বীরসা মুণ্ডা ‘অরণ্যের অধিকার’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। লেখিকা নিজেও সচেতন বলে তিনি স্বীকার করেছেন এই উপন্যাস বীরসা কেন্দ্রিক আদিবাসি সমাজের সংগ্রাম ও মুক্তির ইতিহাসে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরসার জীবনী তাই ঐতিহাসিক। ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরসা এক অবিস্মরণীয় চরিত্র।’ এমনই এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তির জীবন কাহিনী বর্ণনা করার জন্য যে শিল্পনৈপুণ্য, তথ্যপ্রয়োগ প্রয়োজন সবই লেখিকা সযত্নে সম্পন্ন করেছেন। এদিক থেকে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে বীরসার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের আখ্যান। এই দিক থেকে দেখতে গেলে উপন্যাসটিকে ‘জীবনী-উপন্যাস’ বলা যায়।

জীবনী-উপন্যাসে চরিত্রনির্মাণের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা এসে দেখা দেয়। বাস্তব জীবন থেকে যে মানুষকে উপন্যাসে তুলে আনা হয়, তার জীবনবৃত্তের অনেক ঘটনা ও চরিত্র সম্পর্কে কখনো কখনো ফাঁক দেখা দেয়। তখন লেখককে কল্পনা দিয়ে সেই ফাঁককে ভরিয়ে দিতে হয়। জীবনী-উপন্যাসে বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ তাই অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। ঔপন্যাসিকের নির্মাণশিল্পের নানা সঙ্কটের মধ্যে একটা যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্তকে আনতে হয়।

জর্জ লুকারক লিখেছেন— “The important modern historical words show a clear tendency towards biography. The direct link before the two in many cases is most probably the contemporary fashion of historical-biographical belles letters.”

মহাশ্বেতা দেবী ইতিহাসের বীরসাকে এই উপন্যাসের আখ্যানে উত্তীর্ণ করেছেন। একদিকে ইতিহাসের মানুষ, অন্যদিকে তাকে সাহিত্যে রূপায়িত করা জীবনী উপন্যাসের এক প্রধান দায়িত্ব। অরণ্যের অধিকার’-এর নায়ক বীরসা মুণ্ডা মুণ্ডা বিদ্রোহের নেতা। বীরসার জীবনের পঁচিশ বছরকে কেন্দ্র করে লেখিকা তাঁর উপন্যাস রচনা করেছেন। শিল্পের স্বাভাবিক গ্রহণ-বর্জন নীতি প্রয়োগ করে লেখিকা বীরসার জীবনকে চিত্রিত করেছেন। এই চিত্রণের পদ্ধতিটি একটু স্বতন্ত্র। উপন্যাসের কাহিনীর শুরুতে বীরসার মৃত্যু সংবাদ। “৯ই জুন, ১৯০০। রাঁচি জেল। সকাল আটটার সময়ে বীরসা রক্তবমি করে অজ্ঞান হয়ে যায়। বীরসা মুণ্ডা, সুগানা মুণ্ডার ছেলে বয়স পঁচিশ, বিচারাধীন বন্দী।”—এই বলে জীবনী উপন্যাস শুরু হয়। তারপর ক্রমে ক্রমে তার অতীত জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়। ধানী মুণ্ডা মুণ্ডাসম্প্রদায়ের প্রবীণতম ব্যক্তি। তাঁর মুখ দিয়ে বীরসার জন্মকাহিনী, তার বাল্যকাল বর্ণনা করতে শুরু করল। বীরসা যে ঝড় তুলেছিল, তার ইঙ্গিত গানের মধ্যে করল “বোলোপে বোলোপে হেগা মিসি হোন কো/হোইও ডুডুগার হিজু তানা।”—’আঁধি উঠেছে।’ উলগুলান শুরু হয়েছে। ‘উলগুলানের শেষ নাই। ভগবানের মরণ নাই।’ বীরসা ধানীর দৃষ্টিতে ভগবান, ‘ধরতি-আবা’। বীরসার বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবন সবই একে একে ছবির মত ফুটে উঠছে। তথ্যভিত্তিক এই নির্মাণ ইতিহাস থেকে সাহিত্যের জগতে নির্মাণ। উপন্যাসের পরিচ্ছেদ ২০টি। তার প্রথম ৮টি পরিচ্ছেদে নির্বিত্ত মুণ্ডাবালক তার অসামান্য স্বাতন্ত্র্য নিয়ে ফুটে উঠেছে। মুণ্ডাদের স্বপ্ন ভাতের স্বপ্ন। “মুণ্ডার জীবনে ভাত একটা স্বপ্ন হয়ে থাকে। ঘাটো একমাত্র খাদ্য যা মুণ্ডারা খেতে পায় তাই ভাত একটা স্বপ্ন।” ৩রা ফেব্রুয়ারী বীরসা ধরা পড়ে। ভাত রাঁধার ধোঁয়া থেকে শত্রুপক্ষ তাকে চিনতে পারে। তারপর বন্দগাওঁ, তারপর খুনটি, তারপর রাঁচি। বাল্যকালে মুণ্ডাবালক অরণ্যে ছাগল চরিয়ে, বন থেকে কাঠ-পাতা-ফল-মধু এনে সংসারকে সাহায্য করত। তার স্বপ্ন ছিল, “বড় হলে আমি মাকে বোরা-বোরা নুন কিনে দিব-নুন দিলে ঘাটোর স্বাদ হয় কত?” এই অভিলায় থেকে ধীরে ধীরে জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা ভাবতে লাগল। এই বিচিত্র বিরাট জীবনের কাহিনী মহাশ্বেতার বিষয়। বাল্যকালে তার স্বাতন্ত্র্য ফুটে উঠত টুইলা আর বাঁশি বাজানোর যাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে। মাসি জোনীর বাড়ি থাকতে গিয়ে জয়পাল নাগের পাঠশালায় সে পড়াশোনা করতে চায়—”আবা আমি চাইবাসা যাব পড়ব”। জার্মান মিশনে যায় পড়তে, কিন্তু সেখানে থাকতে পারে না। আনন্দ পাঁড়ের আশ্রমেও থাকতে পারে না। এই অধ্যায়ের বর্ণনার মধ্যে লেখিকা তার উচ্চাশা ও স্বপ্নকে উপ্ত করে দিয়েছেন, তাতে ভবিষ্যতের ‘ভগবান’ বীরসার অসামান্য কীর্তিকে বোঝা যায়। বীরসা অন্যরকম ছেলে। মায়ের চিন্তা, সে কেন অন্য ছেলেদের মত নয়? “বোহোন্দার জঙ্গলে তো সকল মুণ্ডা ছেলে গাইছাগল চরাই করতে যায়। এক বীরসা কেমন করে জঙ্গলের সকল রহস্য জেনে আসে।”—এই প্রশ্ন ঔপন্যাসিকের জীবনরসিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উৎসারিত। বাস্তব ইতিহাসের জীবনী থেকে লেখিকার কল্পনার নির্মাণ এইভাবেই সম্ভব হয়েছিল। “কত কথা মনে উঠে, কোথা হতে এলাম আমি? কি জন্য এলাম? কি করে এলাম?”—সেই চিরন্তন প্রশ্ন কিশোর বীরসাকে বাইরের জগৎ সম্পর্কে উৎসুক করে তুলল। জীবন-জিজ্ঞাসা থেকে এল আত্ম-অনুসন্ধান। জীবনী সাহিত্যের মধ্যে এই ক্রম-পর্যায়টি রচনা করতে গিয়ে লেখিকাকে ‘creative imagination’-এর আশ্রয় নিতে হয়েছে। ক্রমে সে বুঝতে পারল, এই অরণ্য ও অরণ্যানীর অধিকার হারানোর ফলেই মুণ্ডাদের জীবনে এত যন্ত্রণা। সে এবার তার সমাজ সম্পর্কে সচেতন হল। দারিদ্র্য-নিপীড়ন-দীর্ঘ জীবন ও সমাজকে মুক্তি দেবার জন্য সে ব্রত গ্রহণ করল। “দিকু’দের হাতে অরণ্য বন্দিনী, বীরসা অরণ্যের কান্না শুনতে পায়। জননী অরণ্য আর্তনাদ করে বলেছিল—“মোরে বাঁচা বীরসা। আমি শুদ্ধ শুচি নিষ্কলঙ্ক হব।” মাটিতে মুখ ঘষতে ঘষতে দুঃসাহসী এই মুণ্ডা কিশোর অরণ্যের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল।—“দিব, দিব তোমারে শুদ্ধ করে, হা তুমি মোর মা বট, সকল মুণ্ডার মা বইট তুমি, তোমা হতে ঘরের চাল, ঘরের দেওয়াল, ক্ষুধায় কন্দ-ফল-মূল-খরা-বরা শজারু হরিণ পাখীর মাংস মা গো।” বীরসার অরণ্যের অধিকারের সংগ্রামে প্রেরণা হয়ে উঠেছিল এই আহ্বানে রক্তমন্ত্রধ্বনি। এই অধিকার গ্রহণের সংগ্রাম কিভাবে সাধারণ মুণ্ডা বালক বীরসার ওপর এসে পড়েছিল, তারই আখ্যান লেখক তাঁর কল্পনা ও ভাষাশিল্পে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। বীরসাকে এই জননায়কে রূপান্তরিত করার মধ্যে জীবনী সাহিত্যের আদর্শবাদ নিঃসন্দেহে বর্তমান।

তাই রোমান্টিক ভাষা ও আবেগ দিয়ে বীরসার মহিমাকে বর্ণনা করেছেন লেখিকা— “সে এক অদ্ভুত, অত্যাশ্চর্য দৃশ্য। সে দৃশ্য ভাবলে বুক কেঁপে যায়। নাগর বাজছে গভীরে, জঙ্গল ঝড়ের চাবুকে আর্তনাদ করছে। আকাশ বজ্র-বিদ্যুতে হাসছে আর জল ঢালছে। আর আকাশ পানে দুহাত তুলে বীরসা আসছে। বীরসার চোখে-মুখে বৃষ্টির জল, দৃষ্টি উজ্জ্বল, ভীষণ ভবিষ্যতের মত, মুণ্ডাদের ভবিষ্যতের মত ভীষণ।”

এই অপূর্ব দৃশ্যে লেখিকা যে আবেগ সৃষ্টি করেছেন, তা জীবনী সাহিত্যেই সম্ভব। ‘অরণ্যের অধিকার’-এ ইতিহাসের সত্যকে সাহিত্যের সত্যে রূপান্তরিত করেছেন বলে বীরসার নায়ক নির্মাণ হয়ে উঠেছে এত অসামান্য চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক সামাজিক আদর্শ সক্রিয় হয়েছে। সুমিতা চক্রবর্তী লিখেছেন, “বীরসা চরিত্র রূপায়ণেও কাজ করেছে একটি সুস্পষ্ট সামাজিক আদর্শ। সত্তরের দশকের মধ্যভাগে রচিত উপন্যাসটিতে লেখিকা একটি অতীত বিপ্লব ও তার নায়কের সঙ্গে রূপ দিতে চেয়েছেন সমকালীন, আধুনিক ভারতের আদিবাসী সমাজের অসহায়তা ও দাবিকে। এ কারণেই সচেতন ও কিছুটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আদর্শায়িত করা হয়েছে বীরসাকে”–(কোরক, জানু, ১৯৯৪)। ইতিহাসের সত্যকে সাহিত্যের সত্যে রূপান্তরিত করার মধ্যে এই ‘আদর্শায়িত’ করার প্রেরণা জীবনী সাহিত্যের সার্থক প্রাণনা।

চরিত্রকে আদর্শায়িত করার সময়, অনেক সময় ব্যক্তিজীবনের অনেক খুঁটিনাটিকে এড়িয়ে যেতে হয়, এটা জীবনী সাহিত্যের দাবি। জীবনী সাহিত্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ বা বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবন আলেখ্য প্রস্ফুটিত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করা হয় তার পরিপার্শ্ব, দেশ ও কালকে। দেশ-কাল-পরিবার পরিজন সহজেই বিচার্য হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে লেখকে সতর্কভাবে কাহিনীর গ্রহণ বর্জন করতে হয়। কারণ জীবনী-সাহিত্যে যুক্ত থাকে লেখকের একটি বিশেষ লক্ষ্য। যে সামাজিক শক্তি জীবনী সাহিত্যে পরিস্ফুট করা হয় সেই সামাজিক শক্তির চরিত্রগত বিন্যাসকে লেখককে লক্ষ্য রাখতে হয়। ড. জর্জ লুকাকস বলেছেন: “The true writer will peep the right proportion even in the case. That is, before introducting the occassin, he will clarify the social forces encompassing his character as a whole and at the same time indicate the psychological qualities of the particular character in question.” I

ইতিহাস এবং শিল্প দুটি স্বতন্ত্র সত্তা। লেখককে এই জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। অরণ্যের অধিকার’ ‘বীরসাকেন্দ্রিক’ উপন্যাস। বীরসার জীবন কাহিনীকে লেখক বর্ণনা করেছেন উপন্যাসের আঙ্গিকরীতি মেনে। লেখিকার অভিপ্রায় ভূমিকায় স্পষ্ট : “লেখক হিসাবে, সমকালীন সামাজিক মানুষ হিসাবে, একজন বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের সমস্ত দায়দায়িত্ব বহনে আমরা সর্বদাই অঙ্গীকারবদ্ধ। আমার বীরসাকেন্দ্রিক উপন্যাস সে অঙ্গীকারের ফলশ্রুতি।” বীরসা জীবনী-উপন্যাস হলেও আদিবাসী জনবৃত্তের কাহিনী। ঐতিহাসিক কারণেই এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘উলগুলানের’ গুরুত্বকে এই জীবনী-উপন্যাসে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই ঐতিহাসিক ব্যক্তির জীবনী হওয়া সত্ত্বেও এখানে একটি সামাজিক ইতিহাসও সাহিত্যে প্রতিভাত হয়েছে।

জীবনী-উপন্যাসের মাহাত্ম্য রক্ষার্থে লেখক যে দেশ-জাতি-কালের অঙ্গীকারকে যেমন স্বীকৃতি জানাতে হয়, তেমনি ব্যক্তির সমুচ্চ শ্রেষ্ঠত্বকেও প্রকাশ করতে হয়। ইতিহাসের সত্যকে সাহিত্যের সত্যে রূপান্তরিত করার মধ্যে এই রহস্যটি বর্তমান।