প্রশ্নঃ কেন আইন বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে?

উত্তরঃ সাধারণ অর্থে আইনের উৎস, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে মৌল তত্ত্বের ধারাবাহিক আলোচনা ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা হচ্ছে আইনবিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু এ কার্যে আইনবিশারদগণ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন নাই। তারা নিজ নিজ ধারণা ও মতাদর্শের দৃষ্টিতে এগুলি ব্যক্ত করেছেন। তাই সকলের গ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কের ঊর্ধে কোন সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভবপর হয় নাই। আইনবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত মতামতগুলি শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে এবং এগুলিকেই আইনবিজ্ঞানের মতবাদ বলে। এই মতবাদগুলি প্রধানতঃ নিম্নোক্ত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্তঃ

(১) বিশ্লেষণমূলক মতবাদ (Analytical School)

(২) ঐতিহাসিক মতবাদ (Historical School) 

(৩) নৈতিক মতবাদ (Ethical School) 

এগুলি ছাড়াও নিম্নোক্ত তিনটি মতবাদ পরিলক্ষিত হয়ঃ 

(১) সমাজতান্ত্রিক মতবাদ (Sociological School)

(২) দার্শনিক মতবাদ (Philosophical School) 

(৩) তুলনামূলক মতবাদ (Comparative School)

১। বিশেষণমূলক মতবাদ (Analytical School): এ মতবাদ প্রচলিত আইনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এই মতবাদ আইনের আদর্শসমূহ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না বরং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত আইনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে আইনের কার্যকারিতা যথার্থভাবে এবং নিশ্চিতভাবে বলবৎ করাই হলো এর মূখ্য উদ্দেশ্য।

২। ঐতিহাসিক মতবাদ(Historical School): অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে জার্মানীতে সর্ব প্রথম আইন-বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক মতবাদের উদ্ভব ঘটে। জার্মান আইন-বিজ্ঞানী স্যাভাইনি এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। হেনরী মেইন (Henry Main-এর মতে মন্টেস্কু (Montes Quien) এই মতবাদের প্রথম প্রবক্তা। এই মতবাদ অনুসারে একটি জাতির অতীত ইতিহাস হতে তার আইনের মূল বিষয়বস্তু গৃহীত হয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মধারার সাথে আইন অলংঘনীয় নিয়মে গ্রথিত। কিরূপে সামাজিক আচরণের নিয়ন্ত্রণবিধি ক্রম-বিবর্তনের ধারায় আইনের অনুশাসন দ্বারা আদিকাল হতে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে এবং কিরূপে বিভিন্ন অবস্থায় তা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপে বিকাশ লাভ করেছে, সেগুলি অনুসন্ধান করাই ঐতিহাসিক মতবাদের লক্ষ্য।

৩। নৈতিক মতবাদ ( Ethical School): নৈতিক মতবাদ ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন বিশেষ আইন কি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রণীত হয়েছে তা অনুসন্ধান করে এই মতবাদ। সামাজিক মঙ্গলই হচ্ছে আইনের লক্ষ্য । তাই রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে আইন প্রয়োগ করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করাই হচ্ছে আইনের উদ্দেশ্য এই মতবাদে বিশ্বাসী আইনবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, নীতিগতভাবে আইনের যে সকল ত্রুটি রয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতঃ এর অসম্পূর্ণতা দূর করা হচ্ছে এর উদ্দেশ্য। মোটের উপর আইনের নীতিগত আদর্শ কিরূপ হওয়া উচিত, নির্ধারণ করাই এই মতবাদের উদ্দেশ্য।

(৪) সমাজতান্ত্রিক মতবাদ (Sociological School): আইনের প্রকৃত সার্থকতা সামাজিক শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সাধন। সামাজিক এ স্বার্থ সংরক্ষণে সুচিন্তিত বিধি বিধান সৃষ্টি এই মতবাদের লক্ষ্য ব্যক্তিস্বার্থের সহিত সমষ্টিগত স্বার্থের সমন্বয় সাধন করার আইনগত কৌশল উদ্ভাবনের পর্যালোচনা করা আইনবিজ্ঞানের কাজ। কোন্ সমাজে কোন্ আইন কিভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে, আইনবিজ্ঞান তা পর্যালোচনা করতঃ সঠিক ও সুষ্ঠু কৌশল প্রদান করে থাকে, যে সকল আইনবিজ্ঞানী সমাজতান্ত্রিক মতবাদে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তন্মধ্যে জার্মান আইনবিজ্ঞানী রুডলক ভন আইহেরিং, ডওইট, এরলিচ এবং মার্কিন আইনবিজ্ঞানী ডীন রস্কো পাউণ্ডের নাম উল্লেখযোগ্য।

(৫) দার্শনিক মতবাদ (Philosophical School): দার্শনিক মতবাদের ভিত্তি হলো প্রকৃতি, ধর্ম এবং বিবেক। প্রাকৃতিক, নৈতিক বা অধিবিদ্যা- এই তিন ধরনের অনুশাসন দ্বারা মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়৷ প্ৰাকৃতিক জগতের কোন অনিয়মের কারণে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, তেমনি মনুষ্য সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম বা বিবেক বিরুদ্ধ আচরণের ফলে সামাজিক অনাচার ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। গ্রীক দার্শনিকগণ তাই প্রকৃতিকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

(৬) তুলনামূলক মতবাদ (Comparative School): আইনবিজ্ঞানের তুলনামূলক মতবাদটি সাম্প্ৰতিক কালের চিন্তাধারার একটি প্রতিচ্ছবি। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয় এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ দ্বারা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি চিহ্নিত করা হয়৷