বলের মত: বলের মতানুসারে সাংবিধানিক কাঠামো, দলব্যবস্থার প্রকৃতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, সামাজিক ও আর্থনীতিক অগ্রগতির পার্থক্য, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের স্তরভেদ অনুসারে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইনসভার প্রকৃতি ও ভূমিকা স্থিরীকৃত হয়ে থাকে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বল আইনসভার কার্যাবলীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন:
- শাসন বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কার্যাবলী (functions in relations with the executive),
- আইন সংক্রান্ত কার্যাবলী _(legislative functions) এবং
- প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যাবলী (representative functions)।
প্রকৃত প্রস্তাবে বর্তমানে আইনসভা হল এমন এক কাঠামো যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুমুখী কাজকর্ম সম্পাদন করে। আধুনিক আইনসভার কার্যাবলী শুধুমাত্র আইন প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যাইহোক আধুনিক আইনসভার কার্যাবলীকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে।
(ক) শাসন-বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কার্যাবলী:
শাসন-বিভাগের সঙ্গে আইনসভার সম্পর্কের এলাকা এখন বিশেষভাবে প্রসারিত। আইনসভার অন্যতম দায়িত্ব হল শাসন-বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। তবে এই নিয়ন্ত্রণ শাসন-বিভাগের রাজনীতিক কর্তাব্যক্তিদের নিয়োগ ও অপসারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ক্ষমতা শাসন-বিভাগের নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তসমূহ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রসারিত। তা ছাড়া অনুসন্ধানমূলক এবং অর্থব্যয়ের অনুমোদন সম্পর্কিত কার্যাবলীও এর অন্তর্ভুক্ত।
(১) সরকার গঠন –
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকার গঠন: শাসন-বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আইনসভার কার্যাবলীর অন্যতম হল সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ। আইনসভার এই কাজটি সকল রকম সরকারী কাঠামোতে অভিন্ন নয়। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য আছে। সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আইনসভার কার্যাবলী এই দু’ধরনের সরকারী কাঠামোতে দু’ভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকে। সংসদীয় শাসনব্যস্থায় দু’ধরনের প্রধান দেখা যায় : সরকারের প্রধান (head of the government) এবং রাষ্ট্র প্রধান (head of the state)। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনসভার তেমন কোন ভূমিকা থাকে না। গ্রেট ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা বা রানী বংশানুক্রমিকভাবে ক্ষমতাসীন হন। ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতির পদ নির্বাচনমূলক। সরকারের প্রধান হলেন গ্রেট ব্রিটেন ও ভারতে প্রধানমন্ত্রী এবং জার্মানীতে চ্যান্সেলার। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সাধারণত আইনসভার জনপ্রিয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ভিতর থেকেই সরকার গঠিত হয়ে থাকে। এটাই হল সংসদীয় প্রথা বা রীতি। তবে ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধী দলের সদস্যদেরও সরকারে নেওয়া হয়। এ ধরনের কোয়ালিশন সরকার ব্যতিক্রম হিসাবে বিবেচিত হয়। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগের বিষয়টি সহজ-সরল। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে জানা যায় প্রধানমন্ত্রীর পদে কে আসীন হবেন? কারণ দু’টি দলের মধ্যে যে দলটি জনপ্রিয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতাই প্রধানমন্ত্রী হন। এবং সংশ্লিষ্ট দলের অন্যান্য বিশিষ্ট নেতারা মন্ত্রিসভার সদস্য হন। এবং এ বিষয়ে আগাম অনুমান করার অসুবিধা থাকে না। তবে বহুদলীয় ব্যবস্থায় এ ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। কোন দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে না পারলে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ রকম ক্ষেত্রে সরকার গঠন করার ব্যাপারে আইনসভার অসহায় অবস্থা প্রকট হয়ে পড়ে। সদস্য কেনা-বেচা, দলত্যাগ, রাজনীতিক দরকষাকষি এবং রাজনীতিক দলগুলির কর্মতৎপরতা রাজনীতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতার সৃষ্টি করে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বর্তমানে ব্রিটেনে কার্যকরী দ্বি-ব্যবস্থার অস্তিত্বের কারণে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও সরকার গঠনের বিষয়টি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয় না। তবে ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং সরকার গঠনের বিষয়টি আগের মত এখন আর তত সাবলীল নেই। বিগত দু-একটি নির্বাচনে কোন দলই এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে নি। তারফলে সাময়িক কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের সাংবিধানিক প্রধান হলেন আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতিকে অপসারণও করতে পারে। ব্রিটেনে রাজা বা রানী এবং ভারতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ব্যতিরেকে পার্লামেন্টে পাস হওয়া বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। আবার অর্থ বিল ও বাজেট পার্লামেন্টে পেশ করার জন্য এঁদের পূর্বানুমোদন লাগে। এঁরা পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করতে এবং অধিবেশন শেষ করতে পারেন। তা ছাড়া এঁরা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষকেও ভেঙ্গেও দিতে পারেন।
রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় সরকার গঠন: রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থাতেও শাসক-প্রধান নিয়োগের ব্যাপারে আইনসভার কিছু ভূমিকা থাকে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় শাসন-বিভাগের প্রধান প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। আর্জেন্টিনা বা ফিলিপিনে রাষ্ট্রপতিকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত করা হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। তবে এ ক্ষেত্রে মার্কিন আইনসভার কিছু ভূমিকা থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য নির্বাচক সংস্থার মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পেতে হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে কেউই যদি তা না পান, তাহলে প্রাপ্ত ভোটসংখ্যার ভিত্তিতে প্রথম তিনজন প্রার্থীর ভিতর থেকে প্রতিনিধি-সভা গোপন ভোটে একজনকে রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী উচ্চপদসমূহে যাবতীয় নিয়োগ সিনেটের অনুমোদনসাপেক্ষ। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও সিনেটের অনুমোদন লাগে। প্রথানুসারে সিনেট অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগগুলিকে অনুমোদন করে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে অনুমোদন প্রদানে অস্বীকারও করে। ফিলিপিনে কমিশনকে রাষ্ট্রপতির ক্যাবিনেট নিয়োগকারী আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Even in presidential systems the assembly shares in some aspects of appointing the executive; in Philippines, although the president is elected directly, his cabinet, in theory, must be approved by a commission responsible to both the Senate and the House of Representatives. The American Senate can veto certain ‘political’ appointments of the president, and although it cannot ‘defeat the president even in the theoretical terms of Parliamentary government, it may use the power to impeach a president.”
(২) সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ:
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভার জনপ্রিয় কক্ষে যে দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে সেই দলই মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন হয়। এই মন্ত্রিসভার কার্যকাল সংশ্লিষ্ট জনপ্রিয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। এই মন্ত্রিসভাকে আইনসভার জনপ্রিয় কক্ষের কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। এই দায়িত্বের প্রকৃতি দ্বিবিধ: ব্যক্তিগত এবং যৌথ। স্ব স্ব দপ্তরের কাজকর্ম পরিচালনার ব্যাপারে মন্ত্রীদের ব্যক্তিগতভাবে পার্লামেন্টের কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। আবার মন্ত্রিসভার যাবতীয় নীতি, সিদ্ধান্ত ও কাজকর্মের জন্য মন্ত্রিসভাকে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। এই দায়িত্বশীলতার অর্থ হল অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে আইনসভার জনপ্রিয় কক্ষ যে-কোন মন্ত্রী বা সমগ্র মন্ত্রিসভার পতন ঘটাতে পারে। মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আইনসভার জনপ্রিয় কক্ষের অনাস্থা জ্ঞাপনের অর্থ সংশ্লিষ্ট কক্ষে মন্ত্রিসভা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। আবার রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায়ও রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা অপসারণ করতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রপতির কার্যকাল হল চার বছর। মার্কিন কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির কার্যকালের এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে ইপিচ (Impeach) করতে পারে এবং ইম্পিচমেন্টের মাধ্যমে অপসারণ করতে পারে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দু’দশক ধরে ব্রিটিশ কমন্সসভা শাসন-বিভাগের ব্যাপক কর্তৃত্ব কায়েম করে। এই সময় ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার উপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বল বলেছেন: “The period of British political history 1845-267 provided an interesting example of what has been referred to as the golden age of the private members.” এই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি বিশেষভাবে প্রতিপন্ন হয়। এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি সুস্থ বৈশিষ্ট্য হিসাবে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়। এই সময় ব্রিটিশ সরকারের উপর কমন্সসভার কর্তৃত্বের কথা বলতে গিয়ে বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…in this period…the House of Commons could make’ and ‘unmake’ governments with frequent ease.” ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন ব্রিটিশ সরকারের স্নায়ুকেন্দ্র (centre of our system) হিসাবে কমন্সসভার কথা উল্লেখ করেছেন। এবং কমন্সসভার প্রাধান্যকে বলেছেন: “the cardinal axiom of the constitution.” আবার ফ্রান্সের বহুদলীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার আগে পর্যন্ত ফরাসী সরকারের অস্তিত্ব জাতীয় সভা (National Assembly)-র মর্জির উপর নির্ভরশীল ছিল। ফরাসি জাতীয় সভা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সময় মোট একুশ বার ক্ষমতাসীন সরকারকে অপসারিত করেছিল। প্রায় ঐ সময়েই ইতালিতে ক্ষমতাসীন সরকারগুলির গড় আয়ু ছিল ন’মাসের মতো।
দেশের শাসন-বিভাগের প্রধানকে নিযুক্ত ও পদচ্যুত করার ক্ষেত্রে আইনসভার ক্ষমতা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বলের মতানুসারে এ হল আইনসভার নেতিবাচক ক্ষমতা এবং এ ক্ষমতা মুখ্য ক্ষমতা নয়। শাসন বিভাগীয় নীতি ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “… power to influence executive policies is more important than the power to appoint and remove the political head of the state” নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা শাসন-বিভাগের হাতে ন্যস্ত আছে। কিন্তু এ বিষয়ে আইন-বিভাগ শাসন-বিভাগকে প্রভাবিত করতে পারে। শাসন-বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে আইনসভার হাতে ত্রিবিধ উপায় আছে। এই তিনটি উপায় হল : প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, বিতর্ক ও সমালোচনা। আইনসভা সরকারী কার্যাবলী সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, বিতর্ক এবং সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। আইনসভা বিকল্প নীতির প্রস্তাব পেশ করে। আইনসভার সমালোচনার চাপে শাসন-বিভাগকে গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বা পরিবর্তন করতে হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় এ ধরনের ঘটনা প্রায়শই ঘটে। বল বলেছেন: “Debates and questions may have some effect on the government and certainly serve to inform the government as to opinion in the assembly. Even in the most stable party-dominated assemblies they may set a chain of events in motion which leads to change of governmen …” আবার মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের কাছে দায়িত্বশীল নন। এতদ্সত্ত্বেও মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিকূল রাজনীতিক প্রতিক্রিয়াকে নিরসনের জন্য রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং অনুমোদন লাভের চেষ্টা করেন। বল বলেছেন: “The American President frequently consults Congressional leaders to secure support and prevent adverse criticism. In 1964 President Johnson obtained Congressional approval for his actions over the Gulf of Tonkin incident….” আবার সুইজারল্যাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা (Federal Assembly)-র হাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ (Federal Council)-কে অপসারণ করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু সরকারী নীতির পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে আইনসভার সমালোচনার কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। বল বলেছেন: “… in Switzerland the federal council cannot be forced to resign in this way, but à clash with the assembly does lead to a modification of government policy.”
(৩) অনুসন্ধানমূলক ক্ষমতা ও কার্যাবলী:
শাসন-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনসভার অনুসন্ধানমূলক ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলের মতানুসারে সরকারী কাজকর্মের উপর আইনসভার এই নিয়ন্ত্রণ হল: “break on the government motor”। তিনি বলেছেন: “Assemblies conduct investigations into government policies, and these serve to act as a break on the government motor.” মন্ত্রিসভা-শাসিত এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত, উভয় ধরনের শাসনব্যবস্থাতেই আইনসভার এই নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কার্যকরী। আইনসভা তার অনুসন্ধানমূলক ক্ষমতাকে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে কার্যকর করে। এই কমিটিগুলি হল তদন্তমূলক। এই সমস্ত কমিটির সভাপতি হিসাবে কাজ করেন বিরোধী দলের কোন নেতা। সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি প্রভৃতি বিষয়ে এই কমিটিগুলি তদন্তকার্য পরিচালনা করে। এই সমস্ত কমিটি অনুসন্ধান চালায়, কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। এদের কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। কিন্তু অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন আইনসভায় আলোচিত হয়। সরকারের নীতি ও ভূমিকা সম্পর্কে কমিটির বিরূপ মন্তব্য প্রতিকূল রাজনীতিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই কারণে সরকারকে সব সময় সংযত থাকতে হয়। মার্কিন কংগ্রেসের এই অনুসন্ধানমূলক ক্ষমতা অত্যন্ত ব্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারী ও সিয়া (CIA)-র কাজকর্ম সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অ্যালান বল বলেছেন: “Committees of investigation have been developed more thoroughly in the American Congress; the Senate Ervin Committee, investigating the Watergate affair, and the Senate Committee, chaired by Senator Church, investigating the activities of the CIA., are two examples of this investigative power.”
(৪) সরকারের আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ:
সরকারের আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনসভা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। সরকারের আর্থিক নীতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা অর্থবহ। সরকার কর্তৃক কর ধার্য, কর সংগ্রহ ও অর্থব্যয়ের ব্যাপারে আইনসভার নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বল বলেছেন: “Supply of money for government spending has been a traditional weapon in an assembly’s arsenal in seeking to exercise some control over government policies….” আইনসভার অনুমোদন ছাড়া সরকার কোন কর ধার্য করতে, করের হার পরিবর্তন করতে বা সংগৃহীত অর্থ ব্যয় করতে পারে না। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারী গণিতক কমিটি, আনুমানিক ব্যয় কমিটি এবং নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক এ ক্ষেত্রে আইনসভার পক্ষে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে। ব্রিটিশ সরকার কমন্সসভার সম্মতি ছাড়া আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও অর্থবিষয়ক কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের অর্থবিষয়ক ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া কোন কর ধার্য করতে বা সরকারী তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করতে পারে না। অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে মার্কিন সিনেটের ক্ষমতা অত্যন্ত ব্যাপক। মার্কিন রাষ্ট্রপতি অর্থ ছাড়া কোন সরকারী কার্য সম্পাদন করতে পারেন না। এবং মার্কিন কংগ্রেস এই অর্থ বিষয়ক ক্ষমতার বলে রাষ্ট্রপতির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। অ্যালান বল বলেছেন: “Again the United States Congress provides the extreme of this form of control and influence… Congress has been able to influence extensively American defence policy by its control over appropriations.”
(খ) আইন সংক্রান্ত কার্যাবলী:
প্রচলিত ধারণা অনুসারে আইন প্রণয়নই হল আইনসভার প্রধান কাজ। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “The usual term ‘ligislature’ is one indication of the exaggeration of lawmaking function of assemblies.” আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজকর্ম আইনসভার উপর ন্যস্ত থাকে। এটাই হল প্রচলিত ধারণা। বল-এর অভিমত অনুসারে আইনসভার এই আইন সংক্রান্ত কার্যাবলী হল শাসন-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কার্যবলীর সম্প্রসারণ। তিনি বলেছেন: “The law-making functions of assemblies may be seen as an extension of the function of influencing the executive.” গ্রেট ব্রিটেনে পার্লামেন্টের উপরই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রথম ধারায় আইন বিষয়ক যাবতীয় ক্ষমতা কংগ্রেসকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মার্কিন কংগ্রেস ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টেই হল আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যাবতীয় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। সুতরাং সাধারণভাবে এবং তত্ত্বগত বিচারে ধরে নেওয়া হয় যে আইনসভাই আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন অনেকের মতানুসারে আইনসভা হল শাসন বিভাগেরই সম্প্রসারিত অংশ। সাম্প্রতিককালে শাসন-বিভাগ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্তমানে শাসন-বিভাগের প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তসমূহকে কার্যকর করার মধ্যেই আইনসভার কাজকর্ম সীমাবদ্ধ থাকে। এবং আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও শাসন-বিভাগই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এই পরিবর্তিত অবস্থার কারণ হিসাবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিচার-বিবেচনা করা দরকার।
(১) সুসংহত দলীয় ব্যবস্থার জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকার গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে বিল উত্থাপনের দায়িত্বটি সাধারণত সরকারই সম্পাদন করে। অধিকাংশ বিল শাসন-বিভাগের দ্বারাই উত্থাপিত হয়। বল বলেছেন: “… as a consequence of administrative complexity and party organisation, the government’s initiative is large. In Britain all important and controversial legislation emanates from government sources, and the very few exceptions to this rule need pronounced government support.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসন-বিভাগই শতকরা আশিভাগ বিল মার্কিন কংগ্রেসে উত্থাপন করে। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকর হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকাই হল মুখ্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপিত বিলের নব্বই শতাংশই হল সরকারী বিল। পার্লামেন্টে শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বর্তমান থাকে। তাই সরকারী বিল পাস হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে। সরকারী বিল নিয়ে পার্লামেন্টে নিছক আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও তর্কবিতর্ক পরিচালিত হয়। ব্রিটিশ কমন্সসভার কাজ হল যাবতীয় বিতর্ক ও সমালোচনার পর সরকারী বিলকে অনুমোদন করা। অপরদিকে সমর্থনের অভাবে বাতিল হয়ে যাওয়াটাই বেসরকারী বিলের ভাগ্য বলে প্রতিপন্ন হয়।
(২) আবার আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সকল দেশেই আইনসভার ক্ষমতা সংবিধানের দ্বারা সুনির্দিষ্ট থাকে। কোন দেশেই আইনসভার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অবাধ বা অনির্দিষ্ট নয়। এই ক্ষমতা সাংবিধানিক আইন ও নিয়ম-নীতির দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। বল বলেছেন: “The legislature may in addition, be constitutionally barred from making laws on certain matters.” সংবিধান-বিরোধী আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কোন দেশের আইনসভার থাকে না। মার্কিন কংগ্রেস ও ভারতীয় পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংবিধান অনুসারে সীমাবদ্ধ। এই দুটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা বর্তমান। তাই সংবিধানের মাধ্যমে লিখিতভাবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকারগুলির আইন বিষয়ক ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সে পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের (১৯৫৮) ৩৪ ধারায় পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের ক্ষমতার উপর কোন সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা নেই। কিন্তু রাজনীতিক সীমাবদ্ধতার কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অবাধ বা অসীম নয়।
(৩) শাসন-বিভাগের হাতে ভেটো (Veto) ক্ষমতা আছে। বল বলেছেন: “Executives are often armed with power to veto legislative proposals; ….” এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে শাসন-বিভাগ আইনসভার সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দিতে পারে। আইনসভায় পাস হওয়া বিলের উপর ভেটো প্রয়োগের সাংবিধানিক ক্ষমতা অনেক দেশের প্রশাসনিক প্রধানকে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি, ব্রিটেনের রাজা বা রানী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রভৃতি পদাধিকারীদের এই ক্ষমতা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতিকে ভেটো-ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের আইনকে রাষ্ট্রপতির ভেটো পুরোপুরি বাতিল করতে পারে না। মার্কিন সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির ভেটোর প্রকারভেদ পরিলক্ষিত হয়। গ্রেট ব্রিটেনে রাজা বা রানীর হাতে ভেটো ক্ষমতা আছে। তবে রাজা বা রানীর এই ভেটো ক্ষমতা তত্ত্বগত এবং অব্যবহৃত। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এক ধরনের ভেটো প্রয়োগের ভয় দেখাতে পারেন। তিনি কমন্সসভা ভেঙ্গে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কমন্সসভার উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেন। মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধাচারণ করলে কমন্সসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের হুমকি দিতে পারেন।
(৪) কোন বিল বা বিষয়ের উপর আলোচনার সুযোগ-সুবিধা অবাধ নয়। আইনসভার সদস্যদের আলোচনা বা বক্তৃতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সভার সভাপতি বা অধ্যক্ষ বিভিন্ন উপায়-পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনা বন্ধের প্রস্তাব, গিলোটিন (Guillotine), ক্লোজার (Closure), মুলতুবী প্রস্তাব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৮ সালের ফরাসী সংবিধানে এই সমস্ত ব্যবস্থাদির প্রয়োগের ব্যাপক সুযোগ বর্তমান। ব্রিটেনের সংসদীয় শাসনব্যবস্থাতেও এ ধরনের বিধি-নিষেধের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সীমিত সময়ের মধ্যে সংসদকে বহু ও বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এই কারণে আইনসভার সদস্যদের আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আইনসভার আলোচনা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত এই সমস্ত ব্যবস্থাদি সকল দেশে পরিলক্ষিত হয় না। অ্যালান বল বলেছেন: “However, they are not universal: Holland, Sweeden, Denmark and Norway either have no provision for them at all or they are not used. The United State Senate provides a good example of unlimited discussion.”
(৫) অর্পিত ক্ষমতা-প্রসূত আইনের (delegated legislation) মাধ্যমেও আইনসভার আইন প্রণয়নের ক্ষমতার উপর সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সময়ের স্বল্পতা, আপৎকালীন অবস্থার প্রয়োজন, আইনসভার সাধারণ সদস্যদের বিশেষজ্ঞতার অভাব প্রভৃতি কারণের জন্য মূল আইনের বিস্তারিত নিয়মকানুন প্রণয়নের দায়িত্ব ও ক্ষমতা শাসন-বিভাগের হাতে অর্পিত হয়। এবং এই সূত্রে শাসন-বিভাগ অর্পিত ক্ষমতা-প্রসূত আইন প্রণয়ন করে। এই পথে শাসন-বিভাগ আইনসভার আইন প্রণয়নের এক্তিয়ারে অনুপ্রবেশের সুযোগ পায়।
এ কথা ঠিক যে আইনসভার আইন প্রণয়নমূলক কাজকর্মের উপর বর্তমানে বিভিন্ন বাধা নিষেধ বর্তমান। এবং এ ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগের ভূমিকার গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান। এতদ্সত্ত্বেও আইনসভার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা বলতে আইন প্রণয়নকেই বোঝায়। বর্তমানে বিশেষত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক প্রক্রিয়া ও সমাজব্যবস্থা বিশেষভাবে জটিল হয়ে পড়েছে। এবং আইন প্রণয়ন ব্যবস্থাও জটিল হয়ে পড়েছে। আইন প্রণয়নের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত আনুষঙ্গিক কিছু কাজও আইনসভায় সম্পাদিত হয়। আইনসভার সদস্যরা দলীয় সভা-সমিতিতে যোগ দেন। তাঁরা যে যার নির্বাচনী এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। দলীয় সিদ্ধান্ত, প্রতিশ্রুতি ও প্রস্তাবগুলিকে আইনে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে তাঁরা উদ্যোগী হন। তা ছাড়া সদস্যরা আইনসভার বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করেন। আইনসভার এই সমস্ত কমিটির মধ্যে কতকগুলি কমিটি বিভিন্ন বিল সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ ও আলাপ-আলোচনা করে। বিচার্য বিল সম্পর্কে এই সমস্ত কমিটির প্রতিবেদন আইন প্রণয়নের ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। আবার আইনসভার বিভিন্ন সদস্যের আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া ব্যক্ত হয়। এবং এইভাবে সামাজিক তথা রাজনীতিক উত্তেজনা বৈধ পথে প্রশমিত হয়ে থাকে। আইনসভার আইন প্রণয়নমূলক কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এই সমস্ত আনুষঙ্গিক কার্যাবলীর গুরুত্বও কম নয়। বলের অভিমত হল: “Of course, the extent of the assembly’s power in the rule-making process will depend on the strength of the government, the scope of its legislative programme and the immediacy of a general election, but in most liberal democracies it is rare for a government to emerge from the legislative process with its programme unscathed.”
(গ) প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যাবলী:
বেজহট তাঁর The English Constitution শীর্ষক গ্রন্থে আইনসভার বিশেষত ব্রিটিশ কমন্সসভার কার্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে ব্রিটিশ কমন্সসভার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল নির্বাচনমূলক, প্রকাশমূলক, প্রশিক্ষণমূলক, তথ্যাদি প্রদানমূলক ও আইন প্রণয়নমূলক। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালন বল বলেছেন: “Walter Bagehot once described…it is the expressive, teaching and informing functions that are most relevant to the representative aspect of modern assemblies. বেজহটের অভিমত অনুসারে আইন প্রণয়ন আইনসভার কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। আইনসভার অন্যান্য কাজগুলি প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত। আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও আইনসভার বহুবিধ কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনায়ও বেজহটের বক্তব্যের সমর্থন পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে বার্ণাড ক্রিক (Bernard Crick) ও স্যামুয়েল বীয়ার (Samuel Beer)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আইনসভার সদস্যরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আইনসভায় ব্যক্ত জনপ্রতিনিধিদের অভিমতের দ্বারা ভোটদাতাদের রাজনীতিক চেতনা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এইভাবে রাজনীতি বিষয়ে নির্বাচক মণ্ডলীকে শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের রাজনীতি সচেতন করে তোলা হয়। আবার আইনসভার সদস্যরা স্ব-স্ব নির্বাচন-ক্ষেত্রে এবং নির্বাচকমণ্ডলীর কাছ থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি তাঁরা আইনসভায় ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন বিষয়ে সরকারী তথ্যাদি সম্পর্কে আইনসভার অভ্যন্তরে অলোচনা, বিতর্ক ও মূল্যায়ন চলে। এই সমস্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা সম্পর্কে জনগণ অবহিত হন। সরকারী সূত্রে এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় ব্যাখ্যা জনগণের কাছে পেশ করা হয়। তারা রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ পান। রাজনীতি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে নির্বাচকমণ্ডলীকে সচেতন করে তোলা আইনসভার সদস্যদের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব।
রাজনীতিক সংযোগ সাধনের ক্ষেত্রেও আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনসভার সদস্যরা আইনসভা ও নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। নির্বাচকমণ্ডলী তাদের বক্তব্য সরকারের কাছে সরাসরি পেশ করতে পারে না। আইনসভার সদস্যগণ জনপ্রতিনিধি হিসাবে জনসাধারণের বক্তব্যকে শাসন বিভাগের কাছে পেশ করে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর বক্তব্যকে সদস্যরা আইনসভায় উপস্থাপিত করেন। বর্তমানে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার এই ভূমিকা কতকাংশে কমেছে। আইনসভার কার্যবলী ও মর্যাদা সকল দেশে সমান নয়। এতদসত্ত্বেও নির্বাচকমণ্ডলীর সঙ্গে সরকারের সংযোগ সাধনের দায়িত্ব সকল দেশেই আইনসভার সদস্যরা সম্পাদন করেন। আইনসভার মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাব ও দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে উপস্থাপিত হয়। আইনসভার সদস্যরা এবং সামগ্রিকভাবে আইনসভা জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের যাবতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তাই শুধু নির্বাচনের সময় এই রাজনীতিক সংযোগ সাধনের বিষয়টি নিরন্তর বা ধারাবাহিকভাবে সম্পাদিত হওয়া আবশ্যক। বল বলেছেন: “… what is significant here is the recognition of the link between the representative, his legislative activities and his electorate.”
বার্নার্ড ক্রিকের অভিমত অনুসারে আইনসভার প্রধান কাজ হল সরকারের কার্যাবলী ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে উপস্থাপন করা। সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে মতামত ও রায় দেয় এই নির্বাচকমণ্ডলী। ক্রিকের মতানুসারে আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন, প্রত্যাখ্যান বা সরকারের অপসারণ আইনসভার মুখ্য কাজ নয়। নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ও ঘটনাবলী পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হলে আইনসভা তার গুরুত্ব হারাবে। এ প্রসঙ্গে স্যামুয়েল বীয়ারের অভিমতও উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর মতানুসারে নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থন ও মতামতের সংহতি সাধনের উপর সরকারের শক্তি-সামর্থ্য নির্ভরশীল। সরকারের কার্যাবলীর পিছনে নির্বাচকমণ্ডলীর সম্মতি বর্তমান থাকলে সরকার শক্তিশালী হয়। ব্রিটিশ কমন্সসভার এই রকম সংযোগ সাধনমূলক ভূমিকার উপর বীয়ার জোর দিয়েছেন। তাঁর অভিমত হল জনসাধারণের কাছে সরকারের সাফল্য এবং শাসনব্যবস্থার সার্থক বিষয়গুলিকে উপস্থাপন করতে হবে। তা হলে জনসাধারণের সম্মতিকে বাস্তবায়িত করা যাবে। এই কারণে নির্বাচন-এলাকা ও নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতি নজর দেওয়া আইনসভার সদস্যদের একটি বড় কাজ। সদস্যদের সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে বা শাসক ও শাসিতের মধ্যে সংযোগ বজায় রাখতে হয়। সরকারের সাফল্যকে নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে পৌঁছে দিতে হয়। তাহলে সরকারের প্রতি জনসাধারণ সহানুভূতিশীল হয় এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার দৃঢ়ভিত্তিক হয়। এই কারণে আইনসভার প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ এত বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। এবং এই কারণে মার্কিন কংগ্রেসে ও ব্রিটিশ কমন্সসভার সদস্যরা তাঁদের অন্যান্য কাজকর্মের পরিবর্তে যে যার নির্বাচনী এলাকা ও এলাকার জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার বিষয়টির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
সরকারী সিদ্ধান্ত ও নীতি বৈধতাযুক্ত হয় আইনসভার অনুমোদনের মাধ্যমে। সুতরাং সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহের বৈধতা প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা আইনসভার হাতেই ন্যস্ত আছে। এবং আইনসভা যত বেশী প্রতিনিধিত্বমূলক হবে তার এই ক্ষমতার পরিধিও তত ব্যাপক হবে ও ক্ষমতার প্রকৃতি হবে অধিকতর দৃঢ়। আবার রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ঐকমত্য যত বেশী ব্যাপক হবে আইনসভার অনুমোদনের ভিত্তিতে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহের বৈধতার ভিত্তি তত বেশী দৃঢ় হবে।
রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা সংরক্ষণ আইনসভার অন্যতম গুরুদায়িত্ব হিসাবে বিবেচিত হয়। এবং আইনসভার এই দায়িত্বও প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্বের অঙ্গীভূত। আইনসভার বিভিন্ন রাজনীতিক দল ও গোষ্ঠী থাকে। এই সমস্ত রাজনীতিক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে যদি ঐকমত্য থাকে তা হলে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনে কোন রাজনীতিক দল এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা দেখা দেয়। এবং তখন রাজনীতিক ব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি হয়। এই আশংকার কারণে রাজনীতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এবং এই কারণে আইনসভার সদস্যরা নির্বাচকমণ্ডলীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেন।
আইনসভার সদস্যরা সভার বিতর্ক ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। সদস্যরা নিজেদের নির্বাচনী এলাকা ও এলাকার অধিবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেন। এইভাবে সরকার দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। এবং তদনুসারে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে সাধ্যমত উদ্যোগী হয়।
আইনসভার আলোচনা ও বিতর্কের শিক্ষামূলক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। সভার সদস্যরা তাঁদের বক্তৃতার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে বহু তথ্য ও পরিসংখ্যান আইন সভায় পেশ করেন। সরকারের তরফ থেকেও বহু ও বিভিন্ন তথ্য সভায় সরবরাহ করা হয়। আইনসভার আলোচনায় উপস্থাপিত তথ্য ও পরিসংখ্যান এবং সভায় গৃহীত প্রস্তাব ও নীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তথ্যাদি জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে তা জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক তথ্য সম্পর্কে জনগণ অবহিত হতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে দেশের রাজনীতিক দল ও গোষ্ঠীগুলির অবস্থান সম্পর্কেও জনসাধারণের ধারণা জন্মায়। তার ফলে জনগণের রাজনীতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে জনগণের সচেতনতা ও সতর্কতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নির্বাচনী এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে আইনসভার সদস্যদের সরাসরি যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আইনসভার সদস্যদের যে যার নির্বাচকমণ্ডলীর সঙ্গে সাধ্যমত প্রত্যক্ষ সংযোগ রক্ষা করার ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়। বিভিন্ন সময়ে এবং প্রয়োজনে পরামর্শ দিতে হয় এবং সাহায্য করতে হয়। আবার প্রয়োজনমত সদস্যরা পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনেরও ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া নির্বাচনের প্রাক্কালে সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিদানে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের ব্যাপারও থাকে।
(ঘ) তদন্ত তত্ত্বাবধানমূলক কার্যাবলী:
যে সমস্ত সংস্থা জনসাধারণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজকর্ম পরিচালনা করে তাদের কার্যাবলী তত্ত্বাবধান ও তদন্ত করার প্রক্রিয়া আইনসভার আছে। আইনসভা প্রয়োজনমত নির্দেশও দিতে পারে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের জবাবদিহির ব্যবস্থাও করা যায়। তার ফলে এই সমস্ত সংস্থার দায়িত্বশীলতা ও উৎপাদনশীলতার উন্নতি ঘটে। আইনসভা বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য অনেক সময় কমিশন নিয়োগ করে থাকে। প্রশাসনের দুর্নীতি অনুসন্ধানের ব্যাপারে আইনসভার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “Its real function is to watch the process of administration to safeguard the liberties of private citizens.” আইনসভা সমকালীন সামাজিক, রাজনীতিক প্রভৃতি বিষয়ের সমস্যাদি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত হওয়ার জন্য কমিটি বা কমিশন নিয়োগ করে থাকে। তাছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের দুর্নীতি তদন্তের জন্যও কমিশন বা কমিটি গঠন করা হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সনের ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারী’ তদন্তের উদ্দেশ্যে ‘মার্কিন সিনেটের’ বিচার সম্পর্কিত কমিটি উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস প্রশাসনিক এজেন্সী গঠন করতে পারে। এবং এই সমস্ত এজেন্সীর কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করতে পারে। ভারতে ১৯৭৫ সালের জরুরী অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কিত অভিযোগসমূহ অনুসন্ধানের জন্য পার্লামেন্ট কর্তৃক গঠিত ‘শাহ-কমিশন’ (Shah Commission)-এর কথাও উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য।
(ঙ) নির্বাচনমূলক কার্যাবলী:
আইনসভাকে নির্বাচনমূলক কাজও করতে হয়। অধিকাংশ দেশের সংবিধানেই আইনসভাকে নির্বাচনমূলক কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এবং আইনসভার এই দায়িত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে পার্লামেন্ট এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ‘কংগ্রেসের’ ভূমিকা সংবিধান অনুসারে স্বীকৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কেউ নির্বাচক সংস্থার সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট না পেলে প্রতিনিধি সভা (House of Representatives) প্রথম তিনজন প্রার্থীর মধ্যে যে-কোন একজনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে পারে। উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিনেট (Senate) -ও অনুরূপ ক্ষমতার অধিকারী। সুইজারল্যাণ্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার প্রধান কাজ হল যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের (Federal Council) সদস্যদের নির্বাচন করা। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনেও আইনসভার নির্বাচনমূলক ক্ষমতাকে স্বীকার করা হয়েছে। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে রাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্যরা, জাতীয় গণ-কমিটির স্থায়ী সদস্যরা, সর্বোচ্চ গণ-আন্দোলনের সভাপতি, সর্বোচ্চ প্রকিউরেটরেটের প্রধান প্রকিউরেটর প্রভৃতি পদাধিকারীরা জাতীয় গণ-কংগ্রেসের দ্বারা নির্বাচিত হন।
আইনসভার হাতে অপসারণমূলক ক্ষমতাও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, পদস্থ কর্মচারী, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি প্রভৃতি পদাধিকারীদের মার্কিন কংগ্রেস পদচ্যুত করতে পারে। ভারতে রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি এবং সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের পার্লামেন্ট পদচ্যুত করতে পারে।
(চ) সংবিধান সংক্রান্ত কাজ:
অনেকক্ষেত্রে আইন বিভাগকে কিছু সংবিধান সম্পর্কিত কাজও করতে হয়। আইনসভা সংবিধান ব্যাখ্যা এবং সংবিধানকে সামগ্রিকভাবে বা আংশিকভাবে সংশোধন করতে পারে। আইনসভা এককভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। আবার কোন কোন দেশে গণভোট ও গণ-উদ্যোগের ব্যবস্থা আছে। সেই সমস্ত দেশে জনগণও সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। আবার সুইজারল্যাণ্ডের আইনসভাই হল সে দেশের সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে জাতীয় গণ-কংগ্রেসের হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা ন্যস্ত আছে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যের অনুমোদন ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না। গ্রেট ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সাধারণ আইন পাসের ক্ষমতা ও সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা অভিন্ন প্রকৃতির।
(ছ) অন্যান্য কার্যাবলী:
আধুনিককালে আইনসভাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই সমস্ত দায়িত্ব ও কার্যাবলীর মধ্যে কতকগুলি হল আইনানুগ ও প্রত্যক্ষ। আইনসভার উপরিউক্ত কার্যাবলী আইনানুগ ও প্রত্যক্ষ। কিন্তু এ ছাড়াও আইনসভা আরও কিছু দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকে। এগুলি পরোক্ষ প্রকৃতির। আইনসভার এই সমস্ত কার্যাবলীকে পরোক্ষ কার্যাবলী বলা হয়। আইনসভার পরোক্ষ কার্যাবলীর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(১) যে-কোন রাষ্ট্রে রাজনীতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সাধনের একটি অত্যাবশ্যক কাঠামো হল আইনসভা। আইনসভা প্রাধান্যযুক্ত স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনীতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভার আলোচনা ও বিতর্ক প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে নির্দিষ্ট মূল্যবোধ বা মনোভাব গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ। এই মনোভাব রাজনীতিক ব্যবস্থার সহায়ক হতে পারে, আবার বিরোধীও হতে পারে। সহায়ক হলে রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং বিরোধী হলে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। আইনসভার কাজকর্ম জনসাধারণের স্বার্থের অনুকূল হলে প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হয়। বিপরীতক্রমে আইনসভার ভূমিকা জনগণের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করলে রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে আইনসভা রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য সামাজিক সংঘ-সংগঠনের ভূমিকাও আছে। তবে এ ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উদ্দেশ্য হল প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং তার অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের প্রতি জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য সৃষ্টি। প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জনগণের অনুকূল অনুভূতি, বিশ্বাস ও আনুগত্য গড়ে তোলাই হল রাজনীতিক সামাজিকীকরণ। সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা অনবদ্য। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর তাৎপর্য অপরিসীম।
(২) বহু ও বিভিন্ন বিষয় রাজনীতিক কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত। রাজনীতিক কার্যাবলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আইনসভার নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণ ও নিয়োগের ব্যাপারে আইনসভার নির্বাচনের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বটেই, নির্বাচকমণ্ডলীর একটি ব্যাপক অংশকেও আইনসভার নির্বাচন উজ্জীবিত ও আবেগ-মথিত করে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নবীন রাজনীতিক নেতা ও কর্মীরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। রাজনীতিক ক্ষমতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। আবার আইনসভা সদস্যদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে এবং সদস্যদের রাজনীতিক বিচক্ষণতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন বিষয়ে আইনসভার আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোন কোন সদস্য নিজেদের বিচক্ষণীয় ভিত্তিতে বিশিষ্ট হয়ে উঠেন। এবং পরবর্তী কালে তাঁরাই রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। আইনসভার সদস্য হিসাবে সফল অভিজ্ঞতাই উচ্চতর রাজনীতিক ও সরকারী পদে আসীন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। মার্কিন কংগ্রেসের বিচক্ষণ সদস্যদেরই পরবর্তী কালে মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হতে দেখা যায়। অন্যান্য দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থাতেও অল্পবিস্তর একই ঘটনা ঘটে।
(৩) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিরা আইনসভায় থাকেন। তাঁদের মাধ্যমে জনসাধারণের বহু ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আইনসভায় উত্থাপিত হয়। অর্থাৎ নানা ধরনের দাবি-দাওয়া আইনসভায় আসে। এর মধ্যে পরস্পর-বিরোধী দাবি-দাওয়া থাকে। আইনসভায় আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে উত্থাপিত দাবি বা স্বার্থসমূহের মধ্যে বাছাই ও চিহ্নিত করা হয়। তারপর নির্দিষ্ট স্বার্থ সম্পর্কিত দাবিগুলিকে সঠিক জায়গায় পেশ করা হয়। অর্থাৎ আইনসভা তার সামনে উপস্থিত করা স্বার্থসমূহকে বাছাই ও চিহ্নিত করে এবং সেগুলিকে বাস্তবে কার্যকর করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এ হল আইনসভার একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনসভা রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের কাছে জনগণের দাবি-দাওয়াকে পেশ করে। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল আইনসভার এই প্রক্রিয়াকে ‘Interest Articulation and Aggregation’ বলে অভিহিত করেছেন। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনসভার এই ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
(৪) আইনসভায় অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তার মধ্যে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তারপর বিতর্কিত বিষয়ের উপর ভোটাভুটি হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এইভাবে বিতর্কিত বিষয়ের উপর বিরোধের অবসান হয়। এই কারণে অনেকের অভিমত হল আলাপ আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে আইনসভা বিরোধের মীমাংসা করে। কোন কোন রাজনীতিক পর্যবেক্ষকের অভিমত অনুসারে আইনসভার এই ভূমিকার রাজনীতিক তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
আইনসভার শাসন-বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কার্যাবলীর মূল্যায়ন:
বর্তমানে সকল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসন-বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং আইনসভা প্রকৃত প্রস্তাবে শাসন বিভাগেরই প্রাধান্যযুক্ত একটি প্রতিরূপে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে কমন্সসভার প্রাধান্যের কথা বলা হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার ইচ্ছার অনুকূলে কমলসভা পরিচালিত হয়। কমন্সসভায় প্রধানমন্ত্রীর আধিপত্য সুবিদিত। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সকল বিষয়ে রাষ্ট্রপতির প্রাধান্য সুবিদিত। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর শাসন-বিভাগকে উপেক্ষা করে কংগ্রেস কিছু করতে পারে না। দেশের শাসনকার্য পরিচালনা সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর শাসন-বিভাগের ভূমিকাই হল মুখ্য। তবে নিয়মমাফিক বিষয়গুলি মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা হয়। এবং কংগ্রেস আলোচনা ও বিতর্কের পর সেগুলিকে অনুমোদন করে। শাসন-বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে কতকগুলি বিষয়ের কথা বলা হয়।
(১) অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে শাসন-বিভাগের উপর আইন-বিভাগের নিয়ন্ত্রণ তত্ত্বগত বিষয়। বাস্তবে এই নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা যায় না। কারণ আর্থিক বিষয় ও পদ্ধতিগুলি হল অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। এই সমস্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান দরকার। আইনসভার সকল সদস্যের এই জ্ঞান থাকে না। তাই আর্থিক বিষয়ের আলোচনায় আগ্রহের অভাব দেখা যায়। আবার এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কের জন্য বরাদ্দ সময় নিতান্তই কম থাকে। বাজেট, অর্থবিল, সরকারের আর্থিক নীতি প্রভৃতি বিষয়ে অল্প সময়ের মধ্যে যথাযথ আলোচনা অসম্ভব। তা ছাড়া প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত তথ্যাদির সরবরাহ ছাড়া আর্থিক নীতির উপর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক তথ্যাদির অভাবহেতু সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত কারণের জন্য আর্থিক বিষয়ের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা আইন-বিভাগের পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে মন্ত্রিসভা এবং অর্থদপ্তর যা করে আইনদপ্তরকে তা অনুমোদন করতে হয়। এই কারণে বল বলেছেন: “Yet the restrictions on influencing policy by means of financial control are obvious even in the most independent of assemblies.”
(২) শাসন-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, বিতর্ক ও সমালোচনা আইনসভার হাতের হাতিয়ার বিবেচিত হয়। বর্তমানে বাস্তবে এই হাতিয়ার অকেজো প্রতিপন্ন হয়। পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে আইনসভা এ ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। পদ্ধতিগত হাতিয়ারের অভাবহেতু আইনসভার নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা অকার্যকর প্রতিপন্ন হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আইনসভার এই দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “Questioning the executive of the floor of the assembly is rare in the most European parliaments;….” গ্রেট ব্রিটেনে কমন্স সভার পদ্ধতিগত ব্যবস্থাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসার পক্ষে সহায়ক বলে বিবেচিত হয় না। আবার অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে মন্ত্রিসভাকে অপসারিত করা সহজ ব্যাপার নয়। মার্কিন কংগ্রেসে ফিলিবাস্টারিং (Filibustering) ব্যবস্থা বর্তমান। এই ব্যবস্থার অস্তিত্বের কারণে মতামত ব্যক্ত করার ব্যাপারে সদস্যরা অসুবিধার সম্মুখীন হন। তা ছাড়া মার্কিন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপনের ক্ষমতা কংগ্রেসের নেই। বল বলেছেন: “Some assemblies, such as the West German Bundestag, rarely make use of the committee of inquiry and there is no provision for votes of conifidence.”
(৩) বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারণ ও তা প্রয়োগের ব্যাপারে শাসন-বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন দেশের স্বরাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি উভয় ক্ষেত্রেই শাসন-বিভাগ যাবতীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে। যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে আইনসভা অনেক সময় অন্ধকারে থেকে যায়। অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করেই একটি দেশ অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে আইনসভাকে অবহিত করা হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নানা উপায়ে সিনেটের অনেক ক্ষমতাকে নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে সিনেটের অনুমোদন এখন আর নেওয়া হয় না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। তা ছাড়া শাসন-বিভাগের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব এবং কাজকর্মের দ্রুতগতির সঙ্গে আইনসভা তাল রাখতে পারে না।
(৪) সংদদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ব্যাপারে সরকার সুনিশ্চিত থাকে। কারণ আইনসভার সরকারী দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে। আইনসভার সদস্যরা দলীয় ভিত্তিতে নেতার নির্দেশে ভোট দেন। দলীয় ব্যবস্থা এখন সুশৃঙ্খল ও সুসংহত। ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনা বোধ বা মতামতের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বা ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা সদস্যদের থাকে না। শাসকদলের সদস্যদের দায়িত্ব হল মন্ত্রিসভার যাবতীয় প্রস্তাবকে অনুমোদন করা। এবং বিরোধী দলের সদস্যদের কাজ হল দলীয় নির্দেশ ও নীতির ভিত্তিতে সরকারের সমালোচনা করা। এই অবস্থায় শাসন বিভাগের উপর আইনসভার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা হ্রাস পায়। সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কিন কংগ্রেসের ভিতরে সদস্যদের কাজকর্মের উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ ততটা কঠোর নয়। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা স্থানীয় স্বার্থের বিচার-বিবেচনার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ও পরিচালিত হন। নিজের নির্বাচন-ক্ষেত্রে ও স্থানীয় স্বার্থ সম্পর্কিত আলোচনার বাইরে তাঁদের আগ্রহ দেখা যায় না। অর্থাৎ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকারী কাজকর্মের সমালোচনার ব্যাপারে কংগ্রেসের মধ্যে সদস্যদের উৎসাহের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তা ছাড়া ভোটাভুটির ক্ষেত্রে কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যেও দলীয় আনুগত্যের বিষয়টিও থাকে। সুতরাং শাসন-বিভাগের উপর আইনসভার অর্থবহ নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে। কারণ শাসন-বিভাগের প্রতি সমর্থনের শক্তি-সামর্থ্য আইনসভার অভ্যন্তরেই বর্তমান থাকে। বল তাঁর Modern Politics and Government গ্রন্থে বলেছেন: “… the key to the power structure in most modern assemblies lies in the party system in the assembly itself: this is where the parliamentary leadership and executive support emerges, and this determines the degree of control and influence the assembly exercises.”
(৫) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেনে যাঁরা শাসন-বিভাগীয় ক্ষমতার অধিকারী হন এবং যাঁরা আইনসভার সদস্যপদ অর্জন করেন, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিন্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত বিত্তবান ও পুঁজিপতি শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গই আইনসভার সদস্যপদ লাভ করেন এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী হন। এই অবস্থায় আইনসভার সদস্য এবং শাসন-বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের শ্রেণীস্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন প্রতিপন্ন হয়। সুতরাং আইন-বিভাগের দ্বারা শাসন-বিভাগের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কায়েম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
উপসংহার: এই সমস্ত কারণের জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন-বিভাগ অধিক ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তত্ত্বগতভাবে একথা ঠিক। বাস্তবে কিন্তু নানা কারণে আইনসভার গুরুত্ব বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। আগেকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমূলক রাষ্ট্রের পরিবর্তে বর্তমানে জন-কল্যাণমূলক সক্রিয় ও কর্মমুখর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার ফলশ্রুতি হিসাবে সরকারের দায়-দায়িত্ব এবং শাসন-বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আইনসভার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তা ছাড়া দলব্যবস্থার প্রসার, আর্থনীতিক সংকট, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমস্যার জটিলতা ও অস্থিরতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে সকল রাষ্ট্রেই শাসন বিভাগের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণে এখন প্রায় প্রত্যেক রাষ্ট্রের শাসন-বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ক্ষমতা ও কার্যাবলীর প্রকৃতি ও পরিধি সর্বদেশে ও সর্বকালে অভিন্ন নয়। এ বিষয়ে দেশকাল ভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তাই এ ক্ষেত্রে কোন সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্ব নেই। তবে একথা ঠিক যে রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাব নির্ধারিত হয়।
Leave a comment