‘স্বাধিকারবোধ ও বিপ্লবেরই আর এক নাম ধানী মুণ্ডা।”—চরিত্রটি বিশ্লেষণ করে তোমার অভিমত দাও।
‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে ধানী চরিত্রটি নানা দিক থেকে অসাধারণ। প্রাচীনত্ব, হৃদয় সংবেদনে ও বিপ্লবী মানসিকতার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সে মুণ্ডাদের প্রাচীন কালপরম্পরায় ইতিহাস ও পুরাণের জীবন্ত কিংবদন্তী। সে ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ আকর ব্যক্তিত্ব। ত্রিকালদর্ষী পুরুষের মত সে যেমন মুণ্ডাদের পৌরাণিক ইতিহাসকে বর্ণনা করে তেমনি বিদ্রোহের ইতিহাসকেও তুলে ধরে।
ধানীর বয়সের কোন হিসেব নেই। আদিবাসী পত্রিকায় তার বয়স ‘আটশ অষ্টাশি চাঁদ’। সারা জীবন সে সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। কোমতা তার সম্পর্কে যথার্থ বলেছে যে সে “লড়াইখেপা, লড়াই যেথা ও সেথা। ওর বয়স আটশো অষ্টাশি চাঁদ হল। এর মধ্যে ও সেই প্রথম মুণ্ডা লড়াই, হুল, খেরোয়ার লড়াই, সর্দারদের মুকি লড়াই, সব জায়গায় লড়ে এসেছে।” এত লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা, এত জায়গায় পরিক্রমার অভিজ্ঞতা, তীরন্দাজ হিসেবে তার দক্ষতা সবই তাকে অপরিহার্য করেছে বীরসার কর্মকান্ডে।
ধানীকে প্রথম দেখা যায় রাঁচি জেলে। জেলের চারশো মুণ্ডা বন্দীদের সঙ্গে সে যখন তার অভিজ্ঞতার কথা বলে তখন জানা যায় মুণ্ডা সম্প্রদায়ের ইতিহাস তার সংগ্রাম ও ইতিকথা। ধানী তার দশটি ছেলেকে লড়াইয়ের ময়দানে নামিয়েছে, সে হচ্ছে ‘লড়াইখেপা’।
ধানী মুণ্ডার মানসিকতার বৈশিষ্ট্য তার আশাবাদ। অন্তহীন উলগুলানে তার বিশ্বাস। লড়াই হল মুক্তির পথ। এই মুক্তির জন্য সে ‘ভগবান’-কে সন্ধান করে। করমি জানে যে ধানী ভগবানের সন্ধানে ব্যাকুল। এই ভগবান “সকল মুণ্ডাদের তরে খুটকাট্টি গ্রাম দিবে। সে এলে দিকু থাকবে না। সে এলে সকল মুণ্ডাদের গায়ে কাপড়, হাঁড়িতে ঘাটো, খুচিতে লবণ থাকবে, ভাঁড়ে থাকবে মৌয়ার কড়ুয়া তেল। তখন মুণ্ডারা রাজা হবে।” এই স্বপ্ন দেখে চলেছে বলে ধানী স্বপ্নদর্শী। জাতির অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সে ভবিষ্যতকে গড়তে চায়। এই আশায় সে বীরসার মধ্যে ‘ভগবান’-কে দেখতে চায়। নশ ষাটটা চাঁদ পার হয়েছে, তবু হতমান, নিপীড়িত মুণ্ডা জাতির ভগবানকে সে দেখতে পায় নি। তার উপলব্ধি তাকে বলেছে বীরসা সেই অনাগত ভগবান। ধানী মুণ্ডা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এই ‘Vision’ বা দিব্যদর্শন।
ধানী বহুদর্শী পুরুষ। সে প্রবীণ মানুষ। ছোটনাগপুর অঞ্চলে সে বহু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সে মুণ্ডাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপ্নকে বুকে লালন করেছে দীর্ঘকাল ধরে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে সে ‘উলগুলান’-এ যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রাঁচি জেলে বন্দী হয়। সেখানে বসে মুণ্ডাদের ইতিহাস বর্ণনা করে। নানা তথ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সূত্র মুণ্ডাদের ওপর দিকুদের অত্যাচার। দিকুদের সম্ভোগ করার জন্য কিভাবে মুণ্ডাদের মূল্য দিতে হয়েছে, তার বর্ণনা ধানী তীব্র ভাষায় দিয়েছে—“দিকু পালকি চায়, মুণ্ডা দাম দিবে, দিকু যা চায়, সব দেবে মুণ্ডা। তা বাদে জোর করে টাকা ধার লিয়া করাবে মুণ্ডাকে। তা বাদে উচ্ছেদ করে দিবে। আড়কাঠি এর মধ্যে এসে বোকা মুণ্ডাগুলাকে কুলি করে নিয়ে কোথায় চলে যাবে কে জানে।” এই সব কাহিনী বর্ণনার সময় ধানীর সংবেদনশীলতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। নানা শক্তি সংহত হয়ে মুণ্ডাদের জীবনের শান্তি নষ্ট করেছে। এই সব দুঃখের যন্ত্রণার কথা একটা গানে বাঁধা আছে। যন্ত্রণাকে ধানী গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে। ধানী এদিক থেকে রোমান্টিক চরিত্র। ধানী জানে, জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণার্ত মুহূর্তগুলো মুণ্ডারা গানে গানে ধরে রাখে। সে গান কে বাঁধে, কে সুর দেয়, কেউ জানে না। ধানীর কণ্ঠে গান জাগে—
“বোলোপে বোলোপে হেগা মিসি হোন কো।
হোইও ডুডুগার হিজু তানা।”
ধানী জন্মবিদ্রোহী। সে মুণ্ডাদের পুরুষ পরম্পরায় অত্যাচার নিপীড়নকে জানে। সে বেঠবেগারী, সেবকপাট্টা সবই দেখেছে তার অনুভূতিতে সবই আলোড়ন তুলেছে। তার কাজ স্বপ্ন ও বিশ্বাসকে পরবর্তী প্রজন্মের ভেতরে ছড়িয়ে দেওয়া। বিরসার শৈশব ও কৈশোর, তার অভ্যুত্থান, তার উলগুলান ও শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু সবই সে দেখেছে এবং যন্ত্রণার্ত হৃদয়ে তার উপলব্ধি করেছে। সে একদিক থেকে বিরসার ব্যক্তিত্বের কারিগর। সে তার মধ্যে ‘ভগবান’কে আবিষ্কার করে মুণ্ডাদের সংগ্রাম এক উন্নত শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। বীরসার মৃত্যুর পরে মুণ্ডা সমাজে যে অভিঘাত আসে, তাকে ধানী সদর্থকভাবে প্রতিরোধ করে।
ধানী মূল্যবোধে বিশ্বাসী, ‘মিথ’-এ বিশ্বাসী প্রবীণ। তাই মুণ্ডা সমাজের ধর্মীয় ‘মিথ’-কে সে একদা বীরসার কাছে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিল। ধানী মুণ্ডাদের মধ্যে জাগরণ চেয়েছিল। সে ‘উলগুলানের’ একনিষ্ঠ সৈনিক। মুন্ডারা বিদ্রোহী চেতনা দিয়ে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হোক– এই ছিল ধানীর স্বপ্ন। বীরসার মৃত্যুর পর হতাশ মুণ্ডাদের সে জানিয়েছে ‘উলগুলানের শেষ নাই। ভগবানের মরণ নাই।” এই বাণী কেবল ধানী চরিত্রের নয়, ‘অরণ্যের অধিকারের সমস্ত কাহিনীর মর্মবাণী।
Leave a comment