কমেডি অব ম্যানার্স (সামাজিক কমেডি) :
যে কমেডিতে সমাজের ধর্ম, রীতিনীতি, জীবনাচরণ, রাষ্ট্রনৈতিক জীবন ইত্যাদি কৌতুকে, বিদ্রূপে ও বাগ্-বৈদগ্ধ্যে উদ্ঘাটিত হয় তাকেই আমরা কমেডি অব ম্যানার্স’ বা সামাজিক কমেডি বলতে পারি। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের রেস্টোরেশন যুগের নাট্যকার জর্জ ইথারেজ-এর নাটকে কমেডি অব ম্যানার্সের সূত্রপাত। ইথারেজের She Would if She Could, The Man of Mode, ড্রাইডেনের Marriage-la-Mode, ওয়াইচার্নির The Country Wife ও The Plan Dealer, কনগ্রিভের Love for Love, The Way of the World প্রভৃতি নাটকে রাজসভাসদ ও অভিজাত শ্রেণীর নারীপুরুষদের, ফরাসী দেশের সভ্যতা, শিষ্টাচার, বুদ্ধির সূক্ষ্মতা ও আলাপচারিতায় সরস পরিহাস ও বাক্চাতুর্যের অনুকরণ, বিলাসলীলা, নৈতিক শিথিলতা, ভোগবাসনার মত্ততা লাম্পট্য, হৃদয়ানুভূতি, দাম্পত্য-প্রেম সতীত্ব, গার্হস্থ্য জীবনের শুচিতা প্রভৃতি সম্পর্কে ব্যঙ্গ ও অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব ইত্যাদি চিত্রিত হয়েছে। এককথায় বলতে পারি, এইসব নাটকগুলি সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের সমাজের দর্পণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেরিডান-এর The Rivals সম্ভবত এই ধারার শ্রেষ্ঠ নাটক। দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’, অমৃতলাল বসুর ‘‘তাজ্জব ব্যাপার’ রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘মানময়ী গার্লস্ স্কুল’, প্রমথনাথ বিশীর ‘মৌচাকে ঢিল’ প্রভৃতি বাঙলা কমেডি অব ম্যানার্সের উদাহরণ। অবশ্য তাদের মধ্যে কোনও নাটককে প্রহসনরূপেও চিহ্নিত করা যায়।
সামাজিক কমেডির মধ্যে প্রহসনের মেজাজ ও ভঙ্গি থাকলেও তা যে স্বরূপগত বৈশিষ্ট্যে প্রহসন থেকে স্বতন্ত্র, মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র সঙ্গে দীনবন্ধুর ‘’সধবার একাদশী’ তুলনা করলেই বোঝা যায়। মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র দ্বারা ‘সধবার একাদশী’ অনুপ্রাণিত হয়েছিল সন্দেহ নেই। মধুসূদনের নাটকটি পুরোপুরিভাবেই গ্রহসন, ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি শিক্ষাভিমানী তরুণদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও সভ্যতার অহংকারের অন্তঃসারশূন্যতা প্রদর্শনের জন্য এই নাটকে শুধু কয়েকটি দৃশ্য পরস্পর গেঁথে তোলা হয়েছে, কাহিনীর যোগসূত্র অত্যন্ত শিথিল, চরিত্র-বিকাশের দিকেও নাট্যকারের কোনও লক্ষ্য ছিল না। ‘সধবার একাদশী’তে সে যুগের উচ্ছৃংখল, মদ্যাসক্ত ও লম্পট তরুণদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক চিত্র থাকলেও তা নিছক প্রহসনে পর্যবসিত হয়নি, তার মধ্যে নাটকের কাহিনীর বিকাশ ও পরিণতি চোখে পড়ে। মূল চরিত্র নিমচাদ দত্ত উচ্চশিক্ষিত ও সৎ হয়েও মদের প্রতি আসক্তির জন্য অধঃপতনের পংকস্তরে তলিয়ে গেছে, কিন্তু নিজের ভ্রষ্টতা ও তার থেকে ভ্রষ্টচারী বন্ধুদের সংসর্গের মাঝখানেও সে তার বিবেক ও আত্মসমালোচনার শক্তিকে হারায় নি, মাতলামির ঝোঁকে তার আপাত হাস্যকর উক্তিগুলির মধ্য দিয়ে তার মনোবেদনা, আত্মগ্লানি ও আত্মসমালোচনা গভীর অর্থপূর্ণ রূপ পেয়েছে; তার পরিহাস, বাক্চাতুর্য, রঙ্গব্যঙ্গ ইত্যাদির পশ্চাতে তার বেদনার অশ্রুর আভাস আমাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন : “নিমচাঁদ দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মানবের রহস্যময় দ্বৈতসত্তার অতুলনীয় প্রতিচ্ছবি। এই একটি চরিত্রের দ্বারা প্রহসন উচ্চাঙ্গের কমেডিতে রূপান্তরিত হইয়াছে।”
প্রহসন :
ইংরেজিতে Farce (ফার্স) বলতে যে ধরনের রঙ্গব্যঙ্গময় চরিত্র অপেক্ষা ঘটনার বা দৃশ্যসংস্থানের প্রাধান্য, মানবজীবনের খন্ডাংশের অতিরঞ্জিত চিত্র ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য সংকলিত নাটক বোঝায়, বাঙলায় আমরা তাকেই প্রহসন বলে থাকি। সমাজে কুরীতি সংশোধনের জন্য রহস্যময় ঘটনাসংবলিত হাস্যপ্রধান একাঙ্কিকা নাটককে সংস্কৃত আলংকারিকেরা প্রহসনরূপে অভিহিত করেছেন। কমেডির মত হাস্যরসের আবরণে সমাজ বা চরিত্র সমালোচনার মননশীলতা প্রহসনে পাওয়া যায় না। দর্শক, পাঠককে নিছক কৌতুকরসের খোরাক জোগানোই এই জাতীয় রচনার লক্ষ্য। কমেডির মত ফার্স বা প্রহসন সামাজিক আচরণ সম্পর্কে মন্তব্য বা সমালোচনা উপস্থাপিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে না। বাঙলা ভাষায় হাসি, তামাসা, রঙ্গরস, ভাঁড়ামো ইত্যাদি হাস্যরসের একটি সাধারণ লক্ষ্য হল, তাদের মধ্যে যে হাসির উত্তেজনা আছে, সেটি সম্পূর্ণরূপেই বাইরের ব্যাপার, বাইরের আচরণ বা কাজের উদ্ভটতা, কথার কায়দা, কোনও চরিত্রের বাতিক বা উৎকেন্দ্রিকতার হাস্যকরতা ইত্যাদিই তার প্রাণ। প্রহসনের বৈশিষ্ট্যও তাই। কোনও চরিত্রের আকস্মিক আবির্ভাবের বিস্ময়, কোনও রহস্যের উদ্ঘাটন, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি বা কথার পুনরাবৃত্তি, চরিত্রের মুদ্রাদোষ, খেয়াল বা উৎকেন্দ্রিক স্বভাব প্রভৃতির মাত্রাতিরিক্ত অতিরঞ্জন ইত্যাদির সাহায্যে প্রহসনে কৌতুকরস সৃষ্টি করা হয়। প্রহসন রচয়িতারা কখনো কখনো অসম্ভব বা সম্পূর্ণ উদ্ভট বিষয়ে কিংবা অতিরঞ্জিত কল্পনার আশ্রয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করেন।
গ্রীক নাট্যকার এরিস্টোফেনিসের The Frogs ও অন্যান্য নাটক প্রাচীন প্রহসনের উদাহরণ। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসী সাহিত্যে প্রহসন বা প্রহসনধর্মী রচনার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়, এই প্রসঙ্গে মলিয়েরের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। ষোড়শ শতাব্দীর ইংরেজ নাট্যকার জন হেডের রচনায় আমরা প্রথম ইংরেজী প্রহসনের লক্ষণ অল্পবিস্তর পরিমাণে প্রকাশিত হতে দেখি। শেক্সপিয়ারের Merry Wives of Windsor 3 Comddy of Errors প্রহসনের উদাহরণ। সপ্তদশ শতাব্দীর থেকেই প্রহসন নাট্য-সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখারূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। বাঙলা সাহিত্যে মধুসূদনের ‘একেই বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, দীনবন্ধু মিত্রের ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘কল্কি অবতার’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য প্রহসন।
প্রহসনেও কখনও কখনও সমাজ সমালোচনার বিরূপ বা করুণরসের আমেজভরা খাঁটি হিউমার বা গভীর হাস্যরসের স্পর্শ অনুভব করা যায়। দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনগুলিতে লঘু হাস্যের অন্তরালে এই গুণ আছে বলেই সেগুলি অমৃতলাল বসুর লঘু তরলহাস্যরসপ্রধান প্রহসন অপেক্ষা অধিকতর শিল্পগুণ সমৃদ্ধ। তাঁর বিয়ে পাগলা বুড়ো’ প্রহসনে বৃদ্ধ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বিবাদ করে, তরুণ সেজে নকল বাসর ঘরে নকল শালাজদের কানমলা সহ্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করেও যখন হঠাৎ ‘মরে গেচি। ও রামমণি’ বলে তার বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র আশ্রয় বয়স্থা বিধবা কন্যার নাম ধরে চীৎকার করে ওঠে, তখন সেই হাস্যরসে আর এক রসের সঞ্চার হয়। নিজের বার্ধক্যকে যে বৃদ্ধ লোভে মোহে অস্বীকার করে বিগত যৌবনের অভিনয়ে রত, সে যে কিছুতেই তার জরাকে ফাঁকি দিতে পারছে না, নিয়তির সঙ্গে কঠিন, মর্মান্তিক সংগ্রামে বিমূঢ় মানুষের এই অবস্থা যেমন হাস্যকর, তেমনি করুণ ; তার অন্তরালে নাট্যকারের গভীর সহানুভূতিই লক্ষ্য করি। এই বিশুদ্ধ হিউমারই দীনবন্ধুর প্রহসনকে হৃদয়গ্রাহী জীবনালেখ্য করে তুলেছে।
নাটকীয় একোক্তি :
একোক্তি বা স্বগতোক্তির ধারণা আমরা মূলত পেয়েছি monologue থেকে, এই শব্দটি যেসব বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাদের পশ্চাদপটভূমিতে যে সাধারণ অর্থ থাকে তা হল, একজন ব্যক্তি একাকী কথনরত, তার সামনে শ্রোতৃমন্ডলী থাকতে পারে, নাও পারে। কবিতার মধ্যে একোক্তি সন্নিবিষ্ট হয়, আবার কখনও কখনও সমগ্র কবিতাটিই একোক্তি, একটি ব্যক্তির স্বগত ভাষণের রূপ নেয়। কবিতায় বা উপন্যাসে ব্যক্তির চিন্তা বা আবেগ অনুভূতি যখন একোক্তির রূপ নেয়, তখন তার মধ্যে একটি ব্যক্তির কণ্ঠের উচ্চারণ আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা দেয়। স্বাভাবিক ভাবেই নাটকে একোক্তির এই ব্যক্তিগত উপচার-ই বৈশিষ্ট্য আরও বেশী প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট। নাটকে অনেক সময় কোনও চরিত্রকে একাকী আপন মনে স্বগতোক্তি করতে দেখা যায়। যখন সেই স্বগতোক্তি দীর্ঘ হয়, তখনই তাকে মনোলোগ বলা হয়ে থাকে। বাঙলায় তাকে আমরা ‘নাটকীয় একোক্তি’ (Dramatic Monologue) বলতে পারি। চেখভের Tabacco নাটকে দেখা যায়, একটি বক্তা-চরিত্র দর্শকদের কাছে তার কাজের নৈতিকতা বিচারের ভার কল্পনা করে নিয়ে দীর্ঘ ভাষণ উচ্চারণ করে, এটি নাটকীয় একোক্তির সুন্দর উদাহরণ। এই অসাধারণ নাটকটিকে দুটি কারণে সার্থক একোক্তি বলতে হয়; প্রথমত, নাট্যকার তাঁর বক্তাকে কল্পনা করেছেন; দ্বিতীয়ত, বক্তাও শ্রোতৃমন্ডলীকে কল্পনা করে নিয়েছে। স্বগতোক্তি (Soliloquy) যখন কোনও চরিত্রের মানসে একটা বিচার-বিতর্কের রূপ নেয়, তখন সেটি নাটকীয় একোক্তির (monologue) রূপ ধারণ করে। যেমন হ্যামলেটের বিখ্যাত ‘to be or not to be বিখ্যাত স্বগতোক্তিটি। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ নাট্যকারেরা সকলেই এই ধরনের নাট-চীয় একোক্তি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের গান্ধারীর আবেদনে’র গান্ধারীর এই স্বগত ভাষণ একোক্তির সুন্দর উদাহরণ :
হে আমার অশান্ত হৃদয়, স্থির হও। নতশিরে
প্রতীক্ষা করিয়া থাকো বিধির বিধিরে,
ধৈর্য ধরি। সেদিন সুদীর্ঘ রাত্রি-পরে
সদা জেগে উঠে কাল সংশোধন করে
আপনারে, সেদিন দারুণ দুঃখদিন।
কখনও কখনও এই ধরনের একক চরিত্রের দীর্ঘ স্বগত ভাষণের ভিত্তিতে নাটক রচনা করা হয়, তাকে ‘নাটকীয় একোক্তিমূলক নাট্য’ (dramatic monologue) বলা হয়। গিরিশংকরের ‘শেষ সংলাপ’, কিংবা ‘নানারঙের দিনগুলি’, ‘নাথবতী অনাথবৎ’ প্রভৃতি নাটকীয় একোক্তিমূলক নাটিকার উদাহরণ। কোনও কোনও সমালোচক তাকে আত্মালাপী নাটিকারূপেও অভিহিত করেছেন।
অপেরা :
অপেরা (Opera) শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে Opus থেকে, তার অর্থ সঙ্গীতকারের সুরসংবলিত সঙ্গীত রচনা। অপেরা বা গীতাভিনয়ে একটি পূর্ণাংগ কাহিনী অঙ্ক ও দৃশ্যবিভাগে এবং প্রধানত সঙ্গীতের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। অপেরায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গীতেরই অবিসংবাদিত প্রাধান্য লক্ষণীয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি নাট্যকার John Gay-র The Beggwar’s Opera বিখ্যাত অপেরা, এক ডাকাত ও তার দুই প্রিয়ার চিত্তাকর্ষক কাহিনীর মধ্যে সমকালীন রাজনীতি ও অভিজাত সম্প্রদায়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অপেরার সর্বাপেক্ষা বেশী প্রচলন ছিল ইটালি, জার্মানি ও ফ্রান্সে। জার্মানিতে সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই অপেরার বহুল প্রচলন লক্ষ্য করা যায়, George Friedrich Handel এই শতাব্দীর বিখ্যাত অপেরা-রচয়িতা। Hoffman-এর Unaine ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে মঞ্চস্থ হয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান অপেরা-রচয়িতা হলেন Richard Wagner, তাঁর প্রথম সফল অপেরা Rienzi-এর নায়ক জনগণের একটি বিদ্রোহের নেতা, Jesus you Nazareth-এ তিনি যীশুকে একজন সমাজ-সংস্কারকরূপে উপস্থাপিত করেছেন। Wanger এর The Flying Dutchman ও Tristan and Isolde-ও বিখ্যাত ও জনসংবর্ধিত অপেরা। অপেরা সেই যুগের রোমান্টিকদের খুব প্রিয় ছিল। Wanger এই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, অপেরায় কবিতা, গান, চিত্রকলা, স্থাপত্য শিল্প ও সুর রচনা প্রভৃতির সম্মিলিত ধারায় একটি সামগ্রিক শিল্পকর্ম সৃষ্টিই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর রচনায় সঙ্গীতই সর্বাপেক্ষা বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান নাট্যকার Bertolt Brecht, বর্তমানে যাঁর প্রভাব বিশ্বব্যাপী, তিনিও John Gay-র Begwar’s Opera-কে আধুনিক রূপ দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত Three Penny Opera-য় (১৯৫৮)।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলার রঙ্গমঞ্চের নাটকের অনুকরণে একটি পূর্ণাংগ কাহিনী, নাটকের ন্যায় অঙ্ক ও দৃশ্য বিভাগের সংবলিত এক নতুন ধরনের যাত্রা উদ্ভূত হয়েছিল, তার মধ্যেই সঙ্গীতেরই প্রাধান্য ছিল। এই যাত্রা অপেরা বা গীতাভিনয় নামে খ্যাত হয়। মনোমোহন বসু নতুন পদ্ধতির যাত্রা ও মঞ্চে অভিনয়যোগ্য নাটকের সমন্বয়ে অপেরা রচনা করেছিলেন, এই রচনাগুলির প্লুটের গঠনরীতি মঞ্চনাটকের মত এবং দীর্ঘ বক্তৃতা ও সঙ্গীত বাহুল্য গীতাভিনয়যোগ্য যাত্রাপালার মত। সেইজন্য তাঁর নাটকগুলি যাত্রাপালারূপেই বেশী অভিনীত হত। মনোমোহন তাঁর ‘হরিশচন্দ্র’ নাটককে অপেরার রূপ দিয়েছিলেন, নাটকে গান আছে আটটি, আর অপেরায় তার সংখ্যা ষোল। ‘পার্থপরাজয়’ একাধারে নাটক ও অপেরা তার গানের সংখ্যা ঊনতিরিশ। ‘যদুবংশ ধ্বংস গীতাভিনয়ের ছাব্বিশটি গান মনোমোহনের নিজস্ব রচনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর যাত্রা পালাকাররূপে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত মতিলাল রায় ‘সীতাহরণ’, ‘ভরতাগমন’, ‘বিজয়চণ্ডী, “নিমাই-সন্ন্যাস ইত্যাদি অনেকগুলি গীতাভিনয় রচনা করেছিলেন। গিরীশচন্দ্র ঘোষও ‘আগমনী’, ‘অকালবোধন’, ‘দোললীলা’, ‘মায়াতরু’ প্রভৃতি কয়েকটি অপেরা রচনা করেছিলেন। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলিবাবা’ বিখ্যাত অপেরা। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ ও ‘মায়ার খেলা’ অপেরা ও গীতাভিনয়ের সার্থক উদাহরণ।
মেলোড্রামা :
‘মেলোড্রামা’ কথাটি বর্তমানে নিম্নস্তরের ট্র্যাজেডি কিংবা স্থূল প্রকৃতিসম্পন্ন শৈল্পিক ত্রুটিপূর্ণ বিয়োগান্ত নাটক অর্থে বোঝায়। কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পৃথক। ‘মেলোস’ অর্থাৎ গীত, ড্রামা অর্থাৎ নাট্যাভিনয়। ইতালীতে এক সময় এক শ্রেণীর গীতি-যুক্ত নাটক রচিত হত— সেগুলিকেই মেলোড্রামার উৎস বলা হয়। প্রথম প্রথম অপেরা অর্থে মেলোড্রামাকেই বুঝাত; পরবর্তীকালে ট্র্যাজেডির স্থূল বা বিকৃত রূপকে ‘মেলোড্রামা’ নামে অভিহিত করা হতে থাকে।
অধ্যাপক নিকল মেলোড্রামা সম্পর্কে লিখেছেন, “Originally the word ‘melodrama’ was introduced to France from Italy as a synonym of ‘opera’ but by the beginning of nineteenth century, it had acquired its later specialized significance—signifying a popular play, with a sensationally serious plot, broken by comic scenes and accompanied throughout by incident music”.
কোন কোন নাট্যসমালোচক বুঝাতে চেয়েছেন যে মেলোড্রামা প্রকৃত অর্থে ট্র্যাজেডির স্থূল ও ব্যর্থ অনুকরণ। এঁদের মতে ট্র্যাজেডি রচনার চেষ্টা ব্যর্থ হলেই মেলোড্রামার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই ধারণা অনেকেই পোষণ করতে চান না এবং এঁরা মনে করেন যে ‘মেলোড্রামা’ আসলে নাটকেরই একটি প্রজাতি। নাট্যকার মেলোড্রামা রচনা করবেন মনে করেই মেলোড্রামা রচনা করেন। নাট্যসমালোচক ব্রুকস ও হিলম্যান এই ধারণা পোষণ করেন। তাঁরা বলেন, সিরিয়াস ড্রামাকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়—
- (১) ট্র্যাজেডি,
- (২) সমস্যামূলক নাটক (Problem play),
- (৩) মেলোড্রামা।
মেলোড্রামায় এক বিশিষ্ট প্রকারের ফলশ্রুতি ঘটে—লৌকিক জীবনের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা, ঔৎসুক্য প্রভৃতি যখন তাৎপর্যহীন ভাবে নাট্য-রূপায়িত হয়— যেগুলিতে হৃদয়াবেগ সৃষ্টি হলেও সমস্যা-সচেতনতা প্রধান ভাবে সৃষ্ট হয় না, সেগুলিকেই ‘মেলোড্রামা’ নামে অভিহিত করা হয়। “মেলোড্রামা ক্রীড়া ব্যাপারের মতই ঔৎসুক্য জনক এবং উত্তেজক অথচ নিছক আমোদজনক বস্তু এবং তা আমাদের মাতিয়ে তোলে বটে, কিন্তু ভাবিয়ে তোলে না। বাইরে তার গাম্ভীর্য যতই থাকে, ভিতরে সে খেলা মাত্র”।
নাট্যসমালোচক এগরি তাঁর আলোচনায় মেলোড্রামার প্রকৃত বৈশিষ্ট্যগুলির কথা আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “In a melodrama the transition is faulty or entirely lacking. Conflict is overemphasized. The characters move with lightning speed from one emotional peak to another-the result of their one-dimensionality, the lack of transition produces melodrama”. তাঁর মতে নাটকের প্রাণ যে দ্বন্দ্ব (conflict) তা মেলোড্রামায় অনুপস্থিত; কেবল তাই নয়–দ্বন্দ্বকে অতিরঞ্জিত করে অনেক সময় তাৎপর্যবিহীন বা স্থূল করে তোলা হয়। মেলোড্রামায় ঘটনা ও চরিত্রের ক্রমবিকাশ প্রদর্শিত হয় না—তার ফলে চরিত্র তার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশে ব্যর্থ হয়। এক কথায় ঘটনার ক্রমবিকাশ, চরিত্রের ক্রম পরিণতি এবং দ্বন্দ্বের ক্রম অভিব্যক্তি প্রভৃতিই ‘মেলোড্রামা’র প্রধান বিশেষত্ব।
অধ্যাপক নিকল তাঁর নাটকের তত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনায় মেলোড্রামার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন।
-
(১) মেলোড্রামায় গীতের প্রাধান্য থাকে।
-
(২) মেলোড্রামায় ঘটনার উপর অনুচিত জোর বা প্রাধান্য থাকে।
-
(৩) মেলোড্রামায় জীবন সম্পর্কে গভীরতর আবেদন বা আত্মিক সংবেদনা সৃষ্টির কথা থাকে না।
-
(৪) মেলোড্রামায় জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয় না—চরিত্রগুলি প্রধানতঃ টাইপ শ্রেণীর হয়।
-
(৫) মেলোড্রামায় সংলাপ অপেক্ষা ঘটনাকেই অত্যধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়।
-
(৬) মেলোড্রামায় করুণ রসের প্রকৃত স্ফূর্তি ঘটে না–করুণ রসের ঘনীভূত রূপটি যেন স্থূল হয়ে অনেকসময় হাসির উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই আলোচনার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে কোন কোন নাট্যকার নাটক রচনা করতে গিয়ে নাট্যরসমূর্তিটিকে প্রকৃতভাবে রূপদান করতে সক্ষম হন না। অনেকটা যেন দেবতা গড়তে গিয়ে বানর গড়ে তোলা। নাটকের মূল কথা যদি দ্বন্দ্বের রূপায়ণ হয়, তবে সেই দ্বন্দ্বের স্বরূপকে নাট্যকার যথার্থভাবে অভিব্যক্ত করে তুলতে চান। কোন নাট্যকার সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে তাঁর নাটককে সার্থক নাট্যসৃষ্টি বলা যাবে না। কিন্তু এ সম্পর্কে বিচারের মাপকাঠি কোথায়, এ নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠবে। নাটকের পরিণতি শোকাবহ (tragic) হলেও যদি অতি চমৎকার রোমাঞ্চকর চরিত্র এবং ঘটনার সন্নিবেশ ঘটে, আর তার ফলে যদি ট্র্যাজেডির গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য বিনষ্ট হয়, তবে সেই জাতীয় নাটক ‘মেলোড্রামা’ বলে গণ্য হয়। কিন্তু বহিরঙ্গ বিচার অপেক্ষা অন্তরঙ্গ লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য বিচার করে তাকে ‘মেলোড্রামা’ আখ্যা দেওয়াই ভাল।
ডঃ সাধনকুমার ভট্টাচার্য এ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন, “…মেলোড্রামা বিচারে নাটকের বিয়োগান্ত বা মিলনান্ত পরিণতির চিন্তা বড় বিচার্য নয়—আসল বিচার্য নাটকের আত্মিক গুরুত্বের অভাবের–অন্তঃসারশূন্যতার মাত্রাটি। যে নাটক অন্তঃসারশূন্য, তার ঘটনা-বিন্যাস যত সুসঙ্গত সমুচিতই হোক আসলে তা অল্প-প্রাণ ও লঘু। আবার যে নাটক অতিমাত্রায় অন্তঃসারবান তার ঘটনাবিন্যাসে যত ত্রুটি-বিচ্যুতিই থাক, তা মহাপ্রাণই বটে। অতএব নাটক ড্রামা কি মেলোড্রামা—এ প্রশ্নের সমাধান করতে নাটকের অন্তঃসারের দিকেই বেশী লক্ষ্য রাখতে হবে–বহিলক্ষণের চেয়ে মর্মের বিচার বেশী করে করতে হবে।”
অ্যাবসার্ড নাটক
‘অ্যাবসার্ড’ শব্দের অর্থ উদ্ভট, অবাস্তব, যাবতীয় জাগতিক যুক্তিপারম্পর্যহীন, অযৌক্তিক, কিস্তৃত, সঙ্গতিবিহীন। তবে শিল্প-সাহিত্যক্ষেত্রে এই ‘অ্যাবসার্ড’ শব্দটির প্রয়োগের বিশেষ অর্থ-তাৎপর্য আছে। বিশেষত নাট্যসাহিত্য বা থিয়েটারের পরিভাষায় ‘অ্যাবসার্ড ড্রামা’ বা ‘অ্যাবসার্ড নাটক’ বলতে এক বিশেষ যুগমানসিকতার প্রতিফলন এবং বিশেষ রূপাঙ্গিক বিশিষ্ট নাটককেই বোঝায়।
‘অ্যাবসার্ড ড্রামা’ সম্পর্কে The Oxford Companion to English Literature-এর বিশ্লেষণ এইরকম—
“Absurd: a term used to characterize the work of a number of European and American dramatists of the 1950s and early 1960s. As the term suggests, the function of such theatre is to give dramatic expression to the philosophical notion of the ‘absurd’… To define the world as absurd is to recognize its fundamentally mysterious frequently associated with feelings of loss, purposelessness, and bewilderment. To such feelings, the theatre of the Absurd gives ample expression, often leaving the observer baffled in the face of disjointed, meaningless, or repetitions dialogues, incomprehensible behaviour, and plots which deny all notion of Logical or ‘realistic’ development.”
[The Oxford Companion to English Literature; Edited by Margarett Drabble: 1997.]
অর্থাৎ—’অ্যাবসার্ড’ শব্দটি ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর প্রথমদিকের বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় এবং আমেরিকান নাট্যকারের নাট্যসৃষ্টির প্রকৃতি নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হত। ‘অ্যাবসার্ড’ থিয়েটার বলতে বোঝায় সেই ধরনের থিয়েটারকে, যেখানে অযৌক্তিক, উদ্ভট-এর দার্শনিক তাৎপর্যকে নাটকীয় অভিব্যক্তির সাহায্যে উপস্থাপিত করা হয়। বিশ্বকে অ্যাবসার্ড বা উদ্ভট অসংলগ্ন হিসাবে প্রতিপাদন করার অর্থ হল বিশ্বের মূল রহস্যাবৃত ও দুরধিগম্য শক্তিকে স্বীকৃতি জানানো এবং এই স্বীকৃতিদান যেন প্রায়শই কোনো ক্ষতি বা ব্যর্থতাবোধ বা বিভ্রান্তির অনুভূতির সঙ্গে দৃঢ়সংলগ্ন। বিশ্বের যাবতীয় যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত বিকাশের ধারণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে অ্যাবসার্ড থিয়েটার অসংলগ্ন, অর্থহীন বা পুনরাবৃত্তিধর্মী সংলাপে, চরিত্রের দুর্বোধ্য আচরণ কিংবা অসংলগ্ন আখ্যানের মধ্য দিয়ে যেন অর্থহীনতার দর্শনকেই ব্যাপকভাবে অভিব্যক্ত করে তোলে।
প্রসঙ্গত Franz Kafka (১৮৩৩-১৯২৪) প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ইয়োনেস্কো অ্যাবসার্ড নাটকের যে বিশ্লেষণ করেছেন, সেটিও দেখে নেওয়া যেতে পারে। ইয়োনেস্কো বলেছেন—
“Absurd is that which is devoid of purpose… Cut off from his religions metaphysical and transcendental roots, man is lost; all his action because senseless, absurd, useless.”
অর্থাৎ, যা কিছু উদ্দেশ্যহীন অসমঞ্জস, তা-ই অ্যাবসার্ড। আধুনিক যুগের মানুষ ধর্মবোধ, অধ্যাত্মচেতনা ও লোকোত্তর আদর্শবিচ্যুত মানুষ সম্পূর্ণ ভ্রষ্ট। সেজন্য তার সমস্ত ক্রিয়াকলাপ আজ অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় এবং খাপছাড়া হয়ে উঠেছে।
অ্যাবসার্ড নাটকের এই ভিত্তি নির্মাণ করেছিল বিংশ শতাব্দীর সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণেই বিংশ শতকের শুরু থেকেই পুরনো বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলি ক্রমাগত ভাঙছিল। একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং শিল্প উৎপাদন বিকাশের ফলে মানুষ ক্রমশই তার পুরনো ধর্মবোধের প্রতি আস্থা হারাচ্ছিল। ব্যক্তিত্ববাদের বিকাশ কখনো কখনো ভুল পথে আত্মকেন্দ্রিকতার বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্বে পথ হারাচ্ছিল। সেইসঙ্গে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা সভ্যতা ও এনলাইটমেন্টের অন্তরালস্থিত মানুষের বর্বরতার স্বরূপটিকে উদ্ঘাটিত করে দিয়েছিল। মানবতাবাদী উদারনৈতিক চিন্তাধারাগুলি বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত অসহায়তার সম্মুখীন হয়েছিল প্রবল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্মুখে। রবীন্দ্রনাথের মতো কল্যাণবাদী কবি-দার্শনিককেও সেই সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা দেখে বলতে হয়েছিল—“শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।” একদিকে উদারপন্থী মানবিক বোধগুলির দুর্বল অসহায়তা, নাৎসী বর্বরতা, অন্যদিকে সোভিয়েতে সমাজতন্ত্রের উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও স্তালিনের প্রবল একনায়কতন্ত্রের নির্মমতা সমগ্র বিশ্বের বিবেকবান সংবেদনশীল চিত্তে এক তীব্র শূন্যতাবোধ সঞ্চারিত করল। ইউরোপ-আমেরিকায় দেখা দিল সমৃদ্ধির আপাত জৌলুসের অন্তরালে গভীর এক পারমার্থিক শূন্যতা। মানবতা, মনুষ্যত্ব, সভ্যতা, শিল্পবিকাশ, প্রযুক্তি উন্নয়ন, সৌন্দর্যসন্ধান, কাব্যের সুষমা, আধ্যাত্মিক প্রশান্তি সমস্তই এক চূড়ান্ত অর্থহীনতার বিষণ্ণতায় ডুবে যেতে চাইল যেন। যেন এই জীবনটার কোনো সদর্থক উদ্দেশ্যই নেই। কেবল আদিম হিংস্রতা ও রিরংসাই যেন জগৎ সত্য। পশুজীবনের জৈবিক স্থূলতার বাইরে আজ যেন মানবজীবনেরও কোনো মহত্তর পরিচয় নেই। কেবল এই আদিমতা, বীভৎসতা, মৃত্যুর কঙ্কাল ঠেলে ঠেলে অনর্থক এক উদ্দেশ্যহীন পদযাত্রা এই জীবন। আলবার্ট কাম্যুর ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’ (১৯৪২) গ্রন্থে যেন যুগগত এই শূন্যতা ও অসহায়তার বোধটাই রূপ নিল সিসিফাস চরিত্রের মধ্য দিয়ে। এখানে দেখানো হল, সিসিফাস একটা ভারী পাথরকে ঠেলে ঠেলে পাহাড়চূড়ায় তোলবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সে নিশ্চিত জানে, কোনোদিনই ওই পাথরটা পাহাড়চূড়ায় পৌঁছে দেওয়া যাবে না। এই অর্থহীনতার নৈরাশ্যই সে যুগের অ্যাবসার্ডবাদীদের জীবনদর্শনের প্রধান কথা।
পাশ্চাত্য দেশে এই অ্যাবসার্ড ভাবনার প্রকাশ ঘটল স্যামুয়েল বেকেট (Samuel Beckit), ইউজিন ইয়োনেস্কো (Eugene Ionesco), আর্থার অ্যাডামভ (Arthur Adamov), জ্যঁ জেনেট (Jean Genet), হ্যারল্ড পিণ্টার (Harold Pinter) প্রমুখের রচনায়। তাঁদেরই অনুসরণ করে অ্যাবসার্ড ড্রামা বিকশিত হল রবার্ট পিঙ্গেট (Robert Pinget), এন. এফ. সিম্পসন (N. F. Simpson), এডওয়ার্ড অ্যালবি (Edward Albee), গুন্টার গ্রাস (Gunter Grass)-এর নাট্যসৃষ্টিতে। মনে রাখতে হবে বেকেট, ইয়োনেস্কো, জেনেটের এই অ্যাবসার্ড ড্রামার ভিত তৈরি হয়েছিল জ্যঁ জিরাদু (Jean Giradoux), জ্যঁ আনুই (Jean Anouith), জ্যঁ পল সার্ত্রে (Jean Paul Sartre), আলবার্ট কাম্যু (Albert Camus)-র রচনায়। এছাড়াও স্ট্রীন্ডবার্গের প্রকাশবাদী নাটক, জয়েস ও কাফকার উপন্যাস, ডাডাইজম ও সুররিয়্যালিজম মতবাদ, ব্রেশট-এর প্রথম পর্বের নাটক ইত্যাদি।
বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে এই অ্যাবসার্ড ড্রামার প্রকাশ ঘটল স্পষ্টভাবেই বেকেট বা ইয়োনেস্কোর অ্যাবসার্ড ড্রামার প্রভাবে। কলকাতার কোনো-কোনো নাট্যগোষ্ঠী তাঁদের অ্যাবসার্ড ড্রামার বাংলা রূপান্তর করে মঞ্চস্থ করে বাংলা থিয়েটারে এক নতুন ধারা বা নতুন স্বাদের সঞ্চার ঘটাতে চাইলেন। যেমন ইয়োনেস্কোর ‘রাইনোসরস্’ নাটকটির বাংলা রূপান্তর ‘গণ্ডার’ মঞ্চস্থ করলেন বঙ্গীয় নাট্য সংসদ ১৯৬৪তে। পরে নাটকটি বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীও মঞ্চস্থ করে। স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গোভো’র বাংলা রূপান্তর ১৯৬৯-এ মঞ্চস্থ হয় শিল্পী যাযাবর গোষ্ঠী কর্তৃক ‘ঈশ্বরবাবু আসছেন’ নামে।
ইয়োনেস্কোর ‘রাইনোসরস্’ বা ‘গণ্ডার’ নাটকে দেখানো হয়েছিল নায়ক বেরেঞ্জা একটি পানশালায় বসে দেখে শহরের রাজপথ দিয়ে একটি গণ্ডার ছুটে গেল। ক্রমে একের পর এক গণ্ডার ছুটে যেতে দেখে বেরেঞ্জা। বেরেঞ্জার চারপাশের সকলেই গণ্ডার হয়ে যেতে থাকে, এমনকি তার প্রিয় বান্ধবীকেও গণ্ডারে রূপান্তরিত হতে দেখে সে। কিন্তু আশ্চর্য, বেরেঞ্জা নিজে মানুষ থেকে যায়। ফলে চারপাশের গণ্ডারসংকুল প্রতিবেশে তার নিজেকেই মনে হতে থাকে খাপছাড়া অস্বাভাবিক। ফ্যাসিজিমের প্রবল পাশবিকতার কাছে সমস্ত মানুষের নিঃশেষে আত্মসমর্পণ ও বিবেকবান মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের বিচ্ছিন্নতা ও অসহায়তাই ‘রাইনোসরস্’ নাটকে প্রদর্শিত।
বিভিন্ন সমালোচকের আলোচনার ভিত্তিতে অ্যাবসার্ড নাটকের চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে আমরা সূত্রবদ্ধ করতে পারি :
(ক) বিশ্বযুদ্ধোত্তর সামাজিক-আর্থিক-রাজনৈতিক এবং পারমার্থিক বিনষ্টির পটভূমিতে সংবেদনশীল মানসের নৈরাশ্যবোধ থেকেই অ্যাবসার্ডবাদের জন্ম। অ্যাবসার্ড নাটকের ভিত্তিভূমি এই সার্বিক নৈরাশ্য বা অ্যাবসার্ডবাদ।
(খ) অ্যাবসার্ডবাদীদের মতে, এই সার্বিক বিনষ্টির যুগে মানুষের বেঁচে থাকা অর্থহীন। এখানে ব্যক্তির অস্তিত্ব বিপন্ন। বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ববোধের যন্ত্রণা মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ অবস্থায় সমগ্র জীবনটাই শূন্যতা ও অর্থহীনতায় ভরা।
(গ) জগৎব্ৰহ্মাণ্ড এক কল্যাণমুখী সুশৃঙ্খল ব্যাপার—এই বিশ্বাস আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে জগতের গতি কিংবা মানবজীবনের ঘটনা-পরম্পরাও আসলে এক পারম্পর্যহীন খাপছাড়া উদ্ভট ব্যাপার।
(ঘ) সর্বব্যাপ্ত অবসাদ, উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপনের একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি, অনপনেয় আশাহীনতার ক্লান্তি, নৈরাশ্যবোধ এবং মৃত্যু-অভীপ্সাই মানবজীবনের সর্বস্ব বলে অ্যাবসার্ড বাদীদের ধারণা।
(ঙ) ফলে অ্যাবসার্ড নাটকে প্রচলিত কাল ঐক্য, স্থান ঐক্য, আখ্যান ঐক্য অস্বীকার করে এক স্বেচ্ছাকৃত সচেতন পারম্পর্যহীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। অর্থাৎ সুনির্মিত বা নিয়মবদ্ধ নাটকের (well made play) বিপরীতে এই ধরনের নাটকে কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক অসংলগ্নতাই প্রাধান্য পায়।
(চ) সংলাপ বা ঘটনার পৌনপুনিকতা জীবনের আদি-মধ্য-অন্তব্যাপী অর্থহীন পুনরাবৃত্তির প্রতিফলন ঘটায় অ্যাবসার্ড নাটকে।
(ছ) মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির আবরণ উন্মোচিত করে মানুষের নগ্ন স্বরূপ, তার হিংস্রতা, জৈব কামনা, পাশব প্রবৃত্তিগুলিকে উদ্ঘাটিত করার প্রবণতা দেখা যায় অ্যাবসার্ড নাটকে।
(জ) অ্যাবসার্ড নাটকে জীবনের বাহ্য ঘটনার অন্তরালস্থিত নির্মম সত্যকে উন্মোচিত করার জন্যই ব্যবহৃত হতে পারে আপাত অবাস্তব নাট্যদৃশ্য। মানুষের গণ্ডার হয়ে যাওয়া বা আসবাবে পরিণত হওয়া কিংবা ঘরে শোয়ানো মৃতদেহের ক্রমপ্রসারণ ইত্যাদি নাট্যদৃশ্য অবাস্তব স্বপ্নের মতোই অসংলগ্ন কিন্তু অবচেতনের গূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনাবাহী।
(ঝ) নিয়মবদ্ধ নাটকের যাবতীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এ নাটক শুধু একটি সার্বিক বিপর্যয়ের বোধকেই পাঠক চিত্তে বা দর্শক চিত্তে সঞ্চারিত করে না, সিসিফাসের মতো বেঁচে থাকার অর্থহীনতাকেও মানবজীবনের অলঙ্ঘ্য নিয়তি হিসাবে প্রতিপাদন করে।
(ঞ) ব্যক্তিপ্রাধান্য বা ব্যক্তিঅস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করে অ্যাবসার্ড নাটক প্রমাণ করে সমস্ত ব্যক্তিজীবনই আসলে একই আদলে গড়া; একইরকম নৈরাশ্যবোধে ক্লান্ত, প্রবৃত্তির তাড়নায় বিকারগ্রস্ত, উদ্দেশ্যহীনতায় বিভ্রান্ত, পরিণামহীন মৃত্যুর অভিমুখে সদা চলমান।
Leave a comment