অ্যারিও পজেটিকা : মূলত একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ যেখানে কবি মিলটন নয়, বরঞ্চ দেখা মেলে রাজনৈতিক এবং সামাজিক চিন্তাভাবনায় মগ্ন মননশীল মিলটনের। ১৬৪৪ খ্রিঃ রাজশক্তি বনাম জনশক্তি যে প্রবাল দ্বন্দ্ব ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিবারকে উত্তপ্ত করে তুলেছিল সেই দ্বন্দ্বে মানুষের পক্ষ নিয়ে মিলটন রচনা করেন ‘অ্যারিও পজেটিকা’। যার আক্ষরিক অর্থ ‘সভাস্থল’। এই গ্রন্থটিতে মিলটন মানুষের মত প্রকাশের ওপর রাজশক্তির হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। পার্লামেন্টের সদস্যদের উদ্দেশ্য করে লেখা এই প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়েছে মিলটনের চিন্তাশীলতা, এবং যুক্তির অবিংসবাদিতা।


ওথেলো : ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাসে রানি এলিজাবেথের যুগকে স্বর্ণময় যুগ বলে অভিহিত করা হয়। ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নাট্য প্রতিভা উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাট্য প্রতিভার হিরন্ময় আলোতে উদ্ভাসিত ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাসের এই পর্ব। কমেডি এবং ট্র্যাজেডি দু’ধরনের নাট্যরচনাতেই শেকস্‌পিয়র সিদ্ধ হস্ত হলেও মূলত ট্র্যাজেডি রচনার ক্ষেত্রে তার প্রতিভার বিকাশ সর্বোত্তম। শেকসপিয়রের শ্রেষ্ঠতম ট্র্যাজেডির মধ্যে ‘ওথেলো’ অন্যতম। নায়ক প্রধান এই ট্র্যাজেডি কেন্দ্রীয় চরিত্র ওথেলো, দেসদিমোনা এবং খলনায়ক ইয়াগো। পরিবার কেন্দ্রিক এই ট্র্যাজেডিতে বর্ণিত হয়েছে ভেনিসের সেনাপতি ওথেলো এবং দেসদিমোনার একনিষ্ঠ প্রেম এবং সন্দেহের বশে নায়ক ওথেলো কর্তৃক নায়িকা দেসদিমোনা হত্যা। তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ওথেলো যখন দেসদিমোনার থেকে দূরে রয়েছেন তখনই খলনায়ক ইয়াগো সুকৌশলে দেসদিমোনা এবং ওথেলো সম্পর্কের মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করেন। সেই সন্দেহের বশে দেসদিমোন শেষ অবধি ওথেলোর হাতে খুন হন।

নিতান্ত ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নির্ভর এই নাটকটি শেকস্‌পিয়রের প্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন। সমস্ত নাটকটিতে যে ট্র্যাজিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে তার অন্যতম কারণ শেকস্পিয়রের ট্র্যাজিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে অপূর্ব দক্ষতা। প্লেটোনিক লোভ বা নিষ্কাম ভালোবাসার এক অনুপম প্রতিধ্বনি অনুরোণিত হয় দেসদিমোনাকে খুন করতে ঔদ্ধত ওথেলোর কণ্ঠে : “T’II kill thee and love thee after.” মহৎ হৃদয় ও ওথেলোর মধ্যে যে মারাত্মক এটি বিরাজমান সেই সন্দেহের পরিণামেই তার পতন তরান্বিত হয়। সমালোচক A.C. Bradley অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, শেকস্‌পিয়রীয় নাটকের পতন দর্শকের মনকে আচ্ছন্ন করে এক “সব হারানোর (sense of loss)” অনুভূতি।


হ্যামলেট : এলিজাবেথীয় যুগে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার উইলিয়াম শেকস্‌পিয়র রচিত ‘হ্যামলেট’ নাটক শেকসপিয়রের শ্রেষ্ঠতম নাট্যকীর্তি বলে পরিগণিত হয়। বিয়োগান্তক এই নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘হ্যামলেট’। ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটের পিতা তার কাকার হাতে নিহত হন এবং তিনি হ্যামলেটের মাকে বিয়ে করেন। কবি এবং দার্শনিক হ্যামলেট পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন কিন্তু তার প্রেয়সী ওফেনিয়ার মৃত্যু আঘাত সহ্য করতে না পেরে নিজেও বিষ পান করেন।

আধুনিক যুগের সমস্যামূলক নাটকের বীজ সম্ভবত রোপিত হয়েছিল শেকস্‌পিয়রের হাতেই হ্যামলেট নাটকে। মনস্তাত্ত্বিক এই নাটকটির ব্যাখ্যা এবং সংজ্ঞা যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন হ্যামলেট শেকস্‌পিয়রের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিক নায়ক। হ্যামলেটের পতনের বীজ, শেকসপিয়রের ট্র্যাজিক নাট্যের রীতি অনুযায়ী নিহিত রয়েছে হ্যামলেটের চরিত্রে মধ্যেই। হ্যামলেট বীর হওয়া সত্বেও তিনি অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং “To be or not to be”-এর দোলাচলে দোদুল্যমান। আর এই অতিরিক্ত ভাবালুতা এবং দোদুল্যমানতার জন্যই হ্যামলেটের পতন তরান্বিত হয়েছে। সমস্যামূলক এ নাটকে শেকসপিয়র জটিল মানসিক সম্পর্কগুলিকে নৈতিকতার এবং অনৈতিকতার তুলাদণ্ডে বিচার করেছেন। নাটকটির অন্যতম চরিত্র পোলনিয়াস-এর মাধ্যমে শেকস্‌পিয়র কিছু অমর বার্তা পাঠিয়েছেন মানুষের কাছে। হ্যামলেট নাটকটির যুগে যুগে নতুন ব্যাখ্যাকে লক্ষ্য করেই বোধ করি আধুনিক যুগের কবি টি.এস.এলিয়াট (Eliot) এই নাটকটিকে তুলনা করেছেন। লিয়োনার্দো দ্যা ভিঞ্চির অমর কীর্তি মোনালিসার দুর্বোধ্য হাসির সাথে।

দ্যা টেমপেস্ট : শেকপিয়রের নাট্য রচনাকালের চতুর্থ পর্বের রচনা ‘দ্যা টেমপেস্ট’। রচনাকাল ১৬১১ খ্রিঃ। মিলনান্তক এটি নাটকটির আদ্যোপান্ত বিরাজমান কল্পনা এবং রোমান্সের যুগলবন্দি।

বিলানের ডিউক প্রসপেরো তাঁর ভাই অ্যাস্টনিও-র ষড়যন্ত্রে রাজ্যচ্যুত ও বিতাড়িত হন। তিনি সামান্য কিছু বইপত্র কন্যা মিরান্দাকে নিয়ে একটি ভাঙা নৌকায় সমুদ্রে অজানা উদ্দেশ্যে ভেসে পড়ে। ভাসতে ভাসতে এক দ্বীপে গিয়ে ওঠেন। প্রসপেরো যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, তিনি সেই যাদুবিদ্যার প্রভাবে সেই দ্বীপের সমস্ত দৃশ্য-অদৃশ্য প্রাণীদের বশীভূত করেন। এক সময় জাহাজডুবির ফলে ওই দ্বীপে এসে পৌঁছান নোপ্লস্ এর যুবরাজ ফর্দিনান্দ এবং প্রসপেরোর ভাই অ্যান্টোনিও। নির্জন দ্বীপে ফার্দিনান্দের সঙ্গে মিরান্দার দেখা হয়, প্রসপেরোর সম্মতিক্রমে উভয়ের বিয়ে হয়। পারস্পরিক ক্ষমা ও মিলনের মধ্যে দিয়ে নাটকটি পরিসমাপ্তি হয়।

শেকসপিয়রের এই নাটকটিতে অতি প্রাকৃতিক চরিত্রের অবতারণা বিভিন্ন ভাবে সমালোচিত হয়েছে। অনেক সমালোচক একটি “কুংস্কারপূর্ণ ভূত প্রেতের গল্প” বলে তাচ্ছিল্য করেছেন। কিন্তু এধরনের সমালোচনার পূর্বে স্মরণ রাখতে হবে শেকপিয়রের সমসাময়িক কালের কথা। অশিক্ষা এবং কুসংস্কার আচ্ছন্নের জন্য দর্শকদের কথা মাথায় রেখে শেকস্‌পিয়র এই নাটকটিতে অতিপ্রকৃতিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু তৎসত্বেও শেকস্‌পিয়রের নাটকটি দর্শকদের মনকে নিয়ে যায় কেন এক রূপকথার দেশে। যেখানে বিস্ময়, অন্ধবিশ্বাস এবং অলৌকিকতা পাশাপাশি বিরাজমান। শেকপিয়রের এই নাটক থেকে মানব চরিত্রের প্রতি নাট্যকারের প্রখর অন্তর্দৃষ্টি নাটকটিকে অন্যান্য নাটকের মতনই স্বতন্ত্র দান করেছে। ভাষার বিস্ময়কর ব্যবহার শেকসপিয়রের ঐশ্বর্য। এই নাটকটিও তার ব্যতিক্রম নয়। শেকসপিয়রের সর্বজনীনতা এখানেই যে তিনি মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি ভাবাবেগকে স্পর্শ করেছেন। জীবনকে তিনি দেখছেন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। সেদিক থেকে বিচার করলে ‘দ্যা টেমপেস্ট’ জীবনের প্রতি শেকপিয়রের দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম প্রকাশ। তাই সমালোচকদের সমালোচনা সত্বেও মিলনান্তক এই নাটকটির জনপ্রিয়তা আজও অক্ষুণ্ণ