প্রশ্নঃ অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও পরিধি আলােচনা কর।

অথবা, অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের মূল বিষয় আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষকে কেন্দ্র করে সকল ধরনের আলােচনা হচ্ছে নৃ-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। নৃ-বিজ্ঞানের যে সকল শাখা রয়েছে তার মধ্যে অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান অন্যতম। অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান সম্পদ আহরণ, উৎপাদন, বণ্টন, ভােগ, বিনিময়, সঞ্চয় এবং লগ্নি সম্পর্কে আলােচনা করে। বস্তুত মানুষ তার অভাব পূরণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানব আবিষ্কৃত অন্যান্য সুযােগের ব্যবহার করার জন্য কীভাবে সংগঠিত প্রয়াস চালায়, সেটাই অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়।

অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুঃ নৃ-বিজ্ঞান আদিম অর্থনীতি সম্পর্কে যেমন কৌতূহলী, তেমনি বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েও উৎসাহী। সমাজভেদে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যাই হােক না কেন অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে সমাজের মানুষ তাদের অভাবপূরণে কীভাবে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত প্রয়াস চালায় তার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ দান করা। নৃ-বিজ্ঞানী জনস্টোন এবং সেলবি (Johnston and Selby) বলেন, অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান হচ্ছে অভাবপূরণের জন্য মানুষ কীভাবে সংগঠিত হয় তার অধ্যয়ন।

সমাজসভ্যতার বিকাশ হয়েছে মূলত প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার উপযােগী করে তােলার মধ্যদিয়ে প্রথমাবস্থায় কেবল জীবিকার তাগিদে মানুষ তার আশে-পাশের পরিবেশকে ব্যবহার করেছে। পরে আস্তে আস্তে তাদের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, আর মানুষ জড়িয়ে পরে নানাপ্রকার অর্থনৈতিক কার্যকলাপে। অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান মানুষের ঐসব অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও আচরণ নিয়ে আলােচনা করে।

তাছাড়া সীমিত উপকরণের সাহায্যে মানুষ কীভাবে তার পরিবেশকে বশ করেছে, কীভাবে নিজেরা সংগঠিত হয়েছে, কীভাবে নতুন নতুন সম্ভাবনা ও সুযােগ সৃষ্টি করেছে আর সেগুলাে কীভাবে ভােগ, বিনিময়, বণ্টন ও বিনিয়ােগ করছে এসব।

অর্থনৈতিক আলােচনা অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। কেবল তাই নয় অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সমাজের অর্থনৈতিক জীবন সমীক্ষা করতে গিয়ে সমাজে অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্রিয়াকর্মের মধ্যে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করে দু’টি পরস্পর বিরােধী তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। সেগুলাে হলাে- Formalism and Substantivism. এ দু’টি দৃষ্টিভঙ্গিকে বিভিন্ন সমাজের অর্থনৈতিক সমাজ সমীক্ষার তাত্ত্বিক পথ নির্দেশিকা বলা চলে।

আধুনিক অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান সমাজ উন্নয়ন মডেল, কৌশল, এক সমাজের ওপর অন্যসমাজের প্রভাব, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দরিদ্রতা ও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে আলােচনা করে। অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের আলােচনার ক্ষেত্রগুলাে নিম্নে দেয়া হলােঃ

(ক) মানুষ ও প্রকৃতিঃ নৃ-বিজ্ঞান সমাজস্থ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার বাস্তবতা সম্পর্কে বিশ্লেষণ প্রদান করে বিভিন্ন সমাজে বিদ্যমান জনগােষ্ঠীসমূহের অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকৃতি অনুসন্ধান করে এবং সেগুলাে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে তা ব্যাখ্যা করতে চায়।

(খ) প্রযুক্তি ও প্রকৃতিঃ মানুষ সকল যুগেই কোনাে না কোনােভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রথমে তারা পুরােমাত্রায় পরিবেশের ওপর নির্ভর করে কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উৎপাদন কৌশল ব্যবহারে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাই প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আলােচনা অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

(গ) শ্রমসংগঠনঃ অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রভাবের ক্ষেত্রে শ্রম সংগঠনের তুলনা হয় না। শ্রমসংগঠন অর্থনৈতিক প্রকৃতির ধরন অনেকটা নির্ধারণ করে। তাই শ্রমসংগঠন অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার বিষয়।

(ঘ) সম্পত্তি, পুঁজিবিনিয়ােগ ও মুনাফাঃ সম্পত্তি, পুঁজিবিনিয়ােগ ও মুনাফা আধুনিক অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার বিষয়। সম্পত্তির ধারণা মানুষের মধ্যে অনেক আগেই ছিল। এই সম্পত্তির ওপর পুঁজি বিনিয়ােগ করে কীভাবে মুনাফা অর্জন করা যায়, অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান মূলত তা আলােচনা করে।

(ঙ) ভােগঃ মানব সভ্যতার অস্তিত্বের সাথে ভােগ সম্পর্কিত। তাই ভােগ অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান আদিযুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমাজে কীরূপ ভােগ ব্যবস্থা শুরু হয় তা আলােচনা করে।

(চ) বিনিময়ঃ সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন বিনিময় ব্যবস্থা ছিল। যেমনঃ মানব ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে দ্রব্য বিনিময় প্রথা বিদ্যমান থাকলেও একসময় মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন। অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজে বিনিময়ের ধরন বিশ্লেষণ করে।

(চ) বণ্টনঃ সমাজ সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। আর এ অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে বণ্টনব্যবস্থাও ছিল একেক রকম। অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান বিভিন্ন সময়ের অর্থনৈতিক বণ্টনব্যবস্থা নিয়ে আলােচনা করে।

(জ) অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান তত্ত্বঃ অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান যে কেবল বিভিন্ন সমাজের অর্থনীতি আলােচনা করে তা নয় বরং তা সম্পর্কে অনেক অর্থবহুল তত্ত্ব প্রদান করে। আবার ১৯৮৩-৮৪ সালের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল কোর্স (M. Phil. Course) অনুসারে অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের আলােচনার ক্ষেত্রগুলাে হলােঃ (১) শিকার সগ্রহ অর্থনীতি (২) পর্যায়ক্রমিক চাষ (৩) পশুপালন ও যাযাবর সমাজের অর্থনীতি (৪) কৃষি সমাজের অর্থনীতি (৫) বিনিময় (৬) ব্যবসায় বাণিজ্য ও বাজার ব্যবস্থা (৭) অর্থনৈতিক নৃ বিজ্ঞান ও তত্ত্ব (৮) তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান খাদ্য সংগ্রহ, উৎপাদন, বন্টন, বিনিময়, ভােগ, সঞ্চয় এবং বিনিয়ােগ সম্পর্কে পঠন-পাঠন ও গবেষণা করে। মানবসভ্যতার সূচনা থেকে বর্তমান পর্যন্ত সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ই অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞানের আলােচনার বিষয়বস্তু। এটি আদিযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষ কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে সে সম্পর্কে আলােচনা করতে চায়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, অর্থনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান নৃ-বিজ্ঞানের বৃহত্তম শাখা যা সমাজস্থ মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ব্যাখ্যা প্রদান করে।