প্রাচীনকালে আইন ও নৈতিক বিধানের মধ্যে পার্থক্য করা হত না: রাজনীতিক আইন ছাড়াও সমাজব্যবস্থায় আরও কতকগুলি বিধি-নিষেধ থাকে যার দ্বারা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের বিবেকবোধ, ন্যায়-নীতি, ঔচিত্য-অনৌচিত্যের ধারণা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে এই সকল বিধি-বিধানের সৃষ্টি হয়। এগুলিকে নৈতিক বিধি (Morality) বলা হয়। প্রাচীনকালে আইন ও নৈতিক বিধানের কোন পার্থক্য করা হত না। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের আমলে আইনসমূহ নীতিশাস্ত্রের উপর ভিত্তিশীল ছিল। অ্যারিস্টটল বলেছেন: “The state continues to exist for the sake of good life.” প্রাচীনকালে চীন ও মিশরে নীতিশাস্ত্রের ভিত্তিতে আইন রচিত হত। প্রাচীন ভারতে রাজা-প্রজার পারস্পরিক সম্পর্ক নীতিবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সম্রাট অশোক প্রজাসাধারণের নৈতিক জীবনের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নীতিবাক্যগুলিকে শিলালিপির মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন এবং এগুলির প্রয়োগের ব্যাপারে নজর রাখার জন্য ‘ধর্মমহাপাত্র’ নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালির চিন্তানায়ক মেকিয়াভেলিই প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্রের প্রভাবমুক্ত করেন এবং বাস্তববোধের উপর প্রশাসনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দিষ্ট করা হয়।

আইন ও নৈতিক বিধানের মধ্যে পার্থক্য:

(১) বিষয়বস্তু ও এক্তিয়ারগত পার্থক্য: রাষ্ট্রনৈতিক আইনের তুলনায় নৈতিক বিধির পরিধি অনেক ব্যাপক। আইন কেবল মানুষের বহির্জীবন ও বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের চিন্তা-ভাবনা অনুভূতি প্রভৃতি অন্তর্জীবনের ক্রিয়াকলাপের উপর এর কোন এক্তিয়ার নেই। পক্ষান্তরে নৈতিক বিধান মানুষের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মন, চিন্তা, অনুভূতি প্রভৃতি সবকিছুই নৈতিক বিধির এক্তিয়ারভুক্ত। চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করাই নীতিশাস্ত্রের উদ্দেশ্য। মানুষের অন্তর্জীবন ও বহির্জীবন সামগ্রিকভাবে নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। চুরি করার ইচ্ছা পোষণ আইন-বিরুদ্ধ নয়; প্রকৃতপক্ষে চুরি করলে তবেই সেই আচরণ আইনের আওতায় আসে। কিন্তু উভয় বিষয়ই নীতিবিরুদ্ধ। ম্যাকাইভার বলেছেন: “Law does not and cannot cover all the grounds of morality.”

(২) অনুমোদনগত পার্থক্য: রাষ্ট্রীয় আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির অনুমোদন থাকে। তাই তা বাধ্যতামূলকভাবে বলবৎ হয়। কিন্তু নৈতিক বিধানের পিছনে এ রকম কোন শক্তির সমর্থন নেই। তাই নৈতিক বিধান আবশ্যিকভাবে কার্যকরী হয় না। নীতিগর্হিত কাজের জন্য কেবল বিবেকের দংশন, লোকনিন্দা প্রভৃতি ভোগ করতে হয়।

(৩) মানদণ্ডের পার্থক্য: নীতিগতভাবে যা অন্যায় আইনের চোখে তা অপরাধ নাও হতে পারে। যেমন মদ্যপান নীতি-বিরুদ্ধ, কিন্তু বে-আইনী নয়। আবার আইনের চোখে যা দণ্ডনীয় নৈতিক বিচারে তা দূষণীয় নাও হতে পারে। যেমন, আমাদের দেশের রাস্তার ডানদিক দিয়ে গাড়ি চালান আইন-বিরুদ্ধ, কিন্তু নীতি-বিরুদ্ধ নয়।

(৪) আইন অনেক বেশী সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট: রাষ্ট্রীয় আইনসমূহ নৈতিক বিধান অপেক্ষা অনেক বেশী সুস্পষ্ট এবং সুসংবদ্ধ। নৈতিক বিধিগুলি মানুষের মন, চিন্তা অনুভূতি প্রভৃতি সূক্ষ্ম প্রবণতাকে নিয়ে পরিচালিত হয় বলে এগুলি নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হতে পারে না।

(৫) দেশ-কাল ভেদে পার্থক্য: নৈতিক বিধানগুলি মোটামুটিভাবে সর্বদেশের এবং সর্বকালের। মানুষ ইচ্ছানুসারে এগুলিকে পরিবর্তন করতে পারে না। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রীয় আইন আপেক্ষিক এবং দেশ ও কালভেদে বিভিন্ন। আবার প্রয়োজনবোধে মানুষ তা সংশোধন বা বাতিল করতে পারে।

(৬) রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য: দেশের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তাই রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের পক্ষে আবশ্যক এমন আইনও সৃষ্টি করতে পারে যা ন্যায়নীতির বিরোধী। তবে যুদ্ধকালীন বা কোন বিশেষ অবস্থায় সাময়িকভাবে রাষ্ট্র এ রকম নীতিজ্ঞানবিরোধী আইন প্রণয়ন করে। স্বাভাবিক অবস্থায় রাষ্ট্রের নীতিবিগর্হিত আচরণ সমর্থন বা স্বীকার করা যায় না।

(৭) প্রকৃতিগত পার্থক্য: প্রকৃতিগত বিচারেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। নীতিশাস্ত্র সকল কাজ বা চিন্তাকে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদির মানদণ্ডে বিচার করে থাকে। অপরপক্ষে সুবিধা অসুবিধার মানদণ্ডে আইন প্রণীত হয়।

নৈতিক বিধি ব্যক্তিকেন্দ্রিক:

নৈতিক বিধি অনেক ক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত বিবেকবোধের বিষয়। তাই তা প্রকৃতিগত বিচারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই কারণে ব্যক্তিভেদে নৈতিক বোধের তারতম্য হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আইন হল সর্বজনীন; সমাজস্থ সকলের ক্ষেত্রে তা সমভাবে প্রযুক্ত হয়।

আইন ও নৈতিক বিধানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক:

রাষ্ট্রীয় আইন ও নৈতিক বিধানের মধ্যে উপরিউক্ত পার্থক্য সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না। বস্তুত প্রাচীনকালে আইন ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। রাষ্ট্রনীতি ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্যমূলক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে ষোড়শ শতাব্দীতে ম্যাকিয়াভেলির সময় থেকে। যাই হোক, আইন ও নৈতিক বিধানের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সমাজ বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গেটেল বলেছেন: “There is a close connection between law and morals.”

(১) আইন নীতিবোধকে প্রভাবিত করে: রাষ্ট্রীয় আইন ও নৈতিক বিধান উভয়েরই উদ্দেশ্য হল সুষ্ঠু, সুসংবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজজীবন সম্ভব করা। আইন অনেক সময় সমাজের নীতিবোধকে প্রভাবিত করে দেশের নৈতিক অবস্থার উন্নতির ব্যবস্থা করে। পূর্বে সতীদাহ, বহুবিবাহ প্রথা প্রভৃতি নীতিসম্মত ছিল। কিন্তু আইন করে এই সকল প্রথা দণ্ডনীয় করার পর এগুলি সমাজে ক্রমশ কেবল বে-আইনি নয় নীতিবিরোধী বলে স্বীকৃত হল। অর্থাৎ আইন প্রচলিত নৈতিক বিধানের পরিবর্তনে সাহায্য করেছে।

(২) নীতিজ্ঞান আইনকে প্রভাবিত করে: সমাজের নীতিবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় আইনকে প্রভাবিত করে। নীতিবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে আইন প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়। সেইজন্য আইনকে একটি দেশের নৈতিক মানের পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। উইলসন বলেছেন: “Law is the mirror of the moral progress of a country.” কোন দেশের নৈতিক মূল্যবোধ উন্নত হলে তার আইনব্যবস্থাও উন্নত হয়ে থাকে।

(৩) আইনের সাফল্য জনমত ও নীতিবোধের উপর নির্ভরশীল: আইনের সাফল্য নির্ভর করে মূলত জনমতের উপর। আইন সামাজিক নীতিবোধের অনুগামী হলে সহজেই জনমতের স্বীকৃতি পায় এবং কার্যকরী হয়। অধ্যাপক গেটেলের মতে, ‘আইন প্রচলিত নীতিজ্ঞান থেকে অগ্রবর্তী বা পশ্চাদপদ হয়ে পড়লে, তাকে বলবৎ করা কঠিন।’ বস্তুত রাষ্ট্র সমাজের সর্বোচ্চ নীতিগুলিকে জনমত অনুসারে বিধিবদ্ধ আইনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সকল নৈতিক বিধিকে আইনে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা সম্ভব বা সঙ্গত নয়। ম্যাকাইভার বলেছেন: “To turn all moral obligations into legal obligations would be to destroy morality.”

(৪) আইভর ব্রাউনের মত: আইন ও নৈতিক বিধানের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে আইভর ব্রাউন (Ivor Brown) -এর অভিমত হল যে, নীতিশাস্ত্রের ধারণাকে উপেক্ষা করলে রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ অর্থহীন; আবার রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ ব্যতিরেকে নৈতিক মতবাদ অসম্পূর্ণ। লিপসন মন্তব্য করেছেন: “Politics is the search of society for public ethics. The study of politics is a search into the results, ethically judged.”

উপসংহার: প্রকৃতপক্ষে, আইন ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক গভীর সম্পর্কের অস্তিত্ব সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা অসম্ভব যে, উভয়ের ক্ষেত্র স্বতন্ত্র। মানুষের কল্যাণ ও সমাজের কল্যাণ যতক্ষণ পর্যন্ত অভিন্ন থাকে রাষ্ট্রনীতি ততক্ষণ পর্যন্ত নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। সিজউইক বলেছেন: “Ethics is connected with politics so far as well-being of any individual man is bound up with the well-being of his history.”