অস্টিন আইনের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে ‘আইন হল সার্বভৌমের আদেশ’। এই সংজ্ঞা অনুসারে সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষই হল আইনের একমাত্র উৎস। কিন্তু কার্যত রাষ্ট্রের মত আইনও ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। আইনের বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, সার্বভৌমের আদেশই আইনের একমাত্র উৎস নয়। মানবসভ্যতার আদিম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নানা সূত্র থেকে আইনের সৃষ্টি হয়েছে। ঐতিহাসিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের নানা উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়। বিশিষ্ট আইন্বিদ হল্যান্ড বলেছেন: “The sources of law are custom religion, judicial decisions, scientific discussions, equity and legislation.” হল্যান্ড ও উইল্সনকে অনুসরণ করে আইনের নিম্নলিখিত উৎসগুলির কথা বলা হয়।
(১) প্রথা: সমাজে বহুদিন ধরে প্রচলিত আচার-আচরণ, রীতিনীতি এবং লোকাচারকেই প্রথা বলে। এই প্রথাই হল আইনের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন উৎস। হল্যান্ড-এর মতানুসারে কোন এক সময়ে কোন ব্যক্তি কোন উদ্দেশ্য বা আকস্মিকভাবে বিশেষ রীতি সমাজে প্রবর্তন করে। কালক্রমে অন্য সকলে তা মেনে চলে। এইভাবে প্রথার সৃষ্টি হয়। উদাহরণ হিসাবে তিনি মাঠের ভিতর দিয়ে পায়ে চলার পথের উল্লেখ করেছেন। প্রাচীনকালে আদিম সমাজব্যবস্থায় মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রথাগত বিধিবিধানের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। আইন ছিল মূলত প্রথামূলক। বর্তমানকালেও প্রত্যেক দেশের আইনব্যবস্থায় প্রথাগত বিধানের গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশ বিধানই প্রথাভিত্তিক। আর ভারতের হিন্দু ও মুসলমান আইন প্রধানত প্রথাগত। কিন্তু তত্ত্বগত বিচারে প্রথাকে আইন হিসাবে গণ্য করা যায় না। তবে দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত প্রথার উপযোগিতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র এদের আইন হিসাবে স্বীকৃতি জানায়। ব্রিটেনের মত অনেক দেশেই এমন কিছু আইন প্রচলিত আছে যা আইনসভা গঠিত হওয়ার আগে থেকেই দেশে প্রচলিত ছিল। এই সমস্ত আইনের পিছনে জনগণের ব্যাপক সমর্থন বর্তমান থাকে। এই কারণে কোন আইনসভাই এই সমস্ত প্রথাভিত্তিক আইনকে বাতিল করতে পারে না। রাষ্ট্র আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রথাগুলিকে যুগোপযোগী করবার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করে আইন হিসাবে অনুমোদন করে।
(২) ধর্ম: ধর্মও আইনের এক প্রাচীন উৎস। মানব সভ্যতার ঊষালগ্নেই ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। আদিম সমাজে ধর্মের সঙ্গে প্রথা ও আচার-পদ্ধতি সংযুক্ত ছিল। সমকালীন সমাজের ধর্মবিশ্বাস ও রীতিনীতি সামাজিক জীবনধারাকে কার্যকরভাবে প্রভাবিত করত। এই কারণে আদিম সমাজের আইন ও প্রথাসমূহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। সমাজের প্রাচীন বিধিনিষেধ ধর্মের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। প্রাচীনকালে ধর্মীয় বিধান ভঙ্গ শুধু নীতিবিরুদ্ধই ছিল না, দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য হত। আদিম যুগে অসভ্য মানুষের উদ্ধত আচরণের উপর ধর্মীয় অনুশাসনগুলি ছিল একমাত্র নিয়ন্ত্রণ। ধর্মের নির্দেশ মেনে চলা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের অধিকাংশ আইনই হল ধর্মভিত্তিক। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুশাসন কালক্রমে রাষ্ট্রীয় আইন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। হিন্দু ও মুসলমানদের বিবাহ, সামাজিক সম্পর্ক, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে আইন হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মশাস্ত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। হিন্দু আইনের উপর মনুসংহিতার এবং মুসলমান আইনের উপর কোরানের প্রভাব সর্বজনবিদিত। আজকের আধুনিক সমাজব্যবস্থায়ও ধর্মীয় আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বড় একটা কমে যায়নি। আধুনিক আইনব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই বর্তমান। বিভিন্ন বিষয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে এখনকার আইনব্যবস্থায় অনেক কিছুই বিকশিত হয়েছে।
(৩) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত: আগেকার দিনের সমাজব্যবস্থায় গোষ্ঠীপতি, জ্ঞানী গুণী ও বর্ষীয়ান ব্যক্তিরাই সমাজের দ্বন্দ্ব-বিবাদের মীমাংসা করতেন। পরবর্তী কালে রাজা বা দলপতির উপর বিচারের দায়িত্ব এসে পড়লো। প্রথা ও ধর্মের অসম্পূর্ণতার কারণে রাজা বা দলপতি অনেক সময়ে আপন বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা করতেন। ভবিষ্যতে এই সমস্ত বিচারের রায় আইন হিসাবে গণ্য হত। এখনও অনেক সময় এইভাবে বিচারের রায় আইন সৃষ্টি করে। বিচারকগণ কেবল আইন প্রয়োগ করেন না, আইন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেন। এর ফলে আইনের অর্থ স্পষ্ট হয়, অস্পষ্টতা দূরীভূত হয়। তা ছাড়া, বিচারকগণের বিশ্লেষণের দ্বারাই স্থিতিশীল আইন গতিশীল সমাজব্যবস্থার প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে। পরবর্তী সময়েও বিচারকগণের ঐ ব্যাখ্যা অনুরূপ মোকদ্দমার মীমাংসার ক্ষেত্রে নজির হিসাবে গণ্য হয়। এই সকল নজিরকে বিচারক-সৃষ্ট আইন (Judge-made law) বলে। বিচারপতি হোমসের মতানুসারে বিচারকগণ আইন প্রণয়ন করেন এবং এ হল তাঁদের এক আবশ্যিক কর্তব্য।
(৪) ন্যায়বিচার: বিচারকগণের দায়িত্ব ন্যায়বিচার সম্পাদনা করা। কিন্তু দেশে প্রচলিত আইনের সাহায্যে এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিচারপতিগণ ব্যক্তিগত ন্যায়নীতির ধারণার ভিত্তিতে বিরোধের মীমাংসা করেন। আইনের সুস্পষ্ট নির্দেশের অনুপস্থিতিতে ন্যায়বিচার আইনের অসম্পূর্ণতা দূর করতে সাহায্য করে থাকে। হেনরী মেইন ‘Equity’-র সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: “…anybody of rules existing by the side of the original civil law, founded on distinct principles and claiming incidentally to supersede the civil law in virtue of a superior sanctity inherent in those principles.” স্যামন্ড বলেছেন: “Equity implies natural justice as opposed to the rigid principles of law.” ফলে প্রয়োজনের তাগিদে আইনের রূপ বদলায়, আবার নতুন আইনেরও সৃষ্টি হয়। ন্যায়বিচারের দ্বারা সৃষ্ট আইনও একপ্রকার বিচারক সৃষ্ট আইন। তবে উভয় ক্ষেত্রে বিচারপদ্ধতির পার্থক্য বর্তমান। বিচারক প্রথম ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর ন্যায়বোধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিচারকার্য সম্পাদন করেন। এ ভাবেও বিচারক নতুন আইন সৃষ্টি করেন। বিচারপতিরা ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে প্রচলিত আইনের অসম্পূর্ণতা দূর করেন এবং দেশের আইনব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে তাকে সম্প্রসারিত করেন। আবার পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতিরা ন্যায়বিচারের মাধ্যমে নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেন। প্রাচীনকালের রোমের প্রেটরগণ (Preators) প্রায়ই দায়িত্ব নেওয়ার পর ন্যায়বিচারের মাধ্যমে নতুন আইন প্রবর্তন করতেন। আর ইংল্যাণ্ডে অতীতকাল থেকে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে আইন কার্যকর হয়ে আসছে।
(৫) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা: প্রত্যেক দেশেই আইন শাস্ত্রে কিছু সংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তি থাকেন। এই সকল বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকাদিতে স্থান পায়। আইন সম্পর্কিত এই সমস্ত বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আলোচনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আইনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উৎস হিসাবে গণ্য হয়। আইনশাস্ত্রের পণ্ডিত লেখকগণ অতীত আইন, আনুষঙ্গিক রীতিনীতি ও আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ পর্যালোচনা করে আইনের মূল নীতি সম্পর্কে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত লিপিবদ্ধ করেন। এই সমস্ত বিদগ্ধ ব্যক্তিদের ভাষ্যের ভিত্তিতে নতুন আইনব্যবস্থা বিকশিত হয়। আইনের এই বিশেষজ্ঞ ভাষ্যকারদের বিচক্ষণতা ও পাণ্ডিত্যের প্রতি আইনবিদ ও সাধারণ মানুষের প্রভূত শ্রদ্ধা থাকে। এই কারণে আইন সম্পর্কিত তাঁদের ব্যাখ্যা উঁচুমানের এবং গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। বিচারপতিগণ এগুলিকে শ্রদ্ধাসহকারে বিবেচনা করেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টোরি ও কেন্ট; ইংল্যাণ্ডের ব্ল্যাকস্টোন, কোক্ (Coke), হেল্ প্রমুখ পণ্ডিতের ভাষ্য উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন ভারতের মিতাক্ষরা, দায়ভাগ ও হেদায়ার প্রণেতাদের আইন সম্পর্কিত ভাষ্য, আইনের প্রামাণ্য ব্যাখ্যা হিসাবে বিবেচিত হয়। ভারতের রাসবিহারী ঘোষের ‘বন্ধকী সম্পত্তি বিষয়ক পুস্তক এবং গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘স্ত্রী ধন’ সম্পর্কিত পুস্তক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন মামলার বিচারের সময় সিদ্ধান্তমূলক প্রভাব বিস্তার করে।
(৬) আইন প্রণয়ন: বর্তমান যুগে আইন হল আইনের সর্বপ্রধান উৎস। গিলক্রিস্ট বলেছেন: “It is chief source of law and is tending to supplant the other sources.” দেশের আইনসভা বিধিনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে জনমত অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে। জনকল্যাণমূলক তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট রাষ্ট্রে সরকারের কর্মক্ষেত্রের পরিধি যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়েছে। এই বিপুল দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন হয় অসংখ্য আইনের। আইন পরিষদই এই সমস্ত আইন সৃষ্টি করে। জনগণের প্রতিনিধিপুষ্ট আইনসভা যে আইন প্রণয়ন করে তা জনমতেরই বিধিবদ্ধ রূপ।
উৎসগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব: আইনের বিভিন্ন উৎসগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে উইলসনের মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে প্রথা হল আইনের সর্বপ্রাচীন উৎস এবং ধর্মও একই সময়ে প্রথাগুলির সঙ্গে একযোগে আইন সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। তারপর বিবর্তনের ধারায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আইনের উৎস হিসাবে বিচারকের রায় ও ন্যায় বিচারের ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়েছে। আবার রাষ্ট্রশাসনের পদ্ধতির যথেষ্ট উন্নতি লাভের পর আইন প্রণয়ন এবং আইন সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক আলোচনা আইনের উৎস হিসাবে কার্যকর হয়েছে।
Leave a comment