‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে অমূল্য একটি বিশিষ্ট চরিত্র। তার মানস বৈশিষ্ট্য এমনই এক আশ্চর্য চিত্র তুলে ধরে যা দেখে মানুষের অপরাজেয় মহত্বে বিশ্বাস বহুগুণে বর্ধিত হয়। অমূল্য সত্যই এক আশ্চর্য ও অসামান্য তরুণ।

অমূল্য বাঙালী যুবক, অনাথ ও আত্মীয় পরিজনহীন। জাতি-ধর্ম কোনো দিক থেকেই সে মুণ্ডা সম্প্রদায়ের কেউ নয়। অথচ ঘটনাচক্রে চাইবাসায় জার্মান লুথেরান চার্চের স্কুলে বিরসার সহধ্যায়ী হয়। এই আকস্মিক ঘটনা তাকে মুণ্ডা সম্প্রদায়ের সংবেদনের সঙ্গে যুক্ত করে। উপন্যাসে অমূল্যর প্রথম পরিচয় মিশনের নবাগতকে সহবৎ শেখাবার দায়িত্বদানের মধ্য দিয়ে। সে বীরসাকে শেখায় কেমন করে সাবান মেখে স্নান করতে হয়, কেমন করে প্যান্টের ভেতর শার্টটা গুঁজে নিতে হয়, কেমন করে মার্জিত সম্ভাষণে মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবে, ‘তুই’ এর বদলে ‘তুমি’ বলতে হবে। সে বিরসাকে বলে যে সে বাঙালী, কিন্তু মুণ্ডারী ভাষা জানে। কারণ সে ‘অরফানেজের ছেলে।’ বিরসা তার ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞাসা করায়, সে বিরসাকে বলে বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে। এইভাবেই শুরু হয় অমূল্যর সঙ্গে বিরসার ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতা মৈত্রী বন্ধন হলেও অমূল্য হয়ে ওঠে ওর শিক্ষক, নির্দেশক ও বন্ধু। ইস্কুলের পড়া হয়ে গেলে অমূল্য ওকে শেখায় ম্যাপ আঁকতে, অঙ্ক কষতে, বই পড়তে। একদিন ওরা সাহেবকে বলে কয়ে শহরে বেড়াতে গেল। অমূল্যর তত্ত্বাবধানে বীরসা শিক্ষিত হয়ে ওঠে। অমূল্য যে ধীমান ও বীরসার অনুরাগী এই ঘটনা দিয়ে আখ্যানের শুরু।

কিন্তু বিশ্বাসের ওপর এসে পড়ে অবিশ্বাসের ছায়া। মিশনের বন্ধুরা এলিয়াজের, মাইকা, টেংগা সকলেই বীরসাকে পরামর্শ দেয় অমূল্যকে দূরত্বে রাখতে। তারা মনে করে অমূল্যই বর্ণচোরা ‘দিকু’ গোত্রের মানুষ। কিন্তু বীরসা অমূল্যের চরিত্র সম্বন্ধে দৃঢ় চিত্ত থাকে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে অমূল্যর ব্যবধান ক্রমশ বাড়তে থাকে। সে অমূল্যকে বলে— “মুণ্ডাদের দেখলে সবাই দিকু হয়, সেই জন্যই বিশ্বাস আসে না। বুঝেছ? তুমি আজ ভাল আছ। যখন মিশন হতে বারাবে? যখন ডাক্তার হবে? তখন কি ভাল থাকবে?” অমূল্যর সঙ্গে বীরসার যোগসূত্র ছিন্ন হয়।

অমূল্য কিন্তু বীরসাকে ভোলে নি। ডাক্তার হয়ে সে রাঁচি জেলের মেডিক্যাল সহকারী হয়। বীরসা তখন গ্রেপ্তার হয়ে রাঁচি জেলে আসে। অমূল্য জেলে বীরসাকে দেখে, তাকে চিনতে পারে, ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। এই সৌজন্য অমূল্যর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। বীরসা কিন্তু অমূল্যর ভাবাবেগ সমভাবে বুঝতে পারে না। অমূল্য তার হাত ধরে। কিন্তু বীরসা তার প্রত্যুত্তর দেয় না, বলে তুমি দিকু’। তারপর অবশ্য দু’জনের মধ্যে ব্যবধান অনেকটা মিলিয়ে যায়। বীরসা অমূল্যকে অনুরোধ করে তার সম্পর্কে সরকারের ব্যবস্থাদি অমূল্য যেন তাকে জানিয়ে দেয়। অমুল্য বিরসার অবিশ্বাসের মুহূর্তে তার বিশ্বাসের কথা বলেছিল—“তুমি তেমনই আছ, তুমি যে একদিন মস্ত বড় হবে আমি তখনি জানতাম।” বীরসা যখন তাকে বলেছে–“তুমি যারে জানতে সে বীরসা নাই। আমি যারে জানতাম সে অমূল্যও নাই।”—এই কথার উত্তরে অমূল্য যা বলেছে, তা মানবীয়।

অমূল্য মুগ্ধ ও অনুরাগী। “অমূল্যবাবু মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে, অভিভূত হয়ে পড়ছে। কেন অভিভূত হচ্ছে? এ ত বীরসা, বীরসা দাউদ। হতভাগা গরিব সুগানা মুণ্ডার ছেলেটা, পড়ব বলে চাইবাসা মিশনে গিয়েছিল, থাবায় থাবায় গরাসে গরাসে ভাত খেত, ইজের প্যান্ট কিভাবে পরতে হয় জানত না, অমূল্যবাবু ওকে পাখিপড়া করে শেখাত।” বীরসাকে অমূল্য মনে করে ‘প্রফেট’। “বীরসা, বীরসা, তুমি কি সত্যই প্রফেট?” এই বিশ্বাস থেকে অমূল্য শেষ পর্যন্ত সরেনি।

অমূল্যর ভালোবাসা বীরসার কাছে কোন প্রতিদান চায় নি। সরকারী চাকরীর দায়িত্ব নিয়েও সে কর্তব্য ভেবে যে সব কাজ করে তা তার চাকরীর পক্ষে অনুকূল নয়। তবু এ ঝুঁকি সে নিতে দ্বিধা করে নি। অমূল্য চরিত্রের সর্বপ্রধান দিক তার বৃত্তি ও বিবেকের দ্বন্দ্ব। তার জীবনের সেরা দ্বন্দ্ব মুহূর্ত দেখা দেয় যখন সে সলিটারি সেলের কামরায় এসে ফিসফিস করে বলে “শাপ দিও না মোরে।” এই উক্তি কতখানি মর্মান্তিক, তা বোঝা যায় তার কন্ঠস্বরে। অমূল্য বীরসাকে দেখার জন্য সরকারি প্রশাসনকে অগ্রাহ্য করল। এই সাহস কোথা থেকে আসে? বীরসার প্রতি তার অনুরাগ ও শ্রদ্ধা থেকে।

জেলে অমূল্য বীরসাকে সাহায্য করে। “অমূল্যবাবু দরজা খুলে ঢুকল। বীরসার মুখের ওপর নিচু হয়ে বলল, ‘তুই আমার সঙ্গে কথা বলবি না, বলিস না, কিন্তু মাগুরাম ওয়ার্ডার যা দেবে, ছাড়া কোন ওষুধ, খাবার খাস না বীরসা, জলও খাস না। আজ পয়লা জুন। তোদের কেশ নিয়ে খুব হইচই উঠে গেছে।” বীরসা তাকে বুঝিয়ে বলে “এবার কথা বলি নাই, সে রাগের বলে নয়। মোর সঙ্গে কথা বললে তুমি বিপদে পড়বে।” বীরসা স্বীকার করে অমূল্য ‘মুণ্ডাদের দুশমন’ নয়। এইখানেই অমূল্যর সারা জীবনের জয় স্বীকৃতি পায়। সে মুণ্ডাদের সঙ্গে একাত্ম, তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে, হতমান এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের লড়াইয়ে সমর্থক হতে চেয়েছে। কেবলমাত্র বীরসাকে ভালোবেসেই সে মুণ্ডা জাতিকে ভালোবেসেছে।

অমূল্য এই উপন্যাসে অসাধারণ ও আশ্চর্য এক চরিত্র। সে বাঙালী হয়ে মুণ্ডাদের জন্য যা করেছে, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সে বীরসাকে নানা বিরুদ্ধতার মধ্যেও সাহায্য করেছে। বীরসা তার কাছে এক বিগ্রহ। তাই ‘নোট বই’ তে সে লিখেছে—“আমার জীবৎকালে বীরসা, যদি কেউ তোমার আশ্চর্য, অপরূপ কথা জানতে চায়, তাকে খাতাটা দেব। যদি না চায়, তাহলে এমন ব্যবস্থা করে যাব, যাতে ভবিষ্যতে যদি কেউ তোমার কথা জানতে চায়, সে আমার নোট বই থেকে সব কথা জানতে পারে।” অমূল্যর হাতে কলম, কিন্তু ধনুক নেই। তবু তার বীরসা পূজা অক্ষয় হয়ে আছে।