‘একদিকে ইতিহাসের ‘মিথ’ অন্য দিকে রক্তমাংসের বীর যোদ্ধা, দুইয়ের সুচারু সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছে বীরসার চরিত্র।” –আলোচনা করো।
‘অরণ্যের অধিকার’ বীরসা কেন্দ্রিক উপন্যাস। বীরসা মুণ্ডার জীবন কাহিনীই এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়। বীরসাই উপন্যাসের নায়ক। লেখিকার সহানুভূতি ও বিবেচনার আলো সবটাই পড়েছে বীরসার ওপর। বীরসার জীবনোতিহাস আসলে একটা হতমান, নিপীড়িত জাতির জাগরণের ইতিহাসের প্রধান কেন্দ্রভূমি। এই কারণে গ্রন্থের ভূমিকায় লেখিকা লিখেছেন, “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরসা মুণ্ডার নাম ও বিদ্রোহ সকল অর্থেই স্মরণীয় ও তাৎপর্যময়। এ দেশের যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিকায় তার জন্ম ও অভ্যুত্থান, তা কেবলমাত্র এক বিদেশী সরকার ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়। একই সঙ্গে এই বিদ্রোহ সমকালীন ফিউডাল ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। এ সমুদায় ইতিহাসের বিবেচনা ভিন্ন বীরসা মুণ্ডা ও তার অভ্যুত্থানের যথার্থ বিবেচনা অসম্ভব।”
বীরসার ঐতিহাসিক ভূমিকা বিবেচনা করলে দেখা যায়, বীরসা একজন অসামান্য নায়ক। বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের দায়বদ্ধতায় এই চরিত্রে আনা হয়েছে নানা তাৎপর্য, নানা স্তরবিন্যাস। সাধারণ মুণ্ডা পরিবারের সামান্য সন্তান কিভাবে আত্মস্বাতন্ত্রে দীপ্ত হয়ে উঠেছেন এবং শেষ পর্যন্ত আত্ম বিসর্জন করেছেন তার সাক্ষ্য উপন্যাসটির কাহিনী।
যে পরিবারে ভাতের স্বপ্ন জীবনের সেরা স্বপ্ন, সেই ছেঁড়া কানির মত দরিদ্র পরিবারে বীরসার জন্ম। চালকোড়ের বাবায় তার জন্ম। বৃহস্পতিবারে জন্ম তাই নাম হয়েছিল বীরসা। “সুগানা ঘর বাঁধল একখানা। সে ঘরে হল ছেলে। বিষ্ণুৎবারে জন্ম। নাম হল বীরসা।” কোমতা সুগানার আর এক ছেলে।
আকারে প্রকারে বীরসা শিশুকাল থেকেই অসামান্য। “মুণ্ডাদের ঘরে অত লম্ব সুগঠিত শরীর, অমন নাক, অমন চোখের চাহনি দেখা যায় না।” ছেলেবেলা থেকেই সে স্বপ্নদর্শী। বড় হবার, লেখাপড়ার স্বপ্ন তার রক্তে। সে ভাতের স্বপ্ন দেখে। কৈশোরে সে বলে, “মারে বোরা ভরা লবণ এনে দিব, খুচি ভরা চাল আর দানা”। বড় হলে সে কী হবে? লেখাপড়া শিখব। অনেক লেখাপড়া তারপর “কাছারি করে বাবার খুটকাটি গ্রামের জমি ফিরাব।” আবার বলে “প্রচারক হব, সবকে যীশুর কথা বলব।” সে মাকে ভালোবাসে। বাবাকে ভালোবাসে, পরিবারের সকলের প্রতি তার প্রীতি ও অনুরাগ। সে সংসারমুখী স্বভাবের ছেলে।
বীরসা শৈশব-কৈশোর থেকেই বন্ধুদের প্রিয়। মাসী জোনীর বাড়ী গিয়ে সে সবার প্রিয় হয়ে ওঠে। সে মিশনেও জনপ্রিয় হয়, সহপাঠীদের আকর্ষণ তার প্রতি প্রচুর, সে হয়ে ওঠে ‘পহান’ বা দলনেতা। তার চরিত্রে স্ব-মতের স্বাতন্ত্র্য্য উল্লেখ্য। তার সহপাঠীরা (য়োহানা, মাইকা, টেংগা, ডুটকা) তাকে অমূল্যর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে বলে। সে সব কথা মানে না। অমূল্য জার্মান লুথেরিয়ান চার্চের চাইবাসার স্কুলে বীরসার সহপাঠী ছিল। প্রথম আলাপ থেকেই অমূল্য বীরসাকে নানা ব্যাপারে মার্জিত করে তোলে। অমূল্য বাঙালী ভদ্র সন্তান তাই সে সম্পূর্ণ আস্থার যোগ্য। বীরসা তার প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও কিছুটা সাবধানী হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তার স্বাতন্ত্র্য উল্লেখযোগ্য।
বীরসা অরণ্যে ঘুরত, ছাগল চরাত, গাইচরী করত, আর অরণ্যের রহস্যকে জানত। সে টুইলা বাজায়, বাঁশী বাজায় মোহন সুরে, এই সব অসাধারণত্ব তার মা করমিকে চিন্তিত করে। লেখিকা তাঁর চরিত্রেও এই স্বাতন্ত্র্য ও অসাধারণত্বকে গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক। সে মাকে বলে ‘জঙ্গলে যাস, জঙ্গলে বাজনা বাজে শুনিস না মা? পাতায় পাতায় বাজনা বাজে শুনে নিয়েছি।’ আবদ্ধতা তার পক্ষে কষ্টকর, তাই সে বাইরের পৃথিবীর ডাক শুনতে পায়। এইখানেই তার চরিত্রের রোমান্টিকতা। বীরসা নিঃসন্দেহে রোমান্টিক চরিত্র।
বীরসা অন্য পৃথিবীর ডাক শুনেছে। “কিন্তু এখন ছেলের চোখের দিকে চেয়ে সুগানা বুঝল আরেক রকম পৃথিবী আছে, যে পৃথিবীর সীমানা নাই, সেই বিশাল অজানা পৃথিবীর ডাক ছেলে শুনেছে।” সুগানা তাকে আর পাঠে উৎসাহ দেয় না। আর পড়ে কি করবি বাপ? পড়লে পরে এ সংসারে তোর মন উঠবে না। মুণ্ডা ছেলেদের মনে হবে লেংটাপরা, অসভ্যটা।” বীরসা এইভাবে এক জন্ম থেকে আর এক জন্মের দিকে হেঁটে চলেছিল। “বীরসা জানত না ও হেঁটেছিল এক জন্ম, এক জীবন থেকে আরেক জীবনের দিকে।” বীরসা চরিত্রে নানা পর্যায়ের নানা জন্মের-জন্মান্তরের কাহিনী।
বীরসা রোমান্টিক, উচ্চাশী, অসাধারণ, স্বপ্নদর্শী অথচ সংসারী। কিন্তু অনাসক্তি তার চরিত্রবৈশিষ্ট্য। বীরসা সংসারের কাজ যত পারে, কোমতা তা পারে না। কিন্তু বীরসার মধ্যে কোন আসক্তি নেই। এই নিরাসক্ত কর্মযোগ বীরসাকে সহস্র মানুষের মধ্যে নিয়ে গেছে। এক জনবৃত্তের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক চরিত্রে পরিণত করেছে। তার অসাধারণত্বের বীজ সবই তার কৈশোরে-যৌবনে উপ্ত হয়েছিল।
বীরসার ব্যক্তিত্বে নারী-মনজয়ের গুণ ছিল। তার বাঁশি শুনে রাতা তাকে ‘আরান্দি’ করতে চেয়েছিল। গুঞ্জা আকৃষ্ট হয়েছিল কিন্তু বীরসা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। পরমী আর সালী দুই নারী তার জীবনে যখন এসেছিল, তখন বীরসা বৃহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। তারা শেষ পর্যন্ত বীরসার মহৎ যজ্ঞে যুক্ত হয়েছিল। সালী বীরসার জন্য জীবনের সব সম্পদ ত্যাগ করেছে। কিন্তু পরমী বীরসাকে ‘আরান্দি’ করতে চায় নি। কারণ “সে কোথা রইবে, আমি কোথা রইব।”
মহৎ কার্যে উৎসর্গীকৃত চরিত্র বীরসা। তার জন্য সংসারের সীমানা নয়, নয় কোন ঘরের স্নিগ্ধ শয্যাতল। সেও কালবৈশাখীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে চলেছে মুণ্ডাদের মুক্তি দিতে। এক অনিঃশেষ ‘উলগুলানের অগ্নিযজ্ঞে বীরসা তখন হয়ে গেল পীড়িত, শোষিত, দরিদ্র, জীর্ণ মুণ্ডা সম্প্রদায়ের নেতা। সে চায় অরণ্যের অধিকার, কৃষ্ণাজননীর কান্না শুনে সে অরণ্যের অধিকারকে ফিরে পেতে চায়। বীরসা চরিত্রের বিবর্তনের সব চেয়ে বড় দিক তার উত্তরণ ও জন্মান্তর। সে জাতিগত সংস্পর্শকে অতিক্রম করে এক নবধর্ম প্রচার করেছিল। সর্বার্থেই সে অন্ধকার জগতে এনেছিল নতুন দিনের আলো। মিশন জীবনের শিক্ষা থেকে সংস্কারমুক্ত মানবসেবার দিশা সে যে পেয়েছে, একথা সে স্বীকার করেছে। বীরসা মড়ক রুখতে ঘরে ঘরে ঘুরেছে। তাদের শিখিয়েছে কিভাবে ‘চেচক-হায়জার’ সঙ্গে যুদ্ধ করা যায়। মুণ্ডারা জানত মড়কে মরণ হচ্ছে ভাগ্যের লেখা, বীরসার মুক্তবুদ্ধি তাদের শেখান “জ্যান্ত ভগবান সঙ্গে থাকলে হায়জা-বুড়ি, চেচক-বুড়ো আপনা হতে পালায়।” বীরসার মানবধর্ম এইভাবেই উদ্ঘাটিত হয়েছে।
বীরসা জাতি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধরতি আবা’ হয়ে ওঠেনি। সে প্রাচীন সংস্কারকে উৎখাত করে নি, তাকে নতুনভাবে ব্যবহার করেছে। সে জাতির নায়ক তবু সে মুণ্ডা জীবনের বহতা ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চায় নি। ‘বীরসা সেই বিশ্বাসেই বড়ো হয়েছে। ও জানে মুণ্ডা হয়ে কয়েক লক্ষ মুণ্ডা যেমন জীবন কাটায়, তার বাইরে অন্য জীবনের কথা ভাবাও মহা পাপ। মুণ্ডাজাতিবোধ যে একটা অহঙ্কার সে কথা বীরসা ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছে। বীরসার অবদান এই আত্মসচেতনতা “মুণ্ডা মানে জংলিটা, অসভ্যটা। মুণ্ডাদের জীবন দিকুদের জন্যে।” এই অপমান থেকে বীরসা ওদের মুক্তি দিয়েছিল। ডোনকা তার স্ত্রী সালীকে বলেছে— “ওরে (বীরসা) দেখলে, ওর কথা শুনলে আমার বুকে জানি বান ছুটে সালী, পাহাড় ভাঙে। ওর কাছে যেয়ে তবে আমি জানলাম মুণ্ডা নামে গরব কত।”
বীরসা চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার আত্মসম্মানবোধ ও তেজস্বিতা। বন্দগাঁওতে বীরসা ভরমি, দাসো আর মাতরির সঙ্গে দেখা। তারা তাদের জঙ্গলের অধিকার হারানোর কথা বীরসাকে বলে। বীরসা রুদ্রমূর্তি হয়ে ওঠে। কারণ “অরণ্যের অধিকার আদি অধিকার।” বীরসা চাইবাসার জঙ্গল অফিসে আর্জি-পত্র জমা দিতে যায়। কিন্তু সেখানে অফিসারদের ব্যবহারে রুষ্ট হয়ে তাদের তীর ছুড়ে আক্রমণের ভয় দেখায়। মুণ্ডাদের আত্মমর্যাদাবোধ দেখে অফিসের কর্মীরা চমকিত ও শঙ্কিত হয়ে ওঠে। এক গভীর আত্মপ্রত্যয় বীরসাকে শক্তি দিয়েছে। জঙ্গল অফিসের বাবুদের অপমানের প্রত্যুত্তরে সে উগ্র হয়েছে। আনন্দ পাণ্ডেকেও তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছে।
উপন্যাসের দশম পরিচ্ছেদের শেষ দিকে দেখা যায় বীরসা মুণ্ডা জাতির অধিনেতা হয়ে উঠেছে। “বীরসার প্রভাব এমন বেড়ে গিয়েছে যে সর্দাররা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। ও একবার ডাক দিলে সবাই, সব মুণ্ডারা বিদ্রোহ করবে।” বীরসার কর্মপন্থা বোঝা গেল—“কবে লড়াই শুরু হবে বলে দিব। এখন থেকে গ্রামে গ্রামে তাঁর পাঠাও হে সবে।” এইভাবে শুরু হল যুদ্ধ ‘উলগুলান’। সে ডাক দেয় সব মুণ্ডাকে। “সবাই চলে গেল একে একে। তবু বীরসার ঘুম আসে না। খাটিয়ায় শুয়ে সে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। ভগবান সে। ভগবানই তো। ভগবান না হলে সে ডাক দিলে সব মুণ্ডা এল কেন।
জননায়কের মত বীরসা ঘোষণা করে ‘উলগুলান’। “বীরসা নাগরাটায় দু’হাতে কাঠি নিয়ে ভীষণ জোরে ঘা দিল। শত শত গলার আওয়াজ উঠল—উলগুলান।” নতুন ছেলেদের নানক’দের দীক্ষা মন্ত্র হল ‘উলগুলান’। বীরসার অভিযানে সকলে এল দলে দলে। এই বিরাট সংগঠনের সে নেতা। “নানকরা বলল, হে ধরতি আবা, একা তুমি মোদের ত্রাতা। মোদের শুচি কর।” উপন্যাসের ষোড়শ পরিচ্ছেদে এই ছন্দের রোমাঞ্চকর বর্ণনা পাওয়া যায়। “জয় স্বর্গের ঈশ্বরের, জয় পৃথিবীর ভগবানের।” (সিরমারে ফিরুন রাজা জয়। ধরতিরে পুড়োই রাজা জয়।”) করমি ভয় পায়, সুগানা গর্বে আবিষ্ট থাকে। বীরসা ভগবান হয়ে, যোদ্ধা হয়ে আসবে, করমির ছেলে হয়ে আসবে না। এই অংশটি প্রমাণ করে বীরসা চরিত্র ঈশ্বরের রূপান্তরের সময় সামান্য মায়ের কি প্রতিক্রিয়া।
বীরসা চরিত্রের নানা পর্যায়ে লেখিকা তার ক্রমাগ্রগতি দেখিয়েছেন। ‘অরণ্যের অধিকার’-এর জন্য ‘উলগুলান’ এর ডাক দিয়ে বীরসা হয়েছে ভগবান। বীরসা চরিত্রের মধ্যে তার সম্ভাবনা কিভাবে বিকশিত হয়েছিল তার প্রমাণ আছে এই আখ্যানে। সে বিশ্বাস করে বলেছে “মোর বিনাশ নাই।” জাতি-জাগরণের ইতিহাসে, মুণ্ডা জাগরণের ইতিহাসে এই চরিত্র সত্যই অবিস্মরণীয়।
Leave a comment