ভূমিকাঃ বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গােটা বিশ্ব ছিল জাহেলিয়াতের চরম তমসায় সমাচ্ছন্ন। ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক অনাচার, অরাজকতা, হানাহানি, বিশৃঙ্খলা আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিরাজ করছিল সমগ্র আরব সমাজে। ঐতিহাসিকগণ এ চরম বীভৎস যুগকে The age of ignorance বা অজ্ঞতার যুগ বলে অভিহিত করেছেন। 

জাহেলিয়া যুগে আরবদের অর্থনৈতিক অবস্থাঃ বিশ্ব নবীর আবির্ভাবের পূর্বে আরবদের নৈরাশ্যজনক অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র নিম্নরূপ-

১. প্রকৃতির প্রভাবঃ আরব উপদ্বীপের ভূ-প্রকৃতি দেশবাসীর অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। যেমন অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হলাে 

ক. কৃষিঃ মরুময় অনুর্বর জমি কৃষি কাজের সম্পূর্ণ অনুপযােগী ছিল। জমিতে উৎপাদিত খাদ্যশস্য প্রয়ােজনের তুলনায় ছিল নিতান্ত অপ্রতুল। 

খ. পশু পালনঃ মরুচারী আরব বেদুইনরা পশুচারণ ও লুণ্ঠন করে কোনাে মতে জীবিকা নির্বাহ করত। সমগ্র পশুর মধ্যে মরুভূমির জাহাজ নামে খ্যাত উট ছিল তাদের। নিকট অমূল্য সম্পদ ও সম্বল। 

২. ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রভাবঃ মরুময় আরবের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা তাদের অভ্যন্তরীণ ও বাহির্দেশীয় ব্যবসায় বাণিজ্যের ওপর বহুলাংশেই নির্ভরশীল ছিল। তাদের ব্যবসায় বাণিজ্যের বিভিন্ন প্রকৃতি নিম্নরূপ-  

ক. কারিগর শ্রেণির ব্যবসাঃ প্রাক ইসলাম যুগে আরবে দেবদেবীর মূর্তি প্রস্তুতকারী কারিগরদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। গােটা সমাজব্যবস্থা পৌত্তলিকতায় পরিপূর্ণ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থা ছিল উন্নত পর্যায়ে। 

খ. ইহুদি সম্প্রদায়ের সুদের ব্যবসাঃ যে যুগে ধনী আরবগণ বিশেষ করে ইহুদিরা সুদের ব্যবসায় করত। সুদী কারবারের নিয়মাবলি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও জটিল। সুদ অনাদায়ে ঋণ গ্রহণকারীর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ইত্যাদি দাসদাসী হিসেবে মহাজনের হাতে চলে যেত। 

গ, শহরবাসী ব্যবসায়ীঃ শহরবাসী প্রভাবশালী আরবগণ ব্যবসায় বাণিজ্য করে জীবিকা অর্জন করত এবং সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করত। হযরত আবু বকর, ওসমান ও বিবি খাদিজা (রা) এ শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের অন্যতম ছিলেন। 

৩. আর্থিক সচ্ছলতাঃ তৎকালীন আরব বেদুইনদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিবরণ নিম্নরূপ-

ক. মক্কাকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থাঃ ব্যবসার কেন্দ্র হিসেব মক্কা ছিল তখন পশ্চিম এশিয়ার সমৃদ্ধ নগরী। মক্কার বণিক সম্প্রদায় বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বজায় ছিল। ঐতিহাসিক ওয়াটের মতে, জাহেলিয়া যুগে মক্কা আরব ভূখণ্ডের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত উকাজের মেলায় বিপুল পরিমাণ পণ্যদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় হতো। তাছাড়া মক্কার বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে পণ্যসামগ্রী সিরিয়া, পারস্য, চীন প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হতাে। 

খ. মদিনা কেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থাঃ মক্কার প্রায় ৩০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত। মদিনা ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত প্রসারিত বাণিজ্য পথের সাথে সংযুক্ত ছিল। মদিনার জমি উর্বর থাকায় সেখানে কৃষি কার্য চলত এবং প্রচুর ফসল উৎপাদন হতাে। মদিনায় পর্যাপ্ত খেজুর ও গম হতাে। এ অঞ্চলের লােকের অর্থনৈতিক অবস্থা মােটামুটি ভালাে অবস্থায় ছিল। 

গ. তায়েফকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থাঃ সে সময় তায়েফ ব্যবসায় বাণিজ্যে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে তায়েফে উৎপাদিত কৃষিজাত দ্রব্যাদি বিশ্বের বাজারে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হতাে। তায়েফে প্রচুর তরমুজ, কলা, ডুমুর, আঙ্গুর জলপাই, পীচ ও মধু উৎপন্ন হতাে। এখানকার আতর ছিল বিশ্ববিখ্যাত। 

ঘ, রিক্ত যাযাবর বেদুইনঃ মরুভূমির তাবুতে বসবাসকারী বেদুইনরা শহরবাসীদের মতাে স্থায়ীভাবে এক স্থানে বসবাস করত না। স্বাধীনচেতা যাযাবরগণ খাদ্য ও পানীয়ের সন্ধানে মরুভূমির এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে বেড়াত। এজন্য তারা ছিল রিক্ত ও অর্থক্লিষ্ট। বিরূপ প্রকৃতির কারণে তারা যাযাবরী জীবন গ্রহণ করে। পশুপালন ও লুটতরাজ ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়। 

৪. ব্যাংক ও নিকাশ ঘর প্রতিষ্ঠাঃ মক্কার বণিক সম্প্রদায় বাণিজ্য পথে তাদের নিরঙ্কুষ আধিপত্যের কারণে কালক্রমে মক্কায় ব্যাংক স্থাপিত হয়। মহাজনী ব্যবসা প্রসার লাভ করে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সহায়ক হিসেবে নিকাশ ঘর (Clearing house)-এর আবির্ভাব ঘটে। ফলে হেজাজের জনসাধারণ একটা সমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। 

উপসংহারঃ জাহেলী যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল বিশৃংখল, যেখানে কোনাে নীতি নৈতিকতা এবং মনুষ্যত্বের বালাই ছিল না। আর ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগােলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে রুক্ষ মরুর দেশ আরব ছিল অনুর্বর। অর্থনীতি সুনিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও সুষ্ঠু বিনিয়ােগের অভাবে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত সমাজের অধিকাংশ মানুষকে অর্থকষ্টের মােকাবেলা করতে হতাে।