আইনের প্রকৃতি ও রাজনীতিক প্রক্রিয়া এই দু’এর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রত্যক্ষ এবং গভীর। রাজনীতিক প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আইন নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। অনুরূপভাবে আইনের প্রকৃতিগত পরিবর্তন রাজনীতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তবে রাজনীতিক ব্যবস্থার পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের প্রকৃতি ও বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রভৃতি রাজনীতিক ব্যবস্থায় আইনের প্রকৃতি ও বিচার বিভাগীয় কাঠামো অভিন্ন ধরনের হয় না।
উদারনীতিক গণতন্ত্রে আইনব্যবস্থা:
উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনগত ও রাজনীতিক সাম্য ও সমানাধিকারের উপর জোর দেওয়া হয়। অ্যালান বল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের পরিকাঠামোর কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল: নিরপেক্ষতা, সামঞ্জস্যতা, খোলামেলা প্রকৃতি, অনুমানযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “In liberal democratic systems the legal system is said to be characterised by such concepts as impartiality, consistency, openness, predictability and stability.” এই ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিচারকার্য সর্ব-সমক্ষে সম্পাদিত হয়। এই ব্যবস্থায় সকল নাগরিক তত্ত্বগতভাবে আইনের দৃষ্টিতে সমান (‘equal before the law’)। কোন কোন কাজকর্মের আইনগত ফলাফল আগেভাগেই যুক্তিসঙ্গতভাবে অনুমান করা সম্ভব। উদারনীতিক ব্যবস্থায় আইনের পদ্ধতি হল অবাধ-উন্মুক্ত এবং সকলের কাছে অবহিত। এখানে আইনের পদ্ধতি একটি নির্দিষ্ট ধারায় পরিচালিত হয়। একেই অনেক সময় আইনের অনুশাসন বলা হয়। বল বলেছেন: “This is what is sometimes meant by the rule of law. “
সমাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনব্যবস্থা:
বলা হয় যে আইনব্যবস্থার উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ সমাজতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে অনুপস্থিত। সমাজতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী রাজনীতিক ব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়। এগুলি হল পুলিশ কর্তৃক স্বৈরাচারী ক্ষমতার ব্যবহার, ন্যায়বিচারের অভাব, গোপনে বিচারকার্য সম্পাদন, আইনের পদ্ধতি ও বিচারের সিদ্ধান্তে গোপনীয়তা প্রভৃতি। এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী।
উদারনীতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা:
উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন ও বিচারব্যবস্থার যে সমস্ত উপাদানের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি সব সময় কার্যকর হয় না। এই ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় যুদ্ধ বা আভ্যন্তরীণ অশান্তিজনিত কারণে জরুরী অবস্থায় সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা (extraordinary powers) প্রদান করা হয়। তারফলে জরুরী অবস্থায় সরকার স্বাভাবিক বিচার-বিভাগীয় পদ্ধতিকে বাতিল করে দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থাতেও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কারণে পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং বর্ধিত এক্তিয়ারসম্পন্ন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ান হয়। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বল মন্তব্য করেছেন: “It is possible to have predictable legal rules and due processes of law in autocratic systems the legal theories of the Prussian state and liberal democratic systems in nineteenth-century Europe seem to underline the fact that the differences are of degree rather than of kind.”
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন ও আদালত:
অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে নিরপেক্ষতা, অবাধ উন্মুক্ত অবস্থা প্রভৃতি উপাদান সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোন কোন ক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকতে পারে। কিন্তু কতকগুলি ক্ষেত্রে উদারনীতিক ও সমাজতান্ত্রিক আইন ও বিচারব্যবস্থা অভিন্ন। সাধারণ ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে এই অভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। চুরি-ডাকাতি, বিষয়-সম্পত্তি প্রভৃতি বিষয়ক মামলা মোকদ্দমা উদারনীতিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সাধারণত একটি পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। কিন্তু রাজনীতিক বিষয় সম্পর্কিত মামলা মোকদ্দমার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতার প্রয়োগ, পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “In Soviet Union there was a marked move towards stabilising the judicial procedures after 1956-57 in what are regarded as political offences.” বলের মতানুসারে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক ব্যবস্থায় উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা প্রয়োগ করা কঠিন ব্যাপার। সমাজতান্ত্রিক মতবাদে যারা বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক, এবং অ-মার্কসীয় সামগ্রিকতাবাদী বা স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনব্যবস্থা হল, শ্রেণী শাসন কায়েম করার অন্যতম হাতিয়ার। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের আরও যুক্তি হল যে, এই সমস্ত রাজনীতিক ব্যবস্থায় আদালতের প্রধান কাজ হল পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রাধান্যের পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং এই প্রাধান্যকে বিধিসম্মত করা। বল বলেছেন: “….it is difficult to apply liberal democratic concepts to regimes whose dominant ideology is based on Marxist-Leninism. Socialists see the legal systems of liberal democracies and non-Marxist totalitarian or autocratic states as instruments of class rule, and argue that the main functions. of the courts in these systems are to legitimise and buttress the domination of the capitalist class.” বলশেভিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির আগে আদালতের অস্থায়ী ভূমিকার কথা বলা হয়। আদালতের এই অস্থায়ী ভূমিকা সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্যও নয়। আদালতের এই ভূমিকার উদ্দেশ্য হল শাসক দলের মাধ্যমে ব্যক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকে কার্যকরী করা। রাজনীতিক ক্রমবিকাশের এই পর্যায়ে বহুবিধ সমস্যা থাকে। ক্রমবিবর্তনের এই স্তরে সকল অপরাধেরই মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জে পরিণত হওয়ার প্রবণতা থাকে। তাছাড়া প্রতিটি অপরাধ প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার দুর্বলতা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। বল বলেছেন: “Moreover, the Russians have a wider range of crimes they cover such categories as ‘economic crimes’, certain of which can be punished with the death penalty.”
য়ুরোপের আইনব্যবস্থা:
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে আইনব্যবস্থা ও আদালতের ভূমিকা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ মার্কিন আইনবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কেবলমাত্র মতাদর্শগত পার্থক্যই এই মতপার্থক্যের মূল কারণ। আইনের পদ্ধতির ক্ষেত্রে পরস্পর-বিরোধী বিকাশের কারণেও এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। আইন-আদালতের ধারণার ক্ষেত্রে পূর্ব য়ুরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ মার্কিন ব্যবস্থার বৈসাদৃশ্য এবং য়ুরোপের অন্যান্য দেশের সাদৃশ্য প্রতীয়মান হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক নির্বিশেষে য়ুরোপের রাষ্ট্রসমূহের আইন-ব্যবস্থায় কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল: মামলা বিচারের আগে গৃহীত ব্যবস্থা, প্রতিশ্রুতিমূলক পদ্ধতি, সরকারী প্রসিকিউটরদের প্রাধান্য, বিচারপতিদের তদন্তকারীর ভূমিকা পালন, জুরি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। আইন ব্যবস্থার উপরিউক্ত য়ুরোপীয় পদ্ধতিগুলিকে বলা হয় তদন্তমূলক (“inquisitorial’)। অপরপক্ষে ব্রিটিশ-মার্কিন আইনব্যবস্থার পদ্ধতিকে বলা হয় অভিযোক্তামূলক (‘accusatorial’)। ‘আইনের অনুশাসন (the rule of law) সম্পর্কিত ধারণার ক্ষেত্রে এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। ব্রিটিশ মার্কিন উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই ফসল হল আইনের অনুশাসনের ধারণা। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেছেন: “This is not simply that there are not important differences between the legal systems of socialist and liberal democratic regimes, but merely that departures from the Anglo-American legal pattern do not necessary indicate the absence of legal concepts regarded as important in liberal democratic systems.”
মতাদর্শের ভিত্তিতে আইনব্যবস্থার শ্রেণী-বিভাজন সম্ভব নয়:
পশ্চিম জার্মানীর রাজনীতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণের স্বার্থে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতান্ত্রিক আদালত’ (Federal Constitutional Court) ভূমিকা পালন করতে দ্বিধা করেনি। অর্থাৎ এই আদালতের ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল না। আদালত এ ক্ষেত্রে প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য রায় দিয়েছেন। আদালতের এই ভূমিকা রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। অ্যালান বল বলেছেন: “The court under the provisions of this article [Article 21 (2) of the 1949 Basic Law], accordingly declared a neo-Nazi party illegal in 1952 and outlawed the German Communist Party in 1956.” সুতরাং সমাজতান্ত্রিক, উদারনীতিক, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক প্রভৃতি সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই আইনব্যবস্থা রাজনীতিক মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়। পশ্চিম জার্মানীর বিচার-বিভাগের ভূমিকা থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও আইনব্যবস্থা রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। এই কারণে অ্যালান বলের অভিমত হল যে, কেবলমাত্র মতাদর্শগত ভিত্তিতে বিভিন্ন আইনব্যবস্থার মধ্যে শ্রেণীবিভাজন করা কঠিন। তিনি বলেছেন: “The West German Federal Constitutional Court provides an illustration of some of the difficulties of attempting to ideologically classify different legal systems.”
Leave a comment