ভূমিকা: যে-কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের জন্য তার সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক কাঠামােসমূহের বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা করা জরুরি। আমাদের সবার আগে জানা প্রয়ােজন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কাঠামাে কী ধরনের এবং কতটুকু ক্ষমতা ভােগ করে থাকে? সরকারের বিভিন্ন কাঠামাের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন কাঠামাের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের এক্তিয়ার কতদূর বিস্তৃত সেই সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। প্রধানত সরকারের কার্যাবলি তিনটি কাঠামাের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। যথা

  • (১) শাসন বিভাগ,
  • (২) আইন বিভাগ এবং
  • (৩) বিচার বিভাগ।

আইনসভার কাঠামাে বিশ্লেষণ

সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা, কার্যাবলি এবং ভূমিকার নিরিখে আইনসভার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘আইনসভা শব্দটি প্রয়ােগের মাধ্যমেই আইনসভার আইন বিষয়ক কার্যাবলির উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে আইনসভা বলে কিছু ছিল না। প্রাচীন গ্রিস ও রােমে স্বাধীন মানুষ তখনকার দিনে আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন করলেও আইনসভা বা প্রতিনিধিত্বের ধারণা ছিল না। সর্বপ্রথম জার্মানির টিউটন জাতির মধ্যে আইনসভা সংক্রান্ত ধারণা গড়ে ওঠে। বর্তমানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে পৃথিবীর সকল দেশের আইনসভার জননী বলে উল্লেখ করা হয়। হােয়াইটেনাগেমট (Whitenagemot) হল পার্লামেন্টের প্রাচীন রূপ। ত্রয়ােদশ ও চতুর্দশ শতকে ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আইনসভার উদ্ভব হতে থাকে। ইংল্যান্ডে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের গৌরবময় বিপ্লবের পর আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে আইনসভার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতকে ইংল্যান্ডে আইনসভা লর্ডসভা ও কমন্সসভা নামে পরিচিতি লাভ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে আইনসভা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে এমন কোনাে দেশ নেই যেখানে কোনাে আইন বিভাগ বা আইনসভা নেই।

আইনসভার গতিশীল ভূমিকা: আধুনিক রাজনৈতিক পরিবেশে আইনসভা গতিশীল ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ এবং তার বিভিন্নমুখী প্রয়ােজনের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে আইনসভার ভূমিকার পরিবর্তন সাধিত হয়। আধুনিক যে-কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইন প্রণয়ন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে পরিগণিত হয়। আইনসভা এমনসব কার্যাবলি সম্পাদন করে, যা আইনানুগ কোনাে কাঠামাের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য এবং পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আইনসভার কাঠামাের বিন্যাস করা হয়। আইনসভার কাঠামােকে তার ক্ষমতা ও ভূমিকা এবং সাংবিধানিক, তাত্ত্বিক ও বাস্তবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্বের চরিত্রের প্রেক্ষাপটের নিরিখে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা উচিত। অধ্যাপক অ্যালান বল আইনসভার কাঠামােগত তারতম্যের কারণ হিসেবে কতকগুলি পরিবর্তনীয় (variable) উপাদানের উল্লেখ করেছেন। যেমন কোনাে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামাে, প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা, সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকাশ, আঞ্চলিক তারতম্য, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশের প্রকৃতিগত পার্থক্য ইত্যাদি। উপরােক্ত পরিবর্তনশীল উপাদান আইনসভার কাঠামাে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জা ব্লদেল তার ‘Comparative Government – A Reader’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মােট ১৬৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গেছে ১৪২টি রাষ্ট্রের আইনসভা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে এমন দেশে নির্বাচিত আইনসভা দেখা যায় না। আবার যেসব দেশে সামরিক শাসন রয়েছে সেইসব দেশে আগেকার নির্বাচিত আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

আইনসভার গঠন বা কাঠামো

সাংগঠনিক বিচারে আইনসভাকে সাধারণত দুটি ক্ষে ভাগ করা হয়েছে। যথা― (১) এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, (২) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা।

(১) এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা: একটি পরিষদ বা কক্ষ নিয়ে গঠিত যে আইনসভা তাকে বলা হয় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। বলাবাহুল্য, এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় কোন একক ব্যক্তির উপর শাসন বিভাগের চরম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় একটিমাত্র কক্ষের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইনসভার যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। যেমন চিনের আইনসভা (পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস) এককক্ষবিশিষ্ট। এ ছাড়াও গ্রিস, বাংলাদেশ, তুরস্ক, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট। বর্তমান বিশ্বে ১১২টি রাষ্ট্রের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যুক্তি দিয়েছেন। যেমন- বেন্থাম, আবেসিয়ে, ল্যাস্কি, ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখরা মনে করেন এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকা উচিত। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যেমন—লর্ড ব্রাইস, জন স্টুয়ার্ট মিল, লেকি, হেনরি মেইন, লর্ড অ্যাক্টন, গেটেল প্রমুখরা এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না।

(২) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: দুটি পরিষদ নিয়ে গঠিত আইনসভাই হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রথম কক্ষকে বলা হয় নিম্নকক্ষ। নিম্নকক্ষের সদস্যরা জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভােটের দ্বারা নির্বাচিত হন। একে জনপ্রিয় কক্ষ বলেও অভিহিত করা হয়। কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষের গঠনপদ্ধতি একটু আলাদা। যেমন— ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা কেবল অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। লর্ডসভার কোনাে সদস্যই নির্বাচিত হন না। আবার অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেট বলে পরিচিত। এই উচ্চকক্ষটি অঙ্গরাজ্যের ২ জন করে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গড়ে উঠেছে।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রথম চালু হয় ব্রিটেনে। তারপর বিভিন্ন দেশে তা সম্প্রসারিত হয়। ইংল্যান্ডে যেহেতু এই ধরনের আইনসভা প্রথম চালু হয়, তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে পৃথিবীর আইনসভার জননী (Mother of the Parliament) বলে অভিহিত করা হয়। ভারতের পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষের নাম হল – রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষের নাম হল― লোকসভা। এই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্য বৃন্দ পরােক্ষভাবে অথবা মনােনয়নের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞান তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। যারা আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হওয়া উচিত বলে মনে করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন লর্ড ব্রাইস, জন স্টুয়ার্ট মিল, লেকি, হেনরি মেইন, লর্ড অ্যাক্টন, গেটেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ। অপরদিকে যারা মনে করেন যে, আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হওয়া উচিত নয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন বেন্থাম, আবে সিয়ে, ল্যাস্কি, ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ।

উপসংহার: উপরােক্ত তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে সহজেই আসা যায় যে, এককক্ষবিশিষ্ট ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমর্থন ও অসমর্থন জানিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সাংগঠনিক বিচারে আইনসভার কাঠামাে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে দুটি কক্ষই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।