(ক) অবক্ষয় যুগ:

সাহিত্যকে বলা হয় সমাজজীবনের দর্পণ এবং সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় অনেকাংশেই রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের প্রেক্ষাপটে। ফলতঃ রাষ্ট্রশক্তির উত্থান-পতন কিংবা বিপর্যয়-আদির সঙ্গে সাহিত্যেও যে অন্ততঃ পরােক্ষ হলেও কোন-না-কোন সম্পর্ক দ্বারা অন্বিত হয়, এই সহজ কথাটা স্বীকার করে নিতেই হয়। গৌড়বঙ্গের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং সাহিত্যিক ইতিহাস পর্যালােচনায় বারবারই প্রমাণিত হয়েছে যে এই তিনটিই যেন একই সূত্রে গ্রথিত। তাই দেখা যায়, দেশের বুকে যখনই কোন রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে, সমাজ-জীবনে তার প্রতিফলন-সূত্রে সাহিত্যেও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। গত সহস্রাব্দকালের তথা বাঙালী জাতির উদ্ভব থেকে আরম্ভ করে একালের ইতিহাস আলােচনায় বারবারই আমরা এই সিদ্ধান্তের মুখােমুখী হই।

তামস যুগ: খ্রীঃ ত্রয়ােদশ শতকের প্রারম্ভেই বাংলার বুকে বহিঃশক্তির তথা তুর্কী-আক্রমণ কার্যতঃ হিন্দু বৌদ্ধ যুগের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ও সমাজজীবনে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে তার ফলে পরবর্তী দেড় শতাব্দীকাল সমাজে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। ইতিহাসের বিচারে এই যুগসন্ধিকাল সাহিত্যের ইতিহাসে ‘অনুর্বর’ বা ‘বন্ধ্যাযুগ’ এমন কি ‘তামস যুগ’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকে—এটিকে সদর্থকরূপে বড় জোর মানস প্রস্তুতির কাল’ বলে সান্ত্বনা লাভ করা যায়। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিকালে রাজশক্তি যখন মুসলমান শাসকদের থেকে ইংরেজ বণিক কোম্পানীতে হস্তান্তরিত হলাে, তারপর শতাব্দী কালকে আবার ‘যুগসন্ধিকাল’-রূপে, অভিহিত করা হয়। রাষ্ট্রশক্তির বিপর্যয়ের ফলে সুদীর্ঘকাল প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরে, প্রাচীন মূল্যবােধ বিপর্যস্ত হয় এবং এর হাত থেকে সামলে উঠতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়ােজন হয়।

আলােচ্য ক্ষেত্রে এই যুগসন্ধিকালের পূর্বে সমগ্র দেশে যে মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রায় দেশবাসী অভ্যস্ত হয়ে ছিল, তা অবশ্য কোনক্রমেই উন্নত মানের ছিল না। তুর্কী-মুঘল আফগান-পাঠান সভ্যতা-সংস্কৃতির যতটুকু এদেশে প্রচারিত হয়েছিল, বিশ্বমানে তা তেমন কিছু উল্লেখযােগ্য ছিল না। কিন্তু তা হলেও একটা প্রচলিত ব্যবস্থায় মানুষ যখন অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তার মনে সাধারণ শাস্তি-স্বস্তি বজায় থাকে এবং একটা মানসিক নিরাপত্তাবােধের কারণে শিল্প সাহিত্য আদি সৃষ্টিকার্যে উৎসাহ বােধ করে, খ্রীঃ সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বাঙালী জীবনে এই সৃষ্টি কামনা সার্থক রূপায়ণ লাভ করেছে অষ্টাদশ শতকের গােড়া থেকেই কিন্তু সাহিত্য জগতে যে বন্ধ্যা দেখা দিয়েছিল সেটা সমাজের প্রভাবেই।

অবক্ষয় যুগ: অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রাজশক্তি হস্তান্তরের ফলে যে যুগসন্ধিকালের সৃষ্টি হয়, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল অষ্টাদশ শতকের গােড়া থেকেই। একটা সুপ্রতিষ্ঠিত রাজশক্তিকে একটা বহির্ভারতীয় বণিকদল সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে দেশের শাসনব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে নিল- এই অসম্ভব ঘটনাই সম্ভব হয়েছিল ভিতরে ভিতরে সেই রাজশক্তিতে ক্ষয় দেখা দিয়েছিল বলেই। অষ্টাদশ শতকের গােড়াতেই (১৭০৭ খ্রীঃ) দিল্লীর বাদশা ঔরংজীবের মৃত্যুর পর সুযােগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে ভারতময় পরিব্যাপ্ত বিশাল সাম্রাজ্য কার্যতঃ ভেঙে খান খান হয়ে গেল। সামন্ত নৃপতিগণ, প্রাদেশিক শাসকগণ প্রত্যেকেই স্ব-স্ব প্রধান হয়ে উঠতে লাগলেন। তারপর চললাে ক্ষমতা-অধিকারের নিমিত্ত যাবতীয় কুকর্মের অনুষ্ঠান এবং দুর্নীতির অবাধ খেলা। এর দেশি-বিদেশি সুযােগসন্ধানী বণিকবেশী দস্যুদলের তৎপরতা দেশময় এই অরাজকতার ফলে সমাজদেহে যে সঠিক অবক্ষয়ের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, তাকে কোনক্রমেই অস্বীকার করা সম্ভবপর নয় বলেই সেটা অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয় যুগ’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। রাজনৈতিক ডামাডােলে অষ্টাদশ শতকের প্রথম অর্ধে বাংলার সমাজজীবনে যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল, তার পরিচয় দিতে গিয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “এই অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি-সমস্তই শঙ্কাতুর প্রহর গণনা করছিল-চারদিকে শাঠ্য, ষড়যন্ত্রের লীলাখেলা, লােভাতুর স্বার্থের সর্পজিহ্বা বিস্তার, আর তারই সঙ্গে বাংলার মধ্যযুগীয় সাহিত্য সংস্কৃতির অবসানের ঘণ্টাধ্বনি-তাই এই অর্ধশতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের মৌলিক অবদান প্রায় শূন্যে পর্যবসিত হতে চলেছিল। তার জীবনে নিরাপত্তা নেই, শান্তি নেই, সমাজে নির্মল আদর্শ নেই—এ রকম পটভূমিকায় মৌলিক সাহিত্য আশা করা যায় না।” অবশ্য অমা-রজনীতেও নক্ষত্রের দ্যুতি দেখা যায়, খদ্যোতের আলাে ঘনান্ধকার অরণ্যানীতে পথের সন্ধান দেয়। প্রকৃতিতে কখনাে শূন্যতার সৃষ্টি হয় না। তাই এই অবক্ষয় যুগেও সাহিত্যসৃষ্টি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। একদিকে যেমন চলছিল প্রাচীন ধারার ব্যর্থ অনুকৃতি, অন্যদিকে পল্লীজীবনের অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশে সৃষ্টি হচ্ছিল পল্লীগীতিকা, শাক্তপদ, বাউলগান এবং বিভিন্ন লােকসঙ্গীত।

অষ্টাদশ শতকে য়ুরােপের ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ বণিকগণ বাংলায় বাণিজ্য ব্যপদেশে যথেষ্ট ক্ষমতা ও প্রভুত্বই শুধু বিস্তার করেনি, ব্যবসা বাণিজ্যের লেন-দেনে প্রচুর টাকা পয়সাও ছড়াচ্ছিল। এই সুযােগ গ্রহণ করে নগরেবন্দরে এক নবােদ্ভূত বেনিয়া-মুৎসুদ্দি সম্প্রদায় প্রায় রাতারাতি বড়লােক হয়ে বহস্থলে রাজা-জমিদার হয়ে দাঁড়ালাে। তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় কিছু কিছু শক্তিমান প্রতিভাধর কবিও যে কাব্য রচনা করেন, তাতে অবক্ষয় যুগের লক্ষণ ছিল বর্তমান-অর্থাৎ কাব্যে বাহ্যশােভার অভাব ছিল না, ছন্দ অলংকারাদি ব্যবহারে তারা যথেষ্টই নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু তাতে অন্তরের দীনতা ঘােচনি অর্থাৎ ঐ সকল কাব্যে তারা প্রাণের স্পন্দন জাগাতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ প্রাচীন কাব্যধারার অনুবর্তী-রূপে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র এবং ‘শিবায়ন’ রচয়িতা রামেশ্বর চক্রবর্তীর নাম এবং লােকসঙ্গীতের নাগরিক ধারার কবি, যাত্রা, টপ্পা, আখড়াই, পাঁচালীকারদের নাম উল্লেখ করা চলে। এঁরা অনেকেই ছিলেন যথার্থ প্রতিভাধর শক্তিমান কবি। এদের রচনাতেও অবক্ষয় যুগের লক্ষণই সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে বলে ঐ যুগটাকেই অর্থাৎ অষ্টাদশ শতককেই ‘অবক্ষয় যুগ’ বলে অভিহিত করা চলে।

(খ) অষ্টাদশ শতকের সাহিত্যকর্ম: 

সাধারণভাবে খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতককে ‘অবক্ষয় যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়। একদিকে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসানে স্থানীয় শাসকগণ স্ব-স্ব প্রধান হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হবার ফলে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী সুযােগসন্ধানী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, অপরদিকে বিদেশীয় বণিক সম্প্রদায়ের ব্যবসা-বাণিজ্যের সংস্পর্শে আসবার ফলেও বহু উঠতি বড়লােকের আবির্ভাব ঘটে। শিক্ষা সংস্কৃতিবিহীন এই নব ভূম্যধিকারীদের পৃষ্ঠপােষকতায় এমন সকল বিলাস-ব্যসন ও আমােদপ্রমােদের ব্যবস্থা তখন অবলম্বিত হতাে যাতে সুরুচির বিশেষ পরিচয় পাওয়া যেতাে না।

সমাজজীবনের এই অবক্ষয় সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল। এই যুগে যে সাহিত্য সৃষ্টি একবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, এমন কথা বলা চলে না। তবে একটা গােটা শতাব্দীতে দুই একজন মাত্র উল্লেখযােগ্য কবির কৃতিত্ব সমগ্র যুগের ব্যর্থতাকে অবশ্যই সামাল দিতে পারে না বলেই সাধারণভাবে এই যুগটিকে প্রায় ‘বন্ধ্যা যুগ’ বলেই মনে করা হয়। মনে রাখতে হবে, বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে ত্রয়ােদশ শতকের তুর্কী আক্রমণের পরবর্তী দু’শাে বছরকেও ‘অন্ধকার যুগ’ বা ‘বন্ধ্যা যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। যাহােক্, অষ্টাদশ শতকের সাহিত্যরচনা-প্রচেষ্টায় দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়, একটি পুরাতনের অনুভৃত্তি এবং অপরটি নবযুগের আগমনী।

পুরাতনের অনুবৃত্তিরূপে প্রথমেই উল্লেখযােগ্য মঙ্গলকাব্যধারা। যুগােচিত কারণেই মধ্যযুগের অন্ধবিশ্বাস ও আবেগসর্বস্ব ভক্তি অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়। তাই এ যুগে দেবদেবীদের প্রতি অচলা ভক্তির পরিবর্তে তাদের অধিকাংশ স্থলেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আধার করে তােলা হয়। ফলে উল্লেখযােগ্য সাহিত্য কম রচিত হয় এ যুগে। মনসামঙ্গল কাব্যে একমাত্র জীবনকৃষ্ণ মৈত্রই (১৭৪৪ খ্রীঃ) কিছুটা সার্থকতার পরিচয় দিতে পেরেছেন। এ ছাড়া উল্লেখ করা চলে দ্বিজ রসিক, রামজীবন, বাণেশ্বর প্রভৃতির নাম। অপরাপর মঙ্গলকাব্যের মধ্যে উল্লেখ করা চলে ভবানীশঙ্করের (১৭৮২ খ্রীঃ) ‘মঙ্গলচণ্ডীর পাঞ্চালিকা’, দ্বিজ মুকুন্দের ‘বাসুলীমঙ্গল’ প্রভৃতি। এ শতাব্দীতে প্রকৃত শক্তিমান কবির সন্ধান পাওয়া গেছে, যার সংখ্যা তিন-এর বেশি নয়। একজন ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের কবি ঘনরাম চক্রবর্তী, দ্বিতীয় জন ‘শিবায়ন’ কাব্য-প্রণেতা রামেশ্বর ভট্টাচার্য এবং অপর জন অবশ্যই সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচয়িতা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়।

ঘনরাম চক্রবর্তী ১৭১১ খ্রীঃ ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। আকারে সুবৃহৎ হওয়া সত্ত্বেও তার কাব্যটি পাঁচালীর স্থল আদর্শের মধ্যেই স্থিত ছিল। তার কাব্যটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও তা কিন্তু কৃত্রিমতার গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেনি। ধর্মমঙ্গলের অপর কয়েকজন কবিও অষ্টাদশ শতকেই বর্তমান ছিলেন, এরা হলেনদ্বিজ রামচন্দ্র (১৭৩২ খ্রীঃ), সহদেব চক্রবর্তী (১৭৩৫ খ্রীঃ) এবং হৃদয়রাম সাউ (১৭৪৯ খ্রীঃ)।

শিবায়ন কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য যে ভারতচন্দ্রকেও প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, এতেই তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলার লােকজীবনের সঙ্গে যে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন, তা কাব্যে সুপরিস্ফুট। তিনি একজন প্রকৃত শক্তিমান কবি ছিলেন।

অষ্টাদশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র নিঃসন্দেহে সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তিনিও ভাগ্যদোষে এমন একটা যুগ ও পরিবেশের শিকার হয়ে পড়েছিলেন যে অসাধারণ প্রতিভা সত্ত্বেও তিনি যুগােত্তীর্ণ হতে পারেন নি। তার অন্নদামঙ্গল কাব্যেও প্রাণহীন অলঙ্কার-সর্বস্বতা প্রাধান্য লাভ করেছে। অষ্টাদশ শতকের ঐতিহ্যহীন কলুষিত অবক্ষয়িত সমাজের চিহ্নই তার কাব্যদেহে পরিস্ফুট। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড ‘বিদ্যাসুন্দর’ তথা ‘কালিকামঙ্গল’ কাব্যের অনুকরণে রামপ্রসাদ, দ্বিজ রাধাকান্ত, মধুসূদন চক্রবর্তী প্রভৃতিও বিভিন্ন নামে ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন, কিন্তু কোনটাই উল্লেখযােগ্য সৃষ্টি নয়।

অষ্টাদশ শতকে রামায়ণ, মহাভারত এবং ভাগবতেরও কিছু কিছু অনুবাদ রচিত হয়, যাদের শুধু নামমাত্রই উল্লেখ করা চলে। কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী রচিত ‘রামলীলা’ বা ‘শ্রীরামমঙ্গল’ কাব্য (১৭০২ খ্রীঃ), পিতা জগদ্রাম (জগৎরাম) ও পুত্র রামপ্রসাদ রচিত ‘রামায়ণ’ (১৭৯১ খ্রীঃ), ‘বুদ্ধাবতার, রামানন্দ ঘােষ-রচিত রামায়ণ এবং পূর্বোক্ত কবিচন্দ্র-রচিত ‘ভাগবতে’র অনুবাদই শুধু এযুগের উল্লেখযােগ্য অনুবাদ সাহিত্য।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুরাতন ধারার অনুবর্তন ছাড়া নবযুগের আগমনী সুর ধ্বনিত হয়েছিল যে সকল ধারায় তাদের মধ্যে পল্লীগীতিকাগুলির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তবে কোন পল্লীগীতিকাই লিখিত আকারে পাওয়া যায়নি—এগুলি ছিল পল্লীবাংলার মৌখিক সাহিত্য। এরূপ কিছু গীতিকা সংগ্রহ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পূর্ববঙ্গগীতিকা’ নামে কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত হয়। গীতিকাগুলির কোন কোন ক্ষেত্রে রচনাকারের নাম পাওয়া গেলেও তাদের পরিচয় এবং রচনাকাল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এগুলি সপ্তদশ শতকের রচনাও হতে পারে। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই—এতে খােলাখুলিভাবে সাধারণ মানুষের প্ৰেমবিরহের কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে। দেবতা ও ধর্ম-সম্পর্ক বর্জিত পদ্যে রােম্যান্টিক উপন্যাস বলেই এদের গ্রহণ করা চলে।

এ যুগের একটি নােতুন ধারার কাব্য শাক্তপদগুলি। বৈষ্ণব পদাবলীর আমলে বিভিন্ন পালার আকারে রচিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদগুলিতে শক্তিদেবীকে দু’রূপে উপাসনা করা হয়েছে। কন্যাসাধনার ধারায় দেবীকে কন্যা ‘উমা’রূপে এবং মাতৃসাধনার ধারায় দেবীকে শ্যামা-রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। উভয়বিধ রচনায় দেবীর সঙ্গে কবি তথা ভক্তের সম্পূর্ণ মানবিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। শাক্ত পদাবলীর প্রবর্তক সাধক কবি রামপ্রসাদ ছিলেন ভারতচন্দ্রের সমসাময়িক কবি। এই ধারার অন্য বিশিষ্ট কবি কমলাকান্ত কিঞ্চিৎ পরবর্তীকালে বর্তমান ছিলেন। অপর কবিগণ বিচ্ছিন্নভাবে ২/৪ টি পদ মাত্র রচনা করেছেন।

গবেষকগণ মনে করেন যে মরমিয়াপন্থী বাউল সাধনার উদ্ভব ঘটেছিল সপ্তদশ শতকেই, কিন্তু সপ্তদশ কিংবা অষ্টাদশ শতকে রচিত বাউল গানের সন্ধান পাওয়া যায় না। বাউল গানের প্রধান পুরুষ লালন ফকিরের জন্মকাল-সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। ওঁর জন্ম অষ্টাদশ শতকে হলেও ওঁর জীবনকাল অতিবাহিত হয়েছে উনিশ শতকেই।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে অর্থাৎ যুগসন্ধিকালের প্রথমার্ধব্যাপী একচ্ছত্রাধিপত্য লাভ করেছিল কবি, যাত্রা, তর্জা, টপ্পা, আখড়াই প্রভৃতি নাগরিক লােকসঙ্গীত। এ বিষয়ে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়ে লিখেছেন, “সাহিত্যের নিরিখে যুগসন্ধিকালকে বুঝতে গেলে শুধু এদেরই শরণ নিতে হবে। বলতে গেলে যুগসন্ধিকালে এর বাইরে আর সাহিত্য ছিল না, সন্ধিকালের সাহিত্য বলেই এগুলিতে আগামী নবযুগের আভাস পাওয়া গিয়েছিল।” এ যুগের বিশিষ্ট সঙ্গীত-রচয়িতাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবেই উল্লেখ করা চলে। বিশিষ্ট কবিওয়ালাদের মধ্যে ‘রাসু’, নৃসিংহ’, ‘হরুঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, আন্টুনি ফিরিঙ্গি, ভােলাময়রা প্রভৃতি এক সময় শহর কলকাতা এবং গ্রাম বাংলাকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। যাত্রাওয়ালাদের মধ্যে গােপাল উড়ে’, ‘কৃষ্ণগােপাল গােস্বামী, পাঁচালীকারদের মধ্যে, ‘দাশরথি রায় এবং টপ্পা-রচয়িতা ‘রামনিধি গুপ্ত’ বা নিধুবাবু যুগসন্ধিকালের বাঙলা সাহিত্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রমরূপেই পরিগণিত হয়ে থাকেন।