প্রাচীন কালে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা কোনাে ব্যক্তি প্রভুর অধীনে ক্রীতদাস হিসেবে বেঁচে থাকত। প্রভু ইচ্ছা করলে তার ব্যক্তিগত সম্পদ এইসব ক্রীতদাসদের বিক্রি বা হত্যাও করতে পারত। অধীনস্থ দাসের ওপর তার প্রভুর এই সার্বিক মালিকানার অধিকার বা প্রথা দাসপ্রথা বা ক্রীতদাস প্রথা নামে পরিচিত।
ক্রীতদাসরা প্রভুর পরিবারের ঘরদোর পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন রাখা, রান্নাবান্না করা, বাগান পরিচর্যা করা, জামাকাপড় কাচা প্রভৃতি কাজকর্ম করত। তারা উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করত। ক্রীতদাসরা তাদের প্রভুর ব্যাবসায়িক কাজকর্মেও সহায়তা করত।
খুবই দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে ক্রীতদাসদের জীবন কাটত। ক্রীতদাসরা ছিল তাদের প্রভুর সম্পত্তি। তাই প্রভু তার অধীনস্থ ক্রীতদাসদের বিক্রি করতে, ভাড়া খাটাতে বা হস্তান্তর করতে পারত|প্রভুরা প্রয়ােজনে তাদের অধীনস্থ ক্রীতদাসদের প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করত।
দাসত্বের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করে তা এককালীন প্রভুকে দিলে ক্রীতদাসরা মুক্তি পেত। অনেক সময় কোনাে ক্রীতদাস সারাজীবন ধরে তার প্রভুর প্রতি গভীর আনুগত্য দেখানাের পুরষ্কার হিসেবে মুক্তি পেত। প্রভুর সেবাযত্ন বা প্রভুর প্রাণরক্ষার বিনিময়েও ক্রীতদাসরা দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারত।
ক্রীতদাস প্রথার ফলে কৃষিজ ও খনিজ সম্পদের উৎপাদন বাড়ে। ক্রীতদাসদের পরিশ্রমে প্রচুর রাস্তাঘাট, সেতু ও স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হয়। ক্রীতদাসদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় স্বাধীন নাগরিকরা কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে।
ক্রীতদাসদের যেসব সন্তান জন্মসূত্রে ক্রীতদাসে পরিণত হত তারা ভার্নি নামে পরিচিত ছিল।
ক্রীতদাসদের লােহার শিকলে বেঁধেরাখা, চাবুক দিয়ে মারা, উত্তপ্ত লােহার ছ্যাকা দেওয়া প্রভৃতি শাস্তি দেওয়া হত।
ইতিহাস চেতনা (History-11 Short Q&A)
রাজনীতির বিবর্তন—শাসনতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা (History-11 Short Q&A)
রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং এর উপাদান (History-11 Short Q&A)
সামাজিক ঘটনাস্রোত (History-11 Short Q&A)
দিগন্তের প্রসার (History-11 Short Q&A)
রােমান ক্রীতদাসরা প্রাসাদ, সাধারণ গৃহ, অট্টালিকা, পাকা পয়ঃপ্রণালী, রাস্তাঘাট, সেতু, ক্রীড়াক্ষেত্র প্রভৃতি নির্মাণকার্যের সঙ্গে যুক্ত থাকত।
প্রভুর আশ্রয় থেকে পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসকে ‘ম্যানুমিসিও’ বলা হত।
প্রাচীন রােমে কোনাে ক্রীতদাসকে হিংস্র পশুর সঙ্গে লড়াই করে নাগরিকদের আনন্দ দিতে হত। এই ক্রীতদাসরা গ্ল্যাডিয়েটর নামে পরিচিত ছিল।
স্পার্টাকাস ছিলেন রােমের একজন ক্রীতদাস ও গ্ল্যাডিয়েটর। তিনি রােমের বিরুদ্ধ সংঘটিত দাস বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
রােমান নাগরিকদের মনােরঞ্জনের অন্যতম উপায় ছিল ‘গ্ল্যাডিয়েটারের লড়াই’ নামে এক প্রকার নিষ্ঠুর খেলা প্রদর্শন করা।
প্রাচীন রােমে একধরনের উৎসবে প্রভু ও তার অধীনস্থ ক্রীতদাস তাদের নিজ নিজ অবস্থান পরিবর্তন করে সাময়িকভাবে প্রভু ক্রীতদাসের এবং ক্রীতদাস প্রভুর ভূমিকা পালন করত। এই অনুষ্ঠানকে সতুরনালিয়া উৎসব বলা হয়।
রােমের মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসকে বলা হত ‘লিবারটাস’।
রােমের ক্রীতদাসরা জলপাই, আঙুর, গম প্রভৃতি কৃষিপণ্য উৎপাদন করত।
প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যে বস্তু সাধারণ মানুষ কোনাে ধনী অভিজাত ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য জানাত এবং অভিজাত ব্যক্তি সেইসব সাধারণ মানুষের রক্ষার দায়িত্ব পালন করত। অভিজাত ব্যক্তির কাছ থেকে নিজেদের জীবনের সুরক্ষা লাভের বিনিময়ে সেইসব সাধারণ মানুষ অভিজাত ব্যক্তির প্রতি সীমাহীন আনুগত্য জানিয়ে তাকে সেবাদান করত। এই সম্পর্ক অনুগত পৃষ্ঠপােষক সম্পর্ক’ বা প্রথা নামে পরিচিত।
প্রাচীন মিশরীয় সমাজ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যেগুলি হল- [1] অভিজাত শ্রেণি, [2] মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং [3] নিম্নশ্রেণি।
মিশরীয় সম্রাট, রাজ পরিবার, ধনী ও সন্ত্রান্ত পরিবার, পুরােহিত, ভিজিয়ার নামে উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার ও অন্যান্য উচ্চবিত্তরা ছিল অভিজাত শ্রেণিভুক্ত। মিশরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগর, নির্মাতা, শিক্ষিত সম্প্রদায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। নিম্নশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য মানুষ যারা কায়ক্লেশে দিনযাপন করত।
মিশরীয় সেনারা পরাজিত শত্রু সৈন্যদের বন্দি করে ক্রীতদাসে পরিণত করত। দরিদ্র পিতামাতা অভাবের তাড়নায় নিজেদের অথবা নিজ সন্তানদের ক্রীতদাস হিসেবে ধনী ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিত। ক্রীতদাসের সন্তানসন্ততি জন্মসূত্রে ক্রীতদাসে পরিণত হত।
মিশরীয় ক্রীতদাসদের অবস্থা গ্রিস বা রােমের ক্রীতদাসদের চেয়ে অনেক বেশি সুখকর ছিল বলে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন। মিশরীয় প্রভুরা তাদের অধীনস্থ ক্রীতদাসদের সঙ্গে যথেষ্ট সদয় ব্যবহার করত। কখনাে-কখনাে তা সন্তানস্নেহের পর্যায়ে পৌছে যেত। ক্রীতদাসরা কখনাে কখনাে তাদের প্রভুর কন্যা বা অন্য কোনাে মহিলাকে বিবাহ করতে পারত বলে জানা যায়।
মিশরের ক্রীতদাসদের মধ্যে বেশিরভাগই গৃহভৃত্য হিসেবে তাদের প্রভুর গৃহ পরিষ্কার, উদ্যান পরিচর্যা, রান্নাবান্না এবং পরিবারের নিত্যদিনের অন্যান্য যাবতীয় কাজকর্ম করত। ক্রীতদাসরা বিভিন্ন ধরনের কুটিরশিল্পের কাজেও নিযুক্ত থাকত৷ বহু ক্রীতদাসকে মিশরের সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ করা হয়েছিল।
মিশরের কৃষি, শিল্প ও পরিশ্রমসাধ্য নির্মাণ কাজগুলি ক্রীতদাসদের দ্বারাই সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। ক্রীতদাসদের অক্লান্ত শ্রমের ফলে মিশরের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে একদিকে যেমন মিশরের রপ্তানি বাণিজ্য বেড়েছিল, অন্যদিকে তেমনি সেদেশের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।
লিবিয়া, মিরাে, কুশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে মিশরে ক্রীতদাস আমদানি করা হত।
প্রাচীন রােমান, মিশরীয় ও ভারতীয় সভ্যতায় ক্রীতদাস প্রথা একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামাে লাভ করেছিল। এই সমস্ত অর্থনীতিতে ক্রীতদাস প্রথার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ক্রীতদাসদের শ্রমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই অর্থনীতি দাস অর্থনীতি (Slave Economy) নামে পরিচিত।
প্রাচীন ভারতে হরপ্পা সভ্যতার যুগে কৃষিজমিতে আবাদকারী কৃষকরা নগরের শাসকদের দ্বারা ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ মার্টিমার হুইলার মনে করেন। ঋগবৈদিক যুগে ‘দস্যুরা আর্যদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ‘দাস’-এ পরিণত হত। মৌর্য যুগে দাসরা বিভিন্ন সরকারি শিল্পসংস্থা, ধনীদের গৃহ ও খামার, রাজপরিবারের অন্দরমহল প্রভৃতি স্থানে কাজ করত।
গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল না।
বৈদিক যুগের অনার্য ব্যবসায়ীরা ‘পনি’ নামে পরিচিত ছিল।
সুলতানি যুগে দুধরনের দাসব্যবস্থার পরিচয় ছিল, যথা—বন্দগান-ই-খাস এবং বুরদা ও কানিজক৷ বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা সুলতানের খাস দাস ছিল বন্দগান-ই-খাস। আর বিভিন্ন উচ্চবংশীয় অভিজাত এবং সাধারণ পরিবারের অধীনস্থ দাসরা ছিল বুরদা ও কানিজক।
সুলতানি আমলে বিভিন্ন উচ্চবংশীয়, অভিজাত এবং সাধারণ পরিবারের অধীনেও প্রচুর সংখ্যক ক্রীতদাস থাকত। এরা বুরদা ও কানিজক নামে পরিচিত ছিল।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের সর্বত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য স্থানীয় সামন্ত প্রভু বা ভূস্বামীদের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হত। সামন্ত প্রভুদের দ্বারা তাদের অধীনস্থ কৃষক শ্রেণি বা ভ্যাসাল এবং ভূমিদাসদের শােষণ করার বিষয়টি সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বলে মার্ক ব্লখ মনে করেন। কার্ল মার্কস সামন্ততন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ম্যানর ব্যবস্থায় কথা উল্লেখ করেছেন।
কৃষক তার উৎপাদনের একটি বড়াে অংশ টাইলে বা মেটায়েজ নামে সম্পত্তি কর হিসেবে দিতে বাধ্য ছিল। সামন্তব্যবস্থায় কৃষককে বেনালিতে নামে একপ্রকার মজুরি কর প্রদান করতে হত। উক্ত বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়াও ম্যানর- প্রভুরা কৃষকের কাছ থেকে জলকর, বনকর, বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে কর প্রভৃতি আদায় করতেন।
নিম্ন সামন্ত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার উর্ধ্বতন সামন্তপ্রভুর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতেন, এর বিনিময়ে উর্ধ্বতন সামন্তপ্রভু তার অধীনস্থ নিম্ন সামন্তকে কিফ’ বা জমি দান করতেন। সামন্তপ্রভু প্রজার জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতেন এবং তাকে যাবতীয় নিরাপত্তা প্রদান করতেন। রাজা ও সামন্তপ্রভুরা কৃষকদের নিরাপত্তা প্রদান করতেন এবং তাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতেন।
সামন্তপ্রভুরা নিজ এলাকার শাসন পরিচালনা করতেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। সামন্তপ্রভুরা তাদের শাসনাধীন এলাকার রাস্তাঘাট, খাল, সাঁকো প্রভৃতি নির্মাণ ও সংস্কার করতেন। তাঁরা তাঁদের অধীনস্থ এলাকায় বসবাসকারী প্রজাদের ওপর ঘটা অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার করতেন।
সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে ‘রােমান তত্ত্ব’-এর প্রবক্তা ছিলেন আবে দুবাে।
সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে ‘জার্মান তত্ত্ব’-এর প্রবক্তা ছিলেন বােলাভিয়ের।
মধ্যযুগে ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে অল্প কিছু মানুষ ছিল যাজক সম্প্রদায়ভুক্ত এবং যাজক শ্রেণির পরেই প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি হিসেবে অভিজাত শ্রেণি অবস্থান করত। সমাজের তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল বিপুল সংখ্যক কৃষক।
নিম্নসামন্ত উধর্বতন সামন্তপ্রভুর সংকটকালে প্রভুকে স্কুটেজ’ নামে কর প্রদান করতেন।
ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযােগে স্থানীয় প্রভুরা অর্থাৎ বৃহৎ জমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের জমি ও জনগণের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। এভাবে সামন্ততন্ত্রের উত্থানের পটভূমি তৈরি হয়।
কমিটেটাস প্রথা থেকে ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি ঘটেছিল বলে বােলাভিয়ের মনে করেন।
মধ্যযুগের ইউরােপের সমাজে মানুষ প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা[1] যাজক শ্রেণি, [2] অভিজাত শ্রেণি ও [3] কৃষক ও সাধারণ মানুষ।
ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে উর্দু কৃষকরা ‘ভিলেইন’ নামে পরিচিত ছিল।
মধ্যযুগের ইউরােপে যে দরিদ্র কৃষকরা জমি ছেড়ে বাইরে যাওয়ার অধিকারী ছিল না, তারা সারফ’ বা ভূমিদাস নামে পরিচিত ছিল।
ক্রফটার ও করাট ছিল মধ্যযুগের ইউরোপের ভূমিহীন কৃষক।
প্রাচীন জার্মানিতে প্রচলিত এক প্রথা অনুসারে, স্বাধীন যােদ্ধারা স্বেচ্ছায় কোনাে সামরিক নেতা বা সেনাপতির প্রতি আনুগত্য জানিয়ে তার স্বার্থপূরণের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দান করত। এটি ‘কমিটেটাস প্রথা’ নামে পরিচিত।
ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক স্তরবিন্যাসটি ছিল পিরামিডের মতাে৷ এই পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে রাজা ও সর্বনিম্ন স্তরে অগণিত দরিদ্র কৃষক অবস্থান করত। সামন্ততান্ত্রিক পিরামিড স্তরে রাজা ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যবর্তী স্তরে অবস্থান করত ডিউক ও আর্ল, ব্যারন, নাইট প্রমুখ।
সামন্ততান্ত্রিক পিরামিডের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থানকারী অগণিত দরিদ্র কৃষকদের ভ্যাসাল বলা হত।
ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে নিম্ন সামন্ত, উধর্বতন সামন্তপ্রভুর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করত এবং বিনিময়ে উধর্বতন সামন্তপ্রভু তার অধীনস্থ নিম্ন সামন্তকে জমি দান করত। এই জমি দানকে ফিফ বলা হত।
ইনভেস্টিচার হল একধরনের অনুষ্ঠান যেখানে উধর্বতন সামন্তপ্রভুর প্রতি আনুগত্য প্রদানের মাধ্যমে তার অধীনস্থ নিম্ন সামন্ত জমি লাভ করত।
শিভালরি কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ফরাসি শব্দ শিভেলিয়ার থেকে, যার অর্থ হল অশ্বারােহী।
নর্মান্ডির ডিউক উইলিয়াম ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে সামন্তপ্রথার প্রবর্তন করেন।
ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকদের প্রদেয় কয়েকটি উল্লেখযােগ্য কর ছিল টাইলে, শিভাজ, বেনালিতে, ক্যাপিটাশিও, প্রেসটেশন প্রভৃতি।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় টাইলে বলতে সম্পত্তি করকে বােঝাত।
প্রভুর হাতে পণ্য বিক্রির জন্য কৃষককে বেনালিতে কর দিতে হত।
খ্রিস্টান চার্চ দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে যে ধর্মকর (১/১০ অংশ) আদায় করত তা ‘টাইদ’ নামে পরিচিত।
দরিদ্র কৃষক সপ্তাহে কয়েক দিন, সুমীর জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খাটতে বাধ্য হত। শ্রমকে কর্ভি বলা হত।
ভূমিদাসের পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার জমি লাভ করার জন্য প্রভুকে যে কর দিতে বাধ্য ছিল তা হেরিয়ট’ নামে পরিচিত।
নিকোলাস জানেকিন-এর নেতৃত্বে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্সে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল।
গিয়ােম কালে ছিলেন ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জাকেরি কৃষক বিদ্রোহের নেতা।
ওয়াট টাইলার ছিলেন ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের নেতা।
বীরত্ব প্রদর্শনের অঙ্গ হিসেবে দুজন সামন্তপ্রভুর মধ্যে যে তলােয়ার যুদ্ধ হত তাকে ‘ডুয়েল’ বলা হত।
একজন প্রভুর অধীনে ম্যানর এলাকায় একটি অনুগত মানবগােষ্ঠী বসবাস করত। প্রতিটি ম্যানরে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি, পশুচারণ ভূমি, পতিতজমি, জঙ্গল, জলাভূমি, বনভূমি, কৃষকের বাসগৃহ, শ্রমিক ও কারিগরদের বাসগৃহ, গির্জা ইত্যাদি থাকত। ম্যানরগুলি ছিল এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম।
মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করত। এই গ্রামগুলিকেই ‘ম্যানর বলা হত।
সামন্তপ্রভুর বাসবাসের জন্য ম্যানরে দুর্গ পরিবেষ্টিত সুরক্ষিত একটি প্রাসাদোপম সুবিশাল বাড়ি থাকত। একে ‘ম্যানর হাউস’ বলা হত।
ম্যানর হাউসে সামন্তপ্রভু, তার আত্মীয়পরিজন ও কর্মচারীরা বসবাস করত।
ম্যানর হাউসে প্রাসাদের দেয়ালে নানা ধরনের। কারুকার্যময় ভারী কাপড়ের পর্দা ঝােলানাে থাকত। একে ট্যাপেস্ট্রি বলা হত।
ম্যানরের প্রশাসন পরিচালনার জন্য নিযুক্ত কয়েকজন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কর্মচারীর নাম হল স্টুয়ার্ড, বেইলিফ, রিভি প্রমুখ।
ম্যানরে প্রভুর খাস জমি ডিমিন নামে পরিচিত ছিল।
ইউরোপে ত্রয়ােদশ শতকে সামন্ত ব্যবস্থায় বিশেষ একধরনের বীরত্বের আদর্শ গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থা সাধারণভাবে শিভালরি নামে পরিচিত।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাইটদের শিভালরি আদর্শের পালন মধ্যযুগে ইউরােপে শৃঙ্খলা স্থাপন করতে সাহায্য করে।
ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় উচ্চবংশীয় যােদ্ধাদের নিয়ে সামন্তপ্রভুর জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠিত হত। এই যােদ্ধারা ‘নাইট’ নামে পরিচিত ছিল। একুশ বছর বয়সে একজন যুবক ‘নাইট হিসেবে গণ্য হতে পারত।
নাইটদের প্রধানত তিনটি আচরণবিধি মেনে চলতে হত। যথা- [1] যুদ্ধ করা, [2] ধর্মপালন করা, [3] নারীজাতির মর্যাদা রক্ষা করা।
মধ্যযুগে নাইটদের বীরত্ব, আদর্শ ও প্রেমের কাহিনি ইউরােপে একদল রণকবি গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে, জমিদার ও কৃষকের বাসস্থানে গিয়ে গেয়ে শােনাতেন। এই সকল চারণকবিরা দক্ষিণ ফ্রান্সে ‘ট্রুবাদুর’ বলা হত।
ইউরােপে একদল চারণকবি মধ্যযুগে নাইটদের বীরত্ব, আদর্শ ও প্রেমের কাহিনি গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন স্থানে ভ্ৰমণ করে গেয়ে শােনাতেন। এই সমস্ত চারণকবিরা জার্মানিতে ‘মিনেসিঙ্গার’ নামে পরিচিত।
গুপ্তযুগে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল বলে ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ড. রামশরণ শর্মা, ড. ডি. ডি. কোশাম্বী, ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ ঝা, অধ্যাপক বি. এন. এস. যাদব, এস. গােপাল, ভকতপ্রসাদ মজুমদার প্রমুখ যুক্তি দেখান।
৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে আগত খ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন ভারতে কোনাে ক্রীতদাস ছিল না।
গুপ্তযুগে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না বলে ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, হরবনস মুখিয়া, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, রণবীর চক্রবর্তী প্রমুখ যুক্তি দেখান।
কৌটিল্য দাসপ্রথাকে স্লেচ্ছপ্রথা বলে উল্লেখ করেছেন।
গুপ্তযুগে সামন্ততন্ত্রের সহায়ক কয়েকটি উপাদান হল[1] দাসপ্রথা, [2] অগ্রহার ব্যবস্থা, [3] বাণিজ্যের অবনতি, [4] নগরের অবক্ষয় প্রভৃতি।
ভারতে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের পরে পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানে নিষ্কর জমি দান করার প্রথা চালু হয়। এই প্রথা ‘অগ্রহার বা ‘ব্রহ্মদেয়’ নামে পরিচিত।
ইত্তা’ শব্দের অর্থ হল ‘এক অংশ।
ইক্তা ব্যবস্থার দ্বারা সুলতান তাঁর ‘খলিসা’ জমির বাইরে অবস্থিত জমিগুলি নির্দিষ্ট শর্ত ও কর্তব্য পালনের বিনিময়ে তাঁর সেনাধ্যক্ষ, সৈনিক ও অভিজাতদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। বিনিময়ে ‘ইকত্তাদার বা ‘মুকতি’ বা ‘মাকৃতি নামে ইক্তার প্রাপকরা সুলতানকে প্রয়ােজনে সৈন্য সরবরাহ করতেন। মাকৃতি তাঁর অধীনস্থ এলাকায় স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন।
বলবন ইকার হিসাব রক্ষা ও কেন্দ্রের প্রাপ্য অর্থ কঠোরভাবে আদায় করার নীতি নেন। আলাউদ্দিন খলজি ইত্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক ইত্তা ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করে এই প্রথাকে বংশানুক্রমিক করে দেন।
ওয়াতন শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল বাস্তুভিটা। যে মনসবদার তার নিজস্ব অঞ্চলের ভূম্যধিকারী হিসেবে জায়গিরের মাধ্যমে বেতন পেতেন, সেই জায়গিরকে বলা হত ওয়াতন জায়গির। এই জায়গিরের ওপর মােগল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ছিল সীমিত এবং এগুলি হস্তান্তর করা যেত না।
মধ্যযুগে ইউরােপের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হল নেপলস, র্যাভেনা, পিসা, ভেনিস, মিলান প্রভৃতি।
দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ে ইউরােপে জিনিসপত্রের মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়, যা সাধারণভাবে ‘মূল্যবিপ্লব’ নামে পরিচিত।
কৃষির অগ্রগতির সঙ্গে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে ভারতে বিভিন্ন কারিগরি শিল্পের ও অন্যান্য পেশার বিকাশ ঘটতে থাকে। নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে একই পেশার শিল্পী ও কারিগররা তাদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তােলে। প্রাচীন ভারতের শিল্পী, কারিগর বা বণিকদের এই সংগঠন নিগম নামে পরিচিত।
মধ্যযুগের ইউরােপে ব্যবসায়ী ও কারিগর শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে আলাদা আলাদা সংগঠন গড়ে তুলত। এই সংগঠনগুলির নাম ছিল গিল্ড। সাধারণত বিভিন্ন বণিক ও কারিগররা একই বাণিজ্য বা শিল্পে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে এক একটি গিল্ড গড়ে তুলত।
মধ্যযুগে ইউরােপে গিল্ড গড়ে ওঠার দুটি প্রধান কারণ ছিল [1] শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ স্বার্থরক্ষার জন্য চেষ্টা করা এবং [2] কারখানায় কাঁচামাল ও শ্রমিকের জোগান অব্যাহত রাখা।
ইউরােপের ইংল্যান্ডে একাদশ-দ্বাদশ শতকে সর্বপ্রথম গিল্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।
কারিগরদের পৃথক গিল্ড সর্বপ্রথম ইটালিতে গড়ে ওঠে৷
খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মাঝে ইউরােপে একদিকে প্রাচীন ও ক্ষয়িষ্ণু নগরগুলি নতুন করে জেগে ওঠে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন নতুন নতুন শহরের উত্থান ঘটে। এই ঘটনাকে ইউরােপের নগর-বিপ্লব’ বলা হয়।
মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল লন্ডন, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, ব্রিস্টল প্রভৃতি।
মধ্যযুগে ফ্রান্সের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল প্যারিস, মার্সেইলস, অর্লিয়েন্স, নারবােনে, মন্টপেলিয়ার প্রভৃতি।
মধ্যযুগের জার্মানির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল হামবুর্গ, নুরেমবার্গ, মিউনিক, ব্রেমেন প্রভৃতি।
মধ্যযুগের ইটালির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল ফ্লোরেন্স, ফ্লানডার্স, মিলান, ভেনিস, জেনােয়া, পিসা প্রভৃতি।
বহির্দেশে মেসােপটেমিয়া, সুমের, মিশর প্রভৃতি স্থানের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্য চলত।
মৌর্য যুগের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বন্দর ছিল ভৃগুচ্ছ, সােপারা, কল্যাণ, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি।
মৌর্য পরবর্তী যুগে ভারত-রােম বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এই বাণিজ্যের দ্বারা ভারতীয় মশলা, চাল, গম, সুগন্ধি দ্রব্য, দামি পাথর, দামি কাঠ, মসলিন, রেশম প্রভৃতি রােমে রপ্তানি হত।
গুপ্তযুগের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বন্দর ছিল ভূপুকচ্ছ, কল্যাপ, তাম্রলিপ্ত, কাম্বে, কাবেরীপত্তনম প্রভৃতি।
প্রাচীন ভারতে গিল্ডের সভাপতি প্রমুখ’ বা ‘জ্যেষ্ঠক’ বা ‘শ্রেষ্ঠিন নামে পরিচিত হতেন।
একাধিক গিল্ডযুক্ত বৃহৎ সংগঠনের প্রধানকে ভান্ডাগারিক বলা হত।
প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলি ধীরে ধীরে নগরের রূপ নেয়। ধর্মস্থানগুলিতে মানুষের যাতায়াত ও বসতি বাড়তে থাকলে সেগুলি ক্রমে নগর হিসেবে গড়ে ওঠে। বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিতে জনসংখ্যা বাড়লে সেগুলি নগর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ভারতে দ্বিতীয় পর্যায়ের নগরায়ণ যােড়শ মহাজনপদের যুগ থেকে প্রাক্ গুপ্তযুগের মধ্যবর্তী সময়ে ঘটেছিল।
ভারতে দ্বিতীয় পর্যায়ের নগরায়ণের সময় বারাণসী, বৈশালী, রাজগৃহ, চম্পা, শ্রাবস্তী, কুশীনগর, পাটলিপুত্র, তক্ষশিলা, মথুরা প্রভৃতি নগরের উত্থান ঘটে।
ভারতে তৃতীয় পর্যায়ের নগরায়ণ মধ্যযুগে সুলতানি আমলে ঘটেছিল।
হরপ্পা সভ্যতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নাম হল— হরপ্পা, মহেনজোদারাের, লােথাল, কালিবঙ্গান, রংপুর, রােজদি প্রভৃতি।
Leave a comment