প্রশ্নঃ 
সঠিকভাবে আইন বোঝার জন্য জুরিসপ্রুডেন্স পাঠ কতটুকু আবশ্যক?

জুরিসপ্রুডেন্সঃ ইংরেজি শব্দ ‘Jurisprudence’-এর বাংলা অনুবাদ আইনবিজ্ঞান৷ ল্যাটিন শব্দ ‘Jurisprudentia’ হতে Jurisprudence উদ্ভূত। ‘জুরিস’ এর অর্থ আইন এবং ‘প্রুডেনসিয়া’র অর্থ জ্ঞান। অতএব উৎপত্তিগত অর্থে আইন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানকে জুরিসপ্রুডেন্স বা আইনবিজ্ঞান বলে। ব্যাপক অর্থে জুরিসপ্রুডেন্স আইনের সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হয় বা কোন শাস্ত্রের আইনগত সম্পর্ককেও বুঝায়। যেমন— মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স, আর্কিটেক্‌চারাল জুরিসপ্রুডেন্স ইত্যাদি। আইন-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জুরিসপ্রুডেন্স এসব ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় না। আইন সম্পর্কে গভীরভাবে অনুসন্ধান ও অনুশীলন করাই হচ্ছে আইনবিজ্ঞান। 

কোন দেশের আইন বা কোন বিশেষ আইন সম্পর্কে অনুসন্ধান না করে বরং আইনের সাধারণ ধারণা সম্পর্কে আইনবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে। এ্যালেনের (Allen) মতে, আইনের মূল নীতিগুলির বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণই হচ্ছে আইন বিজ্ঞান।

বিভিন্ন আইনবিজ্ঞানীগণ তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আইনবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। স্যামন্ড (Salmond) আইনবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, দেশের আইনের প্রাথমিক মূল নীতিগুলির বিজ্ঞান হচ্ছে আইনবিজ্ঞান (The science of the first principles of civil law) রোমান আইনশাস্ত্রবিদ আলপিয়ানের মতে, মানবিক ও ঐশ্বরিক বিষয়বস্তুর পর্যবেক্ষণ এবং ন্যায় অন্যায়ের বিজ্ঞান হচ্ছে আইনবিজ্ঞান। 

সঠিকভাবে আইন বুঝার জন্য জুরিসপ্রুডেন্সের প্রয়োজনীয়তাঃ আইনবিজ্ঞানের কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা যায় না কিন্তু আইন প্রয়োগকালে এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আইনবিজ্ঞানের প্রয়োজন হয়। তাই আইনবিজ্ঞান পাঠের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ না হলেও এর বাস্তব মূল্য অপরিসীম। এগুলি মূলতঃ নিম্নরূপঃ

প্রথমতঃ আইনের মৌলিক ধারণাসমূহ বিশ্লেষণ করে আইনবিজ্ঞান। তাই অধ্যাপক হল্যান্ড আইনবিজ্ঞানকে ‘আইন শিক্ষার ব্যাকরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আইনবিজ্ঞান পাঠ করলে আইনের মূল নীতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়। তাই অবৈধ কার্য, আইনগত ক্ষতি, অভিপ্রায়, শাস্তি ইত্যাদি সম্পর্কে আইনবিজ্ঞান যেরূপ বিশ্লেষণ করে সেগুলি আয়ত্ব করলে একজন আইনের ছাত্র কোন আইনগত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চিত্তাকর্ষক যুক্তি প্রদর্শনের কলা কৌশল আয়ত্ব করতে পারে। কাজেই একজন সুদক্ষ আইনজীবি বা আইনবিদ হতে হলে আইনবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজন।

দ্বিতীয়তঃ সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য আইন গৃহীত হয় বা প্রণীত হয়। স্যামন্ড বলেন, “দেশের আইন কাঠোমোর উপর প্রয়োজনীয় আলোকপাত করাই হলো আইনবিজ্ঞান পাঠের মূখ্য উদ্দেশ্য।” একটি দেশের আইন সভা বা আইন প্রণেতাগণ আইনবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলির উপর ভিত্তি করে দেশের জন্য বিজ্ঞান সম্মত আইন প্রণয়নে সচেষ্ট হন।

কাজেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনবিজ্ঞানের ভূমিকাই যথেষ্ট। নতুন কোন আইন প্রণীত হলে এর কার্যকারিতা কিরূপ হবে এবং ইহা কিভাবে ব্যাবহৃত হতে পারে সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে হলে আইনবিজ্ঞান যথার্থভাবে পাঠ করতে হবে।

তৃতীয়তঃ আইনবিজ্ঞান পাঠ করে এক ব্যক্তি সচেতন নাগরিক হতে পারে। প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু সামাজিক দায়িত্ব ও অধিকার আছে। একজনের অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে অন্যের অধিকার যেনো লংঘিত না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা দরকার। আইন বিজ্ঞান এরূপ প্রয়োজনীয় জ্ঞান দেয়।

চতুর্থতঃ বিচার প্রশাসন আইনবিজ্ঞানের এক অন্যতম বিষয় বিধায় বিচার কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আইনবিজ্ঞান অধ্যয়নের প্রয়োজন। শাস্তির উদ্দেশ কি এবং বিভিন্ন প্রকার শাস্তির প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে হলে আইনবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন। একজন ভাল বিচারক হতে হলে তাকে অবশ্যই একজন ভাল আইন বিজ্ঞানী হতে হবে।

পঞ্চমতঃ এই শাস্ত্র অধ্যয়নের দ্বারা মানুষের মন আইনগত চিন্তাধারার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়। তাই আইনে গবেষণার ক্ষেত্রে আইনবিজ্ঞান যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এজন্য আইনশাস্ত্র গবেষকদের জন্য আইন বিজ্ঞান পাঠ করা অত্যাবশ্যকীয়।

ষষ্ঠতঃ আইনবিজ্ঞান যেহেতু আইনের ব্যাকরণ, চক্ষু ও অভিধান স্বরূপ। আইনে যথার্থ জ্ঞানলাভ করতে হলে প্রথমে আইনবিজ্ঞানে জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।

পরিশেষে, ইহা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আইনবিজ্ঞান শুধু যথার্থ আইনবিদ, বিচারক, আইন গবেষক এবং সচেতন নাগরিক হতে সাহায্য করে তাই নয় এই শাস্ত্র পাঠে লব্ধ জ্ঞান সমগ্র আইনগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে।