প্রশ্নঃ সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ আলােচনা কর। এ ব্যাপারে বহুত্ববাদীদের সমালােচনা বর্ণনা কর।

অথবা, অস্টিনের সার্বভৌমত্ব কী? বহুত্ববাদীরা এর কী কী সমালােচনা করেছেন? আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সার্বভৌমত্ব আধুনিক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সার্বভৌমত্ব ছাড়া রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতা। রাষ্ট্র গঠনের চারটি উপাদানের মধ্যে সার্বভৌমত্ব হল অন্যতম। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও স্বরূপ বহুলাংশে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃতি ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সার্বভৌমিকতাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। (ক) একত্ববাদ, (খ) বহুত্ববাদ। অস্টিন একত্ববাদের প্রবক্তা।

অস্টিনের মতবাদঃ জন অস্টিন হলেন বৃটিশ আইনবিদ ও দার্শনিক। তার ‘আইন শাস্ত্রের ওপর বক্তৃতা’ গ্রন্থটি ১৮৩২ সালে প্রকাশিত হয়। অস্টিন এই গ্রন্থে সার্বভৌমিকতা আইন সম্পর্কে তার ধারণা প্রকাশ করেছেন। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের মতবাদ একত্ববাদ হিসেবে পরিচিত। একে আইনানুগ মতবাদ বলা হয়। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে হবসের তত্ত্ব ও বেন্থামের তত্ত্বের মধ্যে তিনি সমন্বয়সাধন করেছেন।

অস্টিনের সার্বভৌমত্বঃ সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের সংজ্ঞা হল, ‘যদি কোনাে নির্দিষ্ট উর্ধ্বতন মানবীয় কর্তৃপক্ষ অন্য কোনাে উর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করে ও কোন বিশেষ সমাজের অধিকাংশের স্বভাবগত আনুগত্য লাভ করতে থাকে, তাহলে সে সমাজে উক্ত নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ হল সার্বভৌম ও উক্ত কর্তৃপক্ষসহ সমাজটি হল একটি রাজনৈতিক এবং স্বাধীন সমাজ।’ সার্বভৌম ক্ষমতা সম্বন্ধে অস্টিনের মতবাদকে একত্ববাদও বলা হয়।

অস্টিনের সার্বভৌমিকতার বৈশিষ্ট্যঃ অস্টিন প্রদত্ত সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত কতকগুলাে বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা-

(১) স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষঃ অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব শক্তি বলে একটি নির্দিষ্ট মানবীয় কর্তৃপক্ষকে বুঝায়, এটা জনমত বা সাধারণের ইচ্ছা প্রভৃতি কোনাে অস্পষ্ট কর্তৃপক্ষকে বােঝায় না, এটা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট।

(২) চরম, অবাধ ও সীমাহীনঃ সার্বভৌম ক্ষমতা হলাে চরম, অবাধ ও অসীম। এটা অপর কোনাে শক্তির

প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে না।

(৩) আইনঃ সার্বভৌমের আদেশই হলাে আইন। এর নির্দেশ অমান্য করার অর্থ আইন অমান্য করা।

(৪) সার্বভৌমিকতার ভিত্তিঃ জনগণের স্বভাবগত আনুগত্যই সার্বভৌমিকতার ভিত্তি।

(৫) সকল অধিকারের উৎসঃ সার্বভৌম ক্ষমতা হলাে সকল অধিকারের উৎস। এর বিরুদ্ধে কোনাে আইনগত অধিকার থাকতে পারে না।

(৬) অবিভাজ্যঃ অস্টিনের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত ধারণায় প্রমাণিত সার্বভৌম শক্তি অবিভাজ্য।

(৭) সমভাবে প্রযুক্তঃ রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যের সার্বভৌমিকতা সমানভাবে সকলের ওপর প্রযুক্ত হয়।

(৮) সার্বভৌমিকতার অস্তিত্বঃ সার্বভৌমিকতার অস্তিত্ব বর্তমান থাকে কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজে।

সমালােচনাঃ সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষভাবে সমালােচিত হয়েছে। এগুলাে নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

(১) রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতাকে উপেক্ষাঃ আইনগত দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্টিন সার্বভৌম শক্তির চরম, অবাধ ও অসীম ক্ষমতার কথা বলেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতা বা গণ সার্বভৌমিকতার ধারণা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে।

(২) অপ্রতিহত ক্ষমতার ধারণা ঠিক নয়ঃ স্যার হেনরি মেইন ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের দ্বারা প্রমাণ করেন যে, বাস্তব ক্ষেত্রে কোনাে কোনাে সার্বভৌম অসীম ক্ষমতা প্রয়ােগে সক্ষম হয়নি। অথচ অস্টিন আইনানুগ দষ্টিভঙ্গি থেকে বলেছেন যে, সার্বভােম ক্ষমতা চূড়ান্ত অবাধ ও অসীম। এ ক্ষমতা অন্যকোনাে শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না।

(৩) আইন মাত্রই নির্দেশমূলক নয়ঃ অস্টিন প্রদত্ত সকল আইনই সর্বাংশে সত্য নয়। সকল আইনই সার্বভৌম শক্তির নির্দেশক বা আজ্ঞা নয়। বহু অনুমতিজ্ঞাপক আইনও প্রচলিত থাকে।

(৪) সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যঃ অস্টিনের একত্ববাদে একটি নির্দিষ্ট উধ্বর্তন মানবীয় কর্তৃপক্ষকে সার্বভৌম বলা হয়েছে অর্থাৎ সরকারই হলাে সার্বভৌম। কিন্তু আমরা জানি সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সরকারের নয়।

(৫) অগণতান্ত্রিকঃ সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের মতবাদ গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরােধী। এই মতবাদ অনুসারে আইনগত সার্বভৌমতু চরম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী। এই সার্বভৌমের ইচ্ছাপ্রসূত পীড়নমূলক আইন গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

(৬) প্রতিক্রিয়াশীলঃ মার্কসীয় চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অস্টিনের এই কর্তৃত্ববাদী তত প্রতিক্রিয়াশীল মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত। কোন শ্রেণী সরকারের হাতে এই ধরনের সার্বভৌম ক্ষমতা নীতিগতভাবে সমর্থনযােগ্য নয়।

(৭) প্রথাগত আইন উপেক্ষাঃ অস্টিন আইনকে সার্বভৌমের আদেশ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু লাস্কির মতাে আইন ছাড়াও একটি রাষ্ট্র-প্রথাগত আইন থাকে। সার্বভৌম এসব প্রথাকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করতে পারে না।

(৮) জনগণ শাস্তির ভয়ে আইন মেনে চলে নাঃ অস্টিনের মতে, আইন সার্বভৌমের আদেশ। সুতরাং মানুষ শাস্তির ভয়ে আইন মেনে চলে। সমালােচকদের মতে, শুধু শাস্তির ভয়ে মানুষ আইন মেনে চলে একথা ঠিক নয়। তাছাড়া যখন সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল না তখনও মানুষ সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতাে।

(৯) পীড়নমূলক শক্তির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপঃ পীড়নমূলক শক্তির উপর অস্টিন অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করেছেন। জনগণ শুধু শাস্তির ভয়ে আইন মান্য করে না, ধর্মীয় অনুশাসন রীতিনীতি মানুষের আইন মান্য করার অন্যতম কারণ।

(১০) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান নির্ণয় অসম্ভবঃ সমালােচকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান নির্ণয় করা যায় না। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্র কিংবা অঙ্গরাষ্ট্রীয় কোনাে সরকারই সার্বভৌম নয়। উভয় সরকারই সংবিধানের গণ্ডির মধ্যে থেকে ক্ষমতাচর্চা করে।

বহুত্ববাদীদের সমালােচনাঃ বহুত্ববাদীরা অস্টিনের সার্বভৌমত্বের উপযুক্ত সমালােচনা ছাড়াও কিছু সমালােচনা করেছেন তা নিম্নরূপ-

(১) অগণতান্ত্রিকঃ সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের মতবাদ গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরােধী। এ মতবাদ অনুসারে আইনগত সার্বভৌমত্ব চরম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী। কেননা অস্টিনের সার্বভৌমিকতাবাদে গণতন্ত্রের কোনাে স্থান নেই। এ রাষ্ট্র স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়েছে ও গণ সার্বভৌমত্বকে অগ্রাহ্য করেছে।

(২) আইনের একমাত্র উৎস নয়ঃ অস্টিন মনে করেন যে, সার্বভৌমের আদেশই কেবল আইন। কিন্তু তা সঠিক নয়। আইনের অন্যান্য আরাে অনেক উৎস আছে। যেমন রাষ্ট্র সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকেই মানুষ সামাজিক নিয়ম কানুন ও ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হতাে।

(৩) রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার গুরুত্ব নেইঃ অস্টিন রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতাকে অগ্রাহ্য করে আইনগত সার্বভৌমিকতাকেই শুধু প্রাধান্য দিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের যুগে রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক সার্বভৌম ক্ষমতা উপেক্ষা করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না।

(৪) রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধঃ বহুত্ববাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন, প্রথা, বিশ্বজনমত প্রভৃতি মেনে চলতে হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথা, রীতি-নীতি ও জনমতকে অস্বীকার করা যায় না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আইনগত দিক দিয়ে সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ সম্পূর্ণরূপে যুক্তিসঙ্গত। সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান ও প্রকৃতি সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা তার কৃতিত্ব। কিন্তু বাস্তবতার দিক দিয়ে তার মতবাদ আধুনিক বিশ্বে গ্রহণযােগ্য নয়। কিন্তু একথাও সত্য যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যত সংঘ। বা প্রতিষ্ঠানই থাকনা কেন সেগুলােকে পুরােপুরি স্বাধীনতা প্রদান না করে তাদের ওপর কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত।