Air and Space আইনের দুটি স্বতন্ত্র শাখা যা আকাশ ও মহাকাশে ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইনের বিকাশের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত, এবং বর্তমানে প্রযুক্তির উত্থান ও বিশ্বায়নের সাথে সাথে এর গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।


আকাশ সীমা আইন 

(Air Space Law?)

রাষ্ট্রীয় ভূ-খণ্ডের সীমানার উপর দিয়ে যদি মহাশূণ্যের দিকে কাল্পনিক রেখা টানা হয়, তাহলে সেই কাল্পনিক রেখা ঐ ভূ-খণ্ডের আকাশ সীমানা নির্দেশ করবে। ১৯৫৮ সালের সমুদ্র বিষয়ক জেনেভা কনভেনশনের ২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মূল ভূ-খণ্ডসহ আঞ্চলিক সমুদ্রের উপরস্থ বায়ুমণ্ডল (Air Space) ও আঞ্চলিক সমুদ্রের তলদেশ (Sea-bed) এবং অন্তর্ভূমির (Subsoil) উপরও প্রসারিত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আকাশ সীমানা ও বিমান পরিবহন সংক্রান্ত বিষয়াবলী নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের যে অংশ আলোচনা করে সেটাকে আকাশ সীমানা আইন (Air Space Law)বলা হয়।

বায়ু ও মহাকাশ আইনের ইতিহাস

[History of Air and Space Law]

বিমান আইনের প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তিটি ছিল ১৯১৯ সালে প্যারিস কনভেনশন, যা বেসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য মৌলিক নীতি নির্ধারণ করে। প্যারিস কনভেনশন-১৯১৯এর মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর এয়ার ন্যাভিগেশন (ICAN) প্রতিষ্ঠিত হয় যা পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO) নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। আইসিএও(ICAO) তখন থেকে আন্তর্জাতিক বিমান আইনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রোটোকলের খসড়া তৈরি করেছে। যা বেসামরিক বিমান চলাচলের বিভিন্ন দিক পরিচালনা করে।


মহাকাশের ক্রিয়াকলাপের জন্য প্রথম আইনী উপকরণ ছিল ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস চুক্তি(Outer Space Treaty of 1967), যা মহাকাশের অন্বেষণ এবং ব্যবহারের জন্য মৌলিক নীতিগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই চুক্তিটি আরও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে মহাকাশচারীদের উদ্ধার এবং প্রত্যাবর্তন, মহাকাশ বস্তু দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির জন্য দায়বদ্ধতা এবং মহাকাশ বস্তুর নিবন্ধন সহ বিভিন্ন দিক পরিচালনা করে।

আকাশ সীমানার উপর আধিপত্য বিস্তার সংক্রান্ত বিষয়ে তিনটি মতবাদ  


আকাশ সীমানার উপর আধিপত্য বিস্তার সংক্রান্ত বিষয়ে তিনটি মতবাদ রয়েছে। যথা-


(১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই বিমান চলাচল শুরু হয়। এ সময় আকাশ সীমানা সকলের জন্য মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন যেহেতু আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল ছিল না, তাই নিয়ন্ত্রনের প্রশ্নও উঠে নি। 


(২) দ্বিতীয় মতবাদে বলা হয় যে, রাষ্ট্রসমূহ তাদের ভূ-খণ্ডের সংলগ্ন কাছাকাছি আকাশ সীমানায় একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করবে এবং অধিকতর ও উচ্ছ আকাশ সীমানা সব রাষ্ট্রের আকাশ পরিবহনের (বিমান চলাচল) জন্য উন্মুক্ত থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বিমান বাহিনী তৈরী হয়। এই সময় সামরিক বিমানের ভয়াবহতাও বেড়ে যায়।


১৯১৯ সালে প্যারিসে আকাশ পরিবহন সংক্রান্ত কনডেশন (Aerial Navigation Convention in Paris-1919) অনুষ্ঠিত ও স্বাক্ষরিত হয়। এই কনভেনশনে নিম্নলিখিত বিধানগুলো গৃহীত হয়–

(ক) প্রত্যেক বিমান (Air Craft) তার মালিক রাষ্ট্র কর্তৃক নিবন্ধনকৃত হবে;

(খ) প্রত্যেকটি বিশান বা আকাশযান তার জাতীয়তা, নিবন্ধনকৃত চিহ্ন (প্রতীক) এবং মালিক রাষ্ট্রের নাম বহন করবে।

(গ) যে সকল রাষ্ট্রীয় বিমান আন্তর্জাতিক পরিবহনে ব্যবহার করা হবে, তাদেরকে দলিল পত্র সঙ্গে রাখতে হবে; যথা-

(অ) নিবন্ধনের সনদপত্র;
(আ) আন্তর্জাতিক পরিবহন বিমানটির যোগ্যতা উল্লেখপূর্বক সনদপত্র;
(ই) বিমান চালকদের যোগ্যতার সনদপত্র; এবং
(ঈ) যাত্রীদের তালিকা বেতার যন্ত্রপাতির (Wireless equipment) বিশেষ লাইসেন্স।

১৯১৯ সালে প্যারিস কনভেনশনের অনুচ্ছেদে-১ এ বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক রাষ্ট্র তার সীমানাধীন আকাশে পূর্ণ অধিকার ভোগ করবে।


অনুচ্ছেদ-২ বলা হয়েছে, অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ শান্তির সময়ে যে কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় আকাশ সীমানা নির্দোষ চলাচলের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। নির্দিষ্ট আকাশ সীমানার নীচে অবস্থিত রাষ্ট্রটি (Subjacent State) তার রাষ্ট্রীয় শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কোন সামরিক বিমানকে নিজস্ব আকাশ সীমানায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে।


(৩) তৃতীয় মতবাদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় ভূ-খণ্ডের উপরে সীমানাহীন উচ্চতা পর্যন্ত ঐ রাষ্ট্রটির আধিপত্য বলবৎ থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই মতবাদের ব্যাপ্তি রয়েছে। তবে, সাম্প্রতিককালে আর একটি মতবাদে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক রাষ্ট্রের আকাশ সীমানায় সকল দেশের বেসামরিক বিমান নির্দোষভাবে চলাচল করতে পারবে; কিন্তু সামরিক বিমান ঐ আকাশ সীমানার নিয়ে অবস্থিত ভূ-খণ্ড রাষ্ট্রটির অনুমতি ব্যতীত চলতে পারবে না। এটাকে চতুর্থ মতবাদ বলা হয়।


বর্তমানে আকাশ পথে যাত্রী ও দ্রব্য বহনের জন্য বহনকারী বিমানের উন্নতি সাধিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্র জাতীয় এয়ার লাইন (Air lines) গড়ে তোলে। প্রত্যেক রাষ্ট্রহ তার সার্বভৌম ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিমান তৈরী বা ক্রয়ের প্রয়োজন অনুভব করছে। এ জন্য বর্তমানে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরণের বিমানের সংখ্যা দারুনভাবে বেড়ে গেছে। ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত ওয়ারশ বা কনভেনশনে আন্তর্জাতিক আকাশ পরিবহণের ক্ষেত্রে সকল রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য একক বিধান (Uniform Rules) তৈরী করার কথা ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে শিকাগো শহরে একটি সম্মেলন (Chicago Convention, 1944) অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে আকাশ পথে বাণিজ্যিক পরিবহণের ক্ষেত্রে অনেকগুলো কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। 


বিমান চলাচলের ৫টি স্বাধীনতা 

(Five Freedom of Air )


১৯৪৪ সালে শিকাগো কনভেনশনে আন্তর্জাতিক বেসারিক বিমান চলাচলের জন্য যে ৫টি অধিকার স্বীকৃত হয়। আন্তর্জাতিক আইনে এই অধিকারগুলোকে বিমান চলাচলের স্বাধীনতা (Five Freedom of Air) বলা  হয়।

বিমান চলাচলের উপর ৫টি স্বাধীনতা নিম্নরূপ-


১. অবতরণ ছাড়াই অতিক্রম[To Fly Over a Foreign Country Without Landing]

প্রথম স্বাধীনতায় বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক রাষ্ট্রের পতাকাবাহী বেসারিক বিমান অন্য রাষ্ট্রের ভূ-খণ্ডের উপর দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে অতিক্রম করতে পারবে; তবে, ভূমিতে নামতে পারবে না। যেমন- বাংলাদেশের একটি বিমান নির্দোষভাবে ভারতের আকাশ সীমানা দিয়ে উড়ে যেতে পারবে কিন্তু ভারতের ভূ-খণ্ডের কোন অংশ অবতরণ করতে পারবে না।


২. যাত্রীদের যাত্রা বা নামা ছাড়াই অবতরণ [To Land in a Foreign Country Without Embarking or Disembarking Passengers]

পতাকাবাহী বিমান তার যাত্রাপথে বিশেষ প্রয়োজনে কোন রাষ্ট্রের ভূ-খণ্ডে নামতে পারে; তবে তা অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হবে। অর্থাৎ এই অবতরণের সাথে কোন মালামাল লেনদনের সম্পর্ক থাকবে না। যেমন- বাংলাদেশের একটি মান পাকিস্তানে যাওয়ার পথে তার যান্ত্রিক গোলাযোগ দেখা দিলে সাময়িকভাবে ভারতে অবতরণ কারতে পারবে; তবে সেখানে থেকে কোন দ্রব্য উঠাতে বা নামাতে পারবে না।


৩.  যাত্রাপথে অনুমোদিত কোন রাষ্ট্রে যাত্রী বা মালামাল নামানো [Disembarkation of passengers or cargo in any authorised state]


পতাকাবাহী বিমানটি তার যাত্রাপথে কোন রাষ্ট্রের ভূ-খণ্ডে নামতে পারবে এবং অনুমোদিত ঐ রাষ্ট্রে যাত্রী বা মালামাল নামাতে পারবে; তবে, উঠাতে পারবে না। যেমন- বাংলাদেশের বিমান লণ্ডনে যাওয়ার পথে ভারতীয় যাত্রীকে ভারতের কোন বিমান বন্দরে নামিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ভারত থেকে যাত্রী বা মাল তোলার অধিকার এই তৃতীয় স্বাধীনতায় ঘোষণা করা হয়নি।


৪.নির্ধারিত যাত্রী, মেইল ​​এবং পণ্যসম্ভার নামানো এবং উঠানোর অধিকার [To take on passengers, mail, and cargo destined for the territory of the country whose nationality the aircraft possesses]

বিমানকে তার যাত্রাপথে অন্য কোন রাষ্ট্রে অবতরণ এবং সেখান থেকে মালামাল বোঝাই করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। একই সাথে যাত্রী নামান এবং উঠানোর অধিকারও দেওয়া হয়।


৫. আকাশ পরিবহনে বিস্তৃত স্বাধীনতা

আকাশ পরিবহনের ক্ষেত্রে পঞ্চম স্বাধীনতা সবচেয়ে ব্যাপক। যে সকল রাষ্ট্র পঞ্চম স্বাধীনতায় স্বাক্ষর করে তাদেরকে আকাশ পরিবহনে বিস্তৃত স্বাধীনতা দেয়া হয়। এই স্বাধীনতা অনুযায়ী, একটি রাষ্ট্র বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে অবাধে বিমানে যাত্রী ও মালামাল আনা-নেওয়া করতে পারবে।


এছাড়াও বিমান চলাচলের জন্য অন্যান্য স্বাধীনতা(ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম স্বাধীনতা) রয়েছে। তবে এগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা স্বীকৃত হয়নি।

………

উৎস:
১. যুদ্ধ, আকাশ ও মহাকাশ আইন- অধ্যক্ষ মোঃ আলতাফ হোসেন

২. https://www.legalserviceindia.com/legal/article-10600-air-and-space-law-navigating-legal-challenges-in-a-rapidly-advancing-technological-landscape.html

৩. https://home.heinonline.org/content/air-and-space-law/

৪. https://www.icao.int/pages/freedomsair.aspx

৫. https://thepointsguy.com/guide/five-freedoms-of-aviation/