রাষ্ট্র হল একটি তত্ত্বগত ধারণা। এর কোন বাস্তব রূপ নেই। রাষ্ট্রের রূপকার হল সরকার। সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত হয় ও বাস্তবে কার্যকর হয়।

দ্বি-ক্ষমতার তত্ত্ব:

সরকারের কাজকর্ম ও বিভাগ সম্পর্কে একটি তত্ত্ব হল ‘দ্বি-ক্ষমতার তত্ত্ব। এই তত্ত্বের দু’জন প্রধান বক্তা হলেন ফরাসী আইনবিদ গুডনাউ (Goodnow) এবং জেঙ্কস (Jenks)। এই তত্ত্ব অনুসারে সরকারের মূল কাজ দু’টি। একটি হল রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে প্রকাশ করা এবং অপরটি হল সেই ইচ্ছাকে কার্যকর করা। প্রথম কাজটি আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত এবং দ্বিতীয় কাজটি শাসন সংক্রান্ত। এই তত্ত্ব অনুসারে ন্যায় বিচারের কাজ শাসন সংক্রান্ত কাজের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এই তত্ত্ব অনুসারে সরকারের বিভাগ হল দু’টি: 

এই বিচার-বিভাগ শাসন-বিভাগেরই অন্তর্ভুক্ত।

সরকারের ত্রিভাগীয় নীতি:

গ্রীক্ পণ্ডিত অ্যারিস্টটলের আমল থেকেই সরকারের ত্রি-ভাগীয় নীতি চলে আসছে। অ্যারিস্টটল সরকারের কার্যাবলীকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। সিদ্ধান্তমূলক, শাসনসংক্রান্ত এবং বিচারসংক্রান্ত। এই তিন ধরনের কার্য সম্পাদনের জন্য সরকারের তিন প্রকার ক্ষমতাও আছে। এগুলি হল আইন-বিষয়ক, শাসন-বিষয়ক ও বিচার-বিষয়ক ক্ষমতা। ল্যাস্কি বলেছেন: “Since the time of Aristotle it has been generally agreed that political power is divided into three broad categories. There is, first, the legislative power. There is secondly, the executive power. There is thirdly the judicial power.” এই তিন ধরনের ক্ষমতার ভিত্তিতে সরকারী কার্য সম্পাদনকারী বিভাগগুলিকেও তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। এই তিনটি বিভাগ হল: 

  • (১) ব্যবস্থা-বিভাগ বা আইন-বিভাগ (The Legislature), 

  • (২) শাসন-বিভাগ (The Executive) এবং 

  • (৩) বিচার বিভাগ (The Judiciary)।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে আইনসভার আলোচনা অনুচিত:

সাধারণত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। এবং এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভাগসমূহের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন সম্পর্কিত ধারণাকে বিন্যস্ত করা হয়। কিন্তু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি নানা দিক থেকে ত্রুটিযুক্ত। এই নীতিটির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কোন বিভাগেরই চেহারা-চরিত্র যথাযথভাবে অনুধাবন করা যাবে না। সরকারের কোন বিভাগেরই আকৃতি-প্রকৃতিকে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে স্বাধীনভাবে আলোচনা করা যায় না। এতদসত্ত্বেও এই নীতির প্রভাব এবং সীমাবদ্ধ প্রয়োগ সম্পর্কে দ্বি-মতের অবকাশ নেই। তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ আছে। বলের মতানুসারে নীতিটিকে যদি অত্যন্ত কঠোরভাবে ব্যাখ্যা করা হয় বা সার্বজনীনভাবে প্রয়োগ করা হয়, তা হলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশংকা আছে। বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The emphasis on the doctrine of the separation of powers in the liberal democracies provides a useful guide to the distribution of legislative and executive powers, but interpreted to rigidly and applied universally, it leads to misconception rather than enlightenment.”

রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিচ্ছিন্নতার জন্য আইনসভার ভূমিকা বিভিন্ন রকমের হয়:

আইনসভার আলোচনাকে দেশের প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করা উচিত নয়। সরকারের তিনটি বিভাগই হল দেশের প্রচলিত রাজনীতিক প্রক্রিয়ার অন্যতম অংশ। যে কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী একটি সুবিন্যস্ত ও সুসংহত কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। এই কারণে রাজনীতিক ব্যবস্থা যে সমস্ত কাঠামোর মাধ্যমে তার উদ্দেশ্যকে কার্যকর করার চেষ্টা করে সেই সমস্ত কাঠামোর আলোচনা ও মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। এই আলোচনা ও মূল্যায়ন রাজনীতিক ব্যবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের জন্যও একান্তভাবে দরকার। বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত কাঠামোগুলির ক্ষমতা ও কার্যাবলীর পরিধি ও প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আবার এই সমস্ত কাঠামোর পারস্পরিক সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়া (interaction) বিভিন্ন ধরনের হয়। বস্তুত প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির দ্বারাই এগুলি নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত হয়। আইনসভার ক্ষমতা বা এক্তিয়ারের উপর প্রচলিত রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সামগ্রিক প্রভাব অনস্বীকার্য। কারণ আইনসভা হল প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থারই অন্যতম অঙ্গ। বল বলেছেন: “There has been exhaustive accumulation of detail on procedural matters, but less consid Meration of the wider relationship with the total political system.” পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থা বা রাজনীতিক প্রক্রিয়া বিভিন্ন প্রকারের। এই কারণে বিভিন্ন দেশের আইনসভার ভূমিকাও বিভিন্ন ধরনের হয়।

রাজনীতিক ব্যবস্থা ও আইনসভা:

যাইহোক সকল রাজনীতিক ব্যবস্থার স্বীকৃত কার্যাবলী মোটামুটিভাবে ত্রিবিধ। এগুলি হল: আইন প্রণয়ন, আইনের প্রয়োগ ও বিচার সম্পাদন। এই ত্রিবিধ কার্য সম্পাদন করে আইন-বিভাগ, শাসন-বিভাগ ও বিচার-বিভাগ। সরকারের এই বিভাগগুলি হল রাজনীতিক ব্যবস্থার কাঠামো। এই সমস্ত কাঠামোর আকৃতি-প্রকৃতি প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের উপর নির্ভরশীল। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The level of socio economic development and the importance of regional difference are significant for the functioning of national assembly.”

আইন-বিভাগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ:

সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, আইন-বিভাগ আইন প্রণয়ন করে, শাসন-বিভাগ এই আইনকে প্রয়োগ করে এবং বিচার-বিভাগ আইনানুসারে বিচার কার্য সম্পাদন করে। সরকারের বিভাগ তিনটির মধ্যে আইন-বিভাগকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। এর কারণ হল আইন বিভাগের আইন প্রণয়নের উপর অপর দুটি বিভাগের কাজকর্ম নির্ভরশীল। অতএব অপর দুই বিভাগের কাজকর্ম আইন-বিভাগের উপর নির্ভরশীল। আইন-বিভাগ আইন প্রণয়ন না করলে অপর দুই বিভাগের করণীয় কিছু থাকে না। তাই আইন-বিভাগের কাজ শাসন-বিভাগের কার্যের পূর্ববর্তী পর্যায়ের। আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারের কাজকর্ম নির্ধারণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইন-বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইন-বিভাগকে অপর দুই বিভাগ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। আধুনিককালে আইন-বিভাগের প্রাধান্যের কারণ হল এর গঠনতন্ত্র। জনসাধারণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বর্তমান আইন-বিভাগ গঠিত হয়।

বলের মত মতানুসারে আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত কাজকর্ম:

এ প্রসঙ্গে বল ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতানুসারে আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত কাজকর্ম সরকারের অন্যান্য কাজকর্মের পূর্ববর্তী নয়। আবার আইন প্রণয়ন ছাড়াও সরকারের অন্যান্য অনেক কাজ আছে। রাজনীতিক দিক থেকে বিচার করলে আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত কাজকর্মের তুলনায় আইনসভার অন্যান্য কাজকর্ম কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “Legislative functions were neither historically anterior to nor are they more politically important than other functions of modern assemblies.”

আগে কিন্তু আইন প্রণয়নের ব্যাপারটা এ রকম ছিল না। প্রাচীনকালে রাজা স্বয়ং আইন প্রণয়ন করতেন বা তাঁর দ্বারা নিযুক্ত কর্মচারীরা এই দায়িত্ব সম্পাদন করতেন। আগেকার দিনের আইন ছিল মূলত প্রথাভিত্তিক। লিখিত বা বিধিবদ্ধ আইনের সৃষ্টি হয়েছে অনেক পরে। আবার সরকারের আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসাবে আইনসভার সৃষ্টি হয়েছে আরও পরে।

আইনসভার ভূমিকার বিবর্তন ঘটেছে:

আগে আইনসভার আইন প্রণয়নমূলক কার্যাবলীর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হত। এই কারণে আইনসভার আলোচনা মূলত পদ্ধতিগত খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। এইভাবে দীর্ঘকাল ধরে আইনসভার আলোচনায় সাংবিধানিক আইনের প্রাধান্য ছিল অবিসংবাদিত। প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে আইনসভার সম্পর্ক বা পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হত না। বলের মতানুসারে ঐতিহাসিক বিচারে আইনসভার উদ্ভব হয়েছে শাসন বিভাগের উপদেষ্টা হিসাবে। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “… historically assemblies have emerged from the executive’s need for advisory bodies, a need which in the example of the British Parliament later provided a means of limiting the power of the executive.”

রাজনীতিক ব্যবস্থার পার্থক্য অনুসারে আইনসভার ভূমিকা বিভিন্ন হয়:

গার্নারের মতানুসারে যে সমস্ত বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অভিপ্রায় ব্যক্ত ও বলবৎ হয় তাদের মধ্যে আইন-বিভাগের স্থান সবার উপরে। সকল দেশে এবং সকল রকম সরকারে আইনসভার ভূমিকা এক রকম হয় না। আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী সরকারের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতিগত পার্থক্য অনুসারে আইনসভার কার্যাবলীর মধ্যে বিভিন্নতা দেখা যায়। একনায়কতন্ত্রে বা অসীম রাজতন্ত্রে আইনসভার ভূমিকা নেহাতই নগণ্য। মুসোলিনীর মতে, “পার্লামেন্ট হল একটি ক্রীড়নক মাত্র”। তিনি (Benito Mussolini): “Parliament is a plaything, but a plaything that people like to have.” আবার আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের কর্তৃত্বই প্রতিষ্ঠিত হয়; আইন-বিভাগ শাসন বিভাগেরই উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে। আবার অনুরূপ সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেও আইনসভার ক্ষমতা, কার্যাবলী ও মর্যাদার পার্থক্য থাকতে পারে। যেমন, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সুপ্রীম সোভিয়েতের কক্ষ দু’টি সমান ক্ষমতা ও মর্যাদাযুক্ত ছিল। কিন্তু ব্যাপক ও চরম কর্তৃত্বসম্পন্ন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সুপ্রীম সোভিয়েতের গুরুত্বকে ক্ষুণ্ণ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ভারতের আইনসভাও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। কিন্তু মার্কিন আইনসভা ‘কংগ্রেসে’র উচ্চকক্ষ ‘সিনেট’ (Senate) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ‘লর্ডসভা’ বা ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা’র তুলনায় অধিক ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী।

সরকারের কাঠামোগুলির মধ্যে আইনসভার কার্যাবলী অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইন-বিভাগ সরকারের অপর দুই বিভাগ অপেক্ষা অধিক ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। বিশেষত পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকাই মুখ্য এবং বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আইনসভার মাধ্যমেই রাজনীতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে প্রাথমিকভাবে বৈধকরণের ব্যবস্থা করা হয়। ব্রিটেন ও ভারতের ন্যায় পার্লামেন্টীয় সরকারে আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার ব্রিটেন বা ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় তত্ত্বগত বিচারে আইনসভা ব্যাপক ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী হলেও কার্যক্ষেত্রে ক্যাবিনেটের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতিভেদে এবং তত্ত্বগত ও বাস্তব অবস্থার পার্থক্য বিচারে আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী বিচার-বিশ্লেষণ করা বাঞ্ছনীয়।

আইনসভার ভূমিকা ও মর্যাদা

বর্তমানে আইনসভার প্রকৃত ভূমিকা ও মর্যাদা সম্পর্কে যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কতকগুলি বিষয় বিবেচনা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(১) রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যাপক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার ভূমিকার সামগ্রিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা আগে ছিল না। বরাবরই আইনানুগ দৃষ্টিকোণ থেকে আইনসভার ক্ষমতা, কার্যাবলী ও কার্যপদ্ধতির পর্যালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কেবলমাত্র আইনানুগ কাঠামোর সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে আইনসভার যাবতীয় কাজকর্মের সামগ্রিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। কারণ আইনানুগ দায়-দায়িত্বের বাইরেও আধুনিক আইনসভার কাজকর্মের পরিধি সম্প্রসারিত।

(২) বর্তমানে আইনসভা রাজনীতিক অগ্রগতি ও আধুনিকীকরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আধুনিক পরিবেশ হল বিশেষভাবে গতিশীল। এই পরিবেশের একটি বিশেষ দিক হল রাজনীতিক ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ ও অগ্রগতি। এবং এই প্রক্রিয়ার অন্যতম সংগঠিত মাধ্যম হল আইনসভা। রাজনীতিক জীবনের বিকাশ ও তার বহুমুখী প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার ভূমিকা পরিবর্তিত ও গতিশীল হয়েছে।

(৩) আইনসভার কাঠামো, কার্যপদ্ধতি ও কার্যাবলীর বিন্যাস রাজনীতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির সঙ্গে কার্য-কারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী সকল রাজনীতিক ব্যবস্থায় একই রকম হয় না।

(৪) আইনসভার ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়নের স্বার্থে তার তাত্ত্বিক ও বাস্তব মর্যাদার বিবেচনা করা দরকার। কোন দেশের আইনসভা তাত্ত্বিক বিচারে প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও বাস্তবে তা সত্য নাও হতে পারে। কারণ সাংবিধানিক কাঠামোর তাত্ত্বিক বিচারে আইনসভার ক্ষমতা ও ভূমিকা যা প্রতিপন্ন হয়, অনেক সময় বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তা অসঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, তত্ত্বগত বিচারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাতে মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ন্যস্ত আছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট মন্ত্রিসভাই পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে।

(৫) আবার আইনসভার প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বের স্বরূপ সম্পর্কেও বিচার-বিবেচনা করা দরকার। সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের নীতি অনুসৃত হওয়া সত্ত্বেও দেশের একটি বিশেষ শ্ৰেণী বা গোষ্ঠী আইনসভার সদস্যপদের উপর একাধিপত্য কায়েম করতে পারে। 

(৬) কোন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আইনসভা সংযুক্ত থাকে, আবার কোথাও তা থাকে না। যেমন, সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসন-বিভাগের সঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসের ভূমিকার গুরুত্ব স্বীকৃত। কিন্তু ব্রিটিশ রাজনীতিক ব্যবস্থায় সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূল কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে শাসন-বিভাগ। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ভূমিকা গুরুত্বহীন।

(৭) আইনসভার কার্যাবলীর বিভিন্নতার নির্ধারক হিসাবে বল কোন বিশেষ রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিকাশের মান ও মাত্রা, রাজনীতিক সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক বিকাশের ব্যাপকতা ও মাত্রা প্রভৃতির কথা বলেছেন।

(৮) আবার কোন দেশের যদি ব্যাপকভাবে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা পার্থক্য থাকে তা হলে আইনসভার সংগঠন ও ভূমিকার উপর তার প্রভাব পড়ে। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বা বৈষম্য থাকলে আইনসভার উপর তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া এক ধরনের হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে আঞ্চলিক বা সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের সংরক্ষণ, সদস্যদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও আঞ্চলিক মানসিকতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।