গল্প বা উপন্যাসের নামকরণের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় যে, উপন্যাস বা গল্পের কোনো চরিত্র বা আলম্বন বিভাব কিংবা মূল বক্তব্য বা সংশ্লিষ্ট মুখ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে রচয়িতারা তার নামকরণ করে থাকেন। কিন্তু দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে সে নিয়ম প্রযুক্ত হয়নি। বস্তুত গল্পের মধ্যে কোথাও কোনো পৌরাণিক প্রসঙ্গ, অশ্বমেধের আখ্যান, কিংবা অশ্বমেধের ঘোড়ার বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়নি। গল্পের নায়ক কাঞ্চন ও নায়িকা রেখার রেজিস্ট্রী বিয়ের বিবাহবার্ষিকীর দিনে একবার মাত্র ঘোড়া গাড়িতে চড়ার ঘটনা ছাড়া আর কোথাও ঘোড়ার প্রসঙ্গই নেই। গাড়ির ঘোড়াটি অশ্বমেধের কোনো মাহাত্ম্যও বহন করে না তবু গল্পকার এই গল্পের নামকরণ করলেন ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’। প্রাথমিক ভাবে মনে হতেই পারে যে গল্পটির এই নামকরণ অর্থহীন। কিন্তু একজন স্রষ্টা যখন তাঁর সৃষ্টির নামকরণ করেন তখন বিষয়টি ভেবে দেখার বিশেষ প্রয়োজন।
আখ্যান বস্তুর মধ্যে কাঞ্চন-রেখার বিবাহবার্ষিকীর দিনে বৈকালিক ভ্রমণে বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনের কিছু স্মৃতি ও চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরেছেন গল্পকার। যার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে আধুনিক যুগের যুগযন্ত্রণা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার প্রতিবিম্বন। রূঢ় কর্কশ বাস্তবের ভূমিতে স্নেহ-মায়া-প্রেম প্রভৃতি কোমল চিত্তবৃত্তির কোনো দাম নেই। ঘোড়াগাড়ির গাড়োয়ানও একজন কলেজ শিক্ষককে মর্যাদা দিতে পারে না। বাসের কণ্ডাক্টারও কাঞ্চনের উদাসীন মনের মর্ম বুঝতে না পেরে কটু বিদ্রূপ করতে ছাড়ে না। এই বাস্তবতার মধ্যে কোনো খাদ নেই। এ যুগে কেউ কারো মন বুঝতে চায় না, বুঝতে পারেও না। সমস্ত সম্পর্কও যেন কৃত্রিম হয়ে গেছে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও বাস্তবতার চাপে নিষ্পেষিত; অস্বাভাবিকতায় পূর্ণ। সব কিছুই যেন টাকা দিয়ে মাপা। জীবনের আবেগোচ্ছ্বাসও যেন অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
বস্তুত ঘোড়াগাড়িকে এখানে ব্যস্ত শহরের ব্যতিক্রমী প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। গতির প্রতীক ঘোড়া। সে যেমন এযুগে কলকাতা শহরে অচল প্রায়, তেমনি অচল তার বিলাসী গাড়ি। সেই বিলাসের সঙ্গে গতির সঙ্গতি রক্ষা করা এ যুগে অসম্ভব। গতিও নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক সিগন্যালের বা পথ নিরাপত্তা সপ্তাহের ফেরে। কাঞ্চন রেখার মতো দম্পতিরা শহরের ঘোড়াগাড়ির মতোই প্রচলিত জীবনযাপনের থেকে কিছুটা আলাদা ভাবে চলতে চেয়েছে। সেই অনুষঙ্গে গল্পে ঘোড়ার গাড়িটি ব্যবহার করা হলেও, অশ্বমেধের ঘোড়ার প্রসঙ্গ এখানে ভিন্নার্থে প্রযুক্ত হয়েছে।
পুরাণ প্রসঙ্গ থেকে জানতে পারা যায় যে, রাজা মহারাজাদের বীরত্বের নিশান রূপে কীর্তিত হত অশ্বনেবযজ্ঞ। নিরীহ নিষ্পাপ অশ্বকে দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত রাজাদের থেকে বিজয়পত্রী সংগ্রহ করার পরে, সেই দিগ্বিজয়ী অশ্বকে যজ্ঞের নামে হত্যা করা হতো। এ যুগের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, সাধারণ মানুষদের মুনাফার হাতিয়ার করেই নিজেদের কীর্তির ধ্বজা উড়াচ্ছে ধনিক বণিকরা। আর কীর্তির নিদর্শন রূপে, নানা ব্যাভিচারের শেষে, শেষ করে দেওয়া হচ্ছে কাঞ্চনদের মতো যজ্ঞাশ্বদের। আসলে কাঞ্চনরা জীবনভর খেটে মরে অন্যকে বিজয়ী করে তোলার জন্যে। সেই শ্রমেই ক্রমশ নিঃশেষ করে দেয় নিজের যৌবন, প্রেম, আকাঙ্ক্ষা সহ অমূল্য জীবনও। কাঞ্চন-রেখার নিষ্পেষিত, শোষিত জীবনের দিকে তাকিয়ে, তাদের জীবন পরিণামের কথা ভেবে, এবং বিশেষ কাঞ্চন রেখার জীবন সর্বস্বধন যুগের কবলে নিবেদিত করার কথা চিন্তা করলে এ যুগের যুবক সম্প্রদায়কে যে গল্পকার অশ্বমেধের ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন, সে কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। আর সেই দিক থেকে চিন্তা করে দেখলেই আলোচ্য গল্পটির ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ নামকরণ সার্থক হয়ে ওঠে।
Leave a comment