কার্যাবলী ও পদ্ধতির উপর দলের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ভরশীল:

রাজনীতিক দল সরকারী ক্ষমতা দখল, সরকার গঠন ও সরকারী ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকে। এই উদ্দেশ্যে নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে তার সমর্থনের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত ও সুদৃঢ় করার জন্য সর্বতোভাবে উদ্যোগী হতে হয়। এবং তার জন্য রাজনীতিক দল তার সাংগঠনিক কাঠামোকে সুসংগঠিত করে। রাজনীতিক দলের এই সাংগঠনিক কাঠামোর বিষয়টি মোটেই সহজ সরল নয়। এ বিষয়ে কোন সর্বজনগ্রাহ্য কোন সাধারণ তত্ত্ব নেই। দল ভেদে সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর নিজস্ব প্রকৃতি বা ধরন আছে। এই কারণে রাজনীতিক দলগুলির সাংগঠনিক কাঠামোগত বৈসাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো দলের কার্যপদ্ধতি ও কার্যাবলীর উপর নির্ভরশীল। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “The structures of political parties relate very closely to the functions and the methods political parties employ to realise their aim of capturing or retaining political power.” সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দল তার রাজনীতিক সমর্থনের পরিধিকে প্রসারিত করার জন্য এক ধরনের দলীয় কাঠামো গড়ে তোলে। অপরপক্ষে শহর-কেন্দ্রিক রাজনীতিক এলিটদের বিরুদ্ধে যে রাজনীতিক দল গা ঢাকা দিয়ে বা গেরিলা কায়দায় গ্রামাঞ্চল থেকে তৎপরতা পরিচালিত করে, তাদের দলীয় সংগঠন পৃথক প্রকৃতির। কিছু রাজনীতিক দল আছে যেগুলি নাগরিকদের ব্যাপক গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণে বিশ্বাসী। এই সমস্ত দলের সাংগঠনিক কাঠামো, অন্তত তত্ত্বগতভাবে অধিকতর তান্ত্রিক। আবার এমন রাজনীতিক দলও আছে যেগুলি বিদ্যমান রাজনীতিক এলিটদের ক্ষমতাকে অব্যাহত রাখার পক্ষপাতী। এই সমস্ত দলের সাংগঠনিক কাঠামো ততটা গণতান্ত্রিক নয়।

অ্যালান বল রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো আলোচনার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাংগঠনিক কাঠামো:

অ্যালান বল রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো আলোচনার ক্ষেত্রে ফরাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মরিস দ্যুভারজারের সংশ্লিষ্ট আলোচনাকে অনুসরণ করেছেন। Political Par ties শীর্ষক গ্রন্থে দ্যুভারজার এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। বল বলেছেন: “The most important analysis of party structures has been offered by the French political scientist Maurice Duverger.” দ্যুভারজার রাজনীতিক দলের কাঠামোকে প্রাথমিকভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। দলীয় কাঠামোর এই দু’টি ভাগ হল: প্রত্যক্ষ কাঠামো এবং পরোক্ষ কাঠামো। দলীয় সংগঠনের কাঠামো প্রত্যক্ষ হলে সদস্যপত্র পূরণ করে সরাসরি দলের সদস্য হওয়া যায়। সদস্যরা দলের মাসিক চাঁদা দেয় এবং দলের স্থানীয় শাখার সভায় সাধারণত হাজির হয়। সমাজের অন্য কোন গোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়াই সদস্যরা দলের সংগঠনকে গড়ে তোলে। এটাই হল প্রত্যক্ষ সাংগঠনিক কাঠামোর বড় কথা। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক দলের কথা বলা হয়। পরোক্ষ কাঠামোর ক্ষেত্রে রাজনীতিক দল গঠিত হয় বহু ও বিভিন্ন সামাজিক বা পেশাদারী গোষ্ঠীর ঐক্যের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি সরাসরি দলের সদস্য হয় না, দলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোন সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে ব্যক্তি দলের সদস্য হয়। পরোক্ষ কাঠামোর রাজনীতিক দল গঠিত হয় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী, সমবায় সমিতি, শ্রমিক সংঘ প্রভৃতির সমন্বয়ের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ১৯০০ সালে গঠিত গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমিক দলের কথা বলা হয়। মরিস দ্যুভারজারের অভিমত অনুসারে পরোক্ষ কাঠামোভিত্তিক রাজনীতিক দল প্রভাবিত হয় বিশেষ রাজনীতিক মতাদর্শ, মনোভাব ও পরিস্থিতির দ্বারা। মরিস দ্যুভারজারের অভিমত অনুসারে প্রতিটি রাজনীতিক দলের মৌলিক উপাদানসমূহের একটি নির্দিষ্ট ধরন পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতিক দলের মৌলিক উপাদানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দলীয় প্রতিনিধি মনোনয়ন, নির্বাচনের ব্যাপারে নীতি স্থিরীকরণের জন্য সংগঠন প্রভৃতি।

মরিস দ্যুভারজার রাজনীতিক দলের কাঠামো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দলীয় কাঠামোকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। দলীয় কাঠামোর এই চারটি শ্রেণী হল: 

  • (১) কক্যাস (The Caucus); 

  • (২) শাখা (The Branch); 

  • (৩) সেল (The Cell) এবং 

  • (৪) মিলিশিয়া (The Militia)। 

অ্যালান বলের কথায়: “Duverger put forward a fourfold classification of structure: these were 

  • (1) The Caucus; 

  • (2) The branch; 

  • (3) The Cell; 

  • (4) The militia.”

(১) কক্যাস

সীমাবদ্ধ গোষ্ঠী: মরিস দ্যুভারজারের অভিমত অনুসারে কক্যাস হল সাবেকী একটি দলীয় কাঠামো। একে দলের একটি কমিটি বা চক্র বলা যায়। এই চক্র গঠিত হয় সামান্য কিছু সদস্যকে নিয়ে। অর্থাৎ কক্যাসের পরিধি অত্যন্ত সীমিত। কক্যাস গড়ে উঠে প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভ্রান্ত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে। সুতরাং এ হল একটি সীমাবদ্ধ গোষ্ঠী। কক্যাসের সদস্যপদ নীরব নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল। এর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কোন রকম প্রচারের ব্যবস্থা থাকে না। এখানে ব্যাপক গণ-সদস্য পদের বিরোধিতা করা হয়। কক্যাস সদস্যপদ প্রদানের ব্যাপারে সংখ্যার পরিবর্তে গুণগত মানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। অ্যালান বল বলেছেন: “The Caucus or committee is characterised by its small membership and its resistance to seeking wider mass membership; it emphasises quality not quantity in its membership.”

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কক্যাস: কক্যাস দু’ধরনের হতে পারে—প্রত্যক্ষ কক্যাস (direct caucus) এবং পরোক্ষ কক্যাস (indirect caucus)। প্রত্যক্ষ কক্যাসের সদস্যরা স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভিতর থেকে আসেন। ব্যক্তির গুণগত যোগ্যতা ও স্থানীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ কক্যাসের সদস্যরা নির্বাচিত হন। তবে কোন নিয়মের উপর এই নির্বাচন নির্ভরশীল নয়। তা ছাড়া এই সদস্যরা কোন বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসাবে পরিচিত নন। প্রত্যক্ষ কক্যাসের উদাহরণ হিসাবে দ্যুভারজার ফরাসী র‍্যাডিক্যাল পার্টির কথা বলেছেন। অপরদিকে স্থানীয় সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় পরোক্ষ কক্যাস। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ১৯১৮ সালের আগেকার ব্রিটিশ শ্রমিক দলের কথা বলা হয়েছে।

আধা-স্থায়ী: কক্যাসের কার্যাবলী মূলত নির্বাচন সম্পর্কিত কার্যাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ কক্যাসের কার্যাবলী সম্পাদনের সময় বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ। কেবল নির্বাচনের সময়েই কক্যাসের দায় দায়িত্ব সম্প্রসারিত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রচার পরিচালনার উদ্দেশ্যে এর উদ্ভব হয়ে থাকে। নির্বাচনের পরিসমাপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে কক্যাসের প্রয়োজনও আর থাকে না। অর্থাৎ দুটি নির্বাচনের অন্তর্বর্তী সময়ে কক্যাসের দায়দায়িত্বের পরিধি সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই কারণে বলা হয় যে স্থায়িত্বের বিচারে কক্যাস হল আধা-স্থায়ী প্রকৃতির। 

পরোক্ষ কক্যাসের অস্তিত্ব আছে: মরিস দ্যুভারজারের অভিমত অনুসারে ভোটাধিকারের সম্প্রসারিত ফলশ্রুতি হিসাবে কক্যাস ধরনের রাজনীতিক দলগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন: “… the caucus-type party declines with the extension of the franchise.” তবে সাধারণভাবে কক্যাস ধরনের রাজনীতিক দলের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেনি। পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে পরোক্ষ কক্যাস সামঞ্জস্য সাধনে সক্ষম হয়েছে। তাই এই ধরনের কক্যাস তার অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখতে পেরেছে।

(২) শাখা

মরিস দ্যুভারজারের অভিমত অনুসারে শাখা-পার্টির (branch party) উদ্ভাবন ঘটেছে সমাজতন্ত্রীদের দ্বারা। রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে শাখা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে পশ্চিম ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দলগুলি। পশ্চিম ইউরোপে ভোটাধিকারের সম্প্রসারণের ফলশ্রুতি হিসাবে শাখা-পার্টির আবির্ভাব ঘটেছে।অ্যালান বল বলেছেন: “The branch party is the product of the extension of the franchise is Western Europe.”

তার সাংগঠনিক চরিত্রের মধ্যেই শাখা-পার্টির মৌলিকত্ব বর্তমান। শাখা-পার্টির পরিধি ব্যাপকতর। শাখা-পার্টি কক্যাস-পার্টির মত সীমাবদ্ধ উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হয় না। নিজের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য শাখা-পার্টি যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। বল বলেছেন: “Unlike the caucus, the branch party is a mass party secking to enroll the maximum membership.” শাখা-পার্টি সদস্যদের গুণগত যোগ্যতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে না, কিন্তু সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির উপর জোর দেয়। এই পার্টি নিজের শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে সদা সচেষ্ট থাকে।

শাখা পার্টিতে সুনির্দিষ্ট ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগ (hierarchy) পরিলক্ষিত হয়। এখানে দায়িত্বের বণ্টন ব্যবস্থাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কক্যাস-পার্টি বিকেন্দ্রীকরণ নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু শাখা-পার্টি বিকেন্দ্রীকরণ নীতির দ্বারা পরিচালিত হয় না। শাখা-পার্টির পরিচালন ব্যবস্থায় এককেন্দ্রিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সমগ্র সংগঠনের অন্যতম অংশ হিসাবে শাখা-পার্টির কাজকর্ম পরিচালিত হয়। এই কারণে স্বাধিকার ভোগের সুযোগ শাখা-পার্টি পায় না। রাজনীতিক দলের এই ধরনের সাংগঠনিক কাঠামোর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল জার্মানীর সামাজিক গণতান্ত্রিক দল (German Social Democratic Party)। তা ছাড়া এই ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থার সমর্থক ক্যাথলিক এবং রক্ষণশীল দলগুলির মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। অ্যালান বল বলেছেন: “The Branch structure was invented by the European Socialist parties after the extension of the franchise to the working class, and has been imitated by catholic and conservative parties with varying degrees of success.”

(৩) সেল

শাখা-পার্টির থেকে সেলের ভিত্তিতে সংগঠিত পার্টি পৃথক প্রকৃতির। সেল হল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতিসম্পন্ন। এর সদস্যসংখ্যা সীমিত। ক্ষুদ্রাকৃতি এবং সীমিত সদস্যসংখ্যার কারণে সদস্য সংখ্যার উপর দলের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বর্তমান থাকে। তা ছাড়া একই কারণের জন্য দলীয় কর্মসূচীর সাফল্যের সম্ভাবনাও বেশী থাকে। এই ধরনের দলীয় সংগঠনের সদস্যদের বাসস্থানের পরিবর্তে কর্মস্থলের উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাই নির্দিষ্ট অঞ্চলে কর্মরত দলের সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়। দলীয় সদস্যরা কর্মস্থলে নিয়মিতভাবে মিলিত হন, সভা-সমিতি করেন এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেন। তাই এই ধরনের দলীয় কাঠামো প্রকৃতিগতভাবে স্থায়ী হয়। সেলের রাজনীতিক কার্যকলাপ নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হয়। সেলের সংগঠন বহুলাংশে ষড়যন্ত্রমূলক। অ্যালান বল বলেছেন: “The cell-structure was essentially conspirational; it was designed to ensure that the whole party structure was not imperilled by the infiltration or destruction of one cell as there was no contact between individual units at the same level.” সেলের গোপন কাজকর্ম ব্যাপকভাবে রাজনীতিক প্রকৃতির। এবং এই ধরনের দলীয় সংগঠনে সদস্যদের উপর দলের চাপ অত্যন্ত বেশী। ষড়যন্ত্রমূলক প্রকৃতি এবং গোপন কাজকর্মের জন্য এই ধরনের দলকে গুপ্ত দল বলা হয়। শাখা-পার্টির থেকে এই ধরনের দলীয় কাঠামোর কাজকর্মের প্রকৃতি অনেক বেশী রাজনীতিক। এই কারণে নির্বাচনে জয়লাভের বিষয়টিকে এখানে বড় করে দেখা হয় না। বল বলেছেন: “Cell-structured parties tended to regard the winning of elections as of secondary importance.” এ রকম দলের গোপন কাজকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শ্রমিকের মজুরী, কাজের শর্তাদি এবং কলকারখানার আনুষঙ্গিক সমস্যাসমূহ। প্রত্যক্ষ ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ধরনের দল প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের নীতি এই রকম দলে কার্যকর হতে দেখা যায়। ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলিতে এই ধরনের সাংগঠনিক ভিত্তি এখনও পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অনুসরণ করে থাকে। রাজনীতিক দলের সেল-সংগঠনের উদ্ভাবক হিসাবে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলগুলির কথা বলা হয়। অ্যালান বল বলেছেন: “Duverger is third type of structure, the cell, is an invention of the revolutionary socialist parties.” তবে সাম্প্রতিককালে অধিকাংশ অ-সমাজতান্ত্রিক দেশের কমিউনিস্ট পার্টি এই ধরনের দলীয় কাঠামো পরিত্যাগ করেছে এবং সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শাখা-পার্টির সাংগঠনিক ব্যবস্থা বহুলাংশে গ্রহণ করেছে।

(8) মিলিশিয়া

দলীয় সংগঠনের শ্রেণীবিভাগ প্রসঙ্গে মরিস দ্যুভারজার পরিশেষে মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনীর কথা বলেছেন। এই ধরনের দলীয় সংগঠন সামরিক বাহিনীর মত ক্রমস্তরবিন্যস্ত। অ্যালান বল বলেছেন: “Duverger’s fourth form of party structure is the militia type of organisation in which the structure takes on the hierarchical character of an army.” সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মত এই ধরনের সংগঠনের সদস্যদের নিযুক্ত করা হয় এবং সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার উপর জোর দেওয়া হয়। সক্রিয় ও সংরক্ষিত এই দু’ধরনের সদস্য এই ধরনের দলে দেখা যায়। দলের অভ্যন্তরেই এই ধরনের দলের সদস্যদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ থাকে এবং তাদের অসামরিক প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ থাকে। এই ধরনের দলীয় কাঠামো বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। বিপ্লবী দলসমূহ কমিউনিস্ট পার্টির সেল সংগঠনের (Cell structure) মত মিলিশিয়া ধরনের দলীয় সংগঠন অবলম্বন করে। এই ধরনের দলীয় সংগঠনের দু’টি ইউরোপীয় উদাহরণ হল হিটলারের স্ট্রম ট্রুপার্স (Hitler’s Strom Troopers) এবং মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট মিলিশিয়া (Mussolini’s Fascist Militia)।

দলীয় সংগঠন সম্পর্কে দ্যুভারজারের উপরিউক্ত শ্রেণীবিভাজন আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দ্বারা বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছে। বল বলেছেন: “…Duverger does not point out that ‘no political party has ever been exclusively formed on the basis of the militia.’ In fact he goes further, arguing that his four basis types are more likely to be found in mixed rather than pure form.” দ্যুভারজারের দলীয় সংগঠনের শ্রেণী বিভাজনের সমালোচকদের সংখ্যা যেমন অনেক, তেমনি তাঁদের বিরূপ মতামতও বিভিন্ন ধরনের। বল বলেছেন: “Jean Blondel wishes to describe ‘caucus’ and ‘mass’ parties as parties of ‘indirect rule and parties of direct rule’, stressing not membership but the nature of the links between leaders and followers.” ব্লনডেল (Jean Blondel)-এর অভিমত অনুসারে কক্যাস পার্টি হল পরোক্ষ শাসনের দল এবং গণ-ভিত্তিক দল হল প্রত্যক্ষ শাসনের দল। ব্লনডেল সদস্যসংখ্যার উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি। তিনি নেতৃবর্গের সঙ্গে সমর্থকদের সম্পর্কের প্রকৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সদস্যসংখ্যার প্রশ্নটির পরিবর্তে আনুগত্যের প্রকৃতির বিষয়টি এ ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

ম্যাকেঞ্জি (R. T. McKengie) গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিক দলগুলির সাংগঠনিক কাঠামো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর এই বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাকেঞ্জির উদ্দেশ্য ছিল গ্রেট ব্রিটেনের প্রধান দুটি রাজনীতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ব্যাখ্যা করা। এ বিষয়ে তাঁর সাধারণ সিদ্ধান্ত হল যে, ব্রিটেনের দুটি রাজনীতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক ব্যাপক সাদৃশ্য বর্তমান। অথচ এই দুটি দলের মধ্যে তত্ত্বগত বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে সাংগঠনিক কাঠামোতে পার্থক্য বর্তমান। গ্রেট ব্রিটেনে ক্ষমতা সংসদীয় নেতৃত্বের হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। মিচেলস (Robert Michels)-এর অভিমত অনুসারে সামাজিক গণতান্ত্রিক দলগুলি (social democratic parties)-তেও অভিজাততান্ত্রিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত রাজনীতিক দলের মধ্যেও সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতৃবর্গের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে দেখা যায়।

অ্যালান বল রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে কতকগুলি বিষয় বিচার বিবেচনা করার কথা বলেছেন। এই বিষয়গুলি হল: 

  • (১) নেতৃত্বের ভূমিকা এবং তা বাছাই করার পদ্ধতি (“The role of the leadership and the method of selecting it.”); 

  • (২) সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রিকতার মাত্রা (“The degree of organisational centralisation.”); 

  • (৩) দলীয় কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নেতৃত্বের ক্ষমতা, শৃঙ্খলা সম্পর্কিত ক্ষমতার ব্যাপ্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ (“The power of the leadership in relation to the rank and file; the extent of disciplinary power; participation in decision-making and policy initiation.”); 

  • (8) দলীয় আমলাতন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ (“The Control of the party bureaucracy.” 

  • (৫) সংসদীয় শাখার সঙ্গে দলের অবশিষ্ট অংশের সম্পর্ক (“The relationship of the parliamentary wing to the rest of the party.”); এবং 

  • (৬) সদস্যপদের ভিত্তি ও ব্যাপ্তি (“Basis and extent of membership)।