প্রশ্নঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বস্তুনিষ্ঠ উপন্যাস- আলােচনা কর।

অথবা, “মার্কসবাদী জীবনদৃষ্টির বাস্তব রূপ দেখতে পাওয়া যায় চিলেকোঠার সেপাই এ উপন্যাসে।” উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।

উত্তরঃ ষাটের দশকের অন্যতম বিশিষ্ট লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস [১৯৪৩-১৯৯৭]। সে যুগটা ছিল প্রকৃত পক্ষে বাংলা সাহিত্যে নতুন রীতি কৌশল অভিযােজনার উদ্দাম প্রয়াসের যুগ। সাহিত্যে নতুন টেকনিক আনয়নে- কী ভাষায়, কী বাক্য ও শব্দ গঠনে কিংবা শৈলী ও ভঙ্গিতে, বিষয়ের সংবীক্ষণ ও উপস্থাপনায়, সর্বোপরি আত্মমগ্ন চেতনার সাক্ষর পরাবাস্তব প্রকাশে তৎকালীন প্রজন্মের কিছু তরুণ তাদের কতির সাক্ষর রাখেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই প্রতিভাবান তরুণদের একজন। আখতারুজ্জামান ভিন্ন ধারায় হেঁটেছেন। তার লেখার ধরন থেকেই তা স্পষ্ট হয়। কল্পনার হন্দ্রজাল আর ক্ষুরধার মেদহীন লেখা তাকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। তিনি বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে।

‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৬) উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে চিত্র এঁকেছেন তার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক সত্যতা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে অনুসৃত হয়েছে। কাহিনির বাস্তবতার সাথে সংগতি রেখে গড়ে উঠেছে ওসমান খিজিরের মতাে প্রতিবাদী চরিত্র। মানসকে ধারণ করে আছে। লেখক এই উপন্যাসে যে আন্দোলনের কথা বলেছেন, সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। গল্পের প্রধান চরিত্র রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনােয়ার আর আলতাফ। আছে রিকসা শ্রমিক বস্তি বাসিন্দা খিজির। আনােয়ার বামপন্থি আর আলতাফ ডানপন্থি। আনােয়ার আর আলতাফের কথােপকথনের মাধ্যমে লেখক অনেক জটিল রাজনৈতিক জটিলতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। গল্পের ফোকাস কখনাে ছিল হাড্ডি খিজিরের উপর, কখনাে বা আনােয়ারের উপর। তবে পুরাে গল্পে অস্তিত্ব ছিল ওসমানের। ঢাকার এক ঘিনজি গলির মধ্যে ওসমানের বাস। তার বন্ধু আলতাফ, আনােয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে কিন্তু ওসমান কোনাে কিছুতেই নেই। সে যেন চিলেকোঠাতে বন্দি। লেখক ওসমান চরিত্রটিকে রহস্যময় করে তৈরি করেছেন।

ওসমান যে বাসায় ভাড়া থাকে সেটা আবার আইয়ুবপ্রেমী মহাজন রহমতউল্লাহর। খিজির ছােটোবেলা থেকে রহমতউল্লাহর খেয়ে মানুষ। শ্রমিক হিসেবে থাকে তার গ্যারেজে। কিন্তু এই খিজিরই একসময় হয়ে ওঠে বিপ্লবী। বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সাথে সাথে খিজির তার মহাজন রহমতউল্লাহর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলে।

খিজিরের হারানাের কিছু নেই। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাকে বলে প্রলেতারিয়েত। সে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিছিলে যায়, স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ করে। এক সময় বর্বর পাক সেনাদের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হয়। আর ওসমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি। সে চিলেকোঠার নিরাপত্তার সর্বোচ্চ অবস্থানে নিরাপদে অবস্থান করে। কিন্তু এখানেও স্বস্তি পায় না। দেশের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থানে সে কিছু না করতে পারার অন্তর্দাহে দন্ধ। সমাজের সব বাধা অতিক্রম করে বেরিয়ে আসতে চায়, মিছিলে যেতে চায়, কিন্তু বারবার তার মধ্যবিত্ত মানসিকতা বাধা দেয়। শেষ পর্যন্ত এই শ্রেণিচেতনার সাথে আপস করতে না পারায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ও নিরাপদ আশ্রয় চিলেকোঠা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের যে চিরায়ত শ্রেণিদ্বন্দ্বের পরিণতি- শিল্পী এই সমাজচিত্রকে সূক্ষ্মশৈলীর মাধ্যমে অঙ্কন করেছেন।

মার্কসবাদী জীবনদৃষ্টির বাস্তব রূপ দেখতে পারা যায় চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে। একদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দোদুল্যমান অবস্থা অপর দিকে বিত্তহীন শ্রেণির চারিত্রিক দৃঢ়তা উপন্যাসকে বাস্তবতার স্পর্শ দিয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ইলিয়াসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, এই অভিজ্ঞতার শৈল্পিক প্রকাশ এই উপন্যাস। শিল্পী ওসমানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ করেন। ওসমান আর্মি, বুলেট, কারফিউকে ভয় পায় না। খিজির চরিত্রের মাধ্যমে তিনি কার্ল মার্কর্স এর বিখ্যাত উক্তি- প্রলেতারিয়েতের শৃঙ্খল ছাড়া অন্য কিছু হারাবার ভয় নেই। শিল্পী এর সত্যতা প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন।

সর্বহারা শ্ৰেণীর প্রতিনিধি খিজির। সে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বদ্ধ হয়ে মিছিলে যায়, কারফিউ বেরিকেড ভঙ্গ করে এক সময় সে বীরের মতাে মৃত্যুবরণ করে। মার্কস মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণির চেয়ে বিপ্লবই হচ্ছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণি শুধু নিজেকে সমস্ত সামাজিক শোষণ থেকে মুক্ত করে না, বিপ্লবের ফলে অন্যায়শােষিত শ্রেণিও একই সঙ্গে সমস্ত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও চিন্তাগত শােষণ থেকে মুক্তি পায়। সর্বহারাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ সশস্ত্র সংগ্রাম।

এ উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্র ইতিহাস আশ্রয়ী হলেও তা কখনােই আরােপিত নয়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চরিত্রগুলাে ক্রমেই নিজের মূর্তিতে আবিৰ্ভত। রাজনৈতিকভাবে দেশ ও জাতি যে ক্রান্তিলগ্নের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল- জাতিগত শােষণ বা সামরিক শােষণের কবলে সামাজিক স্তরে যে অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে শিল্পীর মনে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সেই চেতনার প্রতিবাদ চিলেকোঠার সেপাই। তিনি একাধারে বস্তির নােংরা জীবন, গ্রামের ধূলি কবলিত প্রান্তরের সংগ্রামী চালচিত্র, দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ ঢাকা শহর, বিভিন্ন শ্রেণি অবস্থানের জীবন অবলােকন করেছেন। আবার গ্রামীণ প্রচ্ছদে সেখানকার শেণিসংঘর্ষ, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের গল্পে আনােয়ার, নাদু, পারামানিক, চেংটুর সাহসিকতাকে স্থান দিয়েছেন।

লেখক এখানে নগর জীবনের বৈচিত্র্যময়তা, অঙ্কন করতে গিয়ে বস্তিজীবনের চালচিত্র এঁকেছেন, ছাত্রদের অবক্ষয় চেতনা, রাজনীতিকদের মূল্যবােধ, বিভিন্ন শ্রেণির পেশাভিত্তিক চরিত্র সফলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। আনােয়ারের গ্রামের মানুষ সবাই শ্রেণি নির্যাতনের শিকার। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্র সবই স্বৈরশাসনের প্রতিভূ। এই গ্রামের মানুষের বেশির ভাগ অশিক্ষিত। তারা প্রতিনিয়ত কুসংস্কারের মধ্যে ডুবে আছে। জালাল মাস্টার একজন শিক্ষিত হলেও তার মধ্যে বুর্জোয়া শােষক শ্রেণিচরিত্র স্পষ্ট। আনােয়ার প্রগতিশীল হওয়ার পরও শুধু পারিবারিক বাধার কারণে গ্রাম্য শােষক চক্রের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। দখলদারিত্ব। ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী বুর্জোয়াদের সাথে চাষা ও মাঝিদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র, জমিদারি ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতি পর্যন্ত গড়ায়। তবুও শ্রমজীবীদের সংগ্রাম চলে। সুবিধাভােগী বিত্তবান শ্রেণিচরিত্রের স্বার্থের জন্য সংগ্রামী চেংটু ও খিজিরকে জীবন দিতে হয়, ওসমানকে পাগল হতে হয়। পাকিস্তান আন্দোলনকে সামনে রেখে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ফসলের ন্যায্য হিস্যার জন্য তেভাগার দাবিতে যেমন সােচ্চার হয়েছিল তেমনি নির্বাচনের পর স্বার্থান্বেষী, বিত্তবান শ্রেণি ও রাজনীতিকরা তেভাগার নেতাদের বিরুদ্ধে কমিউনিজমের অপবাদ দিয়েছিল। গরিব মানুষের হিস্যাকে অস্বীকার করতে জমিদার, জোতদার দিনের পর দিন তাদের নির্যাতন বাড়াতে থাকে। ঔপন্যাসিক মনে করেন খিজির, ওসমান, আনােয়রের মতাে চরিত্ররা দিনে দিনে তাদের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেবে সমগ্র দেশে। বিপ্লবের লাল আগুন জালাবে সংগ্রামী মানুষের মনে। ধর্মের মুখখাশ পরা শ্রেণিশত্রুদের গড়া বিলাসের সুরম্য প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যাবে।

উনসত্তরের গণআন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কারণ এর সাথে জড়িত ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন। শিল্পী এই সত্য অনুধাবন করেছিলেন। তাই তার উপন্যাসে সে সময়ের ইতিহাস গুরুত্ব পেয়েছে। উনসত্তরের গণজোয়ার শুধু ঢাকা নয় গােটা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ স্বৈরাচার আইয়ুব খানের দোসরা এদেশের মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন কাঠামাের মধ্যে থেকে অসহায় মানুষের উপর নির্যাতন চালাচ্ছিল। খয়বার গাজী, আফসার গাজীর মতাে স্বৈরাচারী শাসক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি গ্রামেই ছিল। আবার নাদু, পরামানিক, করমালি, চেংটুর মতাে নির্যাতিত মানুষও গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে ছিল। ফলে কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহ বিপ্লবের আহ্বান তড়িৎ প্রত্যন্ত গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাম সংগঠনের নিবেদিত প্রাণ আলিবক্সের মতাে ছাত্রনেতাদের ভূমিকাও এক্ষেত্রে কম নয়। এছাড়া সে সময় ওসমানের মতাে দীর্ণ অথচ জিজ্ঞাসু মানুষের অভাব ছিল না। তিনি ক্রমাগত খুঁজে চলেছেন তার সমকালকে নানাবিধ পতন ও অ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। সময়ের বিবর্তনে এদের মধ্যেই লেখা হয় শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।

জীবনবাদী ঔপন্যাসিক হওয়ার কারণেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসে এভাবে গ্রাম ও শহর দু’টিই অপরিহার্য প্রেক্ষিত হয়ে আসে। শিল্পী শহুরে ও গ্রাম্য বুর্জোয়াদের রক্তচক্ষু, মধ্যবিত্ত জীবনের বিকৃতি, চাষি ও মাঝিদের জীবনের দুঃখ ও দারিদ্র্য প্রথম থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন। ক্রমে তিনি নির্যাতিত মানুষের প্রতি অনুভূতিপ্রবণ হতে থাকেন। এই পক্ষপাতিত্বের ফলেই তিনি ধীরে ধীরে মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। মার্কসবাদের সাথে পরিচিত হয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের সমাজ জীবনে শােষক ও শােষিতের সংঘাতই দিনদিন প্রকট হয়ে উঠেছে। যার প্রভাব ছিল কল্লোল, কালিকলমীয় বিদ্রোহী সাহিত্যে।

ঔপন্যাসিক মনে করেন, জীবন ও চেতনায় বাস্তবতা ওতপ্রােতভাবে মিশে আছে বলেই সংগ্রাম সত্য। এসব গ্রামকে সাহিত্যে রূপদান, বাংলার চাষি সমাজ জীবনের বাস্তবতার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সাহিত্যের জীবন সত্য রূপায়িত হয়েছে এ উপন্যাসে। শিল্পী ইতিহাসকে পটভূমি করে আপন অভিজ্ঞতা সঞ্জাত প্রতিটি ঘটনার ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করেছেন। এই উপন্যাসে শিল্পী দেখাতে চেয়েছেন কীভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের বুটের তলায় নিষ্পিষ্ট হচ্ছে স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ। এর পাশাপাশি দেশীয় শাসকদের তীব্র অত্যাচারে জর্জরিত হতে হতে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণি। এ উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রের ক্রমপরিণতির মাধ্যমে তিনি এ কথাই বলতে চেয়েছেন, যতদিন না শ্রেণিহীন, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলা যাবে, ততদিন বুর্জোয়া শাসকগােষ্ঠী আপন সাম্রাজ্য রক্ষা ও সম্প্রসারণের তাগিদে অত্যাচার চালাবেই।