান সামলে নেয়। না তার ভয় কি?”
সংঘচেতনায় উদ্দীপ্ত, কিন্তু সংঘবিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় ওসমান চরিত্রের যে দ্বৈততার প্রকাশ, সুদীর্ঘ কলােনিয়াল উত্তরাধিকারবাহী মধ্যবিত্তের স্বভাবের পরিচয়বাহী। খিজির নিহত হওয়ার পরই প্রকৃতপক্ষে আত্মরূপান্তর ঘটতে থাকে। ওসমানের। তার বহু যত্নে অর্জিত শ্রেণি-অস্তিত্বই যেন হয়ে ওঠে প্রকম্পিত। একজন মৃত খিজিরকে কেন্দ্র করে সে আবিষ্কার করে অসংখ্য খিজিরের সম্মিলিত স্রোতােধারাঃ
“আমি তাে খিজিরকে চিনি। খিজিরদের horizontal মিছিল দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।”
ওসমানের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হয়। সে আলতাফ বা আনােয়ার কাউকে চিনতে পারে না। তাদেরকে কর্নেল ব্রিগেডিয়ার এসব ভাবে। ওসমান আনােয়ারের মুখে থুতু দেয় এবং বলে শালা কর্নেলের বাচ্চা- কথা দিয়ে কথা রাখলি না।
ওসমান চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে পড়েছে, আর নেই পিছুটান, মৃত খিজিরের আত্মা তাকে প্রণােদনা দিচ্ছে। ওসমান খিজিরের ডাক শুনতে পায়। আনােয়ার ঘুমাচ্ছে। ওসমান জোড় পায়ের লাথিতে তালা ভেঙে বেরিয়ে আসে। ভিক্টোরিয়া পার্ক ঘুরে ওসমান: কলতাবাজার হয়ে ছুটতে শুরু করে ধােলাই খালের দিকে। হয়তাে সে ঢুকে পড়েছে কোনাে বস্তিতে। খিজিরের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ওসমান টু মেরে চলেছে বস্তির ভেতরে। একসময় ওসমানকে আর ওসমান বলে চেনার উপায় রইল না।
উপসংহারঃ উপন্যাসের শেষে খিজিরের সন্ধানে যে ওসমানকে সমগ্র ঢাকা শহরে পরিভ্রমণরত দেখি, সে বিবরবাসী আত্মপ্রেমিক ওসমান নয়। ওসমান চরিত্রের প্যাটার্নের মধ্যে মধ্যবিত্ত মানসের যে সকল বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস ঘটেছে, তা ঊনসত্তরের প্রগতিশীল রাজনীতিসচেতন বুদ্ধিবিলাসী মধ্যবিত্তের জন্য স্বাভাবিক ও সংগত। ওসমানের আত্মরূপান্তরের দর্পণে বাঙালি জাতিসত্তার সম্মুখগামী উত্তরণের সত্যই যেন প্রতীকায়িত হয়েছে। ওসমানের মস্তিষ্ক বিভ্রাটই স্বাভাবিক। সে দেশ ও জাতিকে ভালােবাসে। অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি সে-পাকিস্তানের শােষণ-বঞ্চনা তাকে অন্য শহিদদের একই পাটাতন সমান্তরাল করে তুলেছে- এখানেই ওসমান চরিত্রের সর্বৈব সফলতা।
Leave a comment