শাস্তির ভয় বা অরাজকতার আশংকায় আইন মান্য করা হয় একটি মত : দেশ-কাল নির্বিশেষে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ নির্দ্বিধায় আইন মান্য করে চলে। প্রাচীনকালে আইনের ধারণা ছিল ধর্মগত। আইনকে ঐশ্বরিক বিধান হিসাবে মান্য করা হত। কিন্তু বর্তমান যুগে আইনের অনুমোদনের ভিত্তি হিসাবে ঐশ্বরিক বিধানের যুক্তি অচল। এ বিষয়ে বর্তমানে দু’ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। হস, বেহাম, অস্টিন প্রভৃতি মনে করে যে, আইন হল সার্বভৌমের আদেশ; আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন বর্তমান। এই সার্বভৌম শক্তির ভয়ে লোকে আইন মান্য করে চলে। হবস বলেছেন যে, সার্বভৌম শক্তিকে অগ্রাহ্য করলে সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। সুতরাং এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত হল, শাস্তির ভয় বা অরাজকতার আশংকায় মানুষ আইনের প্রতি অনুগত থাকে।

উপযোগিতার উপলব্ধি আইন মান্য করার কারণ-দ্বিতীয় মত : কিন্তু রুশো ও তাঁর সমর্থক আদর্শবাদিগণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে আইন হল সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রকাশ। সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে সর্বসাধারণের কল্যাণ নিহিত আছে। সুতরাং আইন সাধারণের কল্যাণ সাধন করে। আইনের এই কল্যাণকর ভূমিকার উপলব্ধি বা উপযোগিতার স্বীকৃতি আইনের অনুমোদন হিসাবে কাজ করে। ল্যাস্কির মতানুসারে আইনের অনুমোদন জনসাধারণের সম্মতির উপর নির্ভরশীল। জনসাধারণের সম্মতি বা ইচ্ছাই হল আইনের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতার ভিত্তি। তাঁর মতে আইনের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য তখনই দাবি করা যায় যখন আইন নিরপেক্ষভাবে সাধারণের স্বার্থের অনুকূল হয়। গ্রীণের অভিমত হল, ‘জনগণের সম্মতিই রাষ্ট্রের ভিত্তি, পশুশক্তি নয়’ (“Will, not force, is the basis of the state.”)। লর্ড ব্রাইস প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ‘অন্যান্য লোকে আইন মান্য করে চলে’ এই ধারণার প্রভাবেই লোকে সাধারণত আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। অর্থাৎ অনুকরণপ্রিয়তাই হল আইনের অনুমোদনের ভিত্তি।

উভয় মতের সমন্বয়: হেনরি মেইন প্রমুখ ঐতিহাসিক আইনানুগদের মতবাদই এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। মেইন প্রকৃতপক্ষে হস ও রুশোর অনুপন্থীদের মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তাঁর মতে আইনের অনুমোদন জনগণের সম্মতি এবং সার্বভৌম শক্তি উভয়ের উপরেই নির্ভরশীল। সার্বভৌম শক্তির ভয় বা আইনগত বাধ্যবাধকতা আইন মান্য করার একটি কারণ, একমাত্র কারণ নয়। জনমতই আইনের পিছনে শক্তিশালী অনুমোদন যোগায়। আইন যদি জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার অনুবর্তী হয় তা হলে জনমত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। জনগণের আনুগত্য আদায়ের জন্য রাষ্ট্রকে শক্তি প্রয়োগ করতে হয় না। জনমতের অনুগামী আইন মানবসমাজে সহজেই প্রযুক্ত হয় এবং স্বীকৃতি লাভ করে। বস্তুত জনমতই হল আইন অনুমোদনের প্রধান শক্তি। ম্যাকাইভারের মতে, জনগণের ইচ্ছা বা সম্মতি আইনের অনুমোদনের ভিত্তি হলেও, আইন বাধ্যতামূলকভাবে পালিত হয়। তিনি বলেছেন: “The root of obedience to law is not coercion but the will to obey; nevertheless law takes the form of an imperative.” বার্কারের মতে, ‘আদর্শ আইনের মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য উভয়েরই সমন্বয় ঘটা উচিত’ (“Ideally law ought to have both validity and value. “)। আইন মান্য করার একটি কারণ আইনগত বাধ্যবাধকতা (legal validity)। কিন্তু এর বড় কারণ হল আইনের একটি নৈতিক মূল্য (Value) আছে।

ব্রাইসের মত এবং মার্কসবাদীদের মত: লর্ড ব্রাইসের মতানুসারে নির্লিপ্ততা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, শাস্তির ভয় এবং যৌক্তিকতার উপলব্ধি থেকেই আইনের প্রতি মানুষ আনুগত্য প্রদর্শন করে। অর্থাৎ ব্রাইস আইন “মান্য করার পাঁচটি কারণ নির্দেশ করেছেন। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে ধনবৈষম্যমূলক সমাজে আইন আর্থনীতিক বিচারে প্রভৃত্বকারী শ্রেণীর স্বার্থ ও ইচ্ছার প্রকাশ মাত্র। এই আইনের পিছনে থাকে সেই প্রভুত্বকারী শ্রেণীর বলপ্রয়োগের যন্ত্র। অর্থাৎ পুলিশ বাহিনী, সৈন্যবাহিনী, আদালত প্রভৃতি। সমাজের আর্থনীতিক দিক থেকে এই প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী দরকারমত বলপ্রয়োগ করে। তার ফলে জনসাধারণ আইন মান্য করতে বাধ্য হয়।