সূচনা: চৌরিচৌরা ঘটনার জেরে গান্ধিজি অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এদিকে তুরস্কে খলিফার পদ লুপ্ত হলে ভারতের খিলাফৎ আন্দোলনও থেমে যায়। ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং পুনরায় উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়তে শুরু করে।
মুসলিম নেতৃত্বের দূরত্ব: খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধের পর আবুল কালাম আজাদ ছাড়া সকল খিলাফৎ নেতাই গান্ধিজিকে ত্যাগ করেন। একদা গান্ধিজির ঘনিষ্ঠ মুসলিম নেতা মৌলানা মহম্মদ আলি ও মৌলানা সৌকত আলি প্রকাশ্যেই ঘােষণা করেন যে, তারা প্রথমে মুসলিম, পরে ভারতীয়। মুসলিম নেতারা ‘তানজিম’ ও ‘তাবলিখ’ আন্দোলন শুরু করে নিজেদের সংগঠনের লােকসংখ্যা ও শক্তিবৃদ্ধিতে মন দেয়।
[1] হিন্দু নেতৃত্বের সাম্প্রদায়িকতা: হিন্দুদের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা এই সময় মুসলিম লিগের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার নিয়মিত বিরােধিতা করতে থাকে। হিন্দু নেতারা ‘শুদ্ধি’ আন্দোলনের মাধ্যমে নিজ সংগঠন ও সম্প্রদায়ের শক্তিবৃদ্ধিতে মনােনিবেশ করে। এই সময় হিন্দু মহাসভা ছাড়াও আর্যসমাজ, ভারত ধর্মমণ্ডল, পাঞ্জাব হিন্দুসভা প্রভৃতি সংগঠনগুলি নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
[2] সাইমন কমিশন: ভারতের নতুন সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন গঠন করলে জাতীয় কংগ্রেস ও আংশিক মুসলিম লিগ এই কমিশন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু লিগের পাঞ্জাব গােষ্ঠী নামে পরিচিত মহম্মদ শফি, ফিরােজ খাঁ নুন, ফজলি হােসেন, মহম্মদ ইকবাল প্রমুখ মুসলিম নেতা সাইমন কমিশনকে স্বাগত জানায়। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে এই নেতাদের বিভেদ বৃদ্ধি পায়।
[3] নেহরু রিপাের্ট: মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে গঠিত একটি সর্বদলীয় কমিটি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে লক্ষৌ অধিবেশনে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করেন। এটি ‘নেহরু রিপাের্ট’ নামে পরিচিত। কিন্তু ওই বছর ২২ ডিসেম্বর কলকাতার সর্বদলীয় অধিবেশনে জিন্না লিগের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা দাবি করলে তা নাকচ হয়। ফলে তিনি অনুগামীদের নিয়ে অধিবেশন ত্যাগ করে মহম্মদ ইকবাল, আগা খাঁ প্রমুখ প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হন। এভাবে লিগে ঐক্য ফিরে এলে লিগের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
[4] জিন্নার ভূমিকা: ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের দিল্লিতে লিগের অধিবেশনে জিন্না ভারতের মুসলিমদের স্বার্থে চোদ্দো দফা দাবি পেশ করেন। এতে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি-সহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাবি জানানাে হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে লিগের ভরাডুবির পর ওই বছর লিগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে জিন্না কংগ্রেস শাসনকে ‘হিন্দু শাসনের নামান্তর বলে ঘােষণা করেন এবং হিন্দু আধিপত্যের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি সর্বশ্রেণির মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন। এভাবে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার পারদ আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
[5] সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডােনাল্ড ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘােষণা করে মুসলিম, ভারতীয় খ্রিস্টান, শিখ, হরিজন, অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয় হয় এবং ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
[6] লাহাের প্রস্তাব: বিখ্যাত উর্দু কবি ও লিগ নেতা মহম্মদ ইকবাল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তােলেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড, খাকসার বাহিনী-সহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন গড়ে ওঠে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহাের লিগের অধিবেশনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক পৃথক পাকিস্তানের দাবি করে বলেন যে, ভারতে হিন্দু-মুসলিম দুটি জাতি আছে—দুটি সম্প্রদায় নয়। এজন্য মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রয়ােজন।
[7] প্রত্যক্ষ সংগ্রাম: মন্ত্রী মিশনের (১৯৪৬ খ্রি.) প্রস্তাব অনুসারে বড়ােলাট লর্ড ওয়াভেল কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুকে মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানান। এতে জিন্না ও মুসলিম লিগ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। তারা এই সরকারে যােগ না দিয়ে পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে সােচ্চার হয়। পৃথক পাকিস্তান আদায়ের উদ্দেশ্যে তারা সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ শুরু করে। এতে কলকাতায় পাঁচদিন ধরে (১৬-২০ আগস্ট, ১৯৪৬ খ্রি.) ব্যাপক দাঙ্গা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ ও হত্যাকাণ্ড চলে।
উপসংহার: প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ঘটনায় কলকাতায় ভয়াবহ হত্যালীলার পর একে একে নােয়াখালি, ত্রিপুরা, বিহার প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ গান্ধিজিকে বােঝান যে, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ভারত বিভাজন ও পৃথক পাকিস্তান সৃষ্টিই একমাত্র পথ। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে গান্ধিজিও এই প্রস্তাব মেনে নিলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশ দ্বিখণ্ডিত হয়।
Leave a comment