প্রেমবৈচিত্ৰ্য্য বা আক্ষেপানুরাগ বৈষ্ণব পদাবলীর এক বিশিষ্ট পর্যায়। এর স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে উজ্জ্বল নীলমণি গ্রন্থে বলা হয়েছে।
“প্রিয়স্য সন্নিকর্ষেহপি প্রেমোৎকর্ষ স্বভাবতঃ
যা বিশ্লেষ ধিয়াতিস্তৎ প্রেমো বৈচিত্র্যমুচ্চতে।।”
অর্থাৎ, প্রেমের উৎকর্ষবশতঃ প্রিয়ের সন্নিধানে তার সঙ্গে সহিত বিচ্ছেদ ভয়ে যে বেদনার উপলব্ধি, তার নাম প্রেমবৈচিত্র্য্য। প্রেম বৈচিত্ত্যের মূলকথা প্রেমের উৎকর্ষ এবং প্রেমের উৎকর্ষের জন্য নিজের ভাগ্যের প্রতি আক্ষেপ—সুতরাং এতে প্রচ্ছন্ন বিরহের সুর আছে। এটিকেই বৈষ্ণব পদাবলীতে বলা হয় আক্ষেপানুরাগ। এ আক্ষেপ-শ্রীকৃষ্ণের প্রতি, নিজের প্রতি, সখীর প্রতি, দূতীর প্রতি, বিধাতার প্রতি, কন্দর্পের প্রতি গুরুজনের প্রতিধ্বনিত হয়েছে। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় প্রিয়তমের দর্শন না পাইলে ক্ষণমাত্রকে যুগ বলিয়া মনে হয়,… মিলনের দীর্ঘ সময়কে পল বলিয়া মনে হয়। মনে হয় এইতো এখনি ফুরাইয়া গেল।” এই ফুরিয়ে যাওয়ার হতাশা বোধ থেকেই আক্ষেপের সুর অনুরণিত হয়।
জ্ঞানদাসের আক্ষেপানুরাগের পদগুলিতে আবেগের স্বাভাবিকতা বিশেষ তাৎপর্যবাহী হয়ে উঠেছে। তবে চণ্ডীদাসের সঙ্গে জ্ঞানদাসের পদের এত সূক্ষ ব্যবধান যে, দুজন কবির ভণিতার গোলমাল এই আক্ষেপানুরাগের পদেই সবচেয়ে বেশি দৃষ্ট হয়। জ্ঞানদাসের নামে প্রচারিত এই বিখ্যাত পদটি চণ্ডীদাসের ভণিতায় পেলে যেন পাঠক অধিকতর আনন্দ পেতেন—
‘সুখের লাগিয়া এখর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয় সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।।
রাধার ভাগ্যদোষে সব বিপরীত হল। তিনি তো সুখের আশায় ঘর বেঁধেছিলেন কিন্তু তা অনলে পুড়ে গেল। শীতল বলে চাঁদের কিরণে হাত বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্যদোষে তাও যে তীব্র দাহে পরিণত হল। পিপাসার্ত হয়ে রাধা মেঘ চাইলেন, কিন্তু মেঘে বজ্র লুকানো ছিল। অর্থাৎ কানুর প্রেমতো আনন্দ বয়ে আনে না।
“কানুর পিরীতি মরণ অধিক শেল।”
এযে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা। রাধা বারবার বলেছেন—
“তোমার গরবে গরবিনী হাম রূপসী তোমার রূপে।
যেন মনে লয় ও দুটি চরণ সদা লয়্যা রাখি বুকে।।”
নিজের কষ্ট দুঃখকে অবদমিত করতে না পেরে কখনো কখনো রাধা বলেন—
তোরা কুলবতী ভজ নিজপতি
যার সেরা মনে লয়।
ভাবিয়া দেখিলু শ্যাম বন্ধু বিনু
আর কেহ মোর নয়।।
রাধা কুল ছেড়ে, ‘গুরু দুরুজনের’ কু’জনের ভয় ছেড়েছেন কারণ—
‘সে রূপ সায়রে নয়ন ডুবিল
সে গুনে বান্ধিলু হিয়া।
রূপগুণে তাঁর তনুমন ভরে গিয়েছে। তাই যখন দয়িতের প্রেমের আতি রাধার মনে পড়ে—
“সে সব আদর ভাদর বাদর
কেমনে ধরিব দে।”
ভাদ্রের বাদলের মত যে প্রেমের মেঘরৌদ্রকে কি সহজে ভোলা যায়? যে প্রেম—
হিয়ার হিতে পিয়া শোজে না ছোঁয়ায়।
বুকে বুকে মুখে মুখে রজনী গোঙায়।।
সে প্রেমের কি পরিণাম? শুধু চোখের জল রাধার সম্বল। সখীগণ তাঁকে সান্ত্বনা দিলে তিনি ব্যাকুল হয়ে বলেন—
“নিভান আনল আর পুন কেন জ্বাল?”
রাধার সাধের প্রদীপ যে সন্ধ্যাবেলাতেই নিভে গেল—
“সাধের প্রদীপ নিভাই সাঁঝে।”
বিরহ খিন্না রাধার শুধু কান্নাই সম্বল—
‘পথ নেহারিতে নয়ন অন্ধায়ল
দিবস লিখিতে পথ গেল।
দিবদ দিবস করি মাস বরিস গেল
বরিযে বরিস কত ভেল।।”
রাধা কৃষ্ণের পথ চেয়ে আছেন। কত যুগ বয়ে যায়, চেয়ে চেয়ে তার চোখ দুটি অন্ধ হয়ে গেল। কত রাত্রি দিন, কত মাস বর্ষ শেষ হয়ে গেল কিন্তু বিরহের সমাপ্তি হয় কই?
সবশেষে, একথাই বলতে হয়, জ্ঞানদাসের যুগ ও আমাদের যুগের মধ্যে প্রায় চারশত বৎসরের ব্যবধান—যে ব্যবধান মন প্রাণ ও হৃদয়ের, তবু কেন জানিনা—জ্ঞানদাসের পদের মধ্যে আমরা আধুনিক মানুষের প্রাণের কথা শুনতে পাই। রাধাকৃষ্মের রূপকে কবি যেন নিখিল মানবের দেশকালাতীত বেদনাকেই নিকষে সোনার রেখার মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। আবেগে তিনি মানবিক, চিত্রকল্পে তিনি আধুনিক।
‘ও অঙ্গ পরশে পরম হরষে
বরষে পরশ শিলা।।”
এই প্রকাশ-রীতি মধ্যযুগীয় নয় আধুনিক। মধ্যযুগীয় কোনও কবিকে যদি আধুনিক যুগের আসনে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয় তাহলে জ্ঞানদাস সে আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবী রাখেন। এবং অন্যান্য পর্যায়ের পদের সঙ্গে তাঁর আক্ষেপানুরাগের পদগুলি সে বিষয়ের উজ্জ্বল সাক্ষ্য।
Leave a comment