আইনের যুক্তিসঙ্গততা : আইনগত ন্যায়ের সঙ্গে দেশের আইন প্রণয়ন পদ্ধতি ও বিচারব্যবস্থার কথা বলা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে আইন প্রণয়নের প্রচলিত পদ্ধতি এবং বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত ন্যায় অনুধাবন করা যায়। আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে বলা হয় যে আইন হবে যুক্তিসঙ্গত এবং আইনানুসারে ন্যায়বিচার সকলের কাছে সহজলভ্য হবে। নির্দিষ্ট একটি সমাজের সামাজিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে কোন একটি আইনের যুক্তিসঙ্গততা নির্ধারিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ আইনের যুক্তিসঙ্গততা সামাজিক চাহিদার উপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে সমাজের মূল্যবোধগুলিও গুরুত্বপূর্ণ। আইনের যুক্তিসঙ্গততা সমাজের মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সামাজিক চাহিদা ও মানবিক মূল্যবোধ সকল সমাজে সমান নয়। স্বভাবতই আইনের যুক্তিসঙ্গততাও সকল সমাজে অভিন্ন নয়। বিশেষ একটি আইন কোন একটি সমাজে যুক্তিসঙ্গত প্রতিপন্ন হতে পারে; সংশ্লিষ্ট আইনটি অন্য একটি সমাজে যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত নাও হতে পারে।
আইনের সমান সংরক্ষণ : যুক্তিসঙ্গততা ছাড়াও আইন হবে সকলের জন্য সমান। আইন বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। একটি জনসম্প্রদায়ের সকলের কল্যাণ সাধনই হল আইনের উদ্দেশ্য। সুতরাং সকলের জন্য আইনের সমান সংরক্ষণ আবশ্যক। তবে আইনের সমান সংরক্ষণের অর্থ এই নয় যে, প্রত্যেকের জন্য অভিন্ন আইন থাকবে। যুক্তিসঙ্গত ভিত্তিতে পৃথকীকরণ করা যেতে পারে। সমান অবস্থার সকলের জন্য আইন হবে সমান। কিন্তু অসমান অবস্থার ব্যক্তিবর্গের জন্য আইন হবে অসমান। অর্থাৎ সমপর্যায়ভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য আইন হবে একই প্রকার এবং তা একইভাবে প্রযুক্ত হবে। জেনিংস এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…that among equals the law should be equal and should be equally administered, that like should be treated alike. “
অন্যায় আইনের প্রতিবাদ: আইন হবে যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত। আইনের যুক্তিসঙ্গততা ও ন্যায়সঙ্গততা সুনিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়নের পদ্ধতি তদনুযায়ী নির্ধারিত হওয়া দরকার। আইন প্রণয়নের প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত হওয়া আবশ্যক। এই কারণে বলা হয় যে আইন প্রণয়নের অধিকার ও ক্ষমতা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত থাকবে। তবে আইনসভায় জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সব সময় আইনসঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত আইন প্রণয়ন করবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে অন্যায়, অযৌক্তিক এবং জনবিরোধী আইনও প্রণীত হতে পারে। এ রকম আশঙ্কা অমূলক নয়। এ রকম ক্ষেত্রে জনগণ জনবিরোধী আইনের প্রতিবাদ করবে। এবং এই প্রতিবাদই হবে আইনগত ন্যায়।
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা: আইনগত ন্যায় বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। দেশের বিচারব্যবস্থা হবে স্বাধীন, নির্ভীক ও নিরপেক্ষ। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের ন্যায়সঙ্গততা নির্ধারণের জন্য বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষার ক্ষমতা আদালতের হাতে থাকতে হবে। এ রকম অবস্থায় আইনসভার সঙ্গে আদালতের বিরোধের আশংকাকে অস্বীকার করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আইন ও বিচারবিভাগের মধ্যে বিরোধ বাধলে আইনের যুক্তিসঙ্গততা ও ন্যায়সঙ্গততা নির্ধারণের চূড়ান্ত ক্ষমতা ও অধিকার থাকবে জনসাধারণের হাতে। বিচারব্যবস্থার নির্ভীকতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। বিচারপতিদের নিয়োগ, কার্যকাল, বেতন ও চাকরির অন্যান্য শর্তাদি বিচারপতিদের স্বাধীন ভূমিকার সহায়ক হওয়া দরকার। আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে দাবি করা হয় যে, বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার সকলের কাছে সহজলভ্য হওয়া আবশ্যক। বিচার-বিভাগীয় প্রক্রিয়া-পদ্ধতি সরল প্রকৃতির হবে এবং মোটেই ব্যয়সাধ্য হবে না। জটিল প্রকৃতির বিলম্বিত ও ব্যয়সাধ্য বিচারব্যবস্থা আইনগত ন্যায়ের সহায়ক নয়। আইনের সমান সংরক্ষণের ব্যবস্থা সকলের কাছে, এমনকি দরিদ্র মানুষের কাছেও সহজলভ্য হওয়া দরকার।
আইনের বৈধতা ও নৈতিক মূল্য: আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে আইনের অনুশাসন, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। শুধু তাই নয়, সমকালীন সামাজিক সচেতনতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামগ্রিক মূল্যবোধ প্রচলিত আইনের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া দরকার। পরিবর্তনশীল সামাজিক মূল্যবোধ আইনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত না হলে সংশ্লিষ্ট আইন সামাজিক প্রগতির পরিপন্থী প্রতিপন্ন হবে। এবং এ রকম আইনকে কার্যকর করা যাবে না, বাতিল করতে হবে। ফ্রিডম্যান বলেছেন: “Law must respond to social change of it is to fulfil its function as a paramount instrument of social. order.” আইন ন্যায়বিচারের অনুগামী হবে, ন্যায়বিচার আইনের মধ্যে প্রতিফলিত হবে। বার্কারের অভিমত অনুসারে আইন বিধিসম্মত এবং যুক্তিসঙ্গত হবে। অর্থাৎ বৈধতার সঙ্গে আইনের নৈতিক মূল্যও থাকা দরকার। তিনি বলেছেন: “Ideally law ought to have both validity and value.” ন্যায়ের ধারণা এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারলে আইন বিশেষভাবে কার্যকর হবে। আইনগত ন্যায়ের ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বার্কার ন্যায়-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের কথা বলেছেন। তা ছাড়া বার্কার রাষ্ট্রীয় আইন (Positive law) এবং প্রাকৃতিক আইন (natural law)-এর মধ্যে পার্থক্যের কথাও বলেছেন।
ন্যায়ানুসারে আইন ও আইনানুসারে ন্যায়: পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, দুটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইনগত ন্যায়ের কথা বলা হয়ে থাকে – (১) ন্যায়ানুসারে আইন (law according to justice) এবং (২) আইনানুসারে ন্যায় ( Justice according to law)। প্রথম ক্ষেত্রে আইন ন্যায়ের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এ ক্ষেত্রে আইনের মূল বিষয় বিচার-বিবেচনা করে দেখা হয় তা ন্যায়-ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন অনুসারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এবং এ ক্ষেত্রে আইনের বৈধতা প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না।
Leave a comment