ভূমিকা: গান্ধীজীর রাজনৈতিক মতাদর্শের আঙিনায় অহিংসা সম্পর্কে তার ধ্যান ধারণা ও চিন্তা দর্শন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অহিংসা নীতি তার নিজের জীবনে প্রয়ােগ করায় তাকে ভারতবাসীর বৃহদংশের মানুষ এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। অহিংসা তাঁর জীবনের ধর্ম। অহিংসা হল তার চিন্তারাজ্যের নির্যাস। গান্ধিজি মনে করতেন, মানুষের দ্বারা অহিংসা নীতি মান্য করাই পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য তৈরি করে। গান্ধীর কাছে অহিংসা কেবলমাত্র একটি নিছক দার্শনিক প্রত্যয় নয়, এটি হল মানব জীবনের শ্বাস প্রশ্বাসের মতো সত্য।

গান্ধীবাদ: পরাধীন ভারতবর্যের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলনের শুকতারা’ ভারতীয় জাতীয় মানসে জাতির জনক’ আখ্যায় ভূষিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত অহিংসার মূর্ত প্রতীক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮ খ্রি.)। গান্ধিজি কোনাে রাষ্ট্রদার্শনিক ছিলেন না, এর জন্যই তিনি কোনাে রাজনৈতিক দর্শন বা মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেননি। গান্ধিজি নিজেই লিখেছেন, গান্ধীবাদ বলে কিছু নেই। কোনাে মৌলিক দর্শন বা নীতির স্রষ্টা হিসেবে আমি কিছু দাবি করি না। গান্ধিজি বলেন, তিনি নিজের মতাে করে দৈনন্দিন জীবন ও সমস্যাবলির ক্ষেত্রে শাশ্বত সত্যকে প্রয়ােগ করার চেষ্টা করেছেন ‘The Story of My Experiments with Truth‘ শীর্ষক রচনায় লিখেছেন, আমার সমস্ত চিন্তা দর্শন যা আমি বলেছি, তাকে আর যাইহােক গান্ধীবাদ বলে অভিহিত না করাই ভালাে।

তার অনুগামীগণ তাঁর চিন্তাভাবনাকে সংকলিত করে ‘গান্ধীবাদ নামে রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করেন। গান্ধিজি, আদর্শ রাষ্ট্র বা সমাজ প্রতিষ্ঠার যে ধ্যান ধারণা প্রচার করেন তাকেই অনেকে গান্ধীবাদ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বাস্তবে গান্ধিবাদ হল একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা একটি জীবনধারা (a way of life)। গান্ধীবাদ কোনাে গোঁড়া মত বা অন্ধবিশ্বাস নয়, এটা হল একটি ভাবের প্রকাশ।

অহিংসা মানে ইতিবাচক ভালােবাসা। অহিংসা মানে অশুভ ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ নয় কিংবা অশুভের সামনে নিষ্ক্রিয়তা বা অলসতা বা অসহায়তা দেখানাে নয়। অহিংসা হল আত্মশক্তি, সত্য এবং সত্যসন্ধানের শক্তি। গান্ধিজির মতে, অহিংসার অর্থ হল চরম নিঃস্বার্থপরতা, শত্রুপক্ষকে ভালােবেসে তার হৃদয় জয় করা। বলা যেতে পারে যে, অপরের কল্যাণের মাধ্যমে পরস্পরের ভালোবাসা সুদৃঢ় শক্তির উপর স্থাপন করাই হল অহিংসা। এই নীতি কোনাে শক্তির দ্বারাই ধ্বংসযােগ্য নয় এ এক মহান আদর্শ। গান্ধিজি তাই অহিংসাকে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই নীতি প্রয়ােগ করেন।

অহিংসার প্রকৃতি : অহিংসা ছিল গান্ধীজীর রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি স্বীকার করেছেন যে, সত্যকে অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই অহিংসা খুঁজে পাওয়া যায়। অহিংসা তার সহজাত ধর্ম নয়। গান্ধিজি অহিংসাকে অসীম, সর্বশক্তিময় এবং ঈশ্বরের প্রতিরূপ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, হিংসা অহিংসার দ্বারাই বশ করা যায়। গান্ধিজির মতে, অহিংসা হল সর্বব্যাপক এক চিরন্তন নীতি যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভালোবাসা প্রসারিত করে। তিনি অন্যায়কারীকে ভালােবাসতে বললেও কোথাও অন্যায়কে ভালােবাসতে বলেননি, পাপীকে ক্ষমা করতে বললেও পাপকে ক্ষমা করতে বলেননি। গান্ধীর অহিংসার ধারণার সঙ্গে প্রেম, ভালােবাসা, সাহস, সংযম ইত্যাদি মানবিক গুণগুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে।

(১) অহিংসা এক ইতিবাচক ধারণা: অন্যর ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকা বা অপরাধ না করা অহিংসা নয়। অহিংসাকে আত্মত্যাগ, সংযম, পরার্থপরতা ও ভালোবাসার প্রতীকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মূল মন্ত্র হল—শত্রু, মিত্র, বিরােধীর হৃদয়কে ভালােবাসার মাধ্যমে জয় করা। গান্ধিজি তার অহিংসা নীতি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করেছিলেন এবং এই প্রয়ােগের মাধ্যমে নৈতিক শক্তির দ্বারা রাজনীতির কদর্য রূপকে এক সুস্থ ও উন্নত রূপ দিতে চেয়েছিলেন।

(২) সত্য এবং অহিংসা ওতপ্রোতভাবে জড়িত: সত্য আর হিংসা পরস্পরের পরিপন্থী। অহিংসা তার কাছে পরম ধর্ম, সত্যের আধার ও সনাতন রুপী। তার মতে, সত্যাগ্রহী সকলপ্রকার বঞ্চনা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত থাকবে, সত্যাগ্রহীর কাছে মিথ্যা কখনােই প্রশ্রয় পাবে না, সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। তিনি এ কথাও বলেছেন যে, অন্যায়ের প্রতিরােধ করার জন্য সত্যাগ্রহী কখনও অন্যায়কারীকে ঘৃণা করবে না। এমনকি তার কোনাে ক্ষতিসাধনও করবে না।

(৩) অহিংসা আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক: গান্ধিজি মনে করতেন অহিংসা হল আধ্যাত্মিক বা নৈতিক শক্তি। তিনি মনে করতেন, পুরােমাত্রায় ঈশ্বরবিশ্বাসী না হলে অহিংস ও নির্ভীক হওয়া যায় না। ঈশ্বরের প্রতি গভীর ও স্থিতিশীল বিশ্বাসই মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস জোগায়।

(৪) অহিংসা কাপুরুষতার স্থান নেই: অহিংসা দুর্বল প্রকৃতির মানুষদের জন্য নয় কারণ, এই প্রকৃতির ব্যক্তিরা অহিংস পথে অবিচল থাকতে পারে না। গান্ধীজীর মতে, দুর্বলতা, ভীরুতা ও কাপুরুষতার পরিত্যাগ করতে পারলেই অহিংসা অনুসরণ করা সম্ভব হবে হাত ধরেই মানবসভ্যতা সাহসী ও সত্যাশ্রয়ী হয়ে উঠতে পারবে।

(৫) অহিংস হল এক জীবন নীতি: অত্যাচার ও অবিচারের প্রতিরােধ করতে গিয়ে একজন অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তি নিজের জীবন বিপন্ন করতে প্রস্তুত থাকবে কিন্তু তার জন্য অন্যের জীবন যেন বিপন্ন না হয় সেদিকেও সেই ব্যক্তি লক্ষ রাখবেন। তাঁর মতে, শুধুমাত্র ঈশ্বরই পারেন কারও জীবন নিতে কারণ তিনিই জীব তথা জীবনের স্রষ্টা (“God alone can take life, because he gives it”)।

(৬) অহিংসা যুদ্ধের বিরােধী: গান্ধিজি অহিংস মন্ত্রে সকলকে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধ বা যে-কোনাে অস্ত্র প্রতিযােগিতার চরম বিরােধী ছিলেন। গান্ধিজি যে-কোনাে প্রকার আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের ঘাের বিরােধী ছিলেন। যুদ্ধকে তিনি ‘অশুভ বলে গণ্য করতেন। তার মতে, অশুভকে অশুভ দিয়ে নয়, তাকে সত্য ও শুভ দিয়ে মােকাবিলা করতে হয়।

(৭) হিংসা ও অহিংসা: কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে গান্ধিজি হিংসার প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করেননি। তার মতে, অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে হিংসার প্রয়ােজন হতেই পারে। যেমনㅡ

  • আত্মরক্ষার জন্য কেউ আক্রমণ করলে তার বিরুদ্ধে),
  • ব্যক্তির অভিভাবকত্বে যারা থাকে তাদের রক্ষা করার জন্য এবং
  • অপরের প্রাণ বাঁচানাের জন্য।

গান্ধীজীর অহিংসা নীতি সমালােচনা

গান্ধীজীর অহিংসার নীতি বিরুদ্ধপন্থীরা বিভিন্নভাবে সমালােচনা করেছেন। যেমন一

[1] গান্ধীজীর অহিংসার তত্ত্ব আধুনিক যুগের বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বর্তমানের রাজনীতি ক্ষমতাপ্রধান হওয়ায় তার অহিংসা নীতি রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রয়ােগের ক্ষেত্রে কার্যত অসম্ভব।

[2] গান্ধিজি অহিংসা তত্ত্বের উপর আধ্যাত্মিকতা অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ায় ধর্ম বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের কাছে তাঁর এই তত্ত্ব একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।

[3] গান্ধীজীর অহিংসা নীতি স্ববিরােধিতা দোষে দুষ্ট। কারণ তিনি অনেকক্ষেত্রে নিজের বক্তৃতার মাধ্যমে নিজেই অহিংসা নীতির সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন আবার সেই নীতিকেই তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমালােচকদের মতে, জাতীয় রাজনীতি এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গান্ধীজীর এই অহিংসার তত্ত্ব একেবারেই কাল্পনিক ও অপ্রাসঙ্গিক বলে চিহ্নিত হয়েছে।

মূল্যায়ন: প্রখ্যাত বিপ্লবী মানবেন্দ্র নাথ রায় গান্ধীর অহিংসা নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন যে, গান্ধীর অহিংসা নীতি জনগণের শক্তি ও সামর্থ্য কে ধ্বংস করে জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এমনকি গান্ধীর মনেও প্রশ্ন ছিল যে, তার অহিংসা নীতিতে সম্পূর্ণ আস্থাশীল মানুষের সংখ্যা কত? তার অহিংসা নীতি ছিল আধ্যাত্মিক বা নৈতিক শক্তির আধারস্বরূপ। সত্যই ছিল তার অহিংসা তত্ত্বের নির্যাস। বলা যেতে পারে, সত্যই ছিল চরম মূল্যবান। সত্য মানুষকে শিক্ষা দেয় যে, মনের সংশয় কিংবা দ্বিধা নিয়ে অহিংসা নীতি গ্রহণ করা যায় না।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, গান্ধীজীর অহিংসা নীতি মানুষের নৈতিক শক্তির জাগরণ ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল। বলাবাহুল্য, তাঁর অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জনগণ ব্যাপকভাবে তাদের মানসিক জাগরণ ঘটাতে পেরেছিল। বর্তমান বিশ্বে আজও এই অহিংসা তত্ত্বটি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। হিংসার ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পেতে সমগ্র বিশ্বের শান্তিপ্রিয় তথা শান্তিকামী মানুষের কাছে এই তত্ত্বটি বিশেষভাবে গ্রহণযােগ্য। গান্ধিজি যেভাবে সত্য ও অহিংসার তত্ত্বকে একসঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন, তা প্রশংসার যােগ্য আর এখানেই গান্ধিজি ও তাঁর অহিংসা তত্ত্বের সাফল্য ও সার্থকতা নিহিত রয়েছে।