“আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।” কার কথা বলা হয়েছে? কটাক্ষের তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।
গাওদিয়া গ্রামের হারু ঘোষের কথা বলা হয়েছে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’—উপন্যাসের সূচনা হয়েছে হারু ঘোষের এই দৃশ্য দিয়ে। গাওদিয়া গ্রামের হারু ঘোষ বাজিতপুরে গিয়েছিল মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে। তার উদ্দেশ্য ছিল পথ সংক্ষিপ্ত করে বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু আকস্মিক দৈবাঘাতে পথ তার অতি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। সে বজ্রাহত হয়ে অজানার পথে পাড়ি জমায়। কে যে কিভাবে এই অজানা পথে পাড়ি জমায় তা কেউ বলতে পারে না। এক বাদল সন্ধ্যায় জনমানবহীন খালের পাড়ে তাকে গাছে ঠেস দিয়ে দেখতে পেয়ে লোকে চকিত বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে পড়ে। কিভাবে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এইরকম জনপ্রাণীহীন স্থানে চলে আসে, তা স্বাভাবিক চিন্তার বাইরে। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটা বটগাছ। সেই বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে হারু ঘোষ দাঁড়িয়ে ছিল। সে চেয়েছিল বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে। তাই বটগাছের গুঁড়ি ঘেঁষে সে দাঁড়িয়ে ছিল আত্মরক্ষার্থে। কিন্তু নিয়তি দুর্জেয়, প্রকৃতি দুর্জেয়। সেই আকাশের দেবতা হঠাৎ কটাক্ষ করে তার জীবনদীপ নিভিয়ে দিলেন। বজ্রাঘাতে তার মৃত্যু হল। যে মানুষ আকাশের বিদ্যুৎ চমক, বৃষ্টিপাতের থেকে রেহাই পেতে বটগাছতলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে মানুষ আকাশের দেবতার কশাঘাতেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। বজ্র ও বৃষ্টি হয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে অভিঘাত, যা দেবতার কটাক্ষের মতই তাকে শেষ করে দেয়। তার এই মৃত্যুর জন্য দায়ী প্রকৃতির ক্রুর আঘাত। এই ক্রুর-কুটিল আক্রমণ কখন কিভাবে মানুষের জীবনে নেমে আসবে কেউ জানে না। তাই কথক হারু ঘোষের প্রকৃতির দুর্দৈব ঘটিত মৃত্যুকে আকাশের দেবতার কটাক্ষ বলে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনার মধ্যে আছে ঈষৎ ব্যঙ্গ। হারু বাজিতপুর গিয়েছিল একটা পারিবারিক উদ্দেশ্যে। সে চেয়েছিল তার মেয়ের বিয়ে হোক উন্নততর পরিবেশে। নিতাইয়ের প্রস্তাবিত পাত্র সুদেবের চেয়ে আরও ভাল পাত্র সে চেয়েছিল। সে ছিল উচ্চাশী, তাই তার উচ্চাশার প্রত্যুত্তরে সে পেয়েছিল দেবতার তির্যক ব্যঙ্গ। দুর্দৈবের আঘাতে মৃত্যু তাকে কেড়ে নিল।
“হারুর মরণের সংস্রবে অকস্মাৎ আসিয়া পড়িয়া শশীর কম দুঃখ হয় নাই কিন্তু তার চেয়েও গভীরভাবে নাড়া খাইয়াছিল জীবনের প্রতি তাহার মমতা।”—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
বাজিতপুরের খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে হারু ঘোষের নিস্পন্দ দেহ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গ্রামের শশী ডাক্তার ও গোবর্ধন বিস্মিত ও ভীত হয়ে পড়ল। শশী ডাক্তার হারুকে যে এই জনমানববর্জিত ভূতুড়ে জায়গায় আবিষ্কার করবে, তা ভাবতে পারেনি। কারণ এখানে মানুষ সচরাচর বড়ো একটা কেউ আসে না। গ্রামের লোক সদাসশঙ্ক। তাই শশীরও প্রথম মনে হয়েছিল চোখের ভুল। হাঁক দিয়ে সাড়া না পেয়ে গোবর্ধনকে সে খালের পাড়ে নৌকা ভিড়াতে বলেছিল। গোবর্ধন বিশ্বাস করে যে এখানে মানুষের আসা অসম্ভব। তাই অন্য কোনো ভৌতিক উপস্থিতির সম্ভাবনায় সে স্থান এড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার শশী কাছে। গিয়ে দেখে যে তার নির্ণয়ই যথার্থ। মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া জনে জনে বিচিত্র। হারুর মৃত্যু দৃশ্য শশীকে দুঃখ দিয়েছিল। অপরিসীম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে প্রশ্নও জেগেছিল প্রচুর। স্বজনের মৃত্যুতে সাধারণত লোকের মনে যেমন শ্মশান-বৈরাগ্য থাকে না, শশীর মনে তেমন আসে না। শশী জানে মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণাম। তাই মৃত্যুর কথা ভাবলেই জীবন তার কাছে পরমরমণীয়, পরম কমনীয় বলে মনে হয়। হারুর প্রতি দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে মমতা এসে শশীর মনকে আপ্লুত করেছে। মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ বাঁচে অন্যমনস্কভাবে। জানে না জীবন কত সুন্দর, কত উপভোগ্য। তা শুধু মনে হয় মৃত্যুর করাল অন্ধকারের তীরে দাঁড়িয়ে। মৃত্যুর করাল অন্ধকারের তীরে বসে মানুষ ভাবে জীবন যেন অপচয়িত না হয় জীবনের সব সুধারসধারা ক্ষণায়ু মানুষ যেন জীবনকে যথাযোগ্য ভোগ করতে দ্বিধা না করে। তাহলে জীবনের পাত্রে যে ক্ষতি হবে তা প্রতিকারহীন। হারুর মৃত্যুর কাছাকাছি এসে এইভাবে শশীর জীবনবোধ জেগে উঠেছিল। এই জীবনবোধের আর এক নাম জীবনপিপাসা।
Leave a comment