আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠন

আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠন ও পদ্ধতির গুরুত্ব: বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার কার্যাবলী বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আইনসভার হাতে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক ক্ষমতাও ন্যস্ত আছে। আইনসভার কার্যাবলীর সফল সম্পাদন এবং আইনসভার ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। তারজন্য আইনসভার উপযুক্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। অর্থাৎ আইনসভার আভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক ব্যবস্থা যথাযথভাবে গড়ে তুলতে হবে। বলও আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠন ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে আধুনিক আইনসভা বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা, শাসন-বিভাগকে প্রভাবিত করা, আইন প্রণয়ন করা প্রভৃতি বহু ও বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে। এই সমস্ত কাজকর্ম কোন্ আইনসভা কতটা সফলভাবে সম্পাদন করতে পারবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠন ও পদ্ধতির উপর। আইনসভার দায়-দায়িত্বের দ্রুত ও সুনিপুণ সম্পাদন সম্ভব কিনা তা নির্ধারিত হয় আইনসভার সাংগঠনিক কাঠামো ও পদ্ধতির দ্বারা। আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠন ও পদ্ধতি বলতে কতকগুলি বিষয়কে বোঝায়। এই বিষয়গুলি হল: আইনসভার অধিবেশনের মেয়াদ, আইনসভায় আলোচনার সুযোগ-সুবিধা, আলোচনায় সদস্যদের অংশগ্রহণ, তথ্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা, কমিটি ব্যবস্থা প্রভৃতি।

অধিবেশনের দীর্ঘ মেয়াদ দরকার: আধুনিক আইনসভার কাজকর্মের চাপ বেড়েছে। আলোচ্য সকল বিষয় নিয়ে সুষ্ঠু আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত সময়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার। এবং তারজন্য আইনসভার অধিবেশনের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হওয়া আবশ্যক। বর্তমানে রাজনীতিক ও আর্থ-সামাজিক সমস্যাদির জটিলতা ও ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার দায়-দায়িত্বের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। নীতি নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন, গণ-সংযোজনমূলক বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক আইনসভার দায়-দায়িত্ব বেড়েছে। এবং এই কারণে আইনসভার অধিবেশনের মেয়াদের পরিবর্ধন প্রয়োজন। কারণ আইনসভার অধিবেশনের মেয়াদ যদি সীমিত হয়, তাহলে বিভিন্ন বিষয় আলোচনার জন্য নির্ধারিত সময়সীমাও সংকুচিত হবে। এবং সেক্ষেত্রে প্রত্যেক বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই আইনসভার অধিবেশন আহ্বান ও অধিবেশনের মেয়াদের বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আবার এ ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ মতও আছে। বলা হয় যে বর্তমানে নির্বাচকমণ্ডলীর সঙ্গে আইনসভার সদস্যদের বিভিন্ন বিষয় যোগাযোগ বজায় রেখে চলতে হয়। আইনসভার অধিবেশনের মেয়াদ বাড়ান হলে সদস্যদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। তবে সামগ্রিক বিচারে আইনসভার ব্যাপক আলোচনা সূচীর প্রতি সুবিচারের স্বার্থে অধিবেশনের মেয়াদ বাড়িয়ে আলোচনা ও বিতর্কের জন্য সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ দেওয়া দরকার।

আলোচনা ও বিতর্কের মানোন্নয়ন: তা ছাড়া এ বিষয়ে আরও কতকগুলি বিষয়ের কথা বলা হয়। আইনসভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এই সমস্ত আলোচনার মান অধিকতর উন্নত হওয়া আবশ্যক। আইনসভার আলোচ্য বিষয়সমূহের আইনগত ও পদ্ধতিগত জটিলতা বেড়েছে। সঙ্গে আইনসভার সদস্যদের এখন ব্যবহারিক রাজনীতির বহু বিষয়ে সংযুক্ত থাকতে হয়। এই অবস্থায় সময় ও সুযোগের অভাবের জন্য সদস্যদের পক্ষে সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করা এবং আলোচনার মানকে উন্নত করা সম্ভব হয় না। আইনসভার সদস্যদের বক্তব্যকে তথ্যবহুল এবং বিতর্ককে গঠনমূলক করতে হলে বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক সংবাদ ও তথ্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা দরকার। এই কারণের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাদারী পরিকাঠামোর মাধ্যমে আইনসভার সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করা দরকার। স্বতন্ত্র সংসদীয় শাখা, আর্থিক সংস্থান, ব্যক্তিগত সাহায্যকারী, পেশাদারী কর্মচারী প্রভৃতির মাধ্যমে আইনসভার সদস্যদের সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়।


আইনসভার কমিটি ব্যবস্থা

আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠনে কমিটি ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ: আধুনিক আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর কমিটি ব্যবস্থা। সাম্প্রতিককালের সকল আইনসভার কার্যাবলী সম্পাদনের প্রক্রিয়া পদ্ধতির সঙ্গে কমিটি ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই সমস্ত কমিটির সংখ্যা সকল দেশের আইনসভায় সমান নয়। কোথাও এই সংখ্যা কম, আবার কোথাও বেশী। অনুরূপভাবে কমিটি ব্যবস্থার গুরুত্বও সকল দেশের আইনসভায় একই রকম নয়। শিল্পোন্নত পশ্চিমী দেশসমূহের আইনসভায় কমিটি ব্যবস্থার বিশেষ প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির আইনসভা সম্পর্কেও মোটামুটি একই কথা প্রযোজ্য। এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলিতেও কমিটি ব্যবস্থার ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু শিল্পোন্নত পশ্চিমী দেশগুলির কমিটি ব্যবস্থা অধিকতর সুসংগঠিত ও সুসংহত। তুলনামূলক বিচারে এশিয়া-আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহের কমিটি ব্যবস্থা অনেকাংশে অ-সংগঠিত ও অবিন্যস্ত। তবে সকল দেশেই কমিটি ব্যবস্থা আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। বল-এর অভিমত অনুসারে আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠনের সর্বাধিক অপরিহার্য অংশ হল কমিটি ব্যবস্থা। Modern Government and Politics গ্রন্থে তিন বলেছেন: “…the committee may be the most vital aspect of the internal organisation of assemblies.”

বস্তুত বর্তমান বৃহদায়তনবিশিষ্ট সকল দেশের আইনসভাতেই কমিটি ব্যবস্থার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক আইনসভার এক অপরিহার্য বা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল কমিটি ব্যবস্থা। সকল রকম রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই কমিটি ব্যবস্থার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়। তবে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারণে কমিটি ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে অভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহে কমিটি ব্যবস্থা একই রকমের হবে, এমন কথাও বলা যায় না। সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে আইনসভার এক-একটি কমিটি গঠিত হয়। এই সমস্ত কমিটির সদস্যসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠিত হওয়া দরকার। তা হলে আইনসভার আলোচনা, বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ ও স্বচ্ছন্দ হয়। আইনসভার কমিটিগুলি বিল ও বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা ও বিতর্ককে এবং সামগ্রিকভাবে আইন পাসের পদ্ধতিকে সহজতর করে। বল আইনসভার কমিটি ব্যবস্থার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ দু’টি দায়িত্ব হল: আইন পাসের পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাহায্য-সহযোগিতা এবং বিশেষ কোন সমস্যা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান।

বিভিন্ন দেশে কমিটি ব্যবস্থার গুরুত্ব: বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় আইনসভায় কমিটিগুলির গুরুত্ব ও ভূমিকার ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থায় আইনসভার কমিটিগুলির বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সিনেট ও প্রতিনিধিসভার কমিটিগুলি একচেটিয়া ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কায়েম করেছে। মার্কিন কংগ্রেসের কমিটিগুলির তথ্যানুসন্ধানমূলক ভূমিকার প্রসার ও প্রাধান্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। অনেকের অভিমত অনুসারে মার্কিন কংগ্রেসের কমিটিগুলি মার্কিন রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধ মীমাংসার ব্যাপারে সহায়ক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থায় কংগ্রেসের কমিটিগুলির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে কতকগুলি কারণের কথা বলা হয়। এই সমস্ত কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, মার্কিন কংগ্রেসে বিভিন্ন দলের সদস্যদের মধ্যে অভিপ্রেত সংহতির অনুপস্থিতি, আঞ্চলিক স্বার্থের দ্বারা সদস্যদের প্রভাবিত হওয়া, মার্কিন রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার অভাব প্রভৃতি। ব্রিটেনের রাজনীতিক ব্যবস্থায়ও বর্তমানে কমিটিগুলির গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়েছে। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কমিটিগুলির সীমাবদ্ধতাও আছে। এ ক্ষেত্রে ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব, কমন্সসভার ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কমিটি ব্যবস্থা মার্কিন কংগ্রেসের কমিটি ব্যবস্থার মত প্রভাবশালী নয়। পশ্চিম জার্মানী ও ফ্রান্সের কমিটি ব্যবস্থা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতীয় পার্লামেন্টের কমিটি ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রাধান্য অস্বীকার করা যায় না। ভারতীয় পার্লামেন্টে সংসদীয় কমিটিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে সরকারী গণিতক কমিটি (Public Accounts Committee), অনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি ( Estimates Committee), সরকারী প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটি (Committee on Government Assurance) প্রভৃতি সংসদীয় কমিটির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠনের গুরুত্ব

নানা কারণের জন্য আইনসভার আভ্যন্তরীণ সংগঠনের ক্ষেত্রে কমিটি ব্যবস্থা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কমিটি ব্যবস্থার প্রকৃতি ও ভূমিকার মধ্যেই তার আইনসভার অপরিহার্য অংশে পরিণত হওয়ার কারণগুলি বর্তমান। এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

(১) বহু সদস্য সমন্বিত আইনসভার কমিটি ব্যবস্থা অপরিহার্য: যে-কোন দেশের আইনসভার প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু আইন প্রণয়নের বিষয়টি বাস্তবে বিশেষজ্ঞের কাজে পরিণত হয়েছে। বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গের বিশেষ বিচার-বিবেচনা ব্যতিরেকে আইনসভার সাধারণ সদস্যদের অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের ফলে এ ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টির আশংকা থাকে। এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সকল বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ আবশ্যক। কিন্তু আইনসভায় সদস্যদের বহু সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবে তা সম্ভব হয় না। বর্তমানে অধিকাংশ দেশের আইনসভাই বহু সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত হতে দেখা যায়। যে কোন বিষয়ে সকল সদস্য মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পায় না। সকল বিষয়ে আলাপ-আলোচনার পর সুষ্ঠুভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে কমিটি গঠিত হয়। বিশেষ বিশেষ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে এই কমিটিগুলি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আইনসভাকে সাহায্য করে।

(২) বিশেষজ্ঞের সুপারিশ: আধুনিক আইনসভায় বিভিন্ন বিষয়ে আইন প্রণীত হয়। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিষয়াদিও থাকে। এই সমস্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দরকার। সংসদীয় কমিটিগুলি সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়। এই কমিটিগুলিকে বিশেষজ্ঞের কমিটি বলা যেতে পারে। এই কমিটিগুলি বিশেষজ্ঞের সুপারিশ দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ত্রুটিহীন আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সাহায্য করে।

(৩) সময়ের সংকট নির্ধারণ: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে আইনসভার উপর কাজের চাপ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য আইন প্রণয়নের কাজ ত আছেই, তা ছাড়াও নানা রকম বিষয় ও সমস্যাদি সম্পর্কে আইনসভাকে আলোচনা করতে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সীমাবদ্ধ সময়ের মধ্যে কাজের অস্বাভাবিক চাপের মধ্যে পড়ে আইনসভা সময়ের স্বল্পতাজনিত সংকটের সম্মুখীন হয়। আইনসভার এই সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে কমিটি ব্যবস্থার উপযোগিতা অনস্বীকার্য। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটিগুলিই অধিকাংশ দায়-দায়িত্ব সম্পাদন করে। কমিটি পর্যায়েই বিলগুলির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক সম্পন্ন হয়। আইনসভার সময়ে ভাগ না বসিয়েও কমিটিগুলি এই সমস্ত বিষয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে পারে। তার ফলে অন্য দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইনসভার পর্যাপ্ত অবকাশ থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে ত্রুটিহীন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও অসুবিধা হয় না। বিশেষত আপৎকালীন অবস্থায় জরুরী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কমিটি ব্যবস্থার এই ভূমিকার গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। প্রকৃত প্রস্তাব সংসদীয় কমিটিগুলির মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে আইনসভার কাজকর্ম অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।

(8) বিরোধের অবসান: সংসদীয় কমিটিগুলিতে সাধারণত প্রতিটি রাজনীতিক দল আইনসভায় তাদের দলীয় শক্তির অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব লাভ করে। অর্থাৎ কমিটিগুলিতে বিভিন্ন দলের সদস্য থাকে। তার ফলে সংসদীয় কমিটির আলোচনায় বিভিন্ন রকম মতামতের প্রতিফলন ঘটে। আইনসভায় প্রতিনিধিত্বকারী সকল রাজনীতিক দল ও গোষ্ঠীর যাবতীয় অভিমত ব্যক্ত হয়। কমিটিগুলির আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিশেষ বিষয়ে বিভিন্ন মতামতের পারস্পরিক বিরোধিতার নিষ্পত্তি হয়।

(৫) বিভিন্ন অভিমতের সংযোগ সাধন: সংসদীয় কমিটিগুলিতে সদস্য হিসাবে আইনসভার সদস্যরা থাকেন। এই কমিটিগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার প্রাক্কালে আইনসভার বাইরের সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গকে সাক্ষ্য দানের জন্য আহ্বান জানায়। এইভাবে আইনসভার বাইরের মতামত কমিটির আলোচনায় প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এবং সংসদীয় কমিটিগুলির মাধ্যমে এই সমস্ত মতামতের মধ্যে সংযোগ সাধিত হয়। এবং কমিটিগুলি বিভিন্ন অভিমত বিচার-বিশ্লেষণের পর বিচার্য বিষয়ে সুনিশ্চিত সুপারিশ প্রদান করে।

(৬) প্রতিনিধিত্বমূলক আইন প্রণয়ন: আইনসভার কমিটিগুলিতে সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করার অবাধ সুযোগ লাভ করেন। বক্তব্য ব্যক্ত করার এরকম স্বাধীনতা তাঁরা আইনসভার আলোচনার ক্ষেত্রে পান না। কারণ আইনসভায় সংসদীয় রীতিনীতির নিয়ন্ত্রণ, সভার সভাপতি বা অধ্যক্ষের রুলিং, দলীয় নির্দেশ (whip) প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণমূলক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই সদস্যদের কাজ করতে হয়। কমিটিগুলির আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে সদস্যদের উপর এরকম কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তার ফলে সদস্যরা তাঁদের যে-কোনো অভিমত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে পারেন। এইভাবে সুষ্ঠু ও সঠিক প্রতিনিধিত্বমূলক আইন প্রণয়নের পথ প্রশস্ত হয়।

(৭) ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ: সারা বছর ধরে আইনসভার কমিটিগুলি তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে। অপরদিকে আইনসভার অধিবেশন চলে বছরে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য। সুতরাং এই কমিটি ব্যবস্থার মাধ্যমেই কাজকর্মের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করা যায়। কেবল কমিটি ব্যবস্থার মাধ্যমেই এই সুযোগ লাভ করা যায়।

(৮) অনুসন্ধানমূলক ভূমিকা: আইনসভার কমিটিগুলি অনুসন্ধানমূলক বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। কোন নির্দিষ্ট সমস্যা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের প্রয়োজন দেখা দিলে আইনসভা কমিটি ব্যবস্থার সাহায্য গ্রহণ করে। তদন্তমূলক কমিটির মাধ্যমে কোন বিশেষ বিষয়ে তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়। এবং আইনসভায় তা পেশ করা হয়। বল কমিটি-ব্যবস্থার এই ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মার্কিন কংগ্রেসের কমিটিগুলির তথ্যানুসন্ধানমূলক ভূমিকা বিশেষভাবে সাড়া জাগিয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধিসভা বা সিনেটের কমিটিগুলির অনুসন্ধানমূলক কার্যাবলী উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য।