‘মুক্তধারা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের মানস প্রতিনিধি রূপে ধনঞ্জয়ের অবস্থান আলোচনা করো।
‘মুক্তধারা’ নাটকের চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র হল বৈরাগী ধনঞ্জয়ের চরিত্র। রবীন্দ্রসাহিত্যে বিশেষত নাট্যসাহিত্যে ধনঞ্জয় চরিত্র নানা পরিচয়ে নানা নাম লয়ে’ নানা রূপে প্রতিভাত হয়েছে। দেখা গেছে প্রায়শই নাট্যকার তাঁর নিজস্ব অনুভবের কথা, অভিমত ব্যক্ত করেছেন এই চরিত্রের মাধ্যমে। আলোচ্য চরিত্রটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, ইনি সত্যে দৃঢ়, মানবতাবাদী, অধ্যাত্মভাবনা মুখর, সংবেদনশীল এবং সাধারণের স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ। আলোচ্য নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার স্বীকার করেছেন যে, ধনঞ্জয় চরিত্রটিকে তিনি এনেছেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক থেকে। প্রায়শ্চিত্ত নাটকে বৈরাগী ধনঞ্জয় দুর্বল ভীরু নিপীড়িত প্রজাদের সাহস যুগিয়েছেন, অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের বিপ্লব, বিদ্রোহের প্রেরণা যুগিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। আলোচ্য নাটকেও ধনঞ্জয় সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তবে আন্দোলনের নেতৃত্বদানের চেয়ে তাঁর পূর্ণ পরিচয় বিধৃত হয়েছে তাঁর গানের মধ্যে। গানের মধ্যেই রয়েছে তাঁর বক্তব্য, প্রেরণা এবং মুক্তধারা ঝর্নার সঙ্গে তাঁর অন্তরের অভেদ যোগ। তাঁর গানেই যেন ফুটে উঠেছে মুক্তধারার প্রাণের কথা। তাই তাঁর কথার মধ্যে অনেকাংশেই মুক্তধারার মূল সুর ও মর্মকথা ধ্বনিত হয়েছে।
আলোচ্য নাটকে ধনঞ্জয় অবির্ভূত হয়েছেন অহিংস নীতি দিয়ে উত্তরকূটের রাজা রণজিতের হিংসাকে প্রতিহত করতে। তিনিই শিবতরাইয়ের নিপীড়িত শোষিত ও অযথা শাসিত প্রজাদের খাজনা দিতে নিষেধ করেছেন- যেমন করেছিলেন প্রায়শ্চিত্ত নাটকে। করবন্ধ এই আন্দোলনের কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে নির্ভিক ভাবে স্পষ্ট করে রাজাকে বলেছেন, ‘যা তোমার নয় তা তো তোমাকে দিতে পারব না। …… আমার উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার, ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।’ ক্ষুধার অন্ন আর উদ্বৃত্ত অন্নের ভেদজ্ঞান তাঁর আছে বলেই শাসক ও শোষকের আঘাত বুক পেতে পিঠ পেতে নিতে তিনি সদা প্রস্তুত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, প্রবলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে আঘাত আসবে এ কথা ধনঞ্জয়ের অজ্ঞাত ছিল না। কেননা তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন, বলবানরা কেবল আঘাত করতেই জানে। তাদের জয় শাসনে, ত্রাসনে। তাই আন্দোলন যত অহিংস উপায়েই হোক না কেন, মার তাঁকে খেতেই হবে। সে মার গায়ে লাগুক কিন্তু মনে মাখলে চলবে না। সে মার পরাজয়ের নয়, জয়েরই নামান্তর। তাই অনুগামীদের বলেছেন, ‘আসল মানুষটি যে তার লাগে না, সে যে আলোর শিখা। লাগে জন্তুটার; সে যে মাংস, মার খেয়ে কেঁই কেঁই করে মরে।’ কিন্তু এই তত্ত্ব অনুগামীরা যদি বুঝতে না পারে সেই জন্যে তাদের শিখিয়েছেন মার সহ্য করার সহজ মন্ত্র — ‘মার জিনিসটাকেই একেবারে গোড়া ঘেঁষে কোপ লাগাও।’ অর্থাৎ, আঘাত পেয়ে অচল থাকার মানসিকতা দিয়েই মারকে জয় করা সম্ভব। কেন না, যিনি আঘাত করেন, তিনি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই নেমে আসেন ছোট হয়ে। তখন প্রবলের প্রাবল্যের অনুমান বাস্তবতায় নেমে আসে বলেই প্রবলের সম্বন্ধে ভয় ভেঙে যায়। মারকে জয় করার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর আন্দোলনের পন্থা হল, অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে প্রবলের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা বজায় রাখা। তাই বলেন, ‘ঢেউকে বাড়ি মারলে ঢেউ থামে না, হালটাকে স্থির করে রাখলে ঢেউ জয় করা যায়।’ তাই আঘাতের মুখে, বিপদের মুখে, শত্রু-শিবিরে তিনি স্থির-লক্ষ্য। এই স্থৈর্য তাঁর বিশ্ববিধাতার ওপর অশেষ আস্থার ফলেই সম্ভব হয়েছে। তাঁর গানের মধ্যে এই কথা ব্যক্ত করে গেয়েছেন—‘আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী / এই শুধু মোর দায়’ বিপ্লবী হলেও ধনঞ্জয় চিত্রিত হয়েছেন, বৈরাগী রূপে। তাই তিনি সত্যের পূজারী, নিরভিমানী, আনন্দময় পুরুষ। কোনো বন্ধন তাঁকে বাঁধে নি বলেই তিনি পথে বেরিয়েছেন মুক্তপুরুষের মতো। কণ্ঠে তার বিপ্লবের প্রেরণা সঞ্চারিণী সঙ্গীত।
রবীন্দ্রনাথ কালিদাস নাগকে এক চিঠিতে লিখেছেন, “আমার নাটকের …. ধনঞ্জয় হচ্ছে যন্ত্রের হাতে মারখানেওয়ালার ভিতরকার পীড়িত মানুষ। সে বলছে, আমি মারের উপরে; মার আমাতে এসে পৌঁছয় না— আমি মারকে না-লাগা দিয়ে জিতব, আমি মারকে না-মার দিয়ে ঠেকাব। যাকে আঘাত করা হচ্ছে সে সেই আঘাতের দ্বারাই আঘাতের অতীত হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু যে মানুষ আঘাত করছে আত্মার ট্র্যাজেডি তারই— মুক্তির সাধনা তাকেই করতে হবে, যন্ত্রকে প্রাণ দিয়ে ভাঙবার ভার তারই হাতে। পৃথিবীতে যন্ত্রী বলছে, মার লাগিয়ে জয়ী হব। পৃথিবীতে মন্ত্রী বলছে, হে মন, মারকে ছাড়িয়ে উঠে জয়ী হও। আর নিজের যন্ত্রে নিজে বন্দী মানুষটি বলছে, প্রাণের দ্বারা যন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। মুক্তি দিতে হবে। যন্ত্রী হচ্ছে বিভূতি, মন্ত্রী হচ্ছে ধনঞ্জয়, আর মানুষ হচ্ছে অভিজিৎ।”
বৈরাগী ধনঞ্জয়ের মধ্যে কিছু বৈপরীত্য বিদ্যমান। ধনঞ্জয় বৈরাগী অথচ কর্মযোগী। ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও হাতগুটিয়ে চোখ বন্ধ করে তাঁর ধ্যানে রত থাকার পক্ষপাতী নন। রুদ্ধ ঘরের চেয়ে জনতার দরবারে তিনি ঈশ্বরের লীলাদর্শনের অভিলাষী। নির্জনতার চেয়ে জনকোলাহলের ঘূর্ণির মাঝেই তিনি জীবনের শিক্ষা অভিলাষী। তাই তাঁকে তাঁর ভক্তরা ভগবান করে তুলতে চাইলে তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। ভক্তিবাদের সঙ্গে কর্মবাদের সংযোগস্থাপন তাঁর অন্যতম অভিপ্রায়। কেন না, শ্রদ্ধা না থাকলে আন্দোলনে নিষ্ঠা আসবে না, আর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে কোনো কাজই যে হবে না সে কথা বলাই বাহুল্য। আর একটি পরিচয়ে ধনঞ্জয় শিক্ষক। নিবীর্য হতোদ্যম শিবতরাইয়ের প্রজাদের প্রকৃত আন্দোলনে সামিল হওয়ার শিক্ষা দিয়ে তিনি তাদের জাগিয়ে তুলেছেন। ধনঞ্জয়ের এই সত্ত্বাটির সঙ্গে অনেকে মহাত্মা গান্ধির ‘জ্যান্তে-মরা ভারতবাসী’কে জাগিয়ে তোলার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এছাড়াও মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে বৈরাগী ধনঞ্জয়ের আরো কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু সে সাদৃশ্য শুধুমাত্র অহিংস অসহযোগ নীতি নির্ভর নয়। গান্ধিজীর মতো ধনঞ্জয়ও লাঞ্ছিত, পীড়িত পরাধীন প্রজাদের নিশ্চেষ্ট ঘুমন্ত দশা ছুটিয়ে দিয়ে তাদের বৈপ্লবিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। যে যন্ত্র মানবকল্যাণের বিরোধী তাকে বর্জন করার দাবি নিয়ে প্রবলের বিরুদ্ধে অসহযোগী আন্দোলনে মুখর হয়েছেন। কিন্তু সে আন্দোলন ধ্বংসাত্মক নয়, মানবতাপূর্ণ। এই সাদৃশ্যের কারণে সেকালের ও একালের অনেক পাঠকই ‘মুক্তধারা’ নাটক পাঠ করার সময় ধনঞ্জয়ের অহিংস নীতি, দুর্গতকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতা দেখে মহাত্মা গান্ধির প্রতিচ্ছবি বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু ঐতিহাসিক সাক্ষ্যানুযায়ী সে মতকে গ্রাহ্য করা যায় না। কারণ, রবীন্দ্রসাহিত্যে ধনঞ্জয় বৈরাগীর আবির্ভাব ১৯০৯ সালে, অর্থাৎ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধির আগমনের প্রায় ছয় বছর আগে। তা ছাড়া নাট্যকার স্বয়ং এই তত্ত্বটিকে স্বীকার করতে চাননি। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে এক পত্রে (১২ ফাল্গুন ১৩২৮ তারিখে) এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “এই (মুক্তধারা’) নাটকের সমস্ত ঘটনা ও বেদনাকে একটিমাত্র পথের সূত্রে গেঁথে তোলা এবং এই পথের বাইরে যেটা আড়ালে পড়ে আছে তাকে আভাসে প্রকাশ করা নিতান্ত সহজ হয় নি বোধহয় যাঁরা কেবল কানে শুনে গেছেন তাঁরা ভিতরের দিক থেকে এই চিরন্তন পথতত্ত্বটিকে একেবারে গ্রহণই করেননি, তাঁরা কেবল মহাত্মা গাঁধিকে আমাকে এবং চরকার সুতোকাটাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন।”
ধনঞ্জয় সম্বন্ধে সাহিত্য সমালোচক বসুমিত্র মজুমদারের অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মানস-প্রতিনিধি হলেন ধনঞ্জয়। তাই এর আচারে, আচরণে, সংলাপে, আধ্যাত্মিকতায় একটা চিরন্তনী বাণী শ্রুত হয়। এই চরিত্র দুঃখে সুখে নির্বিকার হয়ে যথা কর্তব্যের পরামর্শ দেয়। রাজার কাছে, মারের মুখে সে যেমন অবিচল, তেমনি অবিচল রাতের অন্ধকারে উত্তরকূটের লোকের হাতে লাঞ্ছিত হবার সময়ে। আবার ‘মুক্তধারা’র বাঁধ ভেঙে যখন অভিজিতের মৃত্যু সংবাদ আসে, তখনও সে. অবিচল ভাবেই আনন্দিত চিত্তে বলে ওঠে, চিরকালের মতো পেয়ে গেলি রে’। মানুষের মধ্যে যে মনুষ্যত্বের বাস, ধনঞ্জয় তাকে চিনেছিল, সেই মনুষ্যত্বই রূপধারণ করে হয়েছিল অভিজিৎ। তাই দেহী অভিজিতের মৃত্যু হওয়ায় উত্তরকূটের মানুষের মধ্যে যে চিরস্থায়ী মনুষ্যত্বের উদ্বোধন হল এই সংলাপের মধ্যে সেই আভাসই দিয়েছে ধনঞ্জয়।”
প্রকৃতপক্ষে ধনঞ্জয় সাধারণ বৈরাগীর বেশে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি সহৃদয় সামাজিক, প্রেমময়। মানবতায়, সত্যনিষ্ঠায়, সহনশীলতায়, অন্যায়ের বিরোধিতায়, নির্ভিকতায় তিনি আদর্শের প্রতিমূর্তি। রবীন্দ্র-নাট্য-সাহিত্যে মাঝে মাঝেই নানা রূপে ইনি দেখা দিয়েছেন। ‘শারদোৎসবে’ ইনি এসেছেন ঠাকুরদাদা রূপে, ‘অচলায়তনে’ দাদাঠাকুর বা গুরু, ‘রাজা’ নাটকে রাজার সেনাপতি ঠাকুরদাদা এবং ‘প্রায়শ্চিত্ত’ আর ‘মুক্তধারা’ নাটকে ইনি আবির্ভূত হয়েছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী রূপে। ‘রক্তকরবী’তে এর চরিত্রের ছায়াপাত লক্ষ করা যায় বিশুর মধ্যে। এঁরা প্রত্যেকেই মানবকল্যাণকামী। রবীন্দ্র-নাট্যে এই অসাধারণ চরিত্রের আবির্ভাব সম্ভবত নানা সমস্যার মধ্যে তাঁর নিজস্ব মতামত ও সমস্যা উত্তরণের মার্গ দর্শন করানোর অভিপ্রায়ে।
Leave a comment