অলিভার টুইস্ট (Oliver Twist, 1838 )
এ উপন্যাসে ডিকেন্স প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিলেন সমাজ সংস্কারক তথা মানবতাবাদী জীবনশিল্পীর ভূমিকায়। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অলিভার টুইস্টের জন্ম হয়েছিল এক আশ্রয়শালার অসহায় পরিবেশে। অলিভারের জন্মের পর তার মার মৃত্যু হলে এক নিষ্ঠুর অবস্থার মধ্যে বড়ো হতে থাকে অলিভার। একসময় আশ্রয়শালার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনার অভাবে অলিভার স্বল্প (মেয়াদ) শিক্ষানবিশীতে নিজেকে নিযুক্ত করে এবং সেখান থেকে অবশেষে লন্ডনে পালিয়ে যায়। এক সমাজ বিরোধী দলের খপ্পরে পড়ে যায় পাণ্ডা জনৈক ফাগিন (Fagin) আর যাদের আস্তানা লন্ডনের নোংরা বস্তিতে। এই দলের অন্য সদস্যরা হল বিল সাইকস (Bill Sikes), জ্যাক ডকিন্স (Jack Dowkins) ও ন্যান্সি (Nancy)। বিল কুখ্যাত সিঁধেল চোর, জ্যাক দক্ষ পকেটমার, আর ন্যান্সি বিলের সঙ্গিনী এক বারাঙ্গনা।
জনৈক মি. ব্রাউনলো (Brownlow) অলিভারকে উদ্ধার করলে ফাগিনের দল তাকে অপহরণ করতে সমর্থ হয়। এরপর বিল সাইকসের সঙ্গে একটি নৈশ অভিযানে গিয়ে অলিভার গুলিতে আহত হয়। জনৈক মিসেস মেলাই (Maylie) ও তার পালিতা কন্যা রোজ (Rose) এর সেবা যত্নে সুস্থ হয়ে ওঠে অলিভার। ন্যান্সি ফাগিন ও তার পৃষ্ঠপোষক শয়তান মঙ্কসের (Monks) চক্রান্ত ফাঁস করে দিলে বিল সাইকসের হাতে নিহত হয়। বিলও ঘটনাক্রমে মারা পড়ে, আর ধরা পড়ে ফাগিন ও অবশিষ্ট সাঙ্গপাঙ্গ।
অলিভার টুইস্টের মুখবন্ধে পরিষ্কারভাবেই ডিকেন্স তাঁর এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিল। লন্ডন শহরের সমাজ বিরোধী দুষ্টচক্রের ঘৃণ্য চেহারা উদ্ঘাটিত করা এবং ১৮৩৪ এর ‘New Poor Law’-এর অমানবিকতার দিকটিকে জনগণের কাছে তুলে ধরাই ছিল লেখকের মূল অভিপ্রায়। এডওয়ার্ড বুলওয়ার লিটন এবং উইলিয়াম হ্যারিসন এনসওয়ার্থ এর ‘নিউগেট রহস্যোপন্যাসে’ সমাজ বিরোধীদের চিত্রিত করা হয়েছিল সহানুভূতির রোমান্টিক আলোকে। ডিকেন্সের ‘আলিভার টুইস্টের’ দুঃস্বপ্ন তাড়িত বাস্তব সমাজচিত্র সেই রোমান্টিকতাকে ভেঙেচুরে দিয়েছিল।
ওড অন এ গ্রীসিয়ান আর্ন (Ode one a Grecian Urn)
—জন কীট্স।
—সৌন্দর্যমূলক কবিতা।
কবিতাটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত প্রাচীন গ্রিসের এক ভস্মাধারে গায়ে আঁকা একটি উৎসব দৃশ্য দেখে রচিত। “কারা এঁরা? দেবতা না মানুষ? এই কুমারীরাই বা কারা? কারা বাঁশি বাজাচ্ছে? কীসের উল্লাস? শ্রুত সংগীত মধুর, অশ্রুত আরও মধুর (A heard Melodies are sweet, but those unheard are sweeter) বংশীবাদক! বাজাও। তরু তলে হে তরুণ যুবক, কোনো দিন থামবে না তোমার গান। এ তরুণ পাতাও ঝরবেনা। বসন্ত কোনোদিন নেবে না বিদায়। এই যজ্ঞভূমিতে কারা আসছেন? পুরোহিত চলেছেন মাল্যভূষিত ধেনু নিয়ে। কোনো নদীকূলে বা সমুদ্রতীরের ক্ষুদ্র নগরী আজ জনশূন্য হল? নগরীর পথ নীরব। সুন্দর গ্রিসীয় মূর্তি, মর্মরে অঙ্কিত মানব মানবী, বৃক্ষশাখায় দলিত নীরব এই দৃশ্যসমূহ ভাবনার অতীত লোকে কোথায় নিয়ে যায়। এই যুগও জীর্ণ হয়ে যাবে কিন্তু নীরব সংগীত তখনো থাকবে, ক্লান্ত মানুষকে বলবে : “সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর, পৃথিবীর কথাই তোমরা জানো আর এই কথাই তোমাদের জানাবার।”
“Beauty is truth, truth is beauty-that is all ye know on earth, and all ye need to know.”
সব মিলিয়ে বলতে হয়, কবির কাছে সত্য ও সুন্দরের বাণীবাহক হচ্ছে এই প্রাচীন গ্রিসের ভস্মাধার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে শাশ্বত অনুভবের কথা।
অ্যাজ ইউ লাইক ইট (As you like it)
-শেকসপিয়র।
—কমেডি নাটক।
শেকসপিয়রের দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় কমেডি নাটক ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এ নাটক রচিত। শেকসপিয়রের খুশির মেজাজ এখানে উজার করে দিয়েছেন। রৌদ্রালোকিত আকাশ, প্রচণ্ড সবুজ গাছপালা, মিষ্টি পরিবেশ আর গান; দর্শকদের যেন বলছেন যার যেমন ইচ্ছা দেখে নাও, এটি রোমান্সের অবিস্মবাদিত লীলাভূমি।
রাজ্য হতে আপন ভ্রাতার চক্রান্তে নির্বাসিত ডিউক সিনিয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা আশ্রয় নেন আর্ডনের অরণ্যে। ডিউক কন্যা রোজালিন্ড ও সিংহাসন লোভী ফ্রেডিরেক-এর মেয়ে সিলিয়াকে নিয়ে চলে আসে এই অরণ্যে। জনৈক্য স্যার রোনাল্ড-এর ছেলে অর্লান্ডো ও তার শত্রুভাবাপন্ন ভাই অলিভারও আসে আর্ডেনের অরণ্যে। প্রেম এ নাটকের মূল বিষয়। রোজালিন্ড-অর্লান্ডোর রোমান্টিক প্রেমের সমান্তরালভাবে সিলিয়া-অলিভারের কিছুটা স্থূল প্রেম সম্পর্ক এবং টাচস্টোস ও অড্রির নিতান্ত জৈবিক প্রেম বিভিন্ন ধর্মী প্রেমের এক চিত্তাকর্ষক কাহিনি এখানে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে মেষপালকদের সহজিয়া প্রেম ও বিবাহের বৃত্তান্ত। অনেকগুলি গান রয়েছে এ নাটকে। এই গানগুলি কমেডির রোমান্টিকতা ও গীতিধর্মীতাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।
প্রমিথিউস আনবাউন্ড (Prometheus Unbound)
—পাশি বিশি শেলী।
—নাট্যগ্রন্থ।
বিদ্রোহের আগ্নেয় আবেগ ও স্বাধীনতার জন্য অনিঃশেষ আকাঙ্ক্ষা সর্বোত্তম রূপ পেয়েছে শেলীর শ্রেষ্ঠ কীর্তি—‘প্রেমিথিউস আনবাউন্ড’এ, চার অঙ্কে সম্পূর্ণ এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র, বীর বিদ্রোহী প্রমিথিউস মানব সমুদয়ের প্রতিনিধি, দেবরাজ জিউসের আধিপত্যবাদ, পীড়ন ও পাপাচারের বিরুদ্ধে নিজ আদর্শে ও লক্ষ্যে অটল। প্রমিথিউস জননী ধরিত্রী (Earth) অন্যায় ও ঘৃণার প্রতিভূ জিউসের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে সমর্থন জুগিয়েছেন, আর প্রমিথিউস উজ্জীবিত হয়েছে –সহধর্মিণী এশিয়া (Asia)-র চিন্তায়, নারকীয় শক্তির প্রতীক জেমাগর্গন-এর হাতে অবশেষে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জিউস এবং মুক্ত প্রমিথিউস মিলিত হয় এশিয়ার সঙ্গে স্বৈরতন্ত্রী ও পীড়নকারী শাসনের মেয়াদ শেষে সূচিত হয় প্রেম ও আনন্দের যুগপ্লাবন।
গ্রিক নাট্যকার ঈসকিলাসের নাটকের স্মরণীয় চরিত্র প্রমিথিউস বিপ্লব শানিত যুগমানসে বিচিত্র তাৎপর্যে প্রতিভাত হয়েছিল। গ্যেটে ও বায়রণ তাঁদের কাব্যে প্রমিথিউসের মহিলাকীর্তন করেছিলেন। আর শেলীর কাব্যে বীর প্রমিথিউস দেখা দিলেন এক অনমনীয় বিদ্রোহীসত্তা রূপে, যার মুক্তি এবং এশিয়ার সঙ্গে মিলন উদ্বোধন করল এক বিশ্বব্যাপী শান্তিপর্ব। এশিয়া এই কাব্যে প্রেমের আত্মস্বরূপ। প্রমিথিউসের সঙ্গে এশিয়ার মিলনোত্তর পর্বে এক মহাজাগতিক আনন্দোচ্ছলতার ছবি শেলী পরিস্ফুট করেছেন নাটেকর শেষ অংক। যেখানে প্রেমের মহামূৰ্চ্ছনা মানবাত্মার মুক্তি ও নব বসন্তের দৈববাণী বহন করে এনেছে— “Man, one harmonious soul of many a soul, where nature is its own divine control, where all things flow to all as rivers to the sea.”
অরিওপজিটিকা (Areopagitica)
—মহাকবি মিল্টন।
– প্রবন্ধ গ্রন্থ (১৬৪৪), গদ্যে রচিত।
বিদেশ ভ্রমণ শেষে ত্রিশ বছর বয়সে যখন তিনি দেশে ফিরলেন তখন ইংলন্ডের রাজনৈতিক আকাশে দুর্যোগের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। রাজা প্রথম চার্লসের বিরুদ্ধে ইংলন্ডে প্রজাদের অভ্যুত্থান হয়েছে; প্রজাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মসী হাতে প্রজাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এই রাজনৈতিক বিচার বিতর্কে প্রায় বছর কুড়ির জন্য মিল্টন জড়িয়ে পড়লেন। এই সময়ের গদ্য তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রচিত গদ্য রচনা সাময়িক বিষয়কে নিয়ে লেখা। এই প্রবন্ধাবলিতে তার বহু পঠিত জ্ঞান ও বুদ্ধির দীপ্তি আছে। কিন্তু সাহিত্য মূল্য খুবই সামান্য। রচনাশৈলীতে সহজ স্বাচ্ছন্দ্য নেই।
এই সময়কার রাজনৈতিক প্রবন্ধাবলীর মধ্যে ব্যতিক্রম ‘অরিওপাজিটিকা’ প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাধারণের মত প্রকাশের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে গ্রন্থটি রচিত। প্রাচীন এথেন্সে রাজসভার স্থান হচ্ছে ‘অরিওপেগাস’। সেই সূত্র ধরেই গ্রন্থটির নাম ‘অরিওপজিটিকা’। কারণ জনসাধারণের কথাই গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে।
লর্ড সভা ও কমন্সসভার সদস্যদের উদ্দেশ্যে লেখক তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো গ্রন্থ বা যে-কোনো বিষয় ছাপানো চলবে না, এতে সরকারের পছন্দমতো অভিমত ছাড়া অন্য মতের কণ্ঠ রোধ করা হবে। দ্বিতীয়ত বিভিন্নমুখী পড়াশোনা এবং বিভিন্ন মতবাদের সঙ্গে পরিচয় মানব মনের বিকাশের জন্য প্রয়োজন। তৃতীয়ত লাইসেন্স বা অনুমোদনের নাম করে বাজে ও ক্ষতিকর বিষয়ও অনেকসময় চালু হয়ে যায়। এর ফলে সার্বিকভাবেই ক্ষতি হবে। কাজেই জ্ঞানচর্চার সমূহ ক্ষতি হবে বলে মিল্টন জোরালো অভিমত প্রকাশ করলেন। চাইলেন—জানা, বোঝা ও বলার শৃঙ্খলমুক্তি, চাইলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
মিল্টনের মুক্তি, চিন্তাশীলতা ও ওজস্বিতার জন্য এই গ্রন্থটি শুধু প্রসিদ্ধ নয়, তাঁর অন্যান্য গদ্য রচনার মধ্যেও ব্যতিক্রম।
এ টেল অব টু সিটিজ (A Tale of two Cities)
জীবন স্পন্দনে নিগুঢ় রহস্য এবং সমাজ ব্যবস্থার প্রকৃত রূপটি ফুটে উঠেছে ডিকেন্সের এই উপন্যাসটিতে । ফরাসি বিপ্লবে ফ্রান্স ও লন্ডনের পটভূমিকায় রচিত হয়েছে এই উপন্যাসটি।
নায়ক সিডনি কার্টন উপন্যাসের নায়িকা ‘লুসি’কে ভালোবাসে। অথচ লুসি চার্লস ডার্ন এর বিবাহিতা স্ত্রী। বিপ্লবের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ডার্নেটকে কারাগার থেকে পালাতে সাহায্য করা এবং নিজে তাঁর স্থানে প্রাণোৎসর্গ করে সিডনি কার্টন প্রেমের মহৎ পরাকাষ্ঠা দেখিয়াছেন। উপন্যাসটি কিছুটা পরিমাণে ভাবালতায় আক্রান্ত হলেও এর মহত্ব ও জীবনধর্মীতা অনস্বীকার্য। সিডনি কার্টনের চরিত্রের যে মহত্ব লেখক দেখিয়েছেন তা তারই জীবনাদর্শ সঞ্জাত। একটি প্রেমকে অবলম্বন করে দুই বিপ্লবের দুই নগরীর যে চিত্র লেখক এখানে দেখিয়েছেন এবং যে মেলবন্ধন দেখিয়েছেন তা এককথায় অপূর্ব। ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ ডিকেন্সের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম।
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ‘এ টেল অব টু সিজিট’ একটি উল্লেখযোগ্য অবদান সৃষ্টি করেছে। একদিকে জীবন রস অন্যদিকে বিপ্লবের জন্য প্রাণোৎসর্গ উপন্যাসটিকে এনে দিয়েছে মোহনীয়তা। আধুনিক উপন্যাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
টিনটার্ন অ্যাবি (Tintern Abbay)
টিনটার্ন অ্যাবি রোমান্টিক যুগের অন্যতম পথিকৃত কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০)-এর একটি বিখ্যাত কবিতা। যে খণ্ড কবিতাগুলির জন্য ওয়ার্ডসওয়ার্থ বিশ্বখ্যাত তার অন্যতম হল এই কবিতাটি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতি প্রেমিক কবি। প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ স্পর্শ উপভোগ করে কবির ইন্দ্রিয় চেতনা পরিতৃপ্ত। এই পরিতৃপ্ত এক দার্শনিকতায় উন্নীত।
‘টিনটার্ন’ অ্যাবি কবিতাটিতে কবি প্রকৃতির প্রভাবে তাঁর রহস্যবোধ উদ্বোধনের এক চমৎকার কবিত্ব খণ্ডিত বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন—
“We are laid a sleep
In body, and became a leaving soul
We see in to the life of things.”
পরম রমণীয় দৃশ্য দেখার মধ্যে যে ইন্দ্রিয় চেতনা তৃপ্ত হয় তাই কবিস্মৃতিতে চকিত হয়ে সঞ্চারিত হয়েছে কবির দেহমন আত্মায় সর্বত্র। কবিও নিগুঢ় আনন্দ রসে উদ্বোধিত হয়ে এক ধ্যান দৃষ্টি লাভ করেছেন যা দিয়ে জগতের সমস্ত রহস্যের মর্মভেদ করা যায়। এই চোখের দেখা থেকেই দিব্য দৃষ্টি লাভ কবিতাটির মূল বক্তব্য।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ মূলত প্রকৃতির কবি। কিন্তু কবির দৃষ্টি শুধুমাত্র প্রকৃতির রূপরসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রগাঢ় দার্শনিক ও অতিন্দ্রিয় অনুভূতি লাভ করে প্রকৃতি ও মানব মনের মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছেন বলেই কবিতাটি রোমান্টিক যুগের ভাববৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট করেছে।
রোমান্টিক কবি গোষ্ঠীর মধ্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থই আত্মপ্রত্যয়শীল মৌলিক কবি। তাঁর অন্তর অভিজ্ঞতা তাঁর কাব্যের উৎস বলে তিনি এমন এক চৈতন্যের কালে তাঁর দৃষ্টি পার্থিব বস্তুকে অপার্থিব গৌরবে খণ্ডিত করে।
ওড্ টু এ নাইটিঙ্গল
রোমান্টিক যুগের বয়ঃকনিষ্ঠ কবি কীট্স-এর ‘ওড্ টু এ নাইটিঙ্গল’ কবিতাটিতে কবির আন্তর প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপটি উপলব্ধি করা যায়। বন্ধু রেনোলর্ডস্-কে একটি চিঠিতে কবি Keat’s লিখেছেন “Ifind, I can not exist without poetry-withouteternal poetry half the day. Will not do it the hole of it”—এই eternal poetry হল “Ode to a Nightingale.” উন্মাদের মতো যে কবি মানব মনের সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে খুঁজে বেড়িয়েছেন সৌন্দর্য লক্ষ্মীকে তিনিই বলতে পারেন।
“Truth is beauty, Beauty is truth”
আলোচ্য কবিতাটিতে Shelly-র মনোবৃত্তির সঙ্গে কীট্স-এর মিল ও অমিল উভয়ই লক্ষ্য করা যায়। শেলী যেমন কল্পনাচারী, কীটসও তেমনি কল্পনা বিহারী। কিসের কল্পনার বিহারের মধ্যে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধুমাত্র আকাশ বিহারের প্রবণতা নেই। কী চেয়েছেন এই মাটি পৃথিবীর অম্লান সৌন্দর্য রসের বাধাবন্ধহীন পরিপূর্ণ উপভোগ। শেলীর চিন্তায় যে আদর্শবাদ ছিল বিপ্লবীকর্তা ছিল কীটসের সৌন্দর্য চিন্তায়, সেরকম কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এই কবিতাটিতে Keat’s মামুলী চিন্তাধারার পরিবর্তে সৌন্দর্যলোকের বজ্রবিসর্জিত রেখা অনুসরণ করেছেন। অবসাদ ও আনন্দের বিপরীতমুখী দোলায় তাঁর চিত্ত তরঙ্গায়িত হয়েছে। নাইটিঙ্গেলের গানের সূত্র ধরে তিনি নানা বিচিত্র সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন। ফ্রান্স ইটালির সূর্যকরোজ্জ্বল দ্রাক্ষাক্ষেত্র, বিগলিত সূর্যালোক ধারার মতো স্বচ্ছ রক্তিম ফেনায়িত সুরা ও সুর-ভিত অন্ধকারে রহস্যময় আকাবাঁকা অরণ্য বীথিকা এই সমস্তই মিশেছে নাইটিঙ্গলের গানে। পাখির স্বতোৎসারিত গানকে তিনি সৌন্দর্য প্রতিবেশে বেষ্টিত করে এক চিরঅম্লান কল্পলোকের অন্তর্বাণী রূপে অনুভব করেছেন। আর সেই সঙ্গে ক্ষণভঙ্গুর মানবজীবনের অতৃপ্ত সৌন্দর্য পিপাসা অকাল বার্ধক্য বিড়ম্বিত তারুণ্যের বুভুক্ষু হাহাকারকে তীব্র অভিব্যক্তি দিয়েছেন। নাইটিঙ্গেল হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের প্রতীক।
রোমান্টিক যুগের যে সীমান্ত সারি ভাব কল্পনা ও ভাব ব্যঞ্জনা অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাই Keat’s-এর এই কবিতাটিতে পরিস্ফুট। এই কারণে কবিতাটি রোমান্টিক কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রূপে পাঠকমনে চিরজাগ্রত থাকবে।
দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড (The Waste Land)
T.S. Eliot / টি. এস. এলিয়ট।
– কাব্যগ্রন্থ।
১৯২২ খ্রি. প্রকাশিত হয় এলিয়টের এই ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যখানি। মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপের ধ্বংস ও হতাশার মহাকাব্য তথা ‘আধুনিকতার’ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দি বেরিয়াল অব দি ডেড (The Burrial of the Dead), এ গেম অব চেস (A Game of Chess), দি ফায়ার সামন (The Fire Sermon), ডেথ বাই ওয়াটার (Death by Water), এবং হোয়াট দি থান্ডার সেইড (What the Thunder Said)। এই পাঁচটি খণ্ডে সম্পূর্ণ এই মহাকাব্য হয়ে উঠেছিল আধুনিক জীবনের বন্ধ্যাত্ব ও নিরাশার এক আশ্চর্য ও মর্মস্তুক রূপক কাহিনি।
এক শুষ্ক ও প্রাণহীন দেশ যার পুনরুজ্জীবিত হতে পারে একমাত্র উর্বরতা ফিরে এলে, বৃষ্টিপাতে মরুদেশের শুষ্কতা দূর হলে—এমনই এক প্রতীকের আশ্রয়ে এলিয়ট মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপের পোড়ো, বন্ধ্যা, জনশূন্য, ভগ্নরূপ তুলে ধরেছিলেন ‘দ্য ওয়েষ্ট ল্যান্ডে’। মূল কাব্যটি ছিল প্রকাশিত সংস্করণের তুলনায় দীর্ঘতর।
‘ওয়েস্ট ল্যান্ডে’র প্রথম পর্বে বাদ্য মরুদেশের প্রাণহীনতার ভয়ানক চেহারাটি এক পরিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। মহাযুদ্ধোত্তর ধ্বংসের সর্বগ্রাসী রূপটি এলিয়টের নৈরাশ্য লাঞ্ছিত মনোভঙ্গির বিষণ্নতায় করুণ অথচ তীব্র হয়ে ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় পর্বের বিষয় ‘মৌনতা’ যা ক্ষয় ও মৃত্যুর অনিবার্য লক্ষণাক্রান্ত। এখানে সম্ভ্রান্ত ও সাড়ম্বর এক নারীর উপস্থিতি যার রূপ, বৈভব, বেশবাশ ও প্রসাধন প্রলোভন সৃষ্টিকারী মৌনতার প্রতীক। এখানে তিনি সোজাসুজিভাবে প্রশ্নই করেছেন : “What you get married for if you don’t what children?”
তৃতীয় পর্বে মৃত্যু ও শুষ্কতার উপসর্গগুলি গ্রাস করেছে বহতা নদীর গতি, ইঁদুরের পায়ের শব্দ, হাড়ের শব্দ, অপঘাত মৃত্যু, তথা নগ্ন শুভ্র মৃতদেহ ইত্যাদির উল্লেখে ক্রমেই এক ভয়াবহ, শীতার্ত জড়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন এলিয়ট।
চতুর্থ পর্বে, মৃত্যু এসেছে জ্বলন্ত কামনা বাসনার দাহকে নির্বাপিত করতে।
পঞ্চম পর্বে জল ডেকে এনেছে মৃত্যুকে। তবু অন্য এক জলপ্রবাহ, জীবনদায়ী এক ভিন্ন নদীর সন্ধান, কাব্যের শুরুতে যন্ত্রণা ও আর্তির কথা দিয়ে এসেছে খ্রিস্টের মৃত্যু এবং মরণাপন্ন মনুষ্যজন্মের কথা।
সব মিলিয়ে এক শুষ্ক, প্রাণহীন, পাথুরে পার্বত্য ক্ষেত্রের মরুময়তা ও জলের জন্য অপার তৃষ্ট্বা ওয়েস্ট ল্যান্ডের শাপগ্রস্ত ভয়াবহতাকে প্রকট করেছে। এই দেশ অভিশপ্ত লেখকের ভাষায় অবক্ষয়িত মৃতপ্রায় ইউরোপ। তাই এটি রূপক কাব্য মাত্র।
ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান ( Man and Superman)
—বার্নাড শ’।
—নাট্যগ্রন্থ।
১৯০৫ খ্রি. ২৩ মে রয়েল কোর্ট থিয়েটারে অভিনীত হয় নাট্যকার বার্নাড শ’র অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান নাটকটি। এক বিস্ময়কর থিসিস প্লে (Thesis play) এই নাটকেই বার্নাড শ’ উপস্থিত করলেন তাঁর জীবনীশক্তি তথা Lifge Force-এর তত্ত্ব। যে শক্তি মানুষকে ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে এমন এক উচ্চতায় যখন অতিমানব বা ‘সুপারম্যান’-এর আবির্ভাব ঘটবে। শ’ তাঁর এই নাটককে বলেছিলেন—’এ কমেডি অ্যান্ড এ ফিলোজফি’ এবং প্রকৃতই এ নাটকে ভাবাদর্শের ছিল নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। চরিত্রসমূহ, ঘটনা বিন্যাস এবং নাট্যগঠন সবই হয়ে পড়েছিল নাটকের দার্শনিক ভাববস্তুর অনুগত। সপ্তদশ শতকের স্পেনীয় সাহিত্যে যে হৃদয়হীন, নারী সঙ্গলোভী প্রতারক ‘ডন’ জুয়ানের কাহিনি প্রকাশিত ও সমগ্র ইউরোপে প্রচারিত হয়েছিল শ’ নাটকের ‘নব্য ডন জুয়ান’ জন ট্যানার সেই পুরুষকর্তৃক নারী শিকারের পাশ্চাত্য ধারণাটিকে একেবারে উলটে দিল। কোথায় নায়িকা অ্যান হোয়াইট ফিল্ডের আকর্ষণে সে অ্যানের পিছু ধাওয়া করবে, না তার বদলে দেখা গেল অ্যান্ই ছুটে বেড়াচ্ছে অনিচ্ছুক জনের গলায় বরমাল্য দেবার আকাঙ্ক্ষায়। এই নাটকের অন্য এক বিশিষ্ট চরিত্র গাড়ির চালক ‘হেনরি স্ট্রেকার’ যার মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি, তথা মান্দ্রিকতার যুগের এক নতুন মানব রূপ আভাসিত হয়েছে।
নাট্যকার মানুষের ক্রমবিকাশের ও উত্তরণের লক্ষ্যে এক নতুন ধর্ম উপস্থাপিত করলেন। জার্মান দার্শনিক নীটশের সুপারম্যানের ধারণা, স্যামুয়েল বাটলারের ‘জৈবিক বিবর্তন’-এর তত্ত্ব এবং বের্গসর গতিতত্ত্ব (elan vital) এইসব ভাব উপাদানগুলি বার্নাড শ’কে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কার্যক্রমের বাইরে নিয়ে গেল এক নতুন ধর্মতত্ত্বের আশ্রয়ে। ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যানের সঙ্গে সংযোজিত ‘The Revolutionist’s Handbook’-এ শ’ মানুষকে বর্ণনা করলেন ঐশ্বরিক শক্তির মন্দির রূপে, এবং তার উদ্দেশ্যে বললেন –
“Ye must be born again and born different.”
পিগ্ল্যালিয়ন (Pygmalion 1913)
—নাট্যকার বার্নাড শ’।
—নাট্যগ্রন্থ।
—পিগম্যালিয়ন প্রথম অভিনীত হয় ১৯১৩ খ্রি. ভিয়েনাতে। জনৈক্য অধ্যাপক হিগিন্স এর কাছে শিক্ষা পেয়ে গ্রামের ফুলওয়ালী এলিজা কীভাবে তার নারীসত্তার সৌন্দর্য তথা মানবিক সংবেদনশীলতাকে গড়ে তুলল তারই এক অনবদ্য ও সরস নাট্যরূপ এই পিগ্ম্যালিয়ন। যেটি ১৯৫৬-তে চলচ্চিত্রায়িত হয় মাই ফেয়ার লেডি (My Fair Lady) নামে।
দি প্রিলিউড (The Prelude)
—ওয়ার্ডসওয়ার্থ।
—আত্মজীবনীমূলক কাব্য।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন প্রকৃতির পূজারি। আশৈশব প্রকৃতিই তাঁর কাছে দীপ হয়ে জ্বলে উঠেছে এবং সুর হয়ে বেজে উঠেছে। প্রথম যুগে তিনি ভালোবেসেছিলেন প্রকৃতিকে বালকের উদ্দাম ভাব নিয়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি প্রকৃতিকে ভালোবাসলেন তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে। তৃতীয় পর্যায়ে কবি দার্শনিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে চিন্তা ও অনুভূতির মাধ্যমে প্রকৃতির লীলা উপভোগ করেছিলেন। আলোচ্য কাব্যে তিনি বাল্যকাল থেকে কী করে প্রকৃতিকে ভালোবেসেছিলেন তার নিখুঁত বর্ণনা আছে।
‘The Prelude’ লেখা শুরু হয়েছিল ১৭৯৯ খ্রি. এবং শেষ হয় ১৮০০-এ। অবশ্য এটি প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর ১৮৫০ খ্রি.। বন্ধু কোলরিজকে উদ্দেশ্য করে লিখিত ওয়ার্ডস ওয়ার্থের এটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি রূপে স্বীকৃত। এ কাব্যের উপাদান কবির ব্যক্তি জীবনের কালানুক্রমিক স্মৃতিসমূহ। তাঁর শৈশব, স্কুল ও পরে কেমব্রিজের ছাত্রাবস্থা, লন্ডনের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা পর্ব, প্রথম ফ্রান্স ও আল্পস ভ্রমণ, বিপ্লব চলাকালীন ফ্রান্সে বসবাসের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দুর্লভ, হিরন্ময় মুহূর্তগুলি এই কাব্যকে বিরল সার্থকতা দিয়েছে। প্রকৃতির অনুপম জগতের সঙ্গে তাঁর নিবিড় অন্তরঙ্গতার ক্রমবিকাশই ওয়ার্ডস ওয়ার্থের এই অধ্যাত্ম চরিতের মূল বিষয়। প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের মাঝে যুগপৎ ভয় ও আনন্দ, শক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পেয়েছিলেন কবি, খুঁজে পেয়েছিলেন পরিত্রাণের আশ্বাস। প্রকৃতি বিশ্বের অন্তর্গত প্রশান্তি ও সেই প্রশান্তি থেকে জাত আনন্দ The Prelude-এর মূল সুর যা পাঠকচিত্তকে সর্বদা মোহিত করে রাখার দাবি করে।
প্যারাডাইস লস্ট ( Paradise Lost )
—জন মিল্টন।
—মহাকাব্য।
মানুষের পতনের কাহিনিই ‘প্যারাডাইস লস্ট’ জটিল রূপকল্পের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কসূত্র এবং খ্রিস্টের ভূমিকার তাৎপর্য মিল্টনের রচনার মূল বিচার্য। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ও পরে নরকে পতিত শয়তান ও বিদ্রোহী দেবদূতগণ সামগ্রিক বিচারে গৌণ, তারা কেবলমাত্র আদম ও ইভের পতনের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছে এবং শয়তান নয়, আদমই সমগ্র কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র। অনেক সমালোচক অদম্য ও অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন শয়তান চরিত্রের প্রতি মিল্টনের দুর্বলতা লক্ষ্য করেছেন এবং তাকেই নায়ক বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। ঈশ্বরানুগী, শুদ্ধবাদী, মিন্টন তো ঈশ্বরের কার্যাবলিকেই যথার্থ প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ রচনা করেছিলেন।
‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর বারোটি গ্রন্থের সংকলন সম্পর্কে আলোচনাকারী লেখকের রচনাশৈলীর উল্লেখ ব্যতীত সে আলোচনা সম্পন্ন হতে পারে না। মূলত মিল্টনের দৃষ্টিহীনতার কারণে দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্পে ঘাটতি রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আর সেই কারণে ধ্বনিপ্রধান এমন অনেক শব্দ অন্ধ কবি ব্যবহার করেছিলেন সেগুলি হয়তো তেমন অর্থবহ ছিল না। তবে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও পদ্য অনুচ্ছেদের ব্যবহারে এবং ধ্রুবদী শব্দ ও বাক্য গঠনরীতির প্রয়োগে মিল্টন যে অনন্যশৈলী নির্মাণ করেছিলেন সেই মহান রীতি ব্যতিরেকে ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর মতো মহাকাব্য অসম্ভব ছিল।
অলিভার টুইস্ট (Oliver Twist )
—চার্লস ডিকেন্স।
—উপন্যাস।
এক অনাথ আশ্রমে জাত অজ্ঞাত কুলশীল বালকের নাম হল অলিভার টুইস্ট। এই শৈশব থেকে যন্ত্রণা ও অপশাসনের মধ্য দিয়ে একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও দুর্যোগের হাত থেকে কীভাবে জীবনে সুস্থিরতা ফিরে পেয়েছিল তা এ উপন্যাসের মূল কাহিনি।
ডিকেন্সের সময়কালে লন্ডন শহরের অনাথ আশ্রম, কারখানার জীবন, চোরের আড্ডা, সামাজিক অবস্থা সবই লেখকের ছিল জানা, তাই কাহিনি বয়নে এ উপন্যাসে বাস্তবতার অভাব নেই। ডিকেন্সের এই রাস্তব বিমুখতা একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এটাই সব নয়, যে অনুকম্পা, যে দরদ, মানুষের অন্তরকে উদ্ভাসিত করে তোলে সেই দরদবোধ ডিকেন্সের ছিল। তারই ফলে অলিভারের দুঃখ ও বেদনা পাঠকের অন্তরকে স্পর্শ করে আর এরই ফলে অন্যান্য চরিত্রগুলিও হয়ে উঠেছে সজীব। এই সঙ্গে ডিকেন্সের আর একটি বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়। তিনি মানবজীবনের অন্ধকার দিক যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি তাদের মধ্যেও যে ন্যান্সীর মতো মেয়ে আছে, সমাজে চোর, ঠ্যাঙাড়ে, জোচ্চোর, যেমন আছে তেমনি মি. ব্রাউনলোর মতো সদাশয় মানুষও আছে। এবং এই আলো অন্ধকার, ভালো মন্দ নিয়েই যে সাধারণ মানুষ, সেই সমাজের ভালোর দিকও তিনি তুলে ধরতে বিস্মৃত হননি।
ওড টু এ নাইটিঙ্গেল (Ode to a Nightingale) ১৮২০
-কীটস (জন)।
—গাথা কবিতাগ্রন্থ।
জন কীসের রচিত আঠারোটি ওকের মধ্যে ‘ওড টু এ নাইটিঙ্গেল’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কবি এই কবিতাটি তাঁর ভাই টম-এর মৃত্যুর কয়েকমাস পরে রচনা করেন। কবির হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত। এই পৃথিবীতে যেখানে দুঃখ, কষ্ট, অবসাদ, ক্লান্তির মুখোমুখি হয়ে মানুষ বসে আছে, এবং যন্ত্রণায় গভীর আর্তনাদ করছে সেখানে নাইটিঙ্গেল (বুলবুলি) এর অপার্থিব সুর নিয়ে আসে মুক্তির বাণী। কবিতাটিকে রয়েছে মধ্যরাত্রির রহস্য। অপার্থিব সৌন্দর্য ও না পাওয়ার গ্লানি, কবি বুলবুলির অপূর্ব সংগীতের মধ্য দিয়ে এই দুঃখ-কষ্ট বিস্মৃত হতে চান, বুলবুলির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য তিনি উন্মুখ। কল্পনার সাহায্যে কবি সেই একাত্মতা লাভ করলেন। সাময়িকভাবে তাঁর বাস্তব চেতনা যেন বিলুপ্ত হল।
মানুষের মৃত্যু হলেও বুলবুলির সংগীত অনাদিকালের স্রোতে বহমান। যে মধুর স্বর বর্তমানে তাকে মুগ্ধ করেছে, অতীতকালে সম্রাট ও চাষিরা তা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কীট্সের এই কবিতায় শব্দ, ভাষার ব্যঞ্জনা, নিবিড় ভাবদ্যোতিক, কাব্যার্থ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৌন্দর্যের অজস্র বিনাস পাঠক মনকে সম্মোহিত করে রাখে। তাঁর ব্যঞ্জনাময় শব্দের ইন্দ্রজালে ছবির পর ছবি পাঠকের সমানে ভেসে ওঠে। এই নাইটিঙ্গেলের অপার্থিব সুরের প্রেক্ষাপটে এই পার্থিব জগৎ কবির কাছে আরও দুঃখময় বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এই নাইটঙ্গেল কি শুধুই পাখি? এই পাখিকে কেন্দ্র করে কবিমনে যে বিষাদ ঘনিয়ে এসেছে, সেই দুঃখ কবির জীবনের মহৎ প্রেমের প্রতিবিম্বিত দুঃখ।
লিরিক্যাল ব্যালাডস্ (Lyrical Ballads) ১৭৯৮
-ওয়ার্ডসওয়ার্থ।
—কাব্যগ্রন্থ।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ দুই কবি বন্ধুর রচিত গীতি গাথা সংগ্রহ। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এ কাব্যের দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশিত কবিতাগুলির আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবিতা থেকে পৃথক তা ওয়ার্ডসওয়ার্থ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ মূলত তাঁর খণ্ড কবিতার জন্য বিখ্যাত। তাঁর কবিতায় সাধারণ প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষ স্থান গ্রহণ করেছে। ভাব প্রকাশে কবি আশ্রয়ও নিয়েছেন সাধারণ ভাষার। কবির ‘টিনটার্ন অ্যানে’ কবিতাটি এই গ্রন্থে প্রকাশিত। কবি কোলরীজের বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য এনাসিয়েন্ট মেরিনার’, ‘দ্য নাইটিঙ্গেল’ এই কাব্য সংকলনেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরাণের যুগের শেষ ও নতুন যুগের উন্মেষ ঘোষিত হয়।
লিরিক্যাল ব্যালাডসে প্রকাশিত হয়েছিল—We are Seven, The Thorn, The Idiot Boy, Siman Lee ইত্যাদি। ব্যালাড বলতে যে ধরনের সহজ সাবলীল গাথাকবিতা বোঝায় সেই জাতীয় বিষয়গত ও নাটকীয়তার প্রসাদগুণে সমৃদ্ধ গাথা রচনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের সহজাত ছিলনা তবে মরমীয়া বাদী (Mystic) দৃষ্টিতে প্রকৃতি পরিগ্রহ করল এক চৈতন্যময় রূপ, প্রশান্তি ও আনন্দের এক অপার্থিব রসলোক।
ডিকেন্স ও শরৎচন্দ্র
মানবতন্ত্রী ও প্রতিবাদী জীবনশিল্পী ডিকেন্সের রচনার পাশাপাশি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের জনপ্রিয় ও দরদী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়বে। উভয়েই এক জটিল সময়কালের প্রেক্ষাপটে সমাজ ও জীবনকে দেখেছিলেন সহজ ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ডিকেন্সের মতোই শরৎচন্দ্র সনাতনী সমাজের যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত অসহায় ও পীড়িত নারী পুরুষদের পক্ষে মানবতাবাদের পতাকা উচ্চে তুলে ধরেছিলেন।
“সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই” সমাজের নীচুতলার সেই সব মানুষদের হয়ে নালিশ জানাতে চেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। এ ব্যাপারেও তিনি ডিকেন্সের সমগোত্রীয়। সমাজ সংস্কারে তথা সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ডিকেন্সের মতোই সোচ্চার ছিলেন শরৎচন্দ্র। ডিকেন্সের মতোই কোনো বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিত্তি ছিল না শরৎচন্দ্রের প্রতিবাদী চরিত্রের। তিনি কেবল মানবিক সহানুভূতির সংবেদনশীল দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেম ও হৃদয় বিনিময়ের সমস্যা, বিধবা বিবাহ, অরক্ষণীয় কন্যা, মাতৃত্ব ইত্যাদির সমস্যাগুলিকে পাঠক সমীপে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ও মর্মস্পর্শী ঢং-এ।
ডিকেন্সের মতোই শরৎচন্দ্রের সমাজ সচেতনতা ও প্রতিবাদী মানসিকতার ভেতরে ভেতরে প্রবাহিত হয়েছিল এক আদর্শবাদী ভাবধারা। মনুষ্যত্বের অবমাননা, সহায় সম্বলহীন মানুষদের নির্যাতন, উচ্চবর্ণের তথা সনাতনী ভাবধারায় লালিত ও সুবিধাভোগী মানুষদের সংকীর্ণতা ও নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি শরৎচন্দ্রের মতো আর কেউ উদ্ঘাটিত করেননি। কিন্তু কুৎসিত ও জীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে ফেলার ঘোষণা শরৎচন্দ্রে নেই। এক্ষেত্রেও ডিকেন্সের মতো তিনি একজন মানবতন্ত্রী, সমাজমনস্ক লেখক, কিন্তু বিপ্লবী নয়।
ডিকেন্সের মতোই শরৎচন্দ্রের চরিত্ররা—বিশেষত নারী ও শিশুরা — অনেকাংশেই আদর্শায়িত। রমা, সাবিত্রী, কিরন্ময়ীরা প্রত্যেকেই যাবতীয় বিরূপতার মধ্যেও নম্রতা ও প্রেমের আদর্শ যেন। শরৎচন্দ্রের নায়কেরাও অধিকাংশই নমনীয় ও ভাবালু, তবে অস্বাভাবিক তথা উৎকেন্দ্রিক চরিত্র চিত্রণে ডিকেন্সের যে অভাবনীয় সাফল্য তেমনটি শরৎচন্দ্রে দেখা যায় না। আবেগ অনুভূতি তথা হৃদয়-বৃত্তিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন উভয় লেখক।
ডিকেন্সের মতোই শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে আবেগাতিশয্য ও অতি নাটকীয়তার নিশ্চিত প্রাধান্য। তবে ডিকেন্সের রচনায় হাসি ও অশ্রুর যে ভারসাম্য লক্ষণীয়, শরৎচন্দ্রে তার জায়গায় বেদনাশ্রুর আধিক্য স্পষ্ট। নিপীড়িত মানবাত্মার হাহাকার শরৎচন্দ্রকে অনুভূতিপ্রবণ পাঠক সাধারণের কাছে তাই এত বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।
সর্বোপরি, ডিকেন্সের মতোই সহজ ও সরল ভাষা, রীতিতে মানবমনের তন্ত্রীতে করুণ ঝংকার তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র।
জন কীট্স ও রবীন্দ্রনাথ বা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কীট্স
বিশেষত মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্রের কর্ষিত মহাকাব্যে যুগঅন্তে যে আধুনিক গীতিকাব্যের বা গীতি কবিতার যুগ শুরু হল, সেই আধুনিক গীতি কবিদের ওপর ইংলন্ডের রোমান্টিক যুগের কবিদের প্রভাব অনেকখানি। এক্ষেত্রে প্রথমেই যাঁর কথা মনে আসে তিনি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য শুধু কীট্স নন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু কবির কল্পনা রশ্মিই রবীন্দ্রনাথে সংহত হয়েছিল এবং রবি প্রতিভার আতস কাঁচে কেন্দ্রীভূত এই রশ্মিজালেই রবীন্দ্র কল্পনাকে বহ্নিমান করে স্বীকরণের দ্বারা রবীন্দ্রনাথকে করেছিল ভাম্বর। তাঁর কাব্য সমিধ রূপে কবি কীট্সকেও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কীট্সের সৌন্দর্য চেতনা ও প্রকৃতির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপারজিত রবীন্দ্রনাথও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কবির প্রথম দিকের রচনায় এর প্রভাব সুস্পষ্ট।
কীট্সের সৌন্দর্য পিপাসা ও ইন্দ্রিময়তার স্বপ্নজগৎ প্রভাব ফেলেছে রবীন্দ্রনাথের ‘ছবি ও গান’ কাব্যে। দৃষ্টি-শ্ৰুতিস্পর্শ সুখের মাদকতায় কীট্সীয় নেশাচ্ছন্নতার নিদর্শন পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের এই সব চরণে :
“বিভোর হৃদয় বুঝিতে পারিলে/কে গায়, কীসের গান
অজানা ফুলের সুরভি মাখানো/স্বর সুধা করি পান।”
কিংবা অন্যত্র, যেখানে কীসের ‘Odetoa Nightingale’-এ মধুকণ্ঠী পাখির স্তুতিও তাকে অনুসরণ করে নৈশ অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার অনুরূপ স্বপ্ন বিহ্বলতার প্রসঙ্গ আছে :
“যাই যাই ডুবে যাই/আরো আরো ডুবে যাই,
বিহ্বল বিবশ অচেতন / কোনখানে কোন দুরে।”
আকাশ ও মেঘ, ফুল ও পাখিদের নিয়ে প্রকৃতির যে বর্ণনাময় জগৎ কীটসের নিবিড় চিত্ররূপময় চিত্রকল্পে তা অপূর্ব লাবণ্যময়। Hyperion, Endymion ওডগুলির চিত্রকল্প তথা কাব্য পরিবেশের প্রভাব ‘ছবি ও গানে’ নজরে পড়ে। ‘কড়ি ও কোমলে’ কীটসের ইন্দ্রিয়ময়তার স্বাক্ষর আরও পরিণত ও স্পষ্ট। কীসের প্রিয় ফুল গোলাপ, মধ্যরাতের আকাশে তারা ইত্যাদি—কড়ি ও কোমল, মানসী, চিত্রা প্রভৃতি কাব্যে নিবিড়ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যৌবন স্বপ্ন, উর্বশী, স্তন প্রভৃতি কবিতা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
কীট্সের অবিচল সৌন্দর্য তৃষা ‘সোনার তরী’, ও ‘চিত্রায়’ অভিব্যক্ত হলেও ‘চৈতলী’ কাব্যে সে আকাঙ্ক্ষা এক শান্ত মাধুর্যে পরিণত। যেমন কীটসের ‘Ode to Autumn’-এর পরিপক্ক ও অবনত প্রায় আঙুর বাদামের স্থির চিত্র মেলে- “চৈতলী কাব্যের উৎসর্গ কবিতায়—
“আজিমোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে,
গুচ্ছে গুচ্ছে ধরিয়াছে ফল।”
দৃশ্য, স্বাদ, শব্দ, ঘ্রাণের ইন্দ্রিয় মধুর কীট্সীয় জগতের প্রভাব আরও লক্ষ করা যায়—মধ্যাহ্ন, গান, প্রাচীন ভারত প্রভৃতি কবিতায়।
যে ইন্দ্ৰিয়াকুল বিলাসিতা কীট্সের কাব্য জগতের প্রধান লক্ষণ ‘মানসী’ কাব্যের ‘মেঘদূত’ ও ‘অহল্যার প্রতিতে’ ফুটে উঠেছিল। কীসের ‘The Eve of St. Agnes’-এ বর্ণিত ম্যাডেলিনের সুরম্য প্রাসাদ এবং রূপসী ম্যাডেলিনের সৌন্দর্যের প্রতিফলন নজরে পড়ে এই ‘কল্পনা’ কাব্যের স্বপ্ন কবিতায়। মালবিকার রূপের বর্ণনার সঙ্গে কীট্সের ম্যাডেলিনের সৌন্দর্য চিত্রনের সাদৃশ্য স্পষ্ট—
“অঙ্গের কুঙ্কুম গন্ধ কেশধূপবাস,
ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিঃশ্বাস।
কীট্সকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা তাঁর একটি পত্রে ব্যক্ত করেছিলেন : “আমি যত ইংরাজ কবি জানি সবচেয়ে কীটসের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা বেশি করে অনুভব করি। কীটসের লেখায় কবি হৃদয়ের স্বাভাবিক সুগভীর আনন্দ তার রচনার কলা নৈপুণ্যের ভিতর থেকে একটা সজীব উজ্জ্বলতার সঙ্গে বিচ্ছুরিত হতে থাকে ।” অকাল প্রয়াত কবি কীটসের তুলনায় দীর্ঘতর কবিজীবন বরীন্দ্রনাথের, অভিজ্ঞতা ও ভাবনার বৈচিত্র্যে ও সম্পদে সমৃদ্ধ। ইন্দ্ৰিয় চেতনা তথা সৌন্দর্য পিপাসাকে অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি তথা জীবন মৃত্যুর রহস্য জিজ্ঞাসার গভীরে প্রবেশ করেছেন। বর্ণময়তা, কলানৈপুণ্যে, মাধুর্যে ইত্যাদি ছাড়িয়ে জীবন সত্যের এক ব্যাপকতর পরিধিতে উত্তীর্ণ হয়েছে তাঁর কাব্য কবিতা।
ডেভিড কপারফিল্ড (David Copperfield, 1850)
ডিকেন্সের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ বিগত দেড়শ বছর ধরে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাধনা-সংগ্রামের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতাগুলিকে অবলম্বন করে ডিকেন্স লিখেছিলেন ‘ডেভিড কপারফিল্ড’। মে, ১৮৪৯ থেকে ১৯টি মাসিক কিস্তিতে ও ১৮৫০ থ্রি. একত্রে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই উপন্যাসে ডেভিড কপারফিল্ডের জবানীতে ডিকেন্স পরিবেশন করেছিলেন এক যুবা লেখকের জন্ম ও ক্রম পরিণতির মর্মস্পর্শী কাহিনি যা ডিকেন্সেরই জন্মবৃত্তান্ত।
ডেভিডের জন্মের দু’মাস আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন ডেভিডের বাবা। মা ‘ক্লারা’ ছিলেন দুর্বল এবং ডেভিডের বাল্যকালের আনন্দ ধ্বংস করেছিলেন ক্লারার দ্বিতীয় স্বামী মি, ‘মার্ডস্টোন’ নামে জনৈক পাষণ্ড। মি. মার্ডস্টোন ও তার বোনের নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছিল বালক ডেভিডকে। মায়ের মৃত্যুর পর ডেভিডকে যোগ দিতে হয়েছিল মার্ডস্টোনদের লন্ডন স্থিত কারখানায়। এই সময় পরিচয় হয় ডিকেন্স সাহিত্যে স্মরণীয় কমিক চরিত্র মি মিকবার ও তার পরিবারের সঙ্গে।
এরপর লন্ডন থেকে পালিয়ে ডেভিড আশ্রয় নেয় ‘ডোভারে’ তার খুড়ি ‘বেটসি ট্রটউডে’র কাছে। এবং লেখাপড়া চালাতে থাকে বেটসির আইনজীবি ‘মি. উইকফিল্ডের’ বাড়িতে থেকে। এখানেই উইকফিল্ডের তনয়া অ্যাগনেসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। অতঃপর জনৈক স্পেসলোর অধীনে আইন ব্যবসায় কর্মরত হয় ডেভিড, প্রেমে পড়ে ডোরা স্পেসলোর এবং তাদের বিবাহ হয়। ইতিমধ্যে ডেভিড সংসদীয় সংবাদদাতার পেশা গ্রহণ করে। কয়েক বছরের মধ্যেই ডোরার মৃত্যু হয়। ডেভিড ততদিনে লেখকরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভারাক্রান্ত চিত্তে দেশ-বিদেশে ঘুরতে ঘুরতে ডেভিড পুনরাবিষ্কার করে অ্যাগনেসের প্রেম। তাদের বিবাহিত জীবন হয় অতি সুখকর।
ছোটো বড়ো অসংখ্য চরিত্র ও তদের নানা ঘটনার বৈচিত্র্যে ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। প্লটের গঠনে শৈথিল্য কিংবা আবেগাতিশয্য সমালোচক মহলে এই উপন্যাসের ত্রুটি বলে বিবেচিত হলেও ডিকেন্সের চরিত্রসমূহের সজীবতা, তাঁর রসবোধ, হাসি ও অশ্রুর দোদুল্যমানতা ও প্রকাশভঙ্গি ‘ডেভিড কপারফিল্ড’কে অমরত্ব দিয়েছে।
ম্যাকবেথ (1606)
এই নাটকের গল্পাংশ মূলত হলিনসেডের ক্রনিকলম থেকে নেওয়া হয়েছে। ম্যাকবেথ বীরশ্রেষ্ঠ কিন্তু উচ্চাভিলাসের তাড়নায় তিনি প্রজাবৎসল রাজাকে হত্যা করেন। সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি প্রায় নির্বিকারচিত্তে হত্যালীলার আয়োজন অনুষ্ঠান করেন। নারী এবং শিশুও বাদ গেল না। তাঁর স্ত্রী একসময় রাজাকে হত্যা করার জন্য স্বামীকে প্ররোচিত করেছিলেন। প্রকৃতির প্রতিশোধে সে উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করে। আজ ম্যাকবেথ নিঃসঙ্গ জীবনের ছন্দ ও সুর তাঁর হারিয়ে গেছে। কিন্তু শত্রুসেনার আগমনে তিনি তাঁর হৃত সাহস ও মনোবল ফিরে পেলেন। ম্যাকডাফের তরবারির আঘাতে তাঁর জীবনাবসান হল।
ম্যাকবেথের সঙ্গে তৃতীয় রিচার্ডের তুলনা করা হয়। দুজনাই উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতার লালসায় উন্মাদ। দুজনেই অজস্র রক্তপাত করে ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। দুজনেরই উপর নিষ্করুণ প্রকৃতির প্রতিশোধ নেমে এল।
শেকসপিয়রের পরিণত বয়সের রচিত Tragedy-গুলির মধ্যে ম্যাকবেথ-এ Aristotal বর্ণিত হ্যামাটিয়া বা মারাত্মক ভ্রমের অভাব। তিনি ভ্রম করেননি। বলগা ছেঁড়া ঘোড়ার মতো উচ্চাভিলাসের রাশ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই নাটকে প্রকৃত এবং অতিপ্রাকৃতের সমন্বয় ঘটেছে। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল সবই এই নাটকের পটভূমি। ‘King lear’ নাটকের মতো ম্যাকবেথ-এও শুভ অশুভের বিরাট সংঘাত দেখা যায়।
শেকসপিয়রের ভূমিকা (1564-1616–23April)
শেকসপিয়র সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন। তাঁর সম্বন্ধে ভিন্ন দেশের ও ভিন্ন রুচির সমালোচনার মধ্যে যে আদর্শ ঐক্যমত রয়েছে, তেমনি অন্য কোথাও ঘটেনি। তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার—এই মতবাদ সর্বজন স্বীকৃত। প্রায় চার শতাব্দী অতীত হল তাঁর আবির্ভাবের কাল থেকে তৎসত্ত্বেও তাঁর অক্ষুণ্ণ প্রভাবের কারণ তিনি সকল মানুষের চিরন্তন ভাবগুলিকেই সুন্দর প্রকাশ করেছেন। সব দেশের সব যুগের মানুষ তাঁর লেখায় আপন হৃদয়ের কথা শুনতে পেয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে—-(Barnad Show) বার্নাড ‘শ-এর মতো আধুনিক নাট্যকার শেকসপিয়র-এর এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাহাত্মে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই অংশ মূলত নাটকের উদ্দেশ্য ও নাট্য রচনার পদ্ধতি নিয়ে শেকসপিয়রের প্রতিভা খর্ব করার কোনো অভিপ্রায় এতে পরিলক্ষিত হয় না।
মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল
এটি একটি মঞ্চ সফল ছন্দোবন্ধ নাটক। রচনাকার ইংরেজি সাহিত্যের বিশিষ্ট আধুনিক কবি টি, এস. এলিয়ট। নাটকটি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ক্যান্টার বেরী উৎসব উপলক্ষ্যে রচিত ও অভিনীত হয়।
ধর্মের গৌরব রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছায় আত্মানুতী এবং পরিণামে অমরত্ব লাভ, এই বিষয় নিয়ে নাটকটি রচিত। অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েও সমস্ত প্রলোভন জয় করে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে—বেকেটের চরিত্রের এই দিকটি নাট্যকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং মর্মস্পর্শীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
নিছক ধর্মীয় ব্যাপার নিয়েও যে অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের নাটক সৃষ্টি হতে পারে—“মার্ডর ইন দ্য ক্যাথিড্রাল” তারই একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। এলিয়টের নাটকগুলির মধ্যে পাপ এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বিষয়ক এই নাটকটি ইংরেজি নাট্যসাহিত্যে আন্দোলনে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। এলিয়টে নাটকের ওপর গ্রিক নাটকের প্রভাব সুপরিস্ফুট। বিশেষত ‘আলোক’ এই নাটকটিতে গ্রিক নাটকের কাহিনির বর্তমান সমাজের রূপান্তরীকরণ হয়েছে। এলিয়টের কবিতার মতো এই নাটকটিতেও বহির্জগতের ঘটনাগুলির পিছনে একটি রূপকাশ্রয়ী মনজগতের ঘাত প্রতিঘাত দেখা যায়। এই অর্থেও নাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া “মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রালের” সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে যুগের অনেক কবি ছন্দনাট্য রচনা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ‘অডেন’ এবং ‘ক্রিস্টোফার উড’। এই অর্থেও নাটকটি ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
পিকউইক পেপারস্
জীবনবাদী ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) রচিত পিক উইক পেপারস (Pick wick Papers) একটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। স্নিগ্ধ পরিহাস রসিকতা সহৃদয় সমাজ চেতনা কোমল ভাবপ্রবণতা, কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত সমবেদনা, খেয়ালপ্রবণ উৎকেন্দ্রিক চরিত্র সৃষ্টিতে অদ্ভুত নৈপুণ্য ও তীক্ষ্ণ সমাজ সংস্কার প্রবৃত্তি এই বৈশিষ্ট্যগুলি ডিকেন্স-এর উপন্যাসের উপাদান। তাঁর এই রচনা রীতির প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যেই পিকউইক পেপারস্ (১৮৩৬-৩৭)-এ সম্মিলিত হয়েছে।
পিকউইক একজন সরল উদার আত্মভোলা জীবনের অভিজ্ঞতাহীন, সদানন্দ বৃদ্ধ। তাঁর ভুল করার ও প্রতারিত হওয়ার প্রবণতা পাঠকদের হাস্যোচ্ছ্বল করে তোলে। অবশ্য এই হাসির মধ্যে কোনো ঘৃণা নেই। পিকউইক চরিত্রের উপহাস্যতার মধ্যে চরিত্রের মাধুর্য ও গৌরব যুক্ত হয়ে তাকে স্নিগ্ধ করে তুলেছে। অনেক সময় তাকে বাস্তব জগতের মানুষ বলে মনে হয় না। তিনি যেন একটা লোকহিত ব্রত দেবদূতের মানবিক সংস্করণ। তাঁর এই অপার্থিব দিকটি প্রচ্ছন্ন করা হয়েছে উপহাস্যতার সংযোজনের মধ্য দিয়ে।
ডিকেন্সের অসাধারণ পরিহাস রসিকতা পিকউইকের চাকর সামওয়েলার ও তার পিতা বুড়ো ওয়েলারের কৌতুকপ্রদ সরস সংলাপের মধ্যে অফুরন্ত হাস্যরস বিচ্ছুরিত হয়েছে। ইংল্যান্ডের সামাজিক অবস্থার যে বিবরণ এই উপন্যাসে রয়েছে তা অনেকটা কল্পনার আতিশয্যে আক্রান্ত। পিকউইক পেপারসকে অনেকে উপন্যাস বলে মনে করেন না। এক বিশেষ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কতকগুলি কৌতুকপূর্ণ সমাজ চিত্রের সমষ্টি বলে অনেকে মনে করেন। এতদসত্ত্বেও ভিক্টরীয় যুগের উপন্যাস সাহিত্যে এই উপন্যাসটির একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। সহজ সরল জীবন রসপুষ্ট পিকউইক চরিত্রটি পরবর্তীকালের সাহিত্যে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
ডেভিড কপারফিল্ড (David Copperfield, 1850)
ডেভিড কপার ফিল্ড (David Copper Field) ডিকেন্স-এর একটি উচ্চাঙ্গ উপন্যাস। এই উপন্যাসটি অনেকটা পরিমাণে আত্মজীবনী কাহিনির পর্যায়ভুক্ত। অতি সূক্ষ্ম একটি অন্তকালের আশ্রয় নিয়ে লেখক তাঁর বাল্য ও কৈশোর জীবনের দুঃখ-কষ্টপূর্ণ কঠোর জীবন কাহিনি মর্মস্পর্শী করুণ রসে অভিষিক্ত করে পাঠককে শুনিয়েছেন।
বয়স্কলোকের দয়ামায়াহীন পীড়ন বালকের কল্পনার ভিতর দিয়ে অতিরঞ্জিত আকার গ্রহণ করে। অত্যাচারী স্নেহহীন অভিভাবক কীভাবে অতিরঞ্জিত অনুভূতির বলে রূপকথার রাক্ষসের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে, উপন্যাসটিতে তারই ত্রুটিহীন শিল্পমাত্রা জ্ঞানের বর্ণিত হয়েছে। সমস্ত উপন্যাসটি বালকসুলভ কল্পনার অতিরঞ্জিকতা, স্বপ্ন বাস্তবে মেশানো ধ্যানধারণা আনন্দ ও বেদনার বোধ, কৈশোর প্রেমের উদভ্রান্ত মদির আবেশে প্রভৃতি ঘটনা যেমন বাস্তবসম্মত তেমনই জীবন্ত। পিকউইকের মতো খেয়ালি চরিত্র এই উপন্যাসেও রয়েছে। বেডপিট্রটউড মিকবার, প্রমুখের মতো খেয়ালি চরিত্র এখানেও রয়েছে। তা সত্ত্বেও ডেভিডের শুধু ডেভিড চরিত্র নয় পার্শ্ব চরিত্রও লেখকের শৈল্পিক দক্ষতার অসাধারণ নিদর্শন। যেমন—বেহিসাবি, সর্বদা দুর্দশাগ্রস্ত অথচ সর্বদাই ভবিষ্যৎ সুদিনের আশায় আশান্বিত মেগবার চরিত্রটি ইংরেজি সাহিত্যে বিরল বললেই চলে।
ডেভিড কপার ফিল্ড-এ লেখেকের জীবনচিত্রণের সত্য নিষ্ঠ, পরিহাস রসিকতা ও করুণ রসের বিস্তার ইংরাজি উপন্যাসে বহুদিন পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। শুধু ইংরাজি সাহিত্যে নয়, বাংলা সাহিত্যে এই প্রভাব সুস্পষ্ট। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব তার অন্যতম নিদর্শন।
চালর্স ডিকেন্সের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ডেভিড কপারফিল্ড প্রকাশিত হয় ১৯৬০ এ। ১৮২৯-এর মে থেকে উনিশ মাস ধরে রচিত এই উপন্যাস লেখক তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও চোখে দেখা নানা চরিত্রকে উপস্থাপিত করেছেন। তাই অনেকে এই উপন্যাসটিকে ডিকেন্সের আত্মজৈবনিক রচনা বলে মনে করলেও তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কেননা ডিকেন্সের জীবনের সাথে কোনো কোনো অংশ এই উপন্যাসের সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্যও বড়ো কম নেই। বাস্তবতার সাথে রোমান্টিকতার স্যটায়ারের সাথে হিউমারের করুণ রসের সাথে শৃঙ্গাররসের যুক্তাবলি রচনা করে এই উপন্যাসটি শিল্পশীর্ষকে স্পর্শ করেছে। মিসেস পেলোটি, অর্ধোন্মাদ ডিক, ডেভিডের সহপাঠী স্টিয়ার ফোর্স, প্রভৃতি চরিত্র ও তাদের প্রসঙ্গ উপন্যাসটিকে সার্থক করে তুলেছে।
প্রমেথিউস আনবাউণ্ড
প্রথম পর্যায়ে শেলীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘প্রমেথিউস আনবাউণ্ড’। এটি “একটি গীতিকাব্যধর্মী নাটক। এটি প্রকাশিত হয় ১৮১৯-এ। এই নাটকের কাহিনির উপাদান শেলী সংগ্রহ করেছেন প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার এসকাইলসের ‘প্রমেথিউস আনবাউণ্ড’ নাটক থেকে। যদিও তাকে তিনি আপন সৃষ্টি রসে জড়িয়ে নিয়েছেন।
চার অঙ্কে সম্পূর্ণ এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বীর বিদ্রোহী প্রমেথিউস মানব সমাজের প্রতিনিধি। দেবরাজ ডিউসের আধিপত্যবাদ পীড়ন ও পাপাচারের বিরুদ্ধে নিজ আদর্শ ও লক্ষ্যে অটল। শেলী তো মূলত গীতিকবি, তাই তিনি কবিতা বা নাটক যাই-ই লিখুক না কেন। গীতি কবির ভাবকল্পনা— আবেগের আতিশয্যে উপমা অলংকারের মোহময়ী রহস্যছটায় তিনি আত্মহারা হয়ে ওঠেন, এ কাব্যটি ও তার ব্যতিক্রম নয়। এই গ্রন্থটি গীতিকবি হিসাবে শেলীকে অসাধারণ তত্ত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। প্রযুক্তি বিচারেও ‘প্রমেথিউস আনবাউণ্ড’ অসাধারণ শিল্প সুষম। এখানে কবির বাণীবিন্যাস, অমিত্রক্ষের ছন্দের ব্যবহার অত্যন্ত মসৃণ ও ভাবগম্ভীর।
অ্যাডোনাইস
শেলীর চরণাগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল ‘অ্যাডোনাইস’। কীটসের অকাল মৃত্যুর ব্যথাহত চিত্তে কবিতাটি রচনা করেন শেলী ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ‘Adonais’ নামক গ্রিক মাইথোলজিকেই শেলী লিখেছেন Adonais শেলী কীটসকে অ্যাডোনাইস হিসাবে কল্পনা করেছেন। অ্যাডোনাইস ছিলেন মেষপালক ও অপূর্ব সুন্দর বংশীবাদক। নিষ্ঠুর সমালোচকদের আক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। শেলীও মনে করতেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কীটসের কবিতার নির্মম সমলোচক দংশনই কীটসের মৃত্যুর কারণ, শেলীর শোক এ কাব্যের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজের হতাশ কথাও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু শোকাবেগের প্রাবল্য কখনই কবিতার শিল্প সার্থকতার পথে বাধা সৃষ্টি করেনি।
আইভ্যানহো
স্যার ওয়াল্টার স্কট রচিত ‘আইভ্যানহো’ একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসে সঙ্কটে দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল ইংল্যান্ডের প্রতি। উপন্যাসটির সবসময় সিংহহৃদয়ে রিচার্ডের রাজত্ব, ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধের যুগ, আইভ্যান হো-র বীরত্বের পাশাপাশি এই উপন্যাসে ত্রিমুখী প্রণয় সম্পর্কে জটিলতা পাঠকদের দুটি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। মধ্যযুগের ইতিহাস, রূপকথা ও রোমান্সের সার্থক মিশ্রণে এক সজীব ও চিত্তাকর্ষক উপন্যাস আইভ্যান হো।
স্কটের এই উপন্যাসটির সাথে তুলনা করা চলে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের, স্কট ও বঙ্কিমচন্দ্রের সাদৃশ্য এখানেই যে উভয়েই সার্থকভাবে উপন্যাস ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড
টি. এস. এলিয়টের সর্বাপেক্ষা রচিত ও বিখ্যাত কাব্য হল ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ যা প্রকাশিত হয় ১৯২২-এ। এক শুষ্ক ও প্রাণহীন দেশে যা পুনরুজ্জীবিত হতে পারে, কেবলমাত্র উর্বরতা ফিরে এলে বৃষ্টিপাতে মরুদেশের শুদ্ধিতা দূর হলে এমনই এক প্রতীককে আশ্রয় করে এলিয়ট তৎকালীন মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপের বন্ধ্যা জনশূন্য ভগ্নরূপ তুলে ধরেছিলেন দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড এ। এই কাব্যটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। এই পাঁচটি ভাগ হল – (i) The Burial of the Dead (ii) A game of Chess (iii) The Fire Sermon (iv) Death by Water (v) What the Thunder Said.
কাব্যের চিত্রকল্প অসাধারণ, গীতিকবিতা, নাট্য উপাদান, আখ্যান কাব্য পুরাণ সব কিছুই মিলেমিশে ও ভাষানীতির অভিনবত্বে দ্য ওচস্ট ল্যাৎ আধুনিক কবিতার এক দিক চিহ্ন। প্রথমত উল্লেখ্য বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিরা বিশেষত জীবনানন্দ ও বিষ্ণু দে এলিয়ট দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
দি হলো মেন
এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড রচিত হবার প্রায় তিন বছর পরে প্রকাশিত হয় ‘দি হলো মেন’ কবিতাটি। এই কবিতাটিতেও সমকালীন সভ্যতার অবক্ষয়ের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হয়েছে আধুনিক কালের শূন্যগর্ভ মানুষদের। তাঁর মতে আধুনিক মানুষ কৃত্রিম, হৃদয়হীন, তাই তারা সর্ব এই ব্যর্থ। কবিতার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে চরম আশাহীনতা। কবিতাটির সমাপ্তি ও নিরাশদ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে –
This is the way the world ends.
This is the way the world ends
This is the way the world ends.
not with a bang but a whimper’
হলো যেন এর জগৎ জুড়ে শুধুই অন্ধকার ওয়েস্ট ল্যান্ডের সমাপ্তিতে যে আশার সুর ছিল তা এখানে অনুপস্থিত। অবক্ষয়ের নানা প্রতীক, চিত্রকল্প, কবিতাটিকে আলাদামাত্রা দিয়েছে।
আমর্স অ্যান্ড দ্য ম্যান
শেকসপিয়রের পরে ইংরাজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার জর্জ বার্নাড’শ রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক হল আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান। এটি রচিত হয় ১৮৯৪-এ। রোমান্টিক প্রেম ও প্রথাসর্বস্ব বীর পূজার অন্তঃসারশূন্যতা ও অভিজাতদের ভন্ডামি এবং অহংকারকে ‘শ’ এই নাটকে অসাধারণ শ্লেষের তীক্ষ্ণবাণে ও সংলাপের চাবুকে প্রকাশিত করে দিয়েছে এবং যথার্থভাবে উন্মোচিত হয়েছে যুদ্ধ ও প্রেমের যথার্থ স্বরূপ। এই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র ব্লান্টশ্লি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে ঢুকে পড়ে রায়না নামক এক রোমান্টিক কল্পে বিলাসিনীর গৃহে, যে আশার বীর সর্জিয়াসের বাগদত্তা। ব্লান্টশ্লি ছিল অসামান্য বাকপটু সেনা, বাকপটুতার সাহায্যে সার্জিয়াসকে বর্ণনা করে ডন কুইকসটের মতো নির্বোধ ও উন্মাদ রূপে ও ব্লান্টশ্লির মোহভঙ্গ ঘটায় সে বুঝতে পারে প্রেমের প্রকৃত অর্থ ও বিবাহ করে ব্লান্টশ্লিকেই। বিষয় গুরুগম্ভীর হলেও হাস্যপরিহাসময় লঘু নাট্যকৌতুক ও স্বার্থপর দক্ষতায় সেকালে নাটকটি অসাধারণ জনপ্রিয় হয়েছিল।
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট
শেকস্পিয়র রচিত রোমান্টিক ট্র্যাজেডি হল রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। এই গ্রন্থটি ১৫৯৪-তে প্রকাশিত হয়। রোমিও এবং জুলিয়েটের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুই পরিবারের রক্তাক্ত শত্রুতা ও বিরোধ। শেষে ভাগ্যের কাছে হার মেনে রোমিও জুলিয়েট দেবতার উদ্দেশ্য নিবেদন করে আপন বুকের রক্ত। এই ট্র্যাজেডির মধ্যে যে সূক্ষতা ও স্বাভাবিক ছিল তা ছিল সে যুগে নতুন শুধু তাই নয়, চরিত্র চিত্রন গ্রন্থন ও অন্তিম পরিণতির বিচারে ও এই নাটকটি উল্লেখের দাবি রাখে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অনেকে মনে করেন Arthur Brooke -এর ‘The Tragical History of Romeus and Joliet’ অবলম্বনে শেকসপিয়র এ নাটকের আখ্যান ভাগ রচনা করেছিলেন।
Leave a comment