বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনবিদ্ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের সংজ্ঞা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন। আইনের সংজ্ঞা ও স্বরূপ সম্পর্কিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন রকম ধারণাগুলিকে ছয় ভাগে বিভক্ত করা যায় :
-
(ক) বিশ্লেষণমূলক মতবাদ,
-
(খ) ঐতিহাসিক মতবাদ,
-
(গ) দার্শনিক মতবাদ
-
(ঘ) তুলনামূলক মতবাদ,
-
(ঙ) সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ এবং
-
(চ) মার্কসীয় মতবাদ।
(ক) আইন সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক মতবাদ
সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের নির্দেশই হল আইন: অস্টিনের মতানুসারে আইন হল সার্বভৌমের আদেশ। এই বক্তব্য আইনের বিশ্লেষণমূলক মতবাদ হিসাবে পরিচিত। অস্টিন ব্যতীত বেস্থাম, বোঁদা, হবস্, হল্যান্ড, মেকিয়াভেলি প্রভৃতি দার্শনিকও আইন সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করেন। তাঁদের মতে, কতকগুলি কাজ করার এবং কতকগুলি কাজ না করার ব্যাপারে সার্বভৌমের নির্দেশই হল আইন। এই মতবাদ অনুসারে সার্বভৌম শক্তিই হল আইনের উৎস এবং ধারক ও বাহক। ফরাসী দার্শনিক বোঁদার মতানুসারে আইন হল। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশ (command of the human superior) এবং আইন বলবৎ হয় বলপ্রয়োগের দ্বারা। বেহামের মতে সার্বভৌম কর্তৃত্বের আদেশই হল আইন এবং জনগণের কর্তব্য হল সেই আইনের প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য প্রদর্শন করা। ইংরেজ দার্শনিক হসও সার্বভৌম কর্তৃত্বসম্পন্ন রাজার আদেশ বা নির্দেশকে আইন হিসাবে প্রচার করেছেন। বিশ্লেষণমূলক মতবাদ অনুসারে আইনের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল: (১) আইন সার্বভৌম রাজনীতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত এবং (২) আইন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রযুক্ত হয়। অধ্যাপক গেটেলের মতানুসারে এই মতবাদ আইন প্রণয়নকে আইনের উৎস, আইনকে রাষ্ট্রের সচেতন আদেশ এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে চরম ও অখণ্ড বলে মনে করেন। এই মতবাদের আধুনিক প্রবক্তাদের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের হল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলোবির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আইন সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক মতবাদের সমালোচনা
বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণমূলক মতবাদের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।
(১) মেইন, ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, কেবল ‘সার্বভৌমের আদেশই আইন’ এই ধারণা ভ্রান্ত। আইন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সার্বভৌম ছাড়াও সমাজের অন্যান্য উৎস হিসাবে প্রথা, ধর্ম, আদালতের রায়, পণ্ডিত ব্যক্তিদের বক্তব্য প্রভৃতিকে এই মতবাদ উপেক্ষা করেছে।
(২) বিভিন্ন দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রথাগত বিধানসমূহের (Conventions) গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এই প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসাবে ইংল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথাগত বিধানগুলিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সার্বভৌমের নেই। পঞ্জাবকেশরী রঞ্জিত সিংহের মত স্বৈরাচারী শাসকও প্রচলিত প্রথাগুলিকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি।
(৩) নিছক ‘সার্বভৌমের আদেশই আইন’ এই ধারণা গণতান্ত্রিক আদর্শ ও জনগণের সার্বভৌমিকতার তত্ত্বের বিরোধী। আইনের সৃষ্টি ও সাফল্যের ব্যাপারে জনগণের ইচ্ছা ও সমর্থনের কার্যকর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। আইনের উৎপত্তি ও প্রয়োগের সাফল্য জনমতের উপর নির্ভরশীল।
(৪) এই মতবাদ অনুসারে আইন স্থিতিশীল। কিন্তু বাস্তবে সমাজসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনও বিবর্তিত হয়।
(৫) এই মতবাদে ‘আইন’ এবং ‘আদেশ’ এই দু এর মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্যকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ম্যাকাইভারের মতে আইন হল আদেশের বিপরীত (“Law is the very antithesis of command.”)। শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে আদেশের কথা আসে, আইন প্রণয়নের ব্যাপারে নয়। আদেশ বিশেষ অবস্থায় ঘোষিত হয়। তাই আদেশ অস্থায়ী প্রকৃতির হয়ে থাকে। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ নাগরিক ও আইনপ্রণয়নকারী সকলেই আইনের অধীন।
(৬) এই মতবাদ অনুসারে সার্বভৌম শক্তির সমর্থনই আইনের অনুমোদনের ভিত্তি, বাস্তবে কিন্তু মানুষে কেবল শাস্তির ভয়েই আইন মান্য করে না। এ বিষয়ে আইনের উপযোগিতার উপলব্ধি, শ্রদ্ধাবোধ, মানুষের অভ্যাস প্রভৃতির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। ব্রাইসের মতানুসারে আইন মান্য করার কারণ হল নির্লিপ্ততা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, শাস্তির ভয় ও যৌক্তিকতার উপলব্ধি।
বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ আইনের একটি সুস্পষ্ট ও বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ। এই মতবাদ আইনের ধারণা সম্পর্কে অস্পষ্টতা দূর করতে সাহায্য করেছে।
(খ) আইন সম্পর্কে ঐতিহাসিক মতবাদ
ঐতিহাসিক মতবাদ অনুযায়ী আইনের স্বরূপ: এই মতবাদ অনুসারে ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে যে সকল রীতি নীতি, প্রথা প্রভৃতির উৎপত্তি হয়, তার থেকেই আইনের সৃষ্টি হয়। সার্বভৌমের নির্দেশে আকস্মিকভাবে আইনের সৃষ্টি হয়নি। আবার সার্বভৌমের নির্দেশই কেবল মানুষ আইন মান্য করে না। আইন ন্যায়ের প্রতীক বলে এবং অভ্যাসবশে বা স্বভাবগত কারণে মানুষ আইন মেনে চলে। এই মতবাদ ঐতিহাসিক বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের সৃষ্টি ও স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছে। প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত প্রথা, রীতি নীতি ও আচার-ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে আইনের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলি কালক্রমে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রযুক্ত হয়েছে। এখনও আইনের উপর প্রথা ও রীতি-নীতির যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। প্রচলিত প্রথা ও রীতি নীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন আইনকে লোকে মান্য করে না। প্রথাকে কেন্দ্র করে আইনের পরিবর্তনও ঘটে। সমাজব্যবস্থার বিবর্তনের সঙ্গে আইনেরও পরিবর্তন ঘটে। তাই বিভিন্ন যুগের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের আইনের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই মতবাদে আইনকে স্বয়ংসৃষ্ট (Self created) এবং স্বয়ং প্রযুক্ত (Self executed) হিসাবে দেখা হয়। এই মতবাদের মুখ্য প্রবক্তাদের মধ্যে জার্মান আইনবিদ স্যাভিগ্নী, মেইন, মেইটল্যান্ড পোলক, ক্লার্ক, সিজউইক প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্যাভিগ্নীর মতানুসারে আইন প্রণয়ন রাষ্ট্রের কাজ নয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত কাজ হল আইনের যথার্থ উপলব্ধি ও তার প্রয়োগ।
আইন সম্পর্কে ঐতিহাসিক মতবাদের সমালোচনা
আইনের ঐতিহাসিক মতবাদের গুরুত্ব ও মূল্য সত্ত্বেও এর ত্রুটি বিচ্যুতি গুলিকে অস্বীকার করা যায় না।
(১) এই মতবাদে আইনের ইতিহাসের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে আইনের দর্শনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। গেটেল বলেছেন: “This method over emphasised legal history and undervalues legal philosophy:” মতবাদটি আইনের উৎপত্তির উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং আইনের নৈতিক উদ্দেশ্যকে কার্যত অগ্রাহ্য করেছে।
(২) আইনের ক্ষেত্রে সার্বভৌমিকতার প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে এই মতবাদের মূল্যায়ন সঠিক নয়। আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থনকে এই মতবাদ অস্বীকার করেছে। অথচ সার্বভৌম শক্তির দ্বারা স্বীকৃত ও বলবৎ না হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন মান্য করে না।
(৩) এই মতবাদে আইনের উৎপত্তির ব্যাপারে প্রথা ও রীতি-নীতির উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং অন্যান্য উপাদানের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
(৪) এই মতবাদ আইনের সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে সন্দেহের চোখে দেখে। তাই অনেকের মতে এর প্রবক্তাদের মনোভাব রক্ষণশীল।
(৫) মার্কসবাদীদের মতানুসারে ঐতিহাসিক মতবাদ আইনকে শ্রেণীস্বার্থের ধারক ও বাহক হিসাবে প্রতিপন্ন করতে পারেনি। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় বিভিন্ন পর্যায়ে আইন হল বিত্তবান ও প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থ বা ইচ্ছার অভিব্যক্তি মাত্র।
বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও আইনের ঐতিহাসিক মতবাদের তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
মূল্যায়ন: দীর্ঘকাল ধরে সমাজে প্রচলিত প্রথাগুলিই কালক্রমে আইনে পরিণত হয়’—ঐতিহাসিক মতবাদের এই বক্তব্য সঠিক। ‘আইন স্থিতিশীল নয়, গতিশীল’—মতবাদটির এই যুক্তিটিও যথার্থ। আবার সরকারের ক্ষমতাসীন থাকার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করা যায় না।
(গ) আইন সম্পর্কে দার্শনিক মতবাদ
দার্শনিক মতবাদ অনুসারে আইনের প্রকৃতি: এই মতবাদের নৈতিক মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আইনকে আদর্শের প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হয়। বলা হয় যে, আইনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদর্শের প্রকাশ ঘটে; আইন বস্তুনিরপেক্ষ। এই মতবাদের প্রবক্তারা আইনব্যবস্থাকে নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করার এবং ন্যায় বিচারের ধারণাকে আদর্শ আইনব্যবস্থায় পরিণত করার পক্ষপাতী। এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের কর্তব্য হল যথার্থ আইনের সংজ্ঞা নির্দেশ এবং দার্শনিক মানদণ্ডে বিচার করে তার প্রয়োগ। প্রাচীনকালে গ্রীস দেশের ষ্টোইক (Stoics) দার্শনিকগণ প্রাকৃতিক নিয়মকেই আদর্শ আইন বলে মনে করতেন। অ্যারিস্টটলের মতে আইন হল সামাজিক প্রজ্ঞার প্রকাশ। ফরাসী দার্শনিক রুশো আইনকে সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রকাশ বলে প্রচার করেছেন। হেগেল আইনকে সর্বোচ্চ নীতির প্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন। এই মতবাদের আধুনিক সমর্থকরা আইনের উদ্দেশ্য হিসাবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ প্রসঙ্গে জোসেফ কোলারের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি আইনকে সংস্কৃতির সৃষ্টি এবং সংস্কৃতির উপায় হিসাবে দেখেছেন। তাঁর অভিমত হল আইনের বাস্তব বিষয়বস্তু আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে আইনজ্ঞ দার্শনিককে আইনের আদর্শগত দিকটিকে উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করতে হবে।
আইন সম্পর্কে দার্শনিক মতবাদের সমালোচনা
(1) আইনের দার্শনিক মতবাদ কল্পনাপ্রসূত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। বাস্তব জীবনের সঙ্গে এর কোন যোগ নেই।
(২) দার্শনিকগণ বিভিন্ন যুগে আইনের সংজ্ঞা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তার ফলে একটি সুসামঞ্জস্য মতবাদ হিসাবে আইনের দার্শনিক মতবাদ তেমন প্রতিষ্ঠা পায়নি।
(৩) আইনের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। নৈতিক দৃষ্টিতে যা অন্যায়, আইনের দৃষ্টিতে তা সব সময় অপরাধ নাও হতে পারে। আইনের পিছনে একটি কার্যকরী শক্তির সমর্থন থাকে। কিন্তু নৈতিকতার পিছনে তা থাকে না।
(৪) মার্কসবাদীদের মতানুসারে বুর্জোয়া দার্শনিকগণ আইনের উপর শাশ্বত প্রজ্ঞা ও নৈতিকতা আরোপ করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে আইন হল সমাজের প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থের প্রকাশ।
(ঘ) আইন সম্পর্কে তুলনামূলক মতবাদ
তুলনামূলক মতবাদের মূল বক্তব্য: বিভিন্ন দেশের অতীতকালের এবং বর্তমান দিনের আইনসমূহের তূলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে আইনের স্বরূপ সম্পর্কে অনুশীলন করাই হল এই মতবাদের উদ্দেশ্য। বস্তুতপক্ষে আইনের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এ হল একটি তুলনামূলক পদ্ধতিবিশেষ। বিভিন্ন দেশে আইনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ ও তুলনা করে এই মতবাদে আইনের সঠিক স্বরূপ সম্বন্ধে ধারণা লাভের চেষ্টা করা হয়। ইংল্যাণ্ডের ভিনোগ্রাডফ (Vinogradoff) এই মতবাদের প্রবক্তা হিসাবে প্রখ্যাত। এই মতবাদ ত্রুটিমুক্ত নয়। তবে আইনের প্রকৃতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতবাদটির অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
(ঙ) আইন সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ
সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে আইনের প্রকৃতি: আইনের সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ হল আইনের প্রকৃতি বিষয়ক অন্যতম আধুনিক মতবাদ। মূলত মনোবিদ্যা, সমাজতত্ত্ব এবং প্রয়োগবাদী দর্শন থেকে এই মতবাদের প্রবক্তারা তাঁদের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এই মতবাদ অনুসারে সুন্দর সমাজজীবনের সহায়ক হিসাবে বিভিন্ন সামাজিক প্রভাবের মাধ্যমে আইনের সৃষ্টি হয়। সুষ্ঠু সমাজজীবনের স্বার্থেই আইনের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ সামাজিক স্বার্থবোধই হল আইনের উৎস। আর সমাজজীবনের পক্ষে উপকারী বলেই লোকে আইন মান্য করে চলে। সমাজবিজ্ঞানমূলক ধারণা অনুসারে আইন রাষ্ট্রীয় শক্তি থেকে স্বাধীন, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেই এর উৎপত্তি। এই মতবাদ অনুসারে আইনের সার্থকতা তার বাস্তব উপযোগিতায়। আইন হল সর্বোচ্চ শক্তি। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অপেক্ষা আইনের বৈধতাই প্রধান। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ঊর্ধ্বে আইনের স্থান। সামাজিক কল্যাণের কোন্ কোন্ আদর্শ আইনে রূপান্তরিত হওয়া বাঞ্ছনীয় তাকেই এই মতবাদের মুখ্য বিচার্য হিসাবে গণ্য করা হয়। এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তাদের মধ্যে অস্ট্রিয়ার গামপ্লোউইক, ফ্রান্সের দ্যুগুই, হল্যান্ডের ক্রাবে, ইংল্যাণ্ডের ল্যাস্কি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রস্কো পাউন্ড, বিচারপতি হোস প্রমুখ ব্যক্তির নাম উল্লেখযোগ্য। দ্যুওই-এর মতানুসারে আইন রাষ্ট্র নিরপেক্ষ এবং এর স্থান রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে। মানুষ সামাজিক সংহতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বলেই সচেতনভাবে আইন মান্য করে। ক্র্যাবের মতানুসারে আইনের উৎস মানুষের যাথার্থ সম্পর্কে অনুভূতি (Sense of right)। ল্যাস্কির মতে আইনের সামাজিক উপযোগিতাই আইনের প্রতি মানুষকে অনুগত করে।
আইন সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদের সমালোচনা
গুরুত্ব ও মূল্য সত্ত্বেও আইনের সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আইনের পিছনে বলপ্রয়োগের ভূমিকাকে এই মতবাদ অস্বীকার করেছে। তা ছাড়া, ‘সামাজিক কল্যাণ সাধন আইনের প্রধান লক্ষ্য’—একথা সব সময় ঠিক নয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে ধনবৈষম্যমূলক সমাজে সামগ্রিক কল্যাণ অপেক্ষা প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণই হল আইনের উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে আইন রাষ্ট্রনিরপেক্ষ নয়। তবে সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আইনের সৃষ্টি হয়েছে, এই বক্তব্যকে অস্বীকার করা যায় না।
(চ) আইন সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ
আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা: মার্কস ও মার্কসবাদীগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের উৎপত্তি ও স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থের অনুপন্থী নিয়ম কানুনই আইন হিসাবে প্রচারিত হয়। আইন হল শ্রেণীস্বার্থের রাষ্ট্রীয় প্রকাশ। সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরে সমাজের উৎপাদন শক্তি উৎপাদন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণীত হয়। সমাজের প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্ককে বজায় রাখার জন্যই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে। সামাজিক প্রগতির প্রতিটি পর্যায়ে উৎপাদন উপাদানগুলির মালিকানা যে শ্রেণীর হাতে থাকে তারাই হল সম্পদশালী শ্রেণী বা শোষক শ্রেণী। তারাই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজেদের স্বার্থবাহী যে সকল নিয়মকানুন রচনা করে, সমাজে তাই আইন হিসাবে কার্যকরী হয়। আইনের স্বরূপ সম্পর্কে ল্যাস্কিও অনুরূপ মত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন: “The legal order is mask behind which a dominant economic interest secures the benefit of political authority.”
রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও আইনের প্রকৃতি সম্পর্কযুক্ত: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে রাষ্ট্রের প্রকৃতির সঙ্গে আইনের প্রকৃতি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে রাষ্ট্রের প্রকৃতির উপর আইনের প্রকৃতি নির্ভরশীল। সমাজ বিকাশের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্র প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। তাই আইনের মাধ্যমে সেই প্রভুত্বকারী শ্রেণীর ইচ্ছাই প্রকাশিত হয়। ভিশিন্স্কির মতানুসারে আইন হল সেই সকল আচরণবিধি যা সমাজের প্রভুত্বকারী শ্রেণীর ইচ্ছার প্রকাশ। সমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে সমাজের প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করেছে এবং রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে জনগণের বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ করেছে। দাস-সমাজে আইন মুষ্টিমেয় দাস-মালিকদের স্বার্থে দাসদের বিরুদ্ধে; সামন্ত সমাজে আইন সংখ্যালঘু ভূস্বামীদের স্বার্থে সংখ্যাগুরু ভূমিদাসদের বিরুদ্ধে এবং ধনতান্ত্রিক সমাজে আইন মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণীর বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। শ্রেণীবৈষম্যমূলক কোন সমাজে আইন নিরপেক্ষ হতে বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজে আইন প্রকৃতিগতভাবে বৈষম্যমূলক হয়ে থাকে। কিন্তু শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজে আইন নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপযোগী হতে পারে।
মার্কসবাদীদের মতে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইন সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ধারা বজায় রাখার জন্য এবং শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সৃষ্টি ও প্রযুক্ত হয়। সমাজ বিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন রাষ্ট্রবিহীন সমাজের (Stateless Society) সৃষ্টি হবে তখনও সেই সমাজের প্রয়োজন অনুসারে কিছু নিয়ম কানুন থাকবে। সমস্ত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে আইন শাসকশ্রেণীর ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করে। বস্তুত সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়ে সমাজের প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর ইচ্ছাই আইনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ভিশিন্স্কি বলেছেন: “Marxism Leninism gives a clear definition (the only scientific definition of the essence of law. It teaches that relationship (and consequently, law itself) are rooted in the material condition of life, and that law is merely the will of the dominant class elevated into a statute.”
আইন সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদের সমালোচনা:
সমালোচকদের মতে আইন সম্পর্কিত মার্কসীয় ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের মতে মার্কস সমাজজীবনের সহযোগিতার দিকটি বা সমাজের শুভময় রূপটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন এবং শ্রেণীস্বার্থ ও শ্রেণীদ্বন্দ্বের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তা ছাড়া রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা চিরদিনই থেকে যাবে। সর্বোপরি আইন সুশৃঙ্খল সমাজজীবনের স্বার্থে এবং মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনের জন্য প্রযুক্ত হয়, এ কথা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। তবে প্রকৃত প্রস্তাবে আইনের মার্কসীয় ব্যাখ্যাই বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত। মার্কসবাদীদের এই ব্যাখ্যার যাথার্থ্য ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
Leave a comment